শুধুই “তোমার-আমার”

সাহেদ অফিসের জন্য বের হতেই নিলা ফেসবুক চেক করতে বসে যায়। কাল রাতে যে রান্নাবান্না করেছিল তারই একটা পিকচার আপলোড করেছিল। সাহেদ আসার আগেই করতে হয় ওসব, ও একদম পছন্দ করেনা এসব।

ওর কথা, কি খাই, কোথাই যাই, কি কিনি এসব ফেসবুকে দিয়ে মানুষ কি বোঝাতে চায় বুঝিনা। প্রাইভেসি বলে কিছু কি থাকতে নাই? একসাথে গলাগলি করে স্বামী স্ত্রী ছবি তুলে সেটা ফেসবুকে কেন দেয়া, কিছু লাইক বা কমেন্ট পেতে, নাকি আপনি কতটা হ্যাপি সেটা লোককে বুঝাতে চান?
এসব কথা বলে বলেই নিলা ফেসবুকে কি করে সেটা সাহেদকে জানায়না।

ওদের তিন বছরের সংসার। শাশুড়ি থাকেন সাথে, দুই ছেলের বাড়িতে ঘুরেফিরে থাকেন। এখন বড় ছেলের বাড়িতে আছেন। যদিও শাশুড়ির সাথে ভালো বনেনা নিলার তবু তিনি থাকলে ওর রান্না, খাওয়া সব সময়মত করা হয়। নহলে ও শুধু রাতে রান্না করে, বাকি দুবেলা কখনো খায় কখনো না রেঁধে হাবিজাবি খেয়ে কাটিয়ে দেয়। বসেবসে ফেসবুকে কে কি করছে তাই দেখে। কিভাবে সময় চলে যায় ও টেরও পায়না। তবে রোজ ভালো লাগেনা। সাহেদের পড়াশোনা শেষ হল কিছুদিন আগে। এতদিন ওরা বাচ্চাকাচ্চার কথা ভাবেনি সেভাবে, ইদানীং নিলার একা একা লাগে; একটা বাচ্চা থাকলে মন্দ হতনা।

এসব ভাবতে ভাবতে ফোনটা বেজে ওঠে। ওকে আবার কে ফোন করে? মা আর সাহেদ ছাড়া কেউ তো ওকে ফোন করেনা। ফোন দিয়েছে ওর বান্ধবী মিলা। ওর সাথে খুব মেলে না নিলার কিন্তু নামে মিল থাকায় ওদের সাথে কিভাবে কিভাবে ওদের যোগাযোগ রয়ে যায়। সারা দুনিয়ার খবর ওর কাছে পাওয়া যায়, স্বামী দুবাই থাকে।

– হ্যাঁ রে কেমন আছিস?

– এইতো ভালো, তুই কেমন?

– এই জানিস তমার খবর?

– কেন কি হয়েছে, জানিনা তো।

– ও তো বাপের বাড়ি ফিরে এসেছে। ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। স্বামীর নাকি অফিসের কলিগের সাথে পরকীয়া চলছে। জানাজানি হয়ে গেলে তমাই ফিরে এসেছে।

– কিসব বলিস? ওর ফেসবুকে সেদিন ও তো দেখলাম, হাবিব ভাই ওর জন্য সারপ্রাইজ গিফট, পার্টি, আরো কত কি করলো। মাসখানেক আগের কথা।

– হ্যাঁ, সেসব ভুলে যা। ওকে ভুলিয়ে রাখতে কত কি, বড়লোকের মেয়ে, ওকে ছাড়ার ইচ্ছা ছিলনা কিন্তু কিভাবে যেন ও টের পেয়ে গেল।

আরো অনেক কিছুই বলে গেল মিলা, কিছুই কানে গেল না নিলার। তমাকে রীতিমর ঈর্ষা করতো নিলা। ক্লাসে সবচেয়ে সুন্দরী, ভালোছাত্রী, বড়লোকের কন্যা। বিয়েও হয়েছিল খুব ধুমধামে, হাবিব ভাই যেমন স্মার্ট, তেমনি মেধাবী। আর ফেসবুকে দুজনার দেশের বাইরে বেড়াতে যাবার, খেতে যাবার ছবিগুলো রেগুলার আপডেট দিত। মনে হত ওদের মত পারফেক্ট কাপল আর হতেই পারেনা! সাহেদও যদি হাবিব ভাইয়ের মত রোমান্টিক হত, একথা ভেবে কত মন খারাপ হত ওর।

নিলা সাহেদের বিয়ের তৃতীয় বছর চলছে। আজ হঠাৎ সাহেদকে সারপ্রাইজ দিবে বলে ঠিক করল। ও ফেসবুকে সাহেদকে নিয়ে রোমান্টিক একটা পোস্ট দিল। অনেক রান্নাবান্না করে সেসবের ছবি আপ্লোড করল। সেজেগুজে অপেক্ষা করছে সাহেদের ফেরার জন্য। এত দেরিতো হয় না ওর। মনেমনে ভাবছে, হয়তো ওর ফেসবুক পোস্ট দেখে ওর জন্য কোন গিফট কিনতে গিয়ে দেরি করছে।

বেশ রাত করেই ফিরল, কালকে বেশ ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে। ঘরে ফিরে, খাবার খেয়েই বিছানায় চলে গেল সাহেদ। নিলা তখনো ভাবছে, সাহেদ ঘুমের ভান করে পড়ে আছে, ওর জন্য কোন সারপ্রাইজ নিয়ে। সে জলদি সব গুছিয়ে বিছানায়। কিন্তু দেখে সাহেদ সত্যিই ঘুমিয়ে গিয়েছে; ঘরে কোথাও কোন গিফট বা ফুলও নেই। মনটা বিষিয়ে উঠলো নিলার। কেঁদেই ফেললো!

ফোনটা হাতে নিয়ে নোটিফিকেশন চেক করতে লাগলো। ওর ফ্রেন্ড এমনিতেই কম, তাই নিলার পোস্টে লাইক পড়ে কম, একজন কমেন্ট করেছে, “পিকচার চাই দুজনার, কিভাবে দিনটা কাটালে? ” রাগে হাত কাঁপতে থাকে নিলার। তার স্বামীর তো ডেটটাই মনে নাই, আর পিকচার! সারারাত ঘুম হয়না নিলার। সাথে তমার ঘটনাটাও মনে পড়ে যায়। সাহেদের এই ভুলে যাওয়াটা সে সহজে মানতে পারছেনা। তবে কি সাহেদ….নাহ আর ভাবতে পারছেনা।

সাহেদ ঘুম থেকে উঠেই অফিসের জন্য রেডি হয়ে দ্রুত বের হয়ে যায়। নিলা কেন ওঠেনি বুঝতে পারছেনা, ওরতো দেরি হয়না। কাল রাতে শুতে বেশ দেরি হয়েছিল তাই হয়তো! ওদিকে নিলা ঘুম থেকে জেগেই দেখে সাহেদ ঘরে নেই। ওকে না বলে সাহেদ তো কখনো অফিসে চলে যায়না। ওর মাথা আর কাজ করছেনা। কেন সাহেদ এমন করছে ওর সাথে? কিছুই খেতে মন চাচ্ছেনা। কিছুক্ষণ ফেসবুকে অকারণ ঘোরাফেরা করে মিলাকে ফোন দিবে ভাবলো।কিন্তু ওকে কিছু বললেই সেটা সারা দুনিয়ার লোক জেনে যাবে। ওকে কিছু বললোনা শুধু বললো, বাইরে যাবে, সাথে যাবে কিনা? মিলা দুপুরের পরই হাজির। দুজনা মিলে একটা শপিংমলে গেল। শাশুড়ি ফোন দিয়েছিলেন; তিনি আসবেন কয়েকদিন পরই; কিছু জিনিস কেনা দরকার।

অফিসে পৌঁছেই নিলাকে একটা মেসেজ পাঠাবে ভেবে বের হয়েছিল সাহেদ, কিন্তু ভুলে গেল কাজের চাপে। এদিকে অফিসে আজকেই প্রেজেন্টেশন এর পর কার প্রমোশন হবে সেটা ঠিক হবে। সাহেদ প্রথম সারিতেই আছে। তবে যতক্ষণ সব নিশ্চিত না হয় ততক্ষণ নিলাকে কিছু জানাবেনা, ও খুব টেনশন করে, ভিষন ইমোশনাল, হয়তো আশা করে পরে আশাহত হবে। তার চেয়ে সেটা সারপ্রাইজ হিসেবে তোলা থাক।

নিলার খুব ইচ্ছা একটা নতুন গাড়ি। সে যদিও কখনো মুখ ফুটে বলেনি, কিন্তু ফেসবুকের কল্যানে কার ঘরে কি আসবাব তাও লোকে জানে, আর গাড়ি হলেতো কথাই নাই। ওর বান্ধবী মিলা সেতো গাড়ি ছাড়া দুপাও নড়েনা, আর সারাক্ষণ সেটা প্রচার করে বেড়ায়।

নিলাকে যখন ওর গাড়িতে করে কোথাও নিতে চায়, নিলা না করে। আগে যখন ও ফেসবুকে ওর বান্ধবীদের গাড়ি দেখিয়ে জানতে চাইতো, এটা কি গাড়ি, দাম কত; ওর চোখে একটা নতুন গাড়ির স্বপ্ন প্রায়ই দেখেও না দেখার ভান করতো সাহেদ। এরপর থেকেই সাহেদ নিলার ফেসবুক প্রীতি নিয়ে বিরক্ত। দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই কখন যে সেটা চাওয়ায় পরিণত হয়ে যায়!

নিলা অনেক কিছুই মুখে বলেনা, কিন্তু তার বান্ধবীদের কারো কারো লাইফস্টাইল তার ভালো লাগে। দেখা হয়না বছরের পর বছর, কিন্তু হাড়িতে কবে কি রান্না হয় সেটাও অজানা থাকে না কারো। সাহেদ লক্ষ্য করেছে, নিলা প্রায়ই আনমনা হয়ে কি যেন ভাবে; কখনো অকারনেই রেগে যায়, ফ্রাস্টেটেড হয়ে যায়। সাহেদের ধারনা, নিলার এরকম আচরনের কারণও এই ফেসবুক।

যাই হোক, অবশেষে আশা পূর্ণ হল সাহেদের। প্রমোশনের সাথে অফিস থেকে একটা নতুন গাড়ি। যার জন্য গত কয়েকমাস সে এত খাটুনি করেছে। সংসারে বাজারও নিলাকেই করতে হয়েছে। অফিস থেকে একটু জলদিই বের হবে। নিলাকে একটা ফোন দিয়ে রেডি থাকতে বলবে, দুজনা মিলে নতুন গাড়িতে চড়ে বাইরে যাবে।

নিলার ফোন বাজছে তো বাজছেই। কিছুক্ষন পর ফোন ধরলো মিলা। জানলো নিলা শপিংমলে মাথা ঘুরে পরে গিয়েছে ; ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। সাহেদ সাথেসাথে বের হয়ে হাসপাতালের দিকে দৌড় দিল।

বেডে শুয়ে আছে নিলা। ওর হাতটা ধরে আছে সাহেদ। ডাক্তার এসে জানালেন; ভয়ের কিছু নাই। রোগী খুব দূর্বল। তার অনেক কেয়ার লাগবে, আর এখন থেকে খেতে হবে বেশিবেশি, কারন সে মা হতে যাচ্ছে। নিলা সাহেদ দুজন দুজনার দিকে লাজুক চোখে তাকিয়ে থাকে । সাহেদের কাছে তার নতুন গাড়ির গল্পটাও শোনা হয়ে গেছে।

সাহেদ ফেসবুক খোলে। নিলাকে বলে ; আজ একটা পোস্ট না দিলেই না। নতুন গাড়িতে চড়ে সেল্ফি তুলে পোস্ট দেব, ” Going to be parents ” কি বল, খুশিতো?

নিলা ওর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলে ” সব সুখ লোকের সাথে শেয়ার করতে নেই ; কিছু সুখ শুধুই তোমার -আমার।”

ওরা দুজনাই হেসে ফেললো।

……………….

শুধুই “তোমার-আমার”

ফাহমিদা হুসনে জাহান

#রৌদ্রময়ী_জীবনেরগল্প

Original Source

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88