রাসুলুল্লাহ (সা) এর জীবনের শেষ দিন (آخر يوم من الحياة)

সোমবার ফজরের জামা‘আত চলা অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ঘরের পর্দা উঠিয়ে একদৃষ্টে মসজিদে জামা‘আতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এতে তাঁর চেহারা খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং ঠোটে মুচকি হাসির রেখা ফুটে ওঠে। রাসূল (ছাঃ)-এর জামা‘আতে আসার আগ্রহ বুঝতে পেরে আবুবকর (রাঃ) পিছিয়ে আসতে চান। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ইশারায় তাঁকে থামিয়ে দেন এবং দরজার পর্দা ঝুলিয়ে দেন। রাবী আনাস বিন মালেক (রাঃ)-এর ভাষায় ‘ঐ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারা ছিল যেন ‘কুরআনের পাতা’ (كَأَنَّ وَجْهَهُ وَرَقَةُ مُصْحَفٍ)। অতঃপর এদিনই তিনি মৃত্যুবরণ করেন’।[1]

কুরআনের বাস্তব রূপকার, মৃত্যুপথযাত্রী রাসূল (ছাঃ)-এর শুচিশুদ্ধ আলোকময় চেহারা যেন পরম পবিত্র সত্যসন্ধ কুরআনের কনকোজ্জ্বল পৃষ্ঠার ন্যায় দীপ্ত ও জ্যোতির্ময় দেখাচ্ছিল। আনাস (রাঃ)-এর এই অপূর্ব তুলনা সত্যি কতই না সুন্দর ও কতই না মনোহর! ছালাতের পাগল রাসূল (ছাঃ)-এর ভাগ্যে যোহরের ওয়াক্ত আসার সুযোগ আর হয়নি।…

এরপর সূর্য কিছুটা উপরে উঠলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) প্রাণপ্রিয় কন্যা ফাতেমাকে কাছে ডাকেন এবং কানে কানে কিছু কথা বলেন। তাতে তিনি কাঁদতে থাকেন। পরে তাকে আবার ডাকেন এবং কানে কানে কিছু কথা বলেন। তাতে তিনি হেসে ওঠেন। প্রথমবারে রাসূল (ছাঃ) তাকে বলেন যে, এই অসুখেই আমার মৃত্যু ঘটবে। তাতে তিনি কাঁদেন। দ্বিতীয়বারে তিনি বলেন যে, পরিবারের মধ্যে তুমিই প্রথম আমার সাথে মিলিত হবে (অর্থাৎ তোমার মৃত্যু হবে)। তাতে তিনি হাসেন।[2] এই সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাঁকে ‘জান্নাতী মহিলাদের নেত্রী’ سَيِّدَةُ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ হবার সুসংবাদ দান করেন।[3] অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর রোগ-যন্ত্রণার কষ্ট দেখে ফাতেমা (রাঃ) বলে ওঠেন, وَاكَرْبَاهُ ‘হায় কষ্ট’! রাসূল (ছাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, لَيْسَ عَلَى أَبِيْكِ كَرْبٌ بَعْدَ الْيَوْمِ ‘আজকের দিনের পর তোমার পিতার আর কোন কষ্ট নেই’।[4]

অতঃপর তিনি হাসান ও হোসায়েনকে ডাকেন। তাদেরকে আদর করে চুমু দেন ও তাদেরকে সদুপদেশ দেন। উভয়ের বয়স তখন যথাক্রমে ৮ ও ৭ বছর। এরপর স্ত্রীগণকে ডাকেন ও তাদেরকে বিভিন্ন উপদেশ দেন। এ সময় তাঁর রোগ-যন্ত্রণা তীব্র আকার ধারণ করে। তিনি আয়েশা (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে আয়েশা! খায়বরে যে বিষমিশ্রিত খাদ্য আমি খেয়েছিলাম, সে বিষের প্রভাবে আমার শিরা-উপশিরা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে’।[5] তিনি গিলেননি, ফেলে দিয়েছিলেন। তাতেই যে সামান্য বিষক্রিয়া হয়, সেটিই মৃত্যুকালে তাঁকে কঠিনভাবে কষ্ট দেয়। আর এটাই স্বাভাবিক যে, পুরানো কোন অসুখ যা সুপ্ত থাকে, তা বার্ধক্যে বা মৃত্যুকালে মাথা চাড়া দেয়।

উল্লেখ্য যে, ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে খায়বর বিজয় শেষে ইহূদী বনু নাযীর গোত্রের নেতা সাল্লাম বিন মিশকামের স্ত্রী যয়নব বিনতুল হারেছ তাঁকে দাওয়াত দিয়ে বিষমিশ্রিত বকরীর ভুনা রান খেতে দেয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেই গোশত মুখে দিয়ে চিবানোর পর না গিলে ফেলে দেন (فَلَمْ يُسِغْهَا، وَلَفَظَهَا) এবং বলেন, এই হাড্ডি আমাকে বলছে যে এতে বিষ মিশানো আছে’।[6]

অতঃপর তিনি উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন, الصَّلاَةُ الصَّلاَةُ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ‘ছালাত ছালাত এবং তোমাদের দাস-দাসী’ অর্থাৎ ছালাত ও স্ত্রীজাতির বিষয়ে তোমরা সর্বাধিক খেয়াল রেখো’। আয়েশা (রাঃ) বলেন, একথাটি তিনি বারবার পুনরাবৃত্তি করেন’। আনাস (রাঃ) বলেন, এটিই ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর সর্বশেষ অছিয়ত’।[7]

গ্রন্থঃ নবীদের কাহিনী

অধ্যায়ঃ হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) – মাদানী জীবন

[1]. বুখারী হা/৬৮০ ‘আযান’ অধ্যায়-১০, অনুচ্ছেদ-৪৬। [2]. বুখারী হা/৬২৮৫; মুসলিম হা/২৪৫০; মিশকাত হা/৬১২৯। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর মাত্র ছয়মাস পরে ১১ হিজরী ৩রা রামাযান মঙ্গলবার ফাতেমা (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩০ অথবা ৩৫ বছর। তিনি হাসান, হোসায়েন, উম্মে কুলছূম ও যয়নব নামে দু’পুত্র ও দু’কন্যা সন্তান রেখে যান। তাঁর কবর সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ বলেন, নিজের ঘরেই তাঁকে দাফন করা হয়। কেউ বলেন, বাক্বী‘ গোরস্থানে দাফন করা হয় (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১০৮-১০)। [3]. বুখারী হা/৩৬২৪; মুসলিম হা/২৪৫০; মিশকাত হা/৬১২৯। আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত বুখারী হা/৩৬২৩ দ্বারা বুঝা যায় যে, এই সুসংবাদ তাকে শেষ সপ্তাহে দেওয়া হয়’। হা/৩৬২৬ দ্বারা বুঝা যায় যে, মৃত্যু যন্ত্রণার সময় এই সুসংবাদ দেওয়া হয়। দু’টিই হ’তে পারে। কেননা আগে বলার পর তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য পুনরায় বলাতে দোষের কিছু নেই। [4]. বুখারী হা/৪৪৬২, আনাস (রাঃ) হ’তে; মিশকাত হা/৫৯৬১। [5]. বুখারী হা/৪৪২৮; মিশকাত হা/৫৯৬৫। [6]. ইবনু হিশাম ২/৩৩৭-৩৮; বর্ণনাটি ছহীহ, তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৫৬৬; আহমাদ হা/৩৫৪৭; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ৩৪৭ পৃঃ। [7]. ইবনু মাজাহ হা/২৬৯৭; আহমাদ হা/২৬৫২৬; বায়হাক্বী হা/১৫৫৭৮; মিশকাত হা/৩৩৫৬।

মৃত্যু যন্ত্রণা শুরু (بدء سكرات الموت)

এরপর মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হ’ল। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্ত্রী আয়েশার বুকে ও কাঁধে ঠেস দিয়ে বসা অবস্থায় ছিলেন। এমন সময় আয়েশা (রাঃ)-এর ভাই আব্দুর রহমান (রাঃ) সেখানে উপস্থিত হন। তার হাতে কাঁচা মিসওয়াক দেখে সেদিকে রাসূল (ছাঃ)-এর দৃষ্টি গেল। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি তাঁর আগ্রহ বুঝতে পেরে তাঁর অনুমতি নিয়ে মিসওয়াকটি চিবিয়ে নরম করে তাঁকে দিলাম। তখন তিনি সুন্দরভাবে মিসওয়াক করলেন ও পাশে রাখা পাত্রে হাত ডুবিয়ে (কুলি সহ) মুখ ধৌত করলেন। এসময় তিনি বলতে থাকেন, لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، إِنَّ لِلْمَوْتِ سَكَرَاتٍ ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। নিশ্চয়ই মৃত্যুর রয়েছে কঠিন যন্ত্রণা সমূহ’।[1] এমন সময় তিনি ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে হাত কিংবা আঙ্গুল উঁচিয়ে বলতে থাকলেন,

مَعَ الَّذِيْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيْقًا، اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِىْ وَارْحَمْنِىْ وَأَلْحِقْنِىْ بِالرَّفِيْقِ الْأَعْلَى، اللَّهُمَّ الرَّفِيقَ الْأَعْلَى-

‘(হে আল্লাহ!) নবীগণ, ছিদ্দীকগণ, শহীদগণ এবং নেককার ব্যক্তিগণ যাদের তুমি পুরস্কৃত করেছ, আমাকে তাদের সাথী করে নাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর ও দয়া কর এবং আমাকে আমার সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত কর। হে আল্লাহ! আমার সর্বোচ্চ বন্ধু!’ আয়েশা (রাঃ) বলেন, শেষের কথাটি তিনি তিনবার বলেন। অতঃপর তাঁর হাত এলিয়ে পড়ল, দৃষ্টি নিথর হয়ে গেল’। তিনি সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত হ’লেন।[2] আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমার উপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার ঘরে, আমার পালার দিন এবং আমার বুক ও গলার মধ্যে হেলান দেওয়া অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। আর তাঁর মৃত্যুর পূর্বক্ষণে পার্থিব জীবনের শেষ দিন ও পরকালীন জীবনের প্রথম দিন আল্লাহ আমার মুখের লালার সাথে তাঁর মুখের লালা মিলিয়ে দিয়েছেন। আর আমার ঘরেই তাঁর দাফন হয়েছে’।[3]

আয়েশা (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, যখন মৃত্যু ঘনিয়ে এল, তখন তাঁর মাথা ছিল আমার রানের উপর, তিনি বেহুঁশ হয়ে গেলেন। তারপর হুঁশ ফিরে এল। তখন তিনি ছাদের দিকে চক্ষু নিবদ্ধ করলেন। অতঃপর বললেন, اللَّهُمَّ الرَّفِيْقَ الْأَعْلَي ‘হে আল্লাহ! হে সর্বোচ্চ বন্ধু’! আর এটাই ছিল তাঁর শেষ কথা। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এর দ্বারা আমি বুঝলাম, এখন তিনি আর আমাদের পসন্দ করবেন না। বুঝলাম, যে কথা তিনি সুস্থ অবস্থায় বলতেন, সেটাই ঠিক হ’ল। তা এই যে, لَنْ يُقْبَضَ نَبِيٌّ قَطُّ حَتَّى يُرَى مَقْعَدَهُ مِنَ الْجَنَّةِ ثُمَّ يُخَيَّرُ ‘কোন নবী মৃত্যুবরণ করেন না, যতক্ষণ না জান্নাতে তাঁর ঠিকানা দেখানো হয়। অতঃপর তাঁকে এখতিয়ার দেওয়া হয় দুনিয়ায় বেঁচে থাকার অথবা মৃত্যুবরণ করে জান্নাতে যাওয়ার’। আমি বুঝলাম যে, তিনি আখেরাতকেই পসন্দ করলেন।[4] অতঃপর আমি তাঁর মাথা বালিশে রাখি এবং অন্যান্য মহিলাদের সাথে কাঁদতে কাঁদতে উঠে আসি’ (ইবনু হিশাম ২/৬৫৫)। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন (আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী; (বাক্বারাহ ২/১৫৬)।

উপরোক্ত দুই বর্ণনার সমন্বয় এটাই হ’তে পারে যে, বুকের উপরে মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হ’লে তিনি তাঁকে স্বীয় রানের উপরে শুইয়ে দেন এবং তখনই রাসূল (ছাঃ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

দিনটি ছিল সোমবার (বুখারী হা/১৩৮৭) সূর্য অধিক গরম হওয়ার সময় (حِينَ اشتدَّت الضحي) অর্থাৎ ১০/১১ টার সময়। এ দিন তাঁর বয়স হয়েছিল চান্দ্রবর্ষ হিসাবে ৬৩ বছর (বুখারী হা/৩৫৩৬)[5] চার দিন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/২৫১)।

[1]. বুখারী হা/৪৪৪৯; মিশকাত হা/৫৯৫৯। [2]. বুখারী হা/৪৫৮৬, ৫৬৭৪; মিশকাত হা/৫৯৫৯-৬০; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৫৭০৭-০৮। [3]. قَبَضَهُ اللهُ بَيْنَ سَحْرِى وَنَحْرِى وَدُفِنَ فِى بَيْتِى বুখারী হা/১৩৮৯, ৪৪৪৯, ৪৪৫১; মিশকাত হা/৫৯৫৯; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৫৭০৭। [4]. বুখারী হা/৬৩৪৮; মুসলিম হা/২৪৪৪; মিশকাত হা/৫৯৬৪; দারেমী হা/৭৭; মিশকাত হা/৫৯৬৮। [5]. অধিকাংশ জীবনীকারের মতে দিনটি ছিল ১১ হিজরীর ১২ই রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুন। তবে যেহেতু ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম ও মৃত্যু দু’টিই সোমবারে হয়েছিল (মুসলিম হা/১১৬২; বুখারী হা/১৩৮৭)। অতএব সেটা ঠিক রাখতে গেলে তাঁর জন্ম ৯ই রবীউল আউয়াল সোমবার এবং মৃত্যু ১লা রবীউল আউয়াল সোমবার হয়’ (বিস্তারিত দ্রঃ ‘জন্ম ও মৃত্যু’ অনুচ্ছেদ)। রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম ও মৃত্যু তারিখ অস্পষ্ট রাখার মধ্যে শিক্ষণীয় এই, যাতে তাঁর উম্মত অনুষ্ঠানসর্বস্ব হয়ে না পড়ে এবং জন্ম দিবস ও মৃত্যু দিবস পালন করার মত বিদ‘আতী কাজে লিপ্ত না হয়।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button