জাতীয়তাবাদ ও দেশাত্মবাদ

‘জাতীয়তা’ চিন্তামূলক একটি মতবাদ, যার বিশ্বাস একতা ও ভ্রাতৃত্ব হবে স্বজাতিচেতনা অথবা স্বদেশপ্রীতির উপর।

জাতীয়তার ইতিহাস ও উৎপত্তি:

বংশ ও ঐতিহ্য নিয়ে অহংকার করা একাল ও সেকালের জাহিলি যুগের স্বভাব। ইসলাম যেসব জাহিলি রীতি, প্রথা, প্রতীক ও নিদর্শনসমূহ বাতিল করেছে তন্মধ্যে জালিয়াত অন্যতম, তবে অগ্নিপূজক কতক হিংসুক আব্বাসি যুগে আরব জাতীয়তাবাদ হেয় প্রতিপন্ন করে এবং পারস্য জাতীয়তাবাদের ব্যাপারে খুব বাড়াবাড়ি করে। তারা এ আন্দোলনকে ‘শু‘উবিয়্যাহ’ বা জাতীয়তাবাদ নাম দেয়।

বস্তবতা হচ্ছে, এ আন্দোলনের তখন স্বতন্ত্র চিন্তামূলক দর্শন ছিল না, বরং এটা ছিল ইসলামের উপর হিংসাত্মক ষড়যন্ত্র।

জাতীয়তার নতুন অর্থের জন্ম হয় ইউরোপে গত শতাব্দীতে, যখন খৃস্টানদের ধর্মীয় বন্ধন দুর্বল ও বৃহৎ ইউরোপ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়, যা অনেক জাতি ও দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছিল। এ ছাড়া আরো কতক কারণে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার উল্লেখ সামনে আসছে:

জাতীয়তা চিন্তাধারা সৃষ্টির কারণ:

১. ফ্রান্স বিপ্লব, আধুনিক ইতিহাসে তাতে সর্বপ্রথম ধর্মহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব ত্যাগ করে শুধু আঞ্চলিকতার উপর বন্ধুত্ব কায়েম করার নীতি অস্তিত্বে আসে। এর মাধ্যমেই ধর্মীয় ভিত্তি বাদ দিয়ে শুধু জন্মভূমি বা নিজ দেশের প্রতি আনুগত্যের নীতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

২. পুরনো সংস্কৃতির উত্থান, বিলুপ্ত ইতিহাস চর্চা করা ও তার নিদর্শনসমূহ জিন্দা করা, ইত্যাদি কারণে প্রত্যেক জাতি অথবা দেশ তার অতীত নিয়ে অহংকার করতে থাকে ও তার গৌরবগাথা নির্মাণ করে।

৩. ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো তার মহাদেশের ভেতর সংগ্রামে লিপ্ত হয় ও অন্যান্য উপমহাদেশ দখলে মরিয়া হয়ে উঠে।

এ তিনটি কারণ জাতীয়তাবাদ মতবাদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। দ্বিতীয়ত দু’টি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদী মতবাদ তার শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছে, তখন জাতীয়তাবাদী আদর্শের ধারক অনেক বড় ব্যক্তিদের আবির্ভাব ঘটে, যেমন ইউরোপে হিটলার ও মুসোলিনি এবং প্রাচ্যে গান্ধি ও কামাল আতাতুর্ক।

কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে জাতীয়তাবাদ চিন্তাধারা নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে, তখন ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো দেখল বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর বন্ধন ও ঐক্য খুব জরুরি। তার ভিত্তিতে তারা সামরিক জোট ও অর্থনৈতিক সংস্থা গড়ে তুলে, যেমন ইউরোপ ইউনিয়নের ন্যাটো গ্রুপ ও সম্মিলিত ইউরোপীয় অর্থনৈতিক বাজার। তবে আরব রাষ্ট্রসমূহে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির ইতিহাস ভিন্ন:

ইসলামি বিশ্বে জাতীয়তাবাদ ও দেশাত্মবাদ:

দেশাত্মবাদ: দেশাত্মবাদ তার বর্তমান সংজ্ঞাসহ সর্বপ্রথম মিসরে প্রকাশ পায় ফ্রান্সের আক্রমণ পরবর্তী সময়ে। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মিসরকে ইসলামি বিশ্ব ও উসমানী খিলাফত থেকে বিচ্ছিন্ন করা, কারণ ইসলামি বিশ্বের ইলম, ঐতিহ্য ও মর্যাদার ধারক ছিল মিসর।

প্রাচ্যবিদ ও তাদের ন্যায় অন্যান্যরা ইসলামি ঐতিহ্য নিশ্চিহ্ন ও ফিরআউনি স্বভাব জাগ্রত করে মিসরে ফিরআউনি চরিত্র পুনরায় জীবিত করার লক্ষ্যে অনেক শ্রম ব্যয় করে। এরূপ ষড়যন্ত্র তারা ইসলামি সকল দেশের ক্ষেত্রে করে।

মিসরে দেশাত্মবাদ স্পষ্টভাবে সফলতা অর্জন করে, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তার উপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে, যেমন সা‘দ জগলুল, তার শ্লোগান ছিল, (দীন আল্লাহর জন্য কিন্তু দেশ সবার জন্য), এবং মুস্তফা কামিল, তার শ্লোগান ছিল, (যদি আমি মিসরি না হতাম, মিসরি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করতাম)।

চিন্তাবিদ, সাংবাদিক ও কবিদের মাঝে এ মতবাদ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে, এমন কি আহমদ শাওকি, যিনি ইসলামি খিলাফত ও ইসলামি বন্ধনের পক্ষাবলম্বন করতেন, তিনিও দেশাত্মবাদী ছিলেন, তার একটি কবিতা:

أنا مصر بناني من بنى    هرم الدهر الذي أعيا الفنا

আমি মিসরি, আমার আঙ্গুলগুলো বানিয়েছে সেই পিরামিডগুলো , যা ধ্বংসকে পরাজিত করেছে।

এ মতবাদের পশ্চাতে লোকানো ষড়যন্ত্র তখন উন্মোচিত হয়, যখন তার ধারক যেমন ত্বাহা হুসাইনরা ঘোষণা করে, (মিসর পাশ্চাত্যের একটি অংশ, প্রাচ্যের সাথে তার নিকটবর্তী ও দূরবর্তী কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলামের মিসর জয় করার অর্থ একটি আরবি সামরিক যুদ্ধ।

তাদের কেউ আরবি হরফ ত্যাগ করে ল্যাটিন ভাষা প্রতিস্থাপন ও বিশুদ্ধ ভাষার পরিবর্তে মিসরি আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগের দাবি করল। তবে মিসরি দেশাত্মবাদ কয়েকটি কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে, তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে: সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিসর আরবি জাতীয়তাবাদের রূপ নেয়—যা দেশাত্মবাদ থেকে ব্যাপক— ও বিশ্ব সমাজতন্ত্রের দাবি উঠে, যা স্বভাবতই দেশাত্মবাদের সাথে সাংঘর্ষিক।

কিন্তু ইসলামি বিশ্বে ভূ-খণ্ডীয় দেশাত্মবাদ ধীরে ধীরে প্রাণ পেতে থাকে, যা উম্মতে মুসলিমার ঐক্যের পথে এক বড় বাধা।

জাতীয়তাবাদ: বিশ্ব ক্রুসেড ও খ্রীস্ট সম্রাজ্য মিলে ইসলামি বিশ্বে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করে কয়েকটি উদ্দেশ্যে, আর তা হচ্ছে আরব রাজ্যে ইয়াহূদী রাষ্ট্র ও খৃস্টান শাসন কায়েম করা অথবা আরবে পশ্চিমাদের তাবেদার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভূমিকা স্বরূপ উসমানী খিলাফত ধ্বংস ও ঈমানি বন্ধন ছিন্ন করা।

ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, সর্বপ্রথম জাতীয়তাবাদের আহ্বান করে ইয়াহূদীরা তুরস্কে ও খৃস্টানরা আরব বিশ্বে, অতঃপর তাদের সাথে হাত মিলায় বিদ্বেষপোষণকারী স্বভাষী ও স্বজাতি কতক শ্রেণি, যেমন নুসাইরিয়া, অর্থোডক্স, শিয়া-রাফেদি ও কতক নব্য ফ্রান্সিস, অথবা তাদের দ্বারা প্রতারিত কতক আহলে সুন্নাহ।

কতক গোপন সংগঠন দ্বারা জাতীয়তাবাদ প্রচার করা হয়, প্রকৃতপক্ষে যা ছিল ইয়াহূদীদের গুপ্ত সংঘ ‘মাসুনিয়াহ’ বা ফ্রিম্যাসনের শাখা। একই সময় এসব সংগঠন তুরস্কে তুরকি জাতীয়তাবাদ ও আরব রাষ্ট্রসমূহে আরবি জাতীয়তাবাদের আহ্বান করে, অথচ তাদের অনেকে তুরকি বা আরবি ছিল না।

তুরকি জাতীয়তাবাদীরা অ-তুর্কি কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে উসমানিয়া খিলাফত বিলুপ্ত করে, শরীয়তের বিধান বাতিল করে। আরো বিলুপ্ত করে আরবি হরফ, আযান পর্যন্ত তারা বাতিল করে তুরকি ভাষায় তার প্রচলন করে। তারা ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পরিবর্তে মূর্তিপূজক নেতাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে, যেমন চেঙ্গিস খান ও তার নাতি হালাকু, যে বাগদাদ ধ্বংস করেছিল।

অধিকন্তু আরবি জাতীয়তাবাদ প্রচারকারীরা সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদের গণজাগরণ সৃষ্টি করে। প্রকাশিত ঐতিহাসিক সনদ প্রমাণ করে যে, জাতীয়তাবাদের সাথে সম্পৃক্ত প্রত্যেক নেতা ও চিন্তাবিদ উপনিবেশ রাষ্ট্রসমূহের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের সাথে। এ ইংল্যান্ডই আরব লীগ, (তথা আরব রাষ্ট্রসমূহের সংস্থা) গঠনের রূপ রেখা তৈরি করে।

তখন জাতীয়তাবাদের কোনো আকিদা কিংবা নির্ধারিত চিন্তা না থাকার ফলে তারা সমাজতন্ত্র বিপ্লবের সাথে যোগ দেয়, যারা ফিলিস্তিনে ইয়াহূদী রাষ্ট্র কায়েমের পর থেকে সামরিক বিপ্লব ও বামপন্থী দলগুলোর সহায়তায় মুসলিমদের উপর নির্যাতন পরিচালনা করে আসছিল।

আরব বিশ্বে সবচেয়ে বড় জাতীয়তাবাদী দল হচ্ছে ‘বিপ্লবী আরব সমাজতান্ত্রিক’ দল, যার প্রতিষ্ঠাতা খৃস্টান মিশাল আফলাক।

১৩৮৭হি. সফর মোতাবেক জুন ১৯৬৭ই. পরাজয়ের মাধ্যমে আরব জাতীয়তাবাদের মিথ্যাচার স্পষ্ট ও পতন্মোখ হয়, বলা যায় এখন তা মৃত্যুমুখে পতিত।

আরব জাতীয়তাবাদের নেতৃত্ব দিয়ে মিসর এখন তার চিন্তা থেকে দেশাত্মবাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছে। অনুরূপ ব্যর্থ হয় ঐক্যের পরিকল্পনা যা কতক আরব দেশের মাঝে সম্পাদিত হয়েছিল, আরব লীগের কার্যক্রম দুর্বল হয়ে এখন প্রায় নিঃশেষের মত। বর্তমান আরব দেশগুলো একতা ও অঙ্গীভূত হওয়ার চিন্তা থেকে সরে পারস্পরিক সহায়তা অথবা আঞ্চলিক পূর্ণতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

ইসলামের উপর আরব জাতীয়তাবাদের ক্ষতিকর প্রভাব:

শায়খ আব্দুল আযিয বিন বায রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “জেনে রেখো এ দাওয়াত—অর্থাৎ আরব জাতীয়তাবাদের দাওয়াত—পাশ্চ্যতের খৃস্টানরা সৃষ্টি করেছে চটুল কথা, নানা স্বপ্ন ও প্রতারণামূলক বিভিন্ন পদ্ধতিতে ইসলামের ঘরে তার বিরুদ্ধাচারণ ও তাকে নিঃশেষ করার উদ্দেশ্যে, ফলে ইসলামের শত্রু কতিপয় আরব তা সাদরে গ্রহণ করে। অনেক তথাকথিত উদারপন্থী ও তাদের অনুসারী মূর্খরা ধোঁকায় পতিত হয়। নাস্তিক ও ইসলামের দুশমনরা এটা দেখে বিভিন্ন জায়গায় আনন্দ প্রকাশ করে।

ইসলামে অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, আরব জাতীয়তাবাদ অথবা অপর কোনো জাতীয়তাবাদের দিকে আহ্বান করা ভ্রান্ত ও বাতুলতা, মহা অপরাধ, ঘৃণার বস্তু, নিন্দিত জাহেলিয়াত। অধিকন্তু জাতীয়তাবাদ ইসলাম ও তার অনুসারীদের বিপক্ষে প্রকাশ্য ষড়যন্ত্র, কায়েকটি কারণে:

প্রথম কারণ: আরব জাতীয়তাবাদ অনারব মুসলিম ও আরব ভাইয়ের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি ও দূরত্ব তৈরি করে, বরং আরবদেরও বিচ্ছিন্ন করে, কারণ সব আরব তা পছন্দ করে না।

দ্বিতীয় কারণ: ইসলাম জাহিলি দাওয়াত ও তার থেকে সতর্ক করেছে। কোনো অস্পষ্টতা রাখেনি, বিভিন্ন জায়গায় বারবার বলেছে, বরং কতক দলিল জাহিলি সকল আচরণ ও আমল থেকে নিষেধ করেছে, ইসলামে স্বীকৃত কতক ভালো আচরণ ব্যতীত। এতে সন্দেহ নেই যে, আরব জাতীয়তাবাদের দাওয়াত জাহিলি দাওয়াত, কারণ এটা অনৈসলাম ও অসত্যের আহ্বান।

তৃতীয় কারণ: আরব জাতীয়বাদ প্রচার করার অর্থ আরব কাফের ও আরব অমুসলিম নাস্তিকদের সাথে বন্ধু ও অন্তরঙ্গ করার প্রথম সিঁড়ি। মুসলিম ও অমুসলিম যারা জাতীয়তাবাদ সমর্থন করে না তাদের মোকাবিলায় কাফেরদের সাহায্য গ্রহণ করা। এতে যে ফাসাদ ও কুরআন-সুন্নার স্পষ্ট বিরোধিতা রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না, কারণ কুরআন ও সুন্নাহর দাবি আরব-অনারব সকল কাফিরকে অপছন্দ কর, তাদের সাথে শত্রুতা কর এবং তাদেরকে বন্ধু ও অন্তরঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করো না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَتَّخِذُواْ ٱلۡيَهُودَ وَٱلنَّصَٰرَىٰٓ أَوۡلِيَآءَۘ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمۡ فَإِنَّهُۥ مِنۡهُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٥١ فَتَرَى ٱلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ يُسَٰرِعُونَ فِيهِمۡ يَقُولُونَ نَخۡشَىٰٓ أَن تُصِيبَنَا دَآئِرَةٞۚ فَعَسَى ٱللَّهُ أَن يَأۡتِيَ بِٱلۡفَتۡحِ أَوۡ أَمۡرٖ مِّنۡ عِندِهِۦ فَيُصۡبِحُواْ عَلَىٰ مَآ أَسَرُّواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ نَٰدِمِينَ ٥٢ ﴾ [المائ‍دة: ٥١، ٥٢]

“হে মুমিনগণ, ইয়াহূদী ও নাসারাদেরকে তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়েত দেন না। সুতরাং তুমি দেখতে পাবে, যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, তারা কাফিরদের মধ্যে (বন্ধুত্বের জন্য) ছুটছে। তারা বলে, ‘আমরা আশঙ্কা করছি যে, কোন বিপদ আমাদেরকে আক্রান্ত করবে’। অতঃপর হতে পারে আল্লাহ দান করবেন বিজয় কিংবা তার পক্ষ থেকে এমন কি‍ছু, যার ফলে তারা তাদের অন্তরে যা লুকিয়ে রেখেছে, তাতে লজ্জিত হবে”।[1]

সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর বাণী কী সত্য, কী স্পষ্ট! জাতীয়তাবাদীরা আরব জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জোট গঠন ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দাওয়াত দেয়, মুসলিম ও কাফির কোনো পার্থক্য করে না,

﴿ يَقُولُونَ نَخۡشَىٰٓ أَن تُصِيبَنَا دَآئِرَةٞۚ ٥٢ ﴾ [المائ‍دة: ٥١، ٥٢]

“তারা বলে, আমরা আশঙ্কা করছি আমাদের উপর বিপদ ফিরে আসার” [সূরা আল-মায়েদাহ: ৫২] আমরা আশঙ্কা করছি ঔপনিবেশিক আমাদের দেশে পুনরায় ফিরে আসবে, আমরা আশঙ্কা করছি আমাদের শত্রুদের হাতে আমাদের সম্পদ লুণ্ঠিত হবে। আমাদের দেশে ফিরে আসা ও আমাদের সম্পদ লুণ্ঠন করার উদ্দেশ্যে তারা আরব জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করে এবং বলে: জাতীয়তাবাদ নীতি আরব আরবের মাঝে পার্থক্য করে না, যদিও তাদের দীন ভিন্ন। এটা আল্লাহর কিতাবের বিরোধিতা ব্যতীত আর কী হতে পারে? আল্লাহর শরীয়তের বিরোধিতা ব্যতীত আর কি? আল্লাহর সীমালঙ্ঘন ব্যতীত আর কি? এবং আল্লাহর দীন ত্যাগ করে বন্ধুত্ব, শত্রুতা, মহব্বত ও বিদ্বেষ পোষণ ব্যতীত আর কি?

চতুর্থ কারণ: জাতীয়তাবাদের দাওয়াত ও তাকে ঘিরে জোট গঠন করা সমাজকে অবশ্যম্ভাবী করে আল্লাহর বিধান ত্যাগ করতে, কারণ অমুসলিম জাতীয়তাবাদীরা কুরআনকে ফয়সালাকারী মানবে না, তখন এটা জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দকে সুযোগ করে দিবে মানব রচিত কানুন গ্রহণ করতে, যেন তার দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদী সমাজ বরাবর হয়, এটা কুরআনুল কারিমের বিধানের বিপরীত। এ কথা তারা অনেকে স্পষ্ট বলেছে। এখানে বড় ফাসাদ ও স্পষ্ট কুফর এবং প্রকাশ্যভাবে দীন ত্যাগ ও বদ্বীনি গ্রহণ করা, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥ ﴾ [النساء : ٦٥]

“অতএব তোমার রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোন দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়”।[2] অন্যত্র তিনি বলেন:

﴿ أَفَحُكۡمَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ يَبۡغُونَۚ وَمَنۡ أَحۡسَنُ مِنَ ٱللَّهِ حُكۡمٗا لِّقَوۡمٖ يُوقِنُونَ ٥٠ ﴾ [المائ‍دة: ٥٠]

“তারা কি তবে জাহিয়্যাতের বিধান চায়? আর নিশ্চিত বিশ্বাসী কওমের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক উত্তম”?[3] অন্যত্র তিনি বলেন:

﴿ وَمَن لَّمۡ يَحۡكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡكَٰفِرُونَ ٤٤ ﴾ [المائ‍دة: ٤٤]

“আর যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার মাধ্যমে ফয়সালা করে না, তারাই কাফির”।[4] অন্যত্র তিনি বলেন:

﴿وَمَن لَّمۡ يَحۡكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ٤٥ ﴾ [المائ‍دة: ٤٥]

“আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার মাধ্যমে যারা ফয়সালা করবে না, তারাই যালিম”।[5] অন্যত্র তিনি বলেন:

﴿ وَمَن لَّمۡ يَحۡكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ ٤٧ ﴾ [المائ‍دة: ٤٧]

“আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার মাধ্যমে যারা ফয়সালা করে না, তারাই ফাসিক”।[6]

অতএব যেসব রাষ্ট্র আল্লাহর শরীয়ত মোতাবেক ফয়সালা করে না, তার বিধানের নিকট অনুগত নয়, সেটা জাহিলি, কাফের, জালিম ও ফাসেক রাষ্ট্র কুরআনুল কারিমের স্পষ্ট দলিলের ভিত্তিতে। আহলে-ইসলাম ও মুসলিমদের দায়িত্ব এসব শাসকদের সাথে আল্লাহর জন্য বিদ্বেষ পোষণ ও শত্রুতা করা, যতক্ষণ না এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং তার শরীয়ত মোতাবেক ফয়সালা করে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ قَدۡ كَانَتۡ لَكُمۡ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ فِيٓ إِبۡرَٰهِيمَ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ إِذۡ قَالُواْ لِقَوۡمِهِمۡ إِنَّا بُرَءَٰٓؤُاْ مِنكُمۡ وَمِمَّا تَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ كَفَرۡنَا بِكُمۡ وَبَدَا بَيۡنَنَا وَبَيۡنَكُمُ ٱلۡعَدَٰوَةُ وَٱلۡبَغۡضَآءُ أَبَدًا حَتَّىٰ تُؤۡمِنُواْ بِٱللَّهِ وَحۡدَهُۥٓ ٤ ﴾ [الممتحنة : ٤]

“ইবরাহীম ও তার সাথে যারা ছিল তাদের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। তারা যখন স্বীয় সম্প্রদায়কে বলছিল, ‘তোমাদের সাথে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যা কিছুর উপাসনা কর তা হতে আমরা সম্পর্কমুক্ত। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি, এবং উদ্রেক হল আমাদের ও তোমাদের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য, যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আন”[7][8]

অধ্যয়নের জন্য মূল পাঠ

আরব জাতীয়তাবাদ শুরুর ইতিহাস:

লেবাননে ছোট্ট এক সংস্থা ছিল যুবকদের, ‘সুশীল সমাজ’ নামে—তাদের অধিকাংশ ছিল খৃস্টান, যারা সিরিয়ার ইংরেজি কলেজে পড়ুয়া—প্রথম তারা লেবাননকে তুরস্ক থেকে স্বাধীন করার দাবি জানায়।

খ্রিস্টানরা তাদের জন্য আনুমানিক (১৮৭৬ই.) সালে “বিপ্লবী গোপন সংঘ” নামে একটি সংগঠন তৈরি করে। তারা বৈরুতের সীমান্তে অবস্থিত পাথুরে সমুদ্র তীর ‘রাওশাহ’ নামক স্থানে সন্ধ্যায় জড়ো হত, তাদের উদ্দেশ্য হাসিলে সর্বোত্তম করণীয় সম্পর্কে আলোচনা ও পরামর্শের জন্যে। যুবকরা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিল তুর্কিদের তাদেরকে হেয় ও নিন্মস্তরের জ্ঞান করার বিষয় নিয়ে, এটাকে তারা অপমান বোধ করত, তবে আরব মুসলিমরা যখন উসমানী খিলাফতের সমালোচনা করত, তখন তারা বলার সাহস করত: (এটা তুর্কি শাসন), কারণ সেটা ছিল ইসলামি খিলাফত, যা তাদের গা জ্বালার বিষয় হয়।

তুর্কি শাসনের কারণে মুসলিমরা কখনো নিজেদের বিদেশী ভাবত না, আর না ভাবত নিজেদের অসহায় কিংবা পরদেশী। কিন্তু খৃস্টানরা সর্বদা চিন্তা করত সে তুর্কি সুলতানের একজন প্রজা, তুর্কি শাসন কখনো তার শাসন হতে পারে না।

বেশি সময় পার হয় নি, অতিশীঘ্র তারা বুঝতে সক্ষম হয় যে, যদি তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে চায়, অবশ্যই তাদেরকে মুসলিমদের সাথে একযোগে কাজ করতে হবে, যেন মুসলিমরা তাদের স্বীকৃতি ও সনদস্বরূপ হয়।

তাদের জন্য জরুরি ছিল তুর্কিদের মোকাবিলায় মুসলিম-খ্রীস্টান এক প্লাটফর্মে দাঁড়ানো, কিন্তু তখন আরব মুসলিম ও আরব খৃস্টানদের মাঝে আরব জাতীয়তাবাদ ব্যতীত কোনো বন্ধন ছিল না। আরবদের মাঝে আরব জাতীয়তাকে ব্যবহার করা ব্যতীত তুর্কিদের বিপক্ষে বিদ্রোহের বীজ বপন করা সম্ভব নয়। অনুরূপ আরব মুসলিম ও তুর্কিদের থেকে প্রতিশোধ স্পৃহা লালনকারী আরব খৃস্টানদের সাথে তাদের এক হওয়াও সম্ভব নয় জাতীয়তাবাদ ব্যতীত।

এ নীতিতে “বিপ্লবী গোপন সংঘে”র সদস্যবৃন্দ আশ্বস্ত হয় যে, তুর্কিদের থেকে মুক্তি এবং তাদের মাঝে ও মুসলিমদের মাঝে সমতার একমাত্র পথ জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তার ভিত্তিতে আরব সমাজকে গড়ে তোলা, যা ভবিষ্যতে তুর্কিদের মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।

খ্রীস্টান নেতৃবৃন্দ আরেকটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে, আর তা হচ্ছে বৈরুতে ফ্রিম্যাসন সমাবেশে মুসলিম নেতৃবৃন্দের অন্তর্ভুক্ত করা। তাদের সাথে অংশগ্রহণ করে বিপ্লবী গোপন সংঘের সদস্যরাও[9]

লেখক: ড. সফর ইবনে আব্দুর রহমান আল-হাওয়ালি
অনুবাদ : সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া


[1] সূরা মায়েদাহ: (৫১-৫২)

[2] সূরা নিসা: (৬৫)

[3] সূরা মায়েদা: (৫০)

[4] সূরা মায়েদাহ: (৪৪)

[5] সূরা মায়েদাহ: (৪৫)

[6] সূরা মায়েদাহ: (৪৭)

[7] সূরা মুমতাহিনা: (৪)

[8] ইসলাম ও বাস্তবতার নিরিখে আরব জাতীয়তাবাদের সমালোচনা, শায়খ ইবনে বায রহ. রচিত।

[9] যায়ন নুরুদ্দিন যায়ন রচিত “আরব জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি” কিতাব থেকে সংগৃহীত, (পৃ.৬০-৬১), খৃস্টান ফারিস নামর থেকে উদ্ধৃত, যে গোপন জাতীয়তাবাদ সমিতির একজন প্রতিষ্ঠাতা।

সৌজন্যেঃ i-onlimemedia.net

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button