সুন্নাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের অকাট্য দলীল কুরআন ও হাদিসের আলোকে
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান, আর এ ইসলামের বিধানগুলি যেমনি ভাবে আল কুরআনের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয় তেমনি নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহর মাধ্যমেও সাব্যস্ত হয়, সুতরাং সুন্নাহ্ ইসলামের অকাট্য দলীল, বিষয়টি কুরআন, হাদিস ও মুসলিম উম্মার ইজমার আলোকে নিম্নে আলোকপাত করা হল।
আল কুরআনের আলোকে: মহান আল্লাহ তা’আলার বাণী ইসলামের প্রথম মূলনীতি আল কুরআনের অসংখ্য আয়াত প্রমাণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একনিষ্ঠ আনুগত্য ছাড়া ঈমান ও ইসলাম মানা সম্ভব নয়, এ প্রসঙ্গে নিম্নে কয়েকটি দিক তুলে ধরা হল:
[ক] সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য ছাড়া ঈমানদার হওয়া সম্ভব নয়:
আল্লাহ তা’আলা বলেন, ﴿وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ١ ﴾ [الانفال: ١] “তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাক তাহলে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর”।[1]
এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের আনুগত্য করার কথাই বলা হয়েছে। সুতরাং, কোন ঈমানদারের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতকে এড়িয়ে চলার কোন সুযোগ নেই।
[খ] সুন্নাতে রাসূল বর্জন করা কুফরী কাজ:
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
﴿قُلۡ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَۖ فَإِن تَوَلَّوۡاْ فَإِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٣٢﴾ [ال عمران: ٣٢]
“বলুন আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর, আর যদি তারা পলায়ন করে, তাহলে আল্লাহ কাফিরদেরকে ভালবাসেন না”।[2]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য হতে পলায়ন করা অর্থাৎ তাঁর সুন্নাতের অনুসরণ বর্জন করা, ইহা প্রকাশ্য কুফরী।
[গ] করণীয় ও বর্জনীয় ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই একমাত্র মাপকাঠি:
আল্লাহ তা’আলা বলেন, ﴿ وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ٧ ﴾ [الحشر: ٧] “রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক, আর আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তি দাতা”।[3]
এ আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেয়া অর্থ হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের যে সব বিধি-বিধান দিয়েছেন, অর্থাৎ কুরআন এবং হাদিস, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, إنِّىْ أُوْتِيْتُ الكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَه” “আমাকে কিতাব [কুরআন] এবং উহার অনুরূপ [সুন্নাহ্] দেয়া হয়েছে।” আর এটাই তিনি তাঁর উম্মতকে দিয়েছেন।[4]
[ঘ] কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমেই কেবল মাত্র দ্বন্দ্বের সমাধান হতে হবে:
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
﴿ فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ ذَٰلِكَ خَيۡرٞ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلًا ٥٩ ﴾ [النساء : ٥٩]
“যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর যদি তোমরা আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণ কর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম”।[5]
ইমাম তাবারী [রাহিমাহুল্লাহ] বলেন: আয়াতের অর্থ হল যখন তোমাদের মাঝে কোন ধর্মীয় বিষয়ে বিবাদ পরিলক্ষিত হবে, তখন তার সমাধান ও ফয়সালা হল একমাত্র আল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব কুরআন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থাৎ তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর আদেশ ও নিষেধের মাধ্যমে এবং তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর সুন্নাতের মাধ্যমে।
এ আয়াতের শিক্ষা হল আমরা যদি সত্যিকার আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমানদার হই তাহলে আমাদের মাঝে ধর্মীয় বিবাদের সমাধান কোন ইমাম, পীর, দরবেশ, মত ও পথের মাধ্যমে না হয়ে হতে হবে একমাত্র আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহীহ সুন্নাহর মাধ্যমে।
[ঙ] আল্লাহকে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হল সুন্নাহর অনুসরণ:
আল্লাহ তা’আলা বলেন, ﴿قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٣١﴾ [ال عمران: ٣١] “বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসতে চাও, তাহলে আমার অনুসরণ কর। ফলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দিবেন, আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু”।[6]
এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত যা বিদ্বানদের নিকট آية الإمتحان বা পরীক্ষার আয়াত বলে পরিচিত। ইমাম আব্দুর রহমান মুবারকপরী [রাহিমাহুল্লাহ] বলেন, এ আয়াত হতে সাব্যস্ত হয় যে, যে ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিস অনুসরণ করে না এবং সে অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব মনে করে না, সে আল্লাহকে ভালবাসার মিথ্যুক দাবীদার। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালবাসায় মিথ্যুক প্রমাণিত হয়, সে মূলত: আল্লাহর প্রতি ঈমানের মিথ্যুক দাবীদার। অতএব সত্যিকার ঈমানদার ও আল্লাহর প্রিয় হতে হলে সকল গাউছ-কুতুব, পীর-দরবেশ ও ওলী-আওলীয়াকে বাদ দিয়ে একমাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের অনুসারী হতে হবে।
[চ] সুন্নাহর বিরোধিতা হলে ফিতনা ও যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সম্মুখীন হতে হবে:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَلۡيَحۡذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنۡ أَمۡرِهِۦٓ أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٦٣ ﴾ [النور : ٦٣]
“সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা যেন সতর্ক হয় যে, তাদেরকে ফিতনা পেয়ে যাবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে”।[7] অতএব ইহকাল ও পরকালে ফিতনা ও শাস্তি হতে রক্ষা পেতে হলে সুন্নাহ অনুসরণের বিকল্প কোন পথ নেই।
[ছ] মুসলিম উম্মার উত্তম আদর্শের প্রতীক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম:
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ لِّمَن كَانَ يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا ٢١﴾ [الاحزاب : ٢١]
“তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মাঝেই রয়েছে উত্তম আদর্শ, এটা তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে”।[8]
ইমাম ইবনে কাছীর [রাহিমাহুল্লাহ] বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণের বিষয়ে এ আয়াতটি একটি অকাট্য ও বড় ধরণের প্রমাণ —-।”
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ইসলামী নীতিমালার এক অবিচ্ছেদ অংশ, যা ছাড়া ইসলাম কখনও পূর্ণতা লাভ করতে পারে না, সুন্নাহ ইসলামের এক অকাট্য দলীল এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে, নমুনা স্বরূপ সামান্য কিছু উপস্থাপন করা হল, এখন আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসের আলোকে বিষয়টি জানার চেষ্টা করি।
হাদিসের আলোকে: সুন্নাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী শরীয়তের অকাট্য দলীল কুরআনের আলোকে প্রমাণিত হওয়ার পর এ বিষয়ে হাদিসের অবতারণার প্রয়োজন হয় না বরং ইসলামের কোন বিধান প্রমাণের জন্য একটি বিশুদ্ধ ও স্পষ্ট দলীলই যথেষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু পাঠক সমাজের কাছে বিষয়টি আরও স্পষ্ট ও আলোকিত হওয়ার জন্য “সুন্নাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী শরীয়তের অকাট্য দলীলের” প্রমাণে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস নিম্নে উপস্থাপন করা হল:
[ক] প্রসিদ্ধ সাহাবী জাবির বিন আব্দুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঘুমন্ত অবস্থায় কিছু সংখ্যক ফিরিস্তা আসলেন, তাদের কেউ বললেন, তিনি ঘুমন্ত, আবার কেউ বললেন: তাঁর চক্ষু ঘুমন্ত কিন্তু অন্তর জাগ্রত। অতঃপর তারা বললেন, তাঁর একটি দৃষ্টান্ত রয়েছে তোমরা সে দৃষ্টান্ত বর্ণনা কর, অতঃপর বললেন, তাঁর দৃষ্টান্ত হল ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে সুসজ্জিত করে একটি গৃহ নির্মাণ করল, অতঃপর সেখানে খাওয়ার আয়োজন করল এবং একজন আমন্ত্রণকারী প্রেরণ করল, অতঃপর যে আমন্ত্রণ গ্রহণ করল, গৃহে প্রবেশ করল এবং আয়োজিত খানা খেল। আর যে আমন্ত্রণ গ্রহণ করল না, গৃহেও প্রবেশ করল না এবং আয়োজিত খানাও খেল না। এ দৃষ্টান্ত বর্ণনার পর তারা বললেন: দৃষ্টান্তের ব্যাখ্যা করে দিন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝতে পারবেন, কারণ চক্ষু ঘুমন্ত হলেও অন্তর জাগ্রত, তখন তারা ব্যাখ্যায় বললেন,
فَالدَّارُ الْجَنَّةُ وَالدَّاعِي مُحَمَّدٌ فَمَنْ أَطَاعَ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَى مُحَمَّدًا فَقَدْ عَصَى اللَّهَ وَمُحَمَّدٌ فَرْقٌ بَيْنَ النَّاسِ
“নির্মিত গৃহটি হল জান্নাত, আর আমন্ত্রণকারী হলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, অতএব যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য স্বীকার করে, সে যেন প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তা’আলরই আনুগত্য স্বীকার করল। আর যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অমান্য করল, সে যেন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা’আলাকেই অমান্য করল। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন মানুষের মাঝে [ন্যায় ও অন্যায়ের] পার্থক্যকারী”।[9]
[খ] সাহাবী আল ঈরবায বিন সারিয়াহ রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন:
صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللهِ ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَأَوْصِنَا فَقَالَ أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّنَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ [أحمد، أبو داود، الترمذى وإبن ماجة] قال الترمذى حديث حسن صحيح.
“একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের একদিন সালাত পড়ালেন, অতঃপর সালাত শেষে আমাদের দিকে মুখ করে বসে হৃদয় স্পর্শী বক্তব্য শোনালেন, বক্তব্য শুনে আমাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল এবং হৃদয়ে কম্পন শুরু হল, আমরা আবেদন করলাম হে রাসূলুল্লাহ! মনে হয় ইহা যেন বিদায়ী ভাষণ, অতএব আমাদেরকে কিছু উপদেশ দিন! তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমার উপদেশ হল তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের [ধর্মীয় নেতার] আনুগত্য স্বীকার কর এবং তার কথা শ্রবণ কর, যদিও হাব্শী কৃতদাস তোমাদের নেতা হয়ে থাকে। জেনে রেখ তোমাদের মধ্য হতে আমার পরে যে বেঁচে থাকবে সে [দ্বীনী বিষয়ে] বহু মতভেদ দেখতে পাবে, এমতাবস্থায় তোমাদের অপরিহার্য কর্তব্য হল আমার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধর এবং সুপথ প্রাপ্ত আমার [চার] খোলাফায়ে রাশিদার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধর। আর সাবধান থাক [দ্বীনের নামে] নব আবিষ্কৃত বিষয়সমূহ হতে! কারণ প্রতিটি [দ্বীনের নামে] নব আবিষ্কৃত বিষয় হল বিদ’আত, আর সকল প্রকার বিদ’আত হল পথভ্রষ্টটা।[10]
এ মূল্যবান হাদিসটি হতে আমরা একাধিক বিষয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, প্রথমত: ইহা প্রমাণ করে যে, সুন্নাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী শরীয়তের অকাট্য দলীল, তাই তাহা আঁকড়ে ধরতেই হবে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত: সুন্নাহ এর বিপরীত বিষয় হল বিদ’আত, বিদ’আতের পরিচয় হল: ইসলামে ইবাদাতের নামে এমন কোন নতুন বিষয়, অথবা মূল বিষয়ের কোন সংযোজন চালু করা যা কুরআন ও সুন্নায় প্রমাণিত নয়। এরূপ সকল বিদ’আতই ইসলামে গর্হিত ও পরিত্যাজ্য, কারণ আলোচ্য হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ “সকল প্রকার বিদ’আত পথভ্রষ্টটা” অন্য বর্ণনায় এসছে كُلَّ بِدْعَةٍ ضََلالَةٌ وَكُلُّ ضَلاَلَةٍ فِي النَّار “সকল প্রকার বিদ’আতই পথভ্রষ্টটা, আর সকল পথভ্রষ্টটার পরিণতি হল জাহান্নাম।” অতএব মনের খেয়াল খুশী অনুযায়ী বিদ’আতকে ভাগাভাগি করার কোন সুযোগ নেই। আল্লাহ আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতকে পূর্ণভাবে আঁকড়ে ধরে এবং সকল প্রকার বিদ’আত বর্জন করে সঠিক ইসলাম মেনে চলার তাওফীক দান করুন। আমীন!
[গ] সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
تَرَكْتُ فِيْكُمْ شَيْئَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا بَعْدَ هُمَا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّتِيْ
“তোমাদের মাঝে দু’টি বিষয় রেখে গেলাম যতক্ষণ সে দু’টি আঁকড়ে ধরে থাকবে কখনও পথভ্রষ্ট হবে না, আল্লাহ তা’আলার কিতাব ও আমার সুন্নাত”।
এ হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জে লক্ষাধিক জনতার সামনে জীবনের শেষ হজ্জে শেষ ভাষণে শেষ উপদেশ প্রদান কালে বলেন: আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর সুন্নাতই হল সুপথ ও বিপথের মাপকাঠি, এ দু’টিকে সমানভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। শুধু কুরআনকে আঁকড়ে ধরে যেমন সুপথ হতে পারে না, তেমনি শুধু সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরেও সুপথ হতে পারে না। তাই কুরআন ও সুন্নাহ উভয়কে সমানভাবে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে কেবল মানুষ তার দ্বীনকে সংরক্ষণ করতে পারবে, নচেৎ কখনও সম্ভব নয়।
সুন্নাহ ইসলামী শরীয়তের অকাট্য দলীল প্রমাণ করার জন্য নমুনা স্বরূপ এ তিনটি হাদিস উপস্থাপন করেই শেষ করতে চাই, মূলত: এ বিষয়ে অসংখ্য সহীহ হাদিস রয়েছে যা তুলে ধরলে ছোটখাটো একখানা পুস্তক হয়ে যাবে।
ইজমার আলোকে:
সুন্নাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী শরীয়তের অকাট্য দলীল, যা পবিত্র কুরআনের আলোকে অতঃপর হাদিসের আলোকে আলোচনা করা হল। উক্ত আলোচনা হতে এটাই সুস্পষ্ট হয় যে, কোন ঈমানের দাবিদার সুন্নার অনুসরণ হতে দূরে থাকতে পারে না এবং কুরআন ও সুন্নাহর ঊর্ধ্বে কোন কিছুকে প্রাধান্য দিতে পারে না।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُقَدِّمُواْ بَيۡنَ يَدَيِ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٞ ١ ﴾ [الحجرات: ١]
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের অগ্রে কোন কিছু প্রাধান্য দিও না, আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শুননে ও জানেন[11]।” অতএব, কোন ঈমানদার আল্লাহভীরু জ্ঞানীব্যক্তি সুন্নাহবিরোধী হতে পারে না। ইমাম শাফেয়ী [রাহিমাহুল্লাহ] স্বীয় প্রসিদ্ধ গ্রন্থ কিতাবুল উম্মে বলেন:
]لم أسمع أحدا نسبه الناس أو نسب نفسه إلى علم، يخالف في أن فرض الله عزوجل اتباع أمر رسول الله والتسليم لحكمه بأن الله عزوجل لم يجعل لأحد بعده إلا اتباعه[
অর্থাৎ “আল্লাহ তা’আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্ণ অনুসরণ করা এবং তাঁর ফায়সালা মাথা পেতে মেনে নেয়া যে ফরয করে দিয়েছেন এ বিষয়ে কোন জ্ঞানী ব্যক্তিকে দ্বিমত পোষণ করতে আমি শুনিনি। কারণ আল্লাহ তা’আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরবর্তী কোন ব্যক্তির জন্য তাঁর অনুসরণের বিকল্প পথ রাখেননি।” অতএব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ইসলামের অকাট্য দলীল ও অনুসরণীয় হওয়াতে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্ ইজমা বা ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
তথ্যসূত্রঃ
[1] সূরা আনফাল, আয়াত: ১
[2] আল ইমরান: ৩৩
[3] সূরা আল হাশর: ৭
[4] আহমদ, হাদিস: ১৭১৭৪, আবুদ দাউদ হাদিস: ৪৬০৪
[5] সূরা নিসা, আয়াত: ৫৯
[6] সূরা আলু ঈমরান: ৩১
[7] সূরা নূর: ৬৩
[8] সূরা আহযাব: ২১
[9] বুখারি, হাদিস: ৭২৮১
[10] তিরমিযি, ২৬৭৬ ইবনু মাযাহ, ৪২ আবু দাউদ, ৪৬০৭
[11] সূরা আল হুজরাত: ১
বইঃ সুন্নাহের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
লেখকঃ জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের