রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কী?

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম

অন্ধ লোকের হাতি দেখার গল্পটা প্রায় সবারই জানা। একেকজন অন্ধ লোক হাতির একেকটা অঙ্গ ধরেছিলো। তাই হাতির আকৃতির ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্তগুলো ছিল খণ্ডিত পর্যবেক্ষণের ফল। ইসলামও একটা বিশাল সিস্টেম যার অনেকগুলো অঙ্গ আছে। ইসলামকে অসার প্রমাণ করার একটা চৌকস উপায় হলো একদিক ঢেকে রেখে আরেকদিক দেখানো।

বহুল প্রচলিত একটা উদাহরণ হচ্ছে পর্দানশিন নারীদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়া। যদিও এমন ঘটনা খুবই দুর্লভ, তবে এমনটা যে ঘটে না তা না। ইসলামবিরোধীরা এগুলোই তুলে ধরে। এর জবাবে মুসলিমদের একটা বিরক্তিকর অ্যাপ্রোচ হলো মেয়েটার পর্দা ঠিক ছিল কিনা তার চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করা। অথচ সহজ জবাব হলো ইসলামে পুরুষদেরও পর্দার বিধান আছে। সপর্দা-বেপর্দা কোনো নারীকেই উত্যক্ত না করাটা ওই পুরুষটার পর্দার অংশ। যৌন হয়রানিকারী অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া, সঠিক সময়ে সবাইকে বিয়ে দেওয়া- এগুলো ইসলামী রাষ্ট্রের শাসকের দায়িত্ব। এই সবকিছু মিলে হলো ইসলামের পর্দার বিধান।

পৃথিবীর কোনো এক কোনায় (রূপক অর্থে। পৃথিবী যে গোল, সেটা আমি জানি) কেউ একজন ক্ষুধার তাড়নায় চুরি করলো। অথবা একজন নারীর স্বামী কাজ করে না বিধায় সেই নারী ইট ভাঙার কাজ করে। ইসলামবিদ্বেষীরা বলবে “সেই চোরের হাত কাটতে হবে কোন যুক্তিতে?” কিংবা “সেই নারী পর্দা করলে বাঁচবে কী করে?” অথচ এসব পরিস্থিতি তাদেরই প্রবর্তিত জুলুমবাজ অর্থনীতির ফল। ইসলামের নিজস্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আছে। নিজস্ব বিচারনীতি ও সমাজনীতি প্রয়োগের আগে ইসলাম অবশ্যই দেখবে নিজস্ব অর্থনীতি কার্যকর আছে কি না।

অনেক বছর আগের একটা সিনেমা, নামটা সম্ভবত ‘এয়ারপোর্ট’ (বা বিমান সম্পর্কিত কিছু একটা)। কাহিনী যতটুকু শুনলাম সেখানে এক ছেলে তার মা-বোনের উপার্জনের উপর নির্ভরশীল। তারা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে সংসার চালায়। একদিন ‘জঙ্গি’রা সেই ছেলেকে মগজধোলাই দিয়ে বলে যে সুদ হারাম। তখন সেই ছেলে এসে মা বোনকে তিরস্কার করতে থাকে। পরিচালকের বক্তব্য ছিলো “আগে তো বাঁচতে হবে, পরেয় না ধর্ম।” অথচ তারা যে না খেয়ে মরছিলো, তারপর স্বেচ্ছায় ঋণের জালে মরছিলো, এই সব তো ধর্মের দেওয়া অর্থব্যবস্থা না মানার ফল।

একইভাবে নিতান্ত ব্যক্তিগত ‘ইবাদাতগুলোর কথাই ধরেন। অফিসাররা সালাত পড়লে হাজার হাজার কর্মঘন্টা ‘নষ্ট’ হয়। ক্রিকেটাররা সওম পালন করলে তো বাংলাদেশ এ বছরের বিশ্বকাপটা জিততেই পারতো না! তাহলে অফিসটাইম এমন সময়ে দেন যাতে সালাত ঠিক রাখা যায়। ফিক্শচার এমনভাবে তৈরি করেন যাতে রমাদ্বানে খেলা না থাকে। তা তো কখনোই করবেন না।

উপরের সব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ইসলাম যদি কর্তৃপক্ষের আসনে না থাকে, তাহলে তার আসল কল্যাণটা পাওয়া যায় না। ধর্ম যে কর্তৃপক্ষের আসনে থাকতে পারে, এই ধারণাটাকেই আজকে একটা রাক্ষুসে রূপ দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রভাষার প্রয়োজনীয়তা বুঝলেও তাই কেউ আর রাষ্ট্রধর্মের প্রয়োজনীয়তা বোঝে না।

এই রাক্ষুসে রূপ দেওয়ার জন্য শুরুতে সেসব উদাহরণ দেয়া হয় যেখানে ধর্মের কারণে অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিলো। উদাহরণগুলো মূলত মধ্যযুগের ইউরোপের খ্রিষ্টীয় রাষ্টগুলোর। এটা দিয়েই সবকিছুকে বিচার করা হয়। Eurocentric মানসিকতার এ এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ইউরোসেন্ট্রিজমের মূল কথা হলো সাদা চামড়া বা ইউরোপীয়দের জন্য যা আদর্শ, অন্য সব জাতির জন্যও সেটাই আদর্শ। সাদাদের বিশ্বাস, সংস্কৃতি ইত্যাদির সাথে অন্য কোনো জাতির বিশ্বাস, সংস্কৃতির যত মিল থাকবে, তারা তত সভ্য।

এছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যে একেবারে বেহেশত, তা কিন্তু না। সেগুলোতেও প্রচুর অনাচার হয়। তখন কিন্তু কেউ গণতন্ত্র বাদ দেওয়ার কথা বলে না। ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ নামক কোনো একটা অলীক সমাধান হাতড়ে বেড়ায়। বাংলাদেশে যত খুন-ধর্ষণ হয়, তার দায়ভার কি ইসলামী শরিয়তের নাকি বাঙালি সংস্কৃতির নাকি ৭২ এর সংবিধানের?

ইসলামী হুকুমত থাকলে অন্য ধর্মের লোকেরা তা মানবে কেন? সমান অধিকার কায়েম করতে হবে না? ৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের সময় কিন্তু রাজাকারদের মতামত নেওয়া হয় নি। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার সময় জিজ্ঞাসা করা হয় নি কোনো কথিত আদিবাসীকেও। এছাড়া মুসলিমরা যেখানেই যায় সেখানেই দেখবেন একটা নামাজের জায়গার জন্য তোড়জোড় করে। কারণ অন্য কোনো ধর্ম এমন নেই যা তার প্রতিটা অনুসারীর উপর প্রতিদিন পাঁচবার অবশ্য পালনীয় কোনো বিধান আরোপ করেছে। তাই “মাসজিদ বানালে তো মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাও বানাতে হবে” এই যুক্তি নিতান্ত অসার। বৃহত্তর পরিসরে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও বিষয়টা এমনই।

ইসলামের এই অনস্বীকার্য বৈশিষ্ট্যটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর সেক্যুলাররা একটু নরম হয়। তখন তারা যা বলে, তা হলো মিঠা মিঠা কথা। অধর্ম এসে ধর্মকে বলে, “হে ধর্ম! তুমি এত পূত, এত পবিত্র, এত উঁচু, এত সুইটি, এত কিউটি, যে ক্ষমতার লোভ করা তোমাকে একদম মানায় না।” খেয়াল করবেন “ক্ষমতা” কিন্তু কখনো খালি থাকবে না। ধর্ম সেখানে না বসলে কেউ না কেউ ঠিকই বসবে। ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে শাসিতকে তার সম্মতি নিয়ে শাসন করার এই পদ্ধতিকে বলে hegemony.

অন্যান্য শাসনব্যবস্থার উপর ইসলামকে বড় করে দেখানোটা এই লেখার উদ্দেশ্য না। বরং এটাই দেখানো হলো যে অন্যান্য অনেক সিস্টেমের মাঝে ইসলামও একটি বাস্তবতা। এর নাম শুনলে বিস্ময়ে চোখ উল্টে ফেলার মতো কিছু নেই। একে নিয়ে যত অভিযোগ করা যায়, তা অন্য যে কোনো সিস্টেমকে নিয়েই করা যায়। সত্য স্পষ্ট এবং মিথ্যাও স্পষ্ট। যার ইচ্ছা মানবে, যার ইচ্ছা নেই মানবে না।

Source: MuslimMedia

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88