এবং হিমু যখন প্র্যাকটিসিং মুসলমান (পর্ব – ৬)

আমাদের ম্যানেজারের নাম হায়দার আলী খাঁ। নামের সঙ্গে তার চেহারার কোন সঙ্গতি ণেই। রোগা , বেঁটে একজন মানুষ। বেঁটেরা সচরাচর কুজো হয় না। তিনি খানিকটা কুঁজো। ব্যক্তিবিশেষের সামনে তার কুঁজোভাব প্রবল হয়। আমি সেই ব্যক্তিবিশেষের একজন। ইদানীং তিনি কোন কারণ ছাড়াই আমাকে ভয় পায় অথবা বলা যায় সম্মান করে। যখন ইসলাম বুঝতাম না তখন এই লোক আমার সাথে কথা বলতো হেয়ালি করে। আমার জন্য সামান্য তম সম্মান আমি তার চোখে দেখি নি । কিন্তু যখন থেকে নামায শুরু করেছি। হলুদ পাঞ্জাবির বদলে খয়েরি জোব্বা গায়ে দিচ্ছি তখন থেকেই তার ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন । কি জানি আবার পীর টির ভাবা শুরু করল কি না?

হায়দার আলি খাঁ চেয়ারে গুটি সুটি মেরে বসে আছে। পিরিচে করে চা খাচ্ছে। ঐ লোককে আমি কখনো চা এর কাঁপে করে চা খেতে দেখিনি। আমি কাছে এসে হাসিমুখে বললাম, আসসালামু আলাইকুম ভাইসাহেব খবর কি?

ভদ্রলোক যেভাবে চমকালের তাতে মনে হল সাত রিক্টার স্কেলের একটা ভূমিকম্প হয়ে গেছে। পিরিচের সব চা তার জামায় পড়ে গেল। আমি বললাম, করছেন কি?

চা খাচ্ছি স্যার।

খুব ভাল। বেশি বেশি করে চা খান। রিসার্চ করে নতুন বের করেছে- দৈনিক যে সাত কাপ চা খাঁয় তার হার্টের আর্টারি কখনো ব্লক হয় না।

থ্যাংক ইউ স্যার।

যেভাবে তিনি থ্যাংক ইউ বললেন তাতে ধারনা হতে পারে হার্টের আর্টারি সংক্রান্ত রিসার্চটা আমার করা। আমি অবসর সময়ে মেসের ঘরের দরজা বন্ধ করে রিসার্চ করেছি।

বদরুল সাহেবকে নাকি নোটিশ দিয়ে দিয়েছেন? কথা কি সত্যি?

জ্বি। তিন মাসের রেন্ট বাকি । আর নানান যন্ত্রণা করে। বোর্ডাররা নালিশ করেছে।

কি যন্ত্রণা করেছে ?

রান্নার সময় বাবুর্চির পাশে বসে থাকে। ফিস্ট হয়েছে ১০০ টাকা করে চাঁদা । একটা পয়সা দেয় নাই – ফিস্ট খেয়ে বসে আছে।

চাঁদা না দিলেও খাঁটাখাটনি তো করেছে। গোশত কিনে আনা, খসির গোশত যে কেউ কিনতে পারে না। খুবই জটিল ব্যপার । খাসি ভেবে কিনে এনে রান্নার পর প্রকাশ পায় পাঁঠা।

হায়দার আলি খাঁ তাকাচ্ছেন। আমার কথাবার্তার ধরন বুঝতে পারছেন না। কি বলবেন তাও গুছিয়ে উঠতে পারছেন না।

ম্যানেজার সাহেব।

জ্বি স্যার।

বদরুল সাহেবকে আর কিছু বলবেন না।

তিন মাসের রেন্ট বাকি পড়ে গেছে। অন্য পার্টিকে কথা দিয়ে ফেলেছি। মানুষের কথার একটা দাম আছে । ঠিক না স্যার?

ঠিক তো বটেই। কথা দেয়ার ব্যপারে আমাদের মুসলিমদের তো এক্সট্রা সচেতন থাকতে হয়। মুনাফিকরা কথা দিয়ে কথা ভঙ্গ করে । মুমিন রা নয় ।

জ্বি স্যার ।

শুনুন তারপরও একটা ব্যবস্থা করুন। আশা করছি একমাসের মধ্যে সব পেমেন্ট ক্লিয়ার হয়ে যাবে ইন শ আল্লাহ ।

কিভাবে হবে? শুনেছি উনি ব্যাংকের ভালো চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছেন । ব্যংক থেকে যে টাকা তার পাওনা ছিল তাও নাকি তিনি নিবেন না । সুদি ব্যাংক এর কাছ থেকে নাকি আর কোন টাকা পয়সাই নেবেন না? কি নাকি গণ্ডগোলও করে এসেছেন?

গণ্ডগোল তো থাকবেই। পৃথিবীতে বাস করবেন আর গণ্ডগোলে পড়বেন না , তা তো হয় না। এই গণ্ডগোল নিয়েই বাস করতে হবে। উপায় কি? মনে থাকবে তো কি বললাম?

জ্বি স্যার।

আমি ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। ম্যানেজার অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জ্বি স্যার বলেছে বলেই ঠিক ভরসা পাচ্ছি না। ইসলামের ওপর না থাকা মানুষের বিনয়ের বাড়াবাড়িটাই সন্দেহ জনক। আমার নিজের ধারনা মিথ্যা বলার সময় বিনয় ব্যপারটা ব্যবহার না করতে পারলে মিথ্যা ধরে ফেলা সহজ হত। বিনয়ের কারণে সত্য মিথ্যা প্রভেদ করা সমস্যা হয়। মিথ্যার সঙ্গে বিনয় মিশিয়ে দিলে সেই মিথ্যা ধরা কঠিন হয়ে যায়।

টানা একটা ঘুম দিলাম যোহর পর্যন্ত। এই সময় মেসটা প্রায় ফাঁকাই থাকে। বেশির ভাগই চাকরি বাকরি করে তাই অফিসে থাকে। বাকিরা বাইরে খেতে বের হয়ে যায়। মেসে শুধু একবেলা খাবার ব্যবস্থা— রাতে। এক কাপ চা খেতে হলেও রাস্তা পার হয়ে স্টলে যেতে হবে। ইদানীং অবশ্য নতুন এক চা ওয়ালা শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে। এরা বিশাল ফ্লাস্কে করে চা ফেরি করে। চা এর দাম ফিক্সড— পাঁচ টাকা কাপ । চিনি বা দুধের দাম বাড়লে কাঁপের সাইজ ছোট হয় কিন্তু চা এর দামের হের ফের হয় না। আমাদের এখানে যে ছেলে চা বিক্রি করে তার নাম মতি। দেখতে রাজ পুত্রের মতো , আসলে ভিখিরি পুত্র।

বারান্দায় এসে মতিকে খুঁজলাম। ভর দুপুর বলে মতি এখনো আসেনি, তবে অপরিচিত এক লোক এসেছেন। শুকনো মুখে টুলে বসে আছেন। ভদ্রলোক অপরিচিত হলেও দেখা মাত্র চিনলাম– কারণ তার চশমার একটা ডাঁট ভাঙ্গা সুতা দিয়ে কানের সঙ্গে বাঁধা। ভদ্রলোক সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছেন। আমি হাসিমুখে সালাম দিয়ে বললাম, কি ভাই ভালো আছেন ?

তিনি হকচকিয়ে গেলেন উঠে দাঁড়ালেন।

বদরুল সাহেবের কাছে এসেছেন তাই তো?

জ্বি স্যার।

টাকা ধারের জন্য?

ভদ্রলোক খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন। চট করে কিছু বলতে পারছেন না। আবার খুব চেষ্টা করছেন কিছু বলতে।

আমি বললাম, বদরুল সাহেব আমাকে আপনার কথা বলেছেন। খুবই প্রশংসা করেছিলেন । প্রি টেস্ট পরীক্ষায় একটা এক্সটরা নাকি ভুল হয়েছিল। তাড়া হুড়া করেছিলেন নিশ্চই। অনেক সময় ওভার কনফিডেন্সে সমস্যা হয় । যাই হোক কেমন আছেন বলুন।

জ্বি ভাল। বদরুল কখন আসবে?

তা তো ভাই বলতে পারবো না।

এখানে থাকেন না ?

থাকেন এখানেই কিন্তু কত দিন থাকতে পারবে সেটা একটা প্রশ্ন।

মানে?

মানে ওনার অবস্থা আপনার থেকেও করুন। আপনিতো ফার্স্ট বয় হয়ে হাত পেতে দিন যাপন করে যাচ্ছেন এই লোক তো সেটাও পারছে না। আচ্ছা আপনার নামটা জেনো কি ?

আব্দুর রশিদ।

শুনুন আব্দুর রশিদ সাহেব । উনার জন্যে অপেক্ষা করে লাভ ণেই । এখানে উনার খোঁজে আসাও অর্থহীন । চলে যান।

চলে যাবো ?

আপনাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারি , শুধু চা , — খাবেন?

আব্দুর রশিদ হ্যাঁ না কিছুই বলল না।

তার আগে চলেন যোহরের নামাযটা আদায় করে ণেই শোয়া একটায় জামাত। সব মাসজিদে এখন দেড়টায় নামায শুরু হয় কিন্তু আমাদের এই মাসজিদে সব সময় সোয়া একটায় যোহরের নামায হয়। হোক সেটা শীতকাল কিংবা গরমকাল।

ডাঁট ভাঙ্গা সুতা প্যাঁচানো চশমার ভেতর দিয়ে যেই চোখ দেখা যাচ্ছে তাতে বিষণ্ণতা স্পষ্ট। তার মুখও বলে দিচ্ছে সে পুরো পুরি আশা হত।

আমি ভদ্র লোককে মাসজিদে নিয়ে গেলাম। সময় নিয়ে যোহরের নামায আদায় করলাম। তারপর চা খাওয়ালাম , সিঙ্গারা খাওয়ালাম। এইখানেই শেষ করলাম না , রাস্তার পাশে ঘড়ি সারাইয়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে চশমার ডাঁট লাগিয়ে দিলাম। আমার সর্বমোট ৫০ টাকা খরচ হল।

ভদ্রলোক বললেন, ভাই সাহেব আপনাকে একটা কথা বলি যদিকিছু মনে না করেন। আপন ভেবে বলছি।

বলুন কিছু মনে করব না।

কথাটা বলতে খুবই লজ্জা পাচ্ছি। আপনি অতি মহৎপ্রাণ এক ব্যক্তি। আপনাকে বিব্রত করতেও লজ্জায় মাথা কাঁটা যাচ্ছে… ।

মাথা কাঁটা যাওয়ার কিছু ণেই আপনি বলুন।

দারুণ এক সংকটে পড়েছি ভাই সাহেব। আত্মহত্যা ছাড়া এখন আর পথ দেখছি না।

ছেলে আসুস্থ। টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না?

ধরেছেন ঠিকই । তবে ছেলে না , মেয়ে। কনিষ্ঠা কন্যা। সকাল থেকে হাঁপানির মতো হচ্ছে। ডাক্তার ইনজেকশনের কথা বলল।

দাম কত ইঞ্জেকশোনের

শখানেক টাকা হলে হয়। ইনজ্যাকশন , সেই সঙ্গে কি ট্যাবলেট যেন দিয়েছে । আমি আমার স্ত্রীকে বললাম চিকিৎসা করার টাকা কোথায়? তুমি বরং গলা টিপে মেরে ফেল।

উনি গলা টিপে মারতে রাজি হচ্ছেণ না ?

আব্দুর রশিদ আমার এই কোথায় অস্বস্তিতে পড়ে গেল। আমি বললাম, এইসব কঠিন কাজ স্ত্রীলোক দিয়ে হবে না। এইসব হল পুরুষের কাজ। গলা টিপে মারতে হলে আপনাকেই মারতে হবে।

ভাই সাহেব ঠাট্টা করছেন?

হ্যাঁ ঠাট্টা করছি ।তবে মৃত্যু কোন ঠাট্টা তামাশার বিষয় না।

ভাই টাকাটা পেলে খুব উপকার হতো ।

হু। স্কুল জীবনে আপনি অংকে খুব ভাল ছিলেন তাই না? কেমন ভাল ছিলেন প্রমাণ দিন দেখি। সহজ একটা অংক জিজ্ঞেস করব। কারেক্ট উত্তর দেবেন । একশ টাকা নিয়ে চলে যাবেন।

আব্দুর রশিদ ক্ষীণ স্বরে বলল, কি অংক?

একটা বাড়িতে চারটা হারিকেন জ্বলছিল। গভীর রাতে কথা ণেই বার্তা নেই শুরু হল ঝড়। একটা হারিকেন গেল নিভে। এখন আপনি বলুন ঐ বাড়িতে হারিকেন এখন কয়টা ?

তিনটা!

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, হয়নি। একটা হারিকেন নিভে গেছে ঠিকই। হারিকেনের সংখ্যা তো কমেনি। হারিকেন চারটাই আছে। আপনি তো ভাই আগের সেই অংক এক্সপার্ট হওয়ার ব্যপারটা ধরে রাখতে পারেন নি। টাকাটা দিতে পারলাম না। কিছু মনে করবেন না।

আব্দুর রশিদ দাঁড়িয়ে আছে– আমি হাঁটা শুরু করেছি। আব্দুর রশিদ মেয়ের অসুস্থতা নিয়ে মিথ্যা গল্প বলছেন। খারাপ লাগছে,— কারণ আমি ব্যপারটা ধরতে পারছি । হাত পেতে জীবন যাপনের মজা পেয়ে গেলে এই সমস্যা , এরা আর কাজ করতে পারে না। সত্য মিথ্যা যাই হোক এক উসিলায় হাত পাতে।

এখন মেসে ফিরে যাব। দুপুরে না খাঁওয়াতে খিদেয় নাড়িভুঁড়ি পাক দিচ্ছে। সামণের হোটেলটায় খেয়ে নেয়া যায়। গরম ডিম ভাজা দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। আগুণ গরম ভাত ডিম ভাজা দিয়ে খেতে অতি উপাদেয়। তবে খেতে হয় চুলা থেকে ভাত নাম্বার সঙ্গে সঙ্গে। দেরি করা যায় না।

 

তাহাজ্জুতের নামায ঘরে পরা ভালো । কিন্তু আমার ঘরে নামায পড়ার সেই রকম জায়গা নেই। তাই রাতে মাসজিদের বারান্দাতেই নামায আদায় করতে হয়। ইদানীং প্রায় সব মাসজিদ তালাবদ্ধ থাকে । পরিচিত ছাড়া মাসজিদে থাকা এখণ এক রকম অসম্ভব হয়ে গেছে , তবে কিছু মাসজিদের বারান্দা আছে। বারান্দা খোলা থাকে , সেই বারান্দায় নামায আদায় করা যায় । মাসজিদের খাদেম সাহেব জেগে থাকলে , আড় চোখে তাকায়। কিন্তু কিছু বলেন না। আসলে নামাযে বাধা দেয়ার সাহস হয় না কারও । আমি ঘর থেকে বেরুলাম রাত বারোটায় । দরজা তালাবদ্ধ করে বেরুচ্ছি , দেখি বদরুল সাহেব। কলঘর থেকে হাত মুখ ধুয়ে ফিরছেন। মুখ ভেজা , কাঁধে গামছা। রাত বারোটায় আমার মন টন খুব ভাল থাকে, নিজের রবের সামনে দাঁড়াতে যাবো মনতো ভালো থাকবেই। কাজেই আমি উল্লাসের সঙ্গেই বললাম, কি খবর বদরুল সাহেব।

তিনি লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসলেন।

কোথায় ছিলেন আজ সারাদিন?

তিনি আবারো হাসলেন। আমি বললাম , গিয়েছিলেন নাকি ইয়াকুব আলির কাছে?

জ্বি।

দেখা হয়নি?

দেখা হয়েছে । অতিরিক্ত ব্যস্ত।

কথা হয়নি?

হয়েছে। চাকরির ব্যপারটা বললাম।

আগেও তো বলেছিলেন। আবার কেন?

ভুলে গিয়েছে। নানান কাজকর্ম নিয়ে থাকে তো। আজকে তার আবার একটা দুর্ঘটনা ঘটল। তার মনটা ছিল খারাপ।

কি দুর্ঘটনা ?

একুশ লাখ টাকা দিয়ে নতুন গাড়ি কিনেছে। সেই গাড়ির হেডলাইট ভেঙ্গে ফেলেছে, কেয়ারলেস ড্রাইভার। ঐ নিয়ে নানান হৈ-চৈ , ধমকা ধমকি চলছে, তার মধ্যে আমি গিয়ে পড়লাম।

আপনি ধমক খেয়েছেন?

জি না , আমি ধমক খাব কেন? আমার ছেলেবেলার বন্ধু । ভেরি ক্লোজ ফ্রেন্ড। গাড়ির হেডলাইট ভাঙ্গার কারণে ইয়াকুবের মন খারাপ দেখে আমার মন খারাপ হল। এর মধ্যে চাকরির কথা টা তুলে ভুল করেছি।

ইয়াকুব সাহেব রেগে গেছেন?

তা ঠিক না। বলল বায়োডাটা তার সেক্রেটারির কাছে দিয়ে যেতে। দুটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি সহ বায়োডাটা , সে দেখবে।

দেখবে বলেছে?

দেখবে তো বটেই। স্কুল জীবনের বন্ধু , ফেলবে কি করে? বায়োডাটা দিয়েই সারাদিন ছোটা ছুটি করলাম। একদিনের মধ্যে ছবি তুলে বায়োডাটা টাইপ করে পাচটার সময় একেবারে ইয়াকুবের হাতেই ধরিয়ে দিয়েছি।

ইয়াকুব সাহেব আপনার কর্মতৎপরতা দেখে নিশ্চয়ই খুব খুশি হলেন।

বদরুল চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, খুশি হননি?

জি – না। একটু মনে হয় বেজার হয়েছে; সেক্রেটারির হাঁতে দিতে বলেছে, আমি তা না করে তার হাতেই দিলাম– এতে সামান্য বিরক্ত। এত বড় একটা অর্গানাইজেশন চালায়। তার তো একটা সিস্টেম আছে। হুট করে হাঁতে কাগজ ধরিয়ে দিলে হবে না । ভুলটা আমার।

বদরুল সাহেব আপনার কি ধারনা ইয়াকুব আলি আপনাকে চাকরি দেবেন?

সবই আল্লাহর ইচ্ছা ভাই। কিন্তু যেহেতু সে আমার ছোট বেলার বন্ধু ,সে আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারেই না। আমার সামণেই সেক্রেটারিকে ডেকে বায়ডাটা দিয়ে দিল। বলল উপড়ে আর্জেন্ট লিখে ফাইলে রাখতে।

কবে নাগাদ চাকরি হবে বলে মনে করছেন?

আল্লাহ চাহে তো খুব বেশি হলে এক সপ্তাহ। ইয়াকুব আমাকে এক সপ্তাহ পরে খোজ নিতে বলেছে। আগামী শনিবারের মধ্যে ইন শ আল্লাহ হয়ে যাবে। স্বপ্নেও তা–ই দেখলাম।

এর মধ্যে স্বপ্নও দেখে ফেলেছেন?

জ্বি। ছোটা ছোটি করে কাগজ পত্র জোগাড় করে টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, একটু রেস্ট নেই ইয়াকুবের পি এ বলল, বসুন চা খান। চা খাঁওয়ার জন্যে বসেছি। বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনিড় মত এসে গেল। তখন স্বপ্নটা দেখেছি। দেখলাম কি — কে জেনো এসেছে। তার হাঁতে বিরাট এক মৃগেল মাছ। এইমাত্র ধরা হয়েছে। ছটফট করছে। লোকটা বলল নিজের পুকুরের মাছ । আপনার জন্য আনলাম। নিয়ে যান। মাছ স্বপ্নে দেখা খুবই ভাল। হিমু ভাই , আপনি যাচ্ছেন কোথায় ?

হাঁটতে যাচ্ছি , আর সৃষ্টি কর্তার সামনে দাঁড়াতে যাচ্ছি… তার সাথে বাতচিতও করবো।

কি বলেন এইসব । আজব তো ? রাত দুপুরে হাঁটবেন আবার সৃষ্টি কর্তার সাথে কথা বলবেণ ? বুঝলাম না ভাই।

চলুন আজকে আমার সঙ্গে বুঝে যাবেন।

যেতে বলছেন?

এক রাতে একটু অনিয়ম করলে কিছু হবে না।

খুবই টায়ার্ড লাগছে হিমু ভাই । ভাবছি ঘুমুব।

ঘুম তো আপনার আসবে না। খিদে পেটে শুয়ে ছট ফট করবেন। এরচে চলুন কোথাও নিয়ে গিয়ে আপনাকে খাইয়ে আনি। মনে হচ্ছে সারাদিন কিছু খাননি।

সারাদিন খাইনি কি করে বুঝলেন?

বোঝা যায়। মানুষের সব খবর তার চোখে লেখা থাকে। ইচ্ছে করলেই সেই লেখা পড়া যায়। কেউ ইচ্ছে করে না বলে পড়তে পারে না।

আপনি পারেন?

মাঝে মাঝে পারি। সব সময় পারি না। আপনি যে সারাদিন খাননি এটা আপনার চোখে এখন পড়তে পারছি। চলুন গল্প করতে করতে যাই ।

বলার মতো কোন গল্প যে আমার নাই হিমু ভাই।

আছে । বলার মতো গল্প আছে । মানুষের জীবনের সব গল্পই বলার মতো। আপনার বিয়ের গল্প শুনবো আজকে।

রাস্তায় নেমেই বদরুল সাহেব বিস্মিত স্বরে বললেন, হাঁটতে তো ভালোই লাগছে। রাস্তা গুলি অন্য রকম লাগছে। আশ্চর্য তো। সৃষ্টি কর্তার সামনে দাঁড়ানো, তার সাথে বাত চিতের ব্যপারটাও মনে হয় আরও ইন্টারেস্টিং হবে হিমু ভাই? ব্যপারটা কি ?

আমি ব্যপার ব্যখ্যা করলাম না। রাতের বেলায় যেমন রাস্তার চরিত্র বদলায় , মানুষের মনও বদলায়। এর ব্যখ্যা একেক জন একেক ভাবে উপলব্দি করে । এই উপলব্ধিতে বাধ দিয়ে দেয়াড় কি দরকার। যার যার উপলব্ধি থাকনা তার তার মতো।

বদরুল সাহেব বললেন , হাঁটতে হাঁটতে আমরা কোথায় যাব?

আমি বললাম, কোন এক মাসজিদের বারান্দায় ইন শা আল্লাহ। কিন্তু কোন মাসজিদ সেটা বলতে পারছি না। আচ্ছা বলুন কিভাবে আপনাদের বিয়ে হল।

মুন্সিগঞ্জ বেড়াতে গিয়েছিলাম। খালার শ্বশুর বাড়িতে। ওদের একান্নবর্তী পরিবার। লোকজন গিজ গিজ করছে। কে কখন খাঁয় কোন ঠিক ণেই। খাওয়া দাওয়ার ভেতরে কোন যত্ন ণেই। খেলে খাঁও , না খেলে খেও না। ওই রকম ভাব। মাঝে মাঝে কি হয় জানেন? ভাল একটা পদ হয়ত রান্না হচ্ছে , এদিকে বেশির ভাগ মানুষ খেয়ে উঠে গেছে। কেউ জানেই না — মূল পদ এখনো রান্না হয় নি…

বদরুল সাহেব তার বিয়ের গল্পের জায়গায় খাওয়ার গল্প ফেঁদে বসেছেন। এই খাওয়া দাওয়ার ভেতর থেকে বিয়ের গল্প হয়ত শুরু হবে— কখন হবে কে জানে। ভদ্রলোকের সম্ভবত খিদেও পেয়েছে। খিদের সময় শুধু খাবার এর কথাই মনে পড়ে। তাকে খাওয়ানোর কি ব্যবস্থা করা যায় বুঝতে পারছি না। আবারো পকেটবিহীন জোব্বা পড়ে বের হয়েছি। এই জোব্বা মনে হয় আর ব্যবহার করা যাবে না। বদরুল সাহেব গল্প চালিয়ে যাচ্ছেন। সেদিন কি হয়েছে শুনুন। পাবদা মাছ এসেছে। এক ঝুড়ি, প্রত্যেকটা দেড় বিঘত সাইজ। এ বাড়িতে আবার অল্প কিছু আসে না । যা আসে ঝুড়ি ভর্তি আসে…

আমরা মূল রাস্তা ছেড়ে গলিতে ঢুকলাম। বদরুল সাহেবের গল্পে বাঁধা পড়ল। আমরা টহল পুলিশের মুখোমুখি পড়ে গেলাম। ইউনিফর্মের কারণে সব পুলিশ এক রকম মনে হলেও এটি যে গতকালেরই দল এতে আমার কোন সন্দেহ রইল না ।

আমি আন্তরিক ভঙ্গিতে বললাম কি খবর?

টহল পুলিশের দল থমকে দাড়ালো।

আজ আপনাদের পাহারা কেমন চলছে?

এই প্রশ্নেরও জবাব ণেই। বদরুল সাহেব হক চকিয়ে গেছেন। কথা বার্তার ধরন ঠিক বুঝতে পারছেন না।

কালকের ওস্তাদজি আজও প্রথম কথা বললেন তবে তুই তকারি না, ভদ্র ভাষা।

আপনারা কোথায় যান?

ভাত খেতে যাই। আজ অবশ্যি আমি খাব না। এই ভদ্রলোক খাবেন। উনার নাম বদরুল আলম। উনাকে থাপ্পড় দিতে চাইলে দিতে পারেন । উনিও কিছু বলবেন না। উনিও আমার মতই মজলুম টাইপ।

বদরুল সাহেব ফিস ফিস করে বললেন, ব্যপারটা কি কিছুই তো বুঝতে পারছি না । কি সমস্যা ?

কোন সমস্যা না। জনগণের সেবক পুলিশ ভাইরা এখন আপনার রাতের খাবার ব্যবস্থা করবেন ইনশা আল্লাহ।

পুলিশ দলের একজন বলল, কালকের ব্যপারটা মনে রাখবেন না। নানাকিসিমের বদলোক রাস্তায় ঘুরে , নেশা করে । আমরা বুঝতে পারি নাই। একটা মিস্টেক হয়েছে।

আমি কিছু মনে করিনি। মনের ভেতর অতি সামান্য খচ খচানি আছে , সেটা দুর হয়ে যাবে ইন শ আল্লাহ — আচ্ছা আপনারা একটা উপকার করতে পারেন ।

জ্বি বলেন

বদরুল সাহেবের জন্যে রাতে খাবার কিছু ব্যবস্থা করতে পারেন।

এতো রাতে?

আপনাদের কারবারি তো রাতে। আপনাদের একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দেই। যে কোণ একটা হোটেলে গিয়ে বদরুল সাহেবকে দেখিয়ে বিনীত ভাবে বলবেন যে লোকটা সারাদিন ধরে খাঁয় নি ,কিছু ব্যবস্থা করতে,– দেখবেন দৌড়ে ঝাপটে ব্যবস্থা করবে। মধ্যরাতের পুলিশ ভয়াবহ জিনিস ।তবে একটা রিকোয়েস্ট —

জ্বি বলেন ।

টাকা না দিয়ে হোটেল মালিক কে ভয় দেখিয়ে ওনাকে খাওয়াবেন না দয়া করে , এতে পেটে তার খাবার তো ঢুকবে কিন্তু হজম হবে না।

বদরুল সাহেবের হতভম্ব ভাব কাটছে না। তার ক্ষুধা – তৃষ্ণা সম্ভবত মাথায় উঠে গেছে। পুলিশ দলের একজন আমার কাছে এগিয়ে এসে ফিস ফিস করে বলল , স্যার আপনার সঙ্গে একটু প্রাইভেট টক আছে।

আমি প্রাইভেট টক শোনার জন্য ফুটপাত ছেড়ে নিচে নেমে এলাম। সে কানের কাছে গুন গুন করে বলল, স্যার, বিরাট মিস্টেক হয়েছে। রাস্তায় কত লোক হাঁটে , কে সাধু , কে শয়তান বুজব কিভাবে!

আমিও তার মতই নিচু গলায় বললাম , না বোঝারই কথা।

ওস্তাদ একটা ভুল করেছে। চড় দিয়ে ফেলেছে। তারপর থেকে উনার হাত ফুলে প্রচণ্ড ব্যথা। ব্যথার চটে রাতে ঘুমাতে পারেন নি।

বেকায়দায় চড় দিয়েছে রগে টান পরেছে বোধ হয় কিংবা হাতেড় মাসেলে কিছু হয়েছে।

কি যে ব্যপার সেটা স্যার আমরা বুঝে গেছি । এখন স্যার আমাদের ক্ষমা দিতে হবে এটা স্যার আমাদের একটা আবদার।

আপনাদের ওস্তাদ আমাকে থাবড়া দিয়েছে বলেই যে তার হাত ব্যথা করছে বিষয়টা তা নয়। কিন্তু হ্যাঁ তিনি যে আমাকে বিনা অপরাধে থাবড়া দিয়েছেন এতে হাঁককুল ইবাদ অর্থাৎ বান্দার হোক নষ্ট হয়েছে। হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হোক যদি কেউ নষ্ট করে সেটা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন ।কিন্তু বান্দার হোক নষ্ট করলে তা আল্লাহ ক্ষমা করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না যেই বান্দার হক্ক নষ্ট করা হয়েছে সেই বান্দা নিজে যদি ক্ষমা না করেন। বুঝতে পারছেন।

জ্বি স্যার।

কতো বান্দার হক্ক যে আমি , আপনি আপনার ওস্তাদজি নষ্ট করছেন !! যান সেই অর্থে আমি আপনার ওস্তাদকে ক্ষমা দিলাম ।

ওস্তাদজি আজ ছুটি নিয়েছে । সারাদিন শুয়েছিল, রাতে বের হয়েছে শুধু আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে ।

ভালই হয়েছে দেখা হয়ে গেল।

আপনি স্যার আমাদের জন্যে একটু দোয়া রাখবেন।

শত শত মজলুমদের বদ দোয়ার বিপরীতে আমার দোয়ায় কি কাজ হবে।

লোকটার চোখ পিট পিট করছে, বিরক্ত বোধ করছে কিন্তু প্রকাশে ভয় পাচ্ছে, আমি বললাম।

আমি দোয়া রাখবো আপনাদের জন্য। অবশ্যই দোয়া রাখবো।

লোকটার মুখে হাসি ফুটলো

উনার খাবার ব্যপারে স্যার কোন চিন্তা করবেন না।

আমি বদরুল সাহেবকে বললামঃ আপনি এদের সঙ্গে যান খাওয়া দাওয়া করুন। তারপর মেসে চলে যাবেন। আমি ভোরবেলা ফিরবো ইন শা আল্লাহ।

তিনি পুরো পুরি হকচকিয়ে গেছেন। কিছুতেই যাবেন না। পুলিশরা বলতে গেলে তাকে গ্রেফতার করেই নিয়ে গেল। বেচারার হতাশ দৃষ্টি দেখে মায়া লাগছে। মায়া ভালো জিনিস না। ক্ষণস্থায়ী এই সংসারে মায়া বিসর্জন দেয়া শিখতে হয়। আমি শেখার চেষ্টা করছি । ঈশ! বদরুল সাহেবকে স্রষ্টার সামনে দাঁড়ান , তার সাথে বাত চিতের বিষয়টা আর বুঝিয়ে বলা হল না। আমার মনে হয় তিনি জানেন। তিনিও গভীর রাতে তার স্রষ্ঠার সামনে দাঁড়ান , দুই হাত তুলে চোখের পানি ফেলে বাতচিত করেন। একাকী।

(চলবে ইন শা আল্লাহ … )

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
slot gacor skybet88 slot online skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot shopeepay slot gacor skybet88 demo slot skybet88 skybet88 skybet88 skybet88