বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকচিক্যময় জীবন থেকে আল্লাহর কাছে আসার গল্প
বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকচিক্যময় জীবন সবে মাত্র শেষ করেছি। মাত্রাতিরিক্তভাবে নেশার জগতে আবদ্ধ ছিলাম। খুব অল্প বয়সেই আমার ঠোঁট প্রথম সিগারেটের স্পর্শ করে। এটা দিয়ে নিজেকে প্রশান্ত করতাম।
ঘটনার শুরু হয় এক মেয়ে কে দিয়ে। পাগলের মত মরিয়া ছিলাম তার জন্য! দীর্ঘ ২ বছর মেয়েটির পিছু ছুটার ফলাফল হয় এক কষা থাপ্পড় এবং জঘন্যতম অপমান! সেই থেকেই ধূমপান আমার জীবনের একটি অংশ হয়ে পড়ে। বুক ভর্তি দুঃখের কথা বলতাম ড্রাগস যুক্ত পাইপ টার সাথে…. এক দিনে কম করে হলেও ৭-৮ টি সিগারেট খেতাম। বাড়িতে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে বাবার কাছ থেকে টাকা নিতে হত। এ নিয়ে কয়েকবার ধরা খাওয়ার পর টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয় পরিবার। পরবর্তীতে আমি মা’র ব্যাগ থেকে চুরি করতাম, লুকিয়ে বাসার জিনিশপত্র বিক্রয় করে দিতাম। মোট কথা- যাই হোব না কেন, ধূমপান ছাড়া যাবে না!
আমার জীবন খুব একটা সুখ দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল না। বাসায় সবসময় বাবা-মা এর মধ্যে ঝগড়াবিবাদ লেগেই থাকতো। অবৈধ ইনকাম করতো বাবা। স্কুল/কলেজে পড়ালেখায় ছিলাম বরাবরই দুর্বল এবং এ নিয়ে ঘরে তুমুল ঝড় বইতো। প্রাণপ্রিয় বড় ভাই কে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কারাবন্দী সে… মাথায় এক গাদা টেনশন নিয়ে দিন পার হয়ে যেত। রাতে ঠিকমত ঘুমতে পারতাম না। সব মিলিয়ে আমার জীবনপথ ভাল কাটে নি। তাই মূলত সিগারেট হয়ে উঠেছিল আমার বেদনার সঙ্গি।
সাল ২০১০। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকচিক্যময় সময় সবে পার করেছি। চেইন স্মোকার ছিলাম তখন। একদিন বিকেলে ঘুমাচ্ছিলাম, হঠাৎ বাজে ভাবে কাশতে লাগলাম। শরীর জয়েন্টে যেন জমাট বেঁধে আছে! নড়তে পারছি না। মা কে ডাকতে ডাকতেই মাটিতে বমি করে দিলাম। রক্ত বমি! মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো! সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
চোখ খুলে নিজেকে আকাশী রঙা কাপড়ে আবিষ্কার করলাম হাস্পাতালের স্টিল খাটে। পাশে গম্ভীর ভাবে মামা আর মা বসে আছে। আম্মার চোখ মুখ লাল, আউলানো চুল। আমার খুবই দুর্বল লাগছে। পরের ২ দিন যে কীভাবে কেটেছে হসপিটালে- তা জানা নেই…
ঘটনার পর থেকে আমাকে নানান ধরণের ঔষধ খাওয়ানো হয়। কিন্তু আমার কি হয়েছে- তা কেউ বলতে চায় না। ওদিকে বাসা থেকেও বের হতে দেয় না কেউ! দম বন্ধ হয়ে আসছিল! একদিন অনেক কান্নাকাটি করে, হাতে পায়ে পড়ে আম্মার কাছে জানতে চাই আমার মূল সমস্যাটা কি… তিনি হঠাৎ কেঁদে দিয়ে বললেন, আমি সর্বচ্চো ৭-৮ মাসের বেশি বাঁচবো না। নিকোটিন আমার হৃদপিন্ড ঝলসে দিয়েছে! ক্যামো থ্যারাপি দিয়েও এখন কোন ফায়দা নেই, দেরি হয়ে গেছে। সব শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম আম্মার দিকে। তিনি আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলেন…
সেদিন আমি আমার রুমে চেয়ারে বসে প্রায় ১০ ঘন্টা পার করে দেই! ভাবতে শুরু করলাম অতীতের কথা। বুঝ হওয়ার বয়স থেকে যা যা করেছি- সব কিছুর পুনরাবৃত্তি ঘটলো মনের মাঝে। ভীষণ চিন্তিত হয়ে যাই।
জানি না সেদিন কি হয়েছিল… ইশার আজান কেন জানি খুব মধুময় মনে হল। ওজু করে, ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হলাম নামাজে উদ্দেশ্যে। জীবনে প্রথম মসজিদে ইশার নামাজ পড়ি সেদিন। প্রত্যেকটা রুকু, সিজদা, যিকির, তিলাওয়াত, দু’আ যেন চমৎকার লাগছে! এত তৃপ্তি সহকারে কখনো সালাত পড়ি নি আগে! মাসজিদ থেকে বের হয়ে মনে হল কেউ আমাকে গোসল করিয়ে দিয়েছে। পুরো শরীর এখন পরিষ্কার, পবিত্র! বাসায় এসে আমার সূরা ফাতেহা, সূরা আর রহমার ও সূরা ক্বরিয়া এর অর্থ জানার ইচ্ছে জাগলো। ইশার জামাতে এই সূরা গুলো পড়িয়েছেন ইমাম। আমি কিছু বুঝি নি, তাও অবিরাম কেঁদেছি শুধু আর মন হালকা হয়েছে। কি আছে এতে? সূরা আর রহমানের অর্থ পড়ার পর যেন পুরো দুনিয়া উল্টো হয়ে যায়! আমি আম্মার কথা শুনে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু এখন নিজেকে নবজাতক শিশুর মত লাগছে! পুরো জীবন যেন ভবিষ্যতেই পড়ে রয়েছে! কবর, হাশর, জান্নাহ, জাহান্নাম!
ইসলামের সম্পর্কে জ্ঞান ছিল না এমন কিন্তু নয়। তারপরও সেই রাতে কুর’আন টা কে যেন নতুন লাগছিল! দীর্ঘ সময় নিয়ে অর্থ সহ তিলাওয়াত করে ঘুমিয়ে পড়ি। সেই রাতের মত এত ভাল ভাবে আমি সুস্থ অবস্থায়ও ঘুমাই নি! সকালে ফজরের নামাজ পড়লাম বাসায়। নামাজ শেষে যিকর করতে করতে ভাবলাম আমার তাওবা করা দরকার। জীবনে তো ফলপ্রসূ কিছু করি নি, অন্তত এটা করি! খুব কান্না করলাম সকাল থেকে আল্লাহর নিকট। দেখলাম, যত কান্না করি, তত মন শান্ত হয়! ব্যাপারটা আমার খুব তৃপ্তিকর লাগলো….
বর্তমানে আমি অনেকটা সুস্থ আছি আল্লাহর রহমতে। আলহামদুলিল্লাহ আমি শরিয়তসম্মত অনেক ইসলামিক চিকিৎসা করিয়েছি নিজের। আলাহামদুলিল্লাহ অসুস্থতা নিয়ে আজ আমি ২ বছরের উপর বেঁচে আছি। আলহামদুলিল্লাহ বুঝতে পেরেছি জীবনের প্রকৃত অর্থ। আলহামদুলিল্লাহ আমার পরিবারের সকল সদস্য দ্বীনের পথে চলে এসেছে এবং আমার যথাযথা সাহায্য করছে। জীবন মরণের উপর তো একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’আলার অধিকার!
আমার একটি শেষ ইচ্ছে, কুর’আন হিফজ করা। শারীরিক ভাবে দুর্বল থাকায় কষ্ট হচ্ছে হিফজ করতে। তবুও আমার ওস্তাদের অনুপ্রেরণা আমায় অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। সবার কাছে দু’আ চাচ্ছি যাতে বিচার দিবসে এই কুরআনুল কারিম আমার সহায়ক হয়…