ঘুমানোর আগে মরণের স্মরণ

নিদ্রা এক ধরনের মৃত্যু। নিদ্রায় বিভোর মানুষ মৃত ব্যক্তির মতোই। পাশের বাড়িতে চুরি-ডাকাতি হলে সে টের পায় না। খুব পাতলা ঘুম না হলে বিছানায় পাশে থেকে কেউ উঠে গেলেও সে বুঝতে পারে না। অনেক কুম্ভকর্ণের মানুষকে তো ঘুমন্ত অবস্থায় এক ঘর থেকে আরেক ঘরে নিয়ে গেলেও ঠাওর করতে পারে না। আসলে মৃত্যু তো আত্মার স্থানান্তর। মানুষের ধর ভূমিতে থাকে, কিন্তু তার আত্মা চলে জান্নাত বা জাহান্নামের ঠিকানায়। আল্লাহর কবজায়।
জীববিজ্ঞানের ভাষায়, প্রাণ আছে এমন কোনো জৈব পদার্থের (বা জীবের) জীবনের সমাপ্তিকে মৃত্যু বলে। এর মধ্য দিয়ে থেমে যায় প্রাণীর-জীবের শ্বসন, খাদ্যগ্রহণ, পরিচলন- সবই। মৃত মানুষটি আর কথা বলে না। হাসে না। কাঁদেও না। অনন্তকালের জন্য তার চোখের পাপড়ি দুটো বুজে যায়। এই তো মৃত্যু। এই তো চিরবিদায়ে আল্লাহর চিরাচরিত অমোঘ রীতি। এ অনিবার্য। এ অবধারিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ كُلُّ نَفۡسٖ ذَآئِقَةُ ٱلۡمَوۡتِۖ ثُمَّ إِلَيۡنَا تُرۡجَعُونَ ٥٧ ﴾ [العنكبوت: ٥٧]
‘প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে, তারপর আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’ {সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত : ৫৭}
ঘুমের ব্যাপারটিও তেমনি। যত বীর-বাহাদুর হোন না কেন, এক সময় ঘুমের কাছে আপনাকে হার মানতে হবেই। নিদ্রার কোলে ঢলে পড়তে হবে মৃত্যুর মতোই। কুরআন ও সহীহ হাদীস বলছে, নিদ্রাকালে মানুষের রূহ বা আত্মা নিয়ে নেওয়া হয়, যেমন করা হয় তার মৃত্যুকালে। মরণ এসে গেলে এ ঘুম হয়ে যায় চিরনিদ্রা অন্যথায় নিদ্রা টুটে গেলে সে আবার জীবন ফিরে পায়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ ٱللَّهُ يَتَوَفَّى ٱلۡأَنفُسَ حِينَ مَوۡتِهَا وَٱلَّتِي لَمۡ تَمُتۡ فِي مَنَامِهَاۖ فَيُمۡسِكُ ٱلَّتِي قَضَىٰ عَلَيۡهَا ٱلۡمَوۡتَ وَيُرۡسِلُ ٱلۡأُخۡرَىٰٓ إِلَىٰٓ أَجَلٖ مُّسَمًّىۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ٤٢ ﴾ [الزمر: ٤٢]
‘আল্লাহ জীবগুলোর প্রাণ হরণ করেন তাদের মৃত্যুর সময় এবং যারা মরেনি তাদের নিদ্রার সময়। তারপর যার জন্য তিনি মৃত্যুর ফয়সালা করেন তার প্রাণ তিনি রেখে দেন এবং অন্যগুলো ফিরিয়ে দেন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে।’ {সূরা আয-যুমার, আয়াত : ৪২}

sleep
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
﴿ وَهُوَ ٱلَّذِي يَتَوَفَّىٰكُم بِٱلَّيۡلِ وَيَعۡلَمُ مَا جَرَحۡتُم بِٱلنَّهَارِ ثُمَّ يَبۡعَثُكُمۡ فِيهِ لِيُقۡضَىٰٓ أَجَلٞ مُّسَمّٗىۖ ثُمَّ إِلَيۡهِ مَرۡجِعُكُمۡ ثُمَّ يُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ ٦٠ ﴾ [الانعام: ٦٠]
‘আর তিনিই রাতে তোমাদেরকে মৃত্যু দেন এবং দিনে তোমরা যা কামাই কর তিনি তা জানেন। তারপর তিনি তোমাদেরকে দিনে পুনরায় জাগিয়ে তুলেন, যাতে নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ করা হয়। তারপর তাঁর দিকেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তারপর তোমরা যা করতে তিনি তোমাদেরকে সে বিষয়ে অবহিত করবেন।’ {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত : ৬০}
আবূ কাতাদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত,
حِينَ نَامُوا عَنِ الصَّلاَةِ قَالَ النَّبِىُّ – صلى الله عليه وسلم – « إِنَّ اللَّهَ قَبَضَ أَرْوَاحَكُمْ حِينَ شَاءَ ، وَرَدَّهَا حِينَ شَاءَ » . فَقَضَوْا حَوَائِجَهُمْ وَتَوَضّأُوا إِلَى أَنْ طَلَعَتِ الشَّمْسُ وَابْيَضَّتْ فَقَامَ فَصَلَّى .
(একবার এক সফরে সাহাবায়ে কেরামের) যখন সালাতের সময় ঘুমে অতিক্রম হয়ে গেল, নবী ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ যখন চেয়েছেন তোমাদের রূহ কবজা করেছেন আবার তা ফেরত দিয়েছেন যখন তিনি চেয়েছেন।’ অতপর তাঁরা প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারলেন ও অযূ করলেন। এরপর যখন সূর্যোদয় হলো এবং আকাশ ফরসা হলো, তাঁরা সবাই দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করে নিলেন। [বুখারী : ৭৪৭১]
আবু জুহায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِي سَفَرِهِ الَّذِي نَامُوا فِيهِ حَتَّى طَلَعَتِ الشَّمْسُ ، فَقَالَ : إِنَّكُمْ كُنْتُمْ أَمْوَاتًا فَرَدَّ اللَّهُ إِلَيْكُمْ أَرْوَاحَكُمْ ، فَمَنْ نَامَ عَنْ صَلاَةٍ فَلْيُصَلِّهَا إِذَا اسْتَيْقَظَ ، وَمَنْ نَسِيَ صَلاَةً فَلْيُصَلِّ إِذَا ذَكَرَ.
‘এক সফরে সাহাবীরা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আর সূর্য উঠে যাওয়ায় সালাত কাজা হয়ে গিয়েছিল, তখন রাসূলুল্লাহু ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা মরে গিয়েছিলে অতঃপর আল্লাহ তোমাদের রূহ ফিরিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি নিদ্রামগ্নতায় সালাত কাযা করে ফেলে সে যেন তা জেগেই আদায় করে নেয়। আর যে সালাতের কথা ভুলে যায়, সে যেন মনে পড়তেই তা আদায় করে নেয়।”’ [তাবরানী, মু‘জাম : ২৬৮, শায়খ আলবানী সহীহ বলেছেন]
নিদ্রা যেহেতু মৃত্যুর নমুনা, তাই আমাদের কর্তব্য হবে নিদ্রা গমনের আগে মরণের মতো প্রস্তুতি সম্পন্ন করা। আমাদের কাউকে যদি বলা হয়, আপনাকে কয়েক মিনিট সময় দেয়া হলো আপনি মৃত্যুর জন্য চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত হোন, আমরা কী করব? আমরা যত গাফেল ও আল্লাহর দীন সম্পর্কে উদাসীন হই না কেন, এ কথায় কিন্তু সবাই সিরিয়াস হয়ে যাব। পড়িমরি করে আমরা যথাসম্ভব কর্তব্যকাজ সমাধা করব। তওবা করে সবার কাছ থেকে মাফটাফ চেয়ে নেব। কোনো পাওনাদার থাকলে তার সঙ্গে সুরাহা করে নেব ইত্যাদি। উপর্যুক্ত কুরআন ও হাদীসের উদ্ধৃতিগুলোয় যদি আমরা পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস স্থাপন করি তাহলে ঘুমানোর আগেও আমাদের তেমন একটি সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। আমরা কেউ জানি না রাতের এ ঘুম অবশেষে চিরনিদ্রায় পরিণত হয় কিনা।
প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে মানুষ কত কিছুই তো জানে। বিজ্ঞানীরা কত কিছুর সূত্রই তো আবিষ্কার করেন, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি দিয়ে নাকি পৃথিবীর কোনো কোনো উন্নত দেশ সারা পৃথিবীর সবখানেই নজর রাখে, আবার কোনো কোনো দেশের দাবি মহাসাগরে একটি বল ভাসলেও তাদের রাডারে তা ধরা পড়ে, মানুষ মঙ্গলগ্রহে বসত গড়ছে, বোতাম টিপে হাজার মাইল দূর থেকে নির্ভুল লক্ষ্যবস্তুতে অব্যর্থ মিসাইলের আঘাত হানছে, অথচ এতসব প্রযুক্তি আর জ্ঞান-বিজ্ঞান এখনো আল্লাহর সেই ১৪ শত বছর আগের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেনি। কে কবে মারা যাবে তা উদ্ধারের কোনো প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। কোনো মানুষ জানে না কে কখন মারা যাবে। আল্লাহর ভাষায় :
﴿ إِنَّ ٱللَّهَ عِندَهُۥ عِلۡمُ ٱلسَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ ٱلۡغَيۡثَ وَيَعۡلَمُ مَا فِي ٱلۡأَرۡحَامِۖ وَمَا تَدۡرِي نَفۡسٞ مَّاذَا تَكۡسِبُ غَدٗاۖ وَمَا تَدۡرِي نَفۡسُۢ بِأَيِّ أَرۡضٖ تَمُوتُۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرُۢ ٣٤ ﴾ [لقمان: ٣٤]
‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকট কিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। আর তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং জরায়ূতে যা আছে, তা তিনি জানেন। আর কেউ জানে না আগামীকাল সে কী অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন্ স্থানে সে মারা যাবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।’ {সূরা লুকমান, আয়াত : ৩৪}
হ্যা ঘুমানোর আগে আমাদের সব হিসাব-নিকাশ করে শোয়া উচিত। সারাদিনের কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা জরুরী। উচিত হলো, আল্লাহ ও তার বান্দার কোনো হক অনাদায়ী থেকে গেলে সেটা আদায় করা। যেমন সারাদিন কর্মব্যস্ততা বা শয়তানের প্রবঞ্চনায় কোনো সালাত বাদ গিয়ে থাকলে সেটা অবশ্যই আদায় করে নেব। আল্লাহর কোনো বান্দাকে কথা বা কাজে কষ্ট দিয়ে থাকলে তার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নেব। মোবাইলের যুগে এখন এ কাজ কত সহজ হয়ে গেছে। আমরা আল্লাহর কাছে কী অজুহাত দেব? মাত্র দুটাকা খরচ করে ফোনে বলতে পারি, ভাই আজ তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি মাফ করে দাও কিংবা ভাই, আজ তোমার গীবত করেছি ক্ষমা করে দাও ইত্যাদি। এভাবে নিজেই নিজের হিসাব নিয়ে কবরে যাওয়ার জন্য ঘুমানোর আগে প্রস্তুতি সম্পন্ন করি। উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সেই বিখ্যাত বাণীটি আমরা স্মরণ করতে পারি, তিনি বলেছেন,
حاسِبُوا أَنْفُسَكُمْ قَبْلَ أَنْ تُحَاسَبُوا وَزِنُوا أَنْفُسَكُمْ قَبْل أَنْ تُوزَنُوا ، وَتَزَيَّنُوا لِلْعَرْضِ الأَكْبَرِ ، يَوْمَ تُعْرَضُونَ لاَ تَخْفَى مِنْكُمْ خَافِيَةٌ.
‘তোমাদের কাছে হিসাব চাওয়ার আগে নিজেরাই নিজেদের হিসাব সম্পন্ন করে নাও, তোমাদের আমল ওজন করার আগে নিজেরাই নিজেদের আমলসমূহ ওজন করে নাও, কিয়ামত দিবসে পেশ হওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করো। সুসজ্জিত হও সেদিনের জন্য, যেদিন তোমাদের সামনে কোনো কিছু অস্পষ্ট থাকবে না।’ [মুছান্নাফ, ইবন আবী শাইবা : ৩৫৬০০]
ঘুমানোর আগে সেই দিনটির কথা মনে করা উচিত যেদিন আমার সব কর্মফল সম্মুখে উপস্থিত পাব, কোনো কিছু রেকর্ডের বাইরে থাকবে না, আর কেউ কারও উপকারেও আসবে না। আল্লাহর ভাষায় পড়ুন :
﴿ فَإِذَا نُفِخَ فِي ٱلصُّورِ نَفۡخَةٞ وَٰحِدَةٞ ١٣ وَحُمِلَتِ ٱلۡأَرۡضُ وَٱلۡجِبَالُ فَدُكَّتَا دَكَّةٗ وَٰحِدَةٗ ١٤ فَيَوۡمَئِذٖ وَقَعَتِ ٱلۡوَاقِعَةُ ١٥ وَٱنشَقَّتِ ٱلسَّمَآءُ فَهِيَ يَوۡمَئِذٖ وَاهِيَةٞ ١٦ وَٱلۡمَلَكُ عَلَىٰٓ أَرۡجَآئِهَاۚ وَيَحۡمِلُ عَرۡشَ رَبِّكَ فَوۡقَهُمۡ يَوۡمَئِذٖ ثَمَٰنِيَةٞ ١٧ يَوۡمَئِذٖ تُعۡرَضُونَ لَا تَخۡفَىٰ مِنكُمۡ خَافِيَةٞ ١٨ فَأَمَّا مَنۡ أُوتِيَ كِتَٰبَهُۥ بِيَمِينِهِۦ فَيَقُولُ هَآؤُمُ ٱقۡرَءُواْ كِتَٰبِيَهۡ ١٩ إِنِّي ظَنَنتُ أَنِّي مُلَٰقٍ حِسَابِيَهۡ ٢٠ فَهُوَ فِي عِيشَةٖ رَّاضِيَةٖ ٢١ فِي جَنَّةٍ عَالِيَةٖ ٢٢ قُطُوفُهَا دَانِيَةٞ ٢٣ كُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ هَنِيٓ‍َٔۢا بِمَآ أَسۡلَفۡتُمۡ فِي ٱلۡأَيَّامِ ٱلۡخَالِيَةِ ٢٤ وَأَمَّا مَنۡ أُوتِيَ كِتَٰبَهُۥ بِشِمَالِهِۦ فَيَقُولُ يَٰلَيۡتَنِي لَمۡ أُوتَ كِتَٰبِيَهۡ ٢٥ وَلَمۡ أَدۡرِ مَا حِسَابِيَهۡ ٢٦ يَٰلَيۡتَهَا كَانَتِ ٱلۡقَاضِيَةَ ٢٧ مَآ أَغۡنَىٰ عَنِّي مَالِيَهۡۜ ٢٨ هَلَكَ عَنِّي سُلۡطَٰنِيَهۡ ٢٩ ﴾ [الحاقة: ١٣، ٢٩]
‘অতঃপর যখন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে- একটি মাত্র ফুঁক। আর যমীন ও পর্বতমালাকে সরিয়ে নেয়া হবে এবং মাত্র একটি আঘাতে এগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। ফলে সে দিন মহাঘটনা সংঘটিত হবে। আর আসমান বিদীর্ণ হয়ে যাবে। ফলে সেদিন তা হয়ে যাবে দুর্বল বিক্ষিপ্ত। ফেরেশতাগণ আসমানের বিভিন্ন প্রান্তে থাকবে। সেদিন তোমার রবের আরশকে আটজন ফেরেশতা তাদের উর্ধ্বে বহন করবে। সেদিন তোমাদেরকে উপস্থিত করা হবে। তোমাদের কোন গোপনীয়তাই গোপন থাকবে না। তখন যার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে সে বলবে, ‘নাও, আমার আমলনামা পড়ে দেখ’। ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আমি আমার হিসাবের সম্মুখীন হব’। সুতরাং সে সন্তোষজনক জীবনে থাকবে। সুউচ্চ জান্নাতে, তার ফলসমূহ নিকটবর্তী থাকবে। (বলা হবে,) ‘বিগত দিনসমূহে তোমরা যা অগ্রে প্রেরণ করেছ তার বিনিময়ে তোমরা তৃপ্তি সহকারে খাও ও পান কর’। কিন্তু যার আমলনামা তার বাম হাতে দেয়া হবে সে বলবে, ‘হায়, আমাকে যদি আমার আমলনামা দেয়া না হত’! ‘আর যদি আমি না জানতাম আমার হিসাব’! ‘হায়, মৃত্যুই যদি আমার চূড়ান্ত ফয়সালা হত’! ‘আমার সম্পদ আমার কোন কাজেই আসল না!’ ‘আমার ক্ষমতাও আমার থেকে চলে গেল! {সূরা আল-হাক্কা, আয়াত : ১৩-২৯}
আরেক সূরায় আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন ইরশাদ করেন,
﴿ فَإِذَا جَآءَتِ ٱلصَّآخَّةُ ٣٣ يَوۡمَ يَفِرُّ ٱلۡمَرۡءُ مِنۡ أَخِيهِ ٣٤ وَأُمِّهِۦ وَأَبِيهِ ٣٥ وَصَٰحِبَتِهِۦ وَبَنِيهِ ٣٦ لِكُلِّ ٱمۡرِيٕٖ مِّنۡهُمۡ يَوۡمَئِذٖ شَأۡنٞ يُغۡنِيهِ ٣٧ وُجُوهٞ يَوۡمَئِذٖ مُّسۡفِرَةٞ ٣٨ ضَاحِكَةٞ مُّسۡتَبۡشِرَةٞ ٣٩ وَوُجُوهٞ يَوۡمَئِذٍ عَلَيۡهَا غَبَرَةٞ ٤٠ تَرۡهَقُهَا قَتَرَةٌ ٤١ ﴾ [عبس: ٣٣، ٤١]
‘অতঃপর যখন বিকট (কিয়ামত দিবসের) আওয়াজ আসবে, সেদিন মানুষ পালিয়ে যাবে তার ভাই থেকে, তার মা ও তার বাবা থেকে, তার স্ত্রী ও তার সন্তান-সন্ততি থেকে। সেদিন তাদের প্রত্যেকেরই একটি গুরুতর অবস্থা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে। সেদিন কিছু কিছু চেহারা উজ্জ্বল হবে। সহাস্য, প্রফুল্ল। আর কিছু কিছু চেহারার উপর সেদিন থাকবে মলিনতা। কালিমা সেগুলোকে আচ্ছন্ন করবে।’ {সূরা আবাসা, আয়াত : ৩৩-৪১}
ঘুমানোর আগে আমরা মুহাসাবা তথা আত্মপর্যালোচনার পাশাপাশি কিয়ামত দিবসে হাশরের সেই বিচারলগ্নের কঙ্কটাপন্ন মুহূর্তগুলোর কথাও মনে করতে পারি, যার পুনঃপুনঃ বিবরণ দিয়েছেন খোদ সে দিবসের মহাবিচারক। ইরশাদ হয়েছে :
﴿ وَيَوۡمَ نُسَيِّرُ ٱلۡجِبَالَ وَتَرَى ٱلۡأَرۡضَ بَارِزَةٗ وَحَشَرۡنَٰهُمۡ فَلَمۡ نُغَادِرۡ مِنۡهُمۡ أَحَدٗا ٤٧ وَعُرِضُواْ عَلَىٰ رَبِّكَ صَفّٗا لَّقَدۡ جِئۡتُمُونَا كَمَا خَلَقۡنَٰكُمۡ أَوَّلَ مَرَّةِۢۚ بَلۡ زَعَمۡتُمۡ أَلَّن نَّجۡعَلَ لَكُم مَّوۡعِدٗا ٤٨ وَوُضِعَ ٱلۡكِتَٰبُ فَتَرَى ٱلۡمُجۡرِمِينَ مُشۡفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَٰوَيۡلَتَنَا مَالِ هَٰذَا ٱلۡكِتَٰبِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةٗ وَلَا كَبِيرَةً إِلَّآ أَحۡصَىٰهَاۚ وَوَجَدُواْ مَا عَمِلُواْ حَاضِرٗاۗ وَلَا يَظۡلِمُ رَبُّكَ أَحَدٗا ٤٩ ﴾ [الكهف: ٤٧، ٤٩]
‘আর যেদিন আমি পাহাড়কে চলমান করব এবং তুমি যমীনকে দেখতে পাবে দৃশ্যমান, আর আমি তাদেরকে একত্র করব। অতঃপর তাদের কাউকেই ছাড়ব না। আর তাদেরকে তোমার রবের সামনে উপস্থিত করা হবে কাতারবদ্ধ করে। (আল্লাহ বলবেন) ‘তোমরা আমার কাছে এসেছ তেমনভাবে, যেমন আমি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম; বরং তোমরা তো ভেবেছিলে আমি তোমাদের জন্য কোন প্রতিশ্রুত মুহূর্ত রাখিনি’। আর আমলনামা রাখা হবে। তখন তুমি অপরাধীদেরকে দেখতে পাবে ভীত, তাতে যা রয়েছে তার কারণে। আর তারা বলবে, ‘হায় ধ্বংস আমাদের! কী হল এ কিতাবের! তা ছোট-বড় কিছুই ছাড়ে না, শুধু সংরক্ষণ করে’ এবং তারা যা করেছে, তা হাযির পাবে। আর তোমার রব কারো প্রতি জুলুম করেন না।’ {সূরা আল-কাহফ, আয়াত : ৪৭-৪৯}
সূরা যিলযালে আল্লাহ সে মুহূর্তের দৃশ্যগুলোর চমৎকার চিত্র তুলে ধরেছেন। ইরশাদ হয়েছে,
﴿ إِذَا زُلۡزِلَتِ ٱلۡأَرۡضُ زِلۡزَالَهَا ١ وَأَخۡرَجَتِ ٱلۡأَرۡضُ أَثۡقَالَهَا ٢ وَقَالَ ٱلۡإِنسَٰنُ مَا لَهَا ٣ يَوۡمَئِذٖ تُحَدِّثُ أَخۡبَارَهَا ٤ بِأَنَّ رَبَّكَ أَوۡحَىٰ لَهَا ٥ يَوۡمَئِذٖ يَصۡدُرُ ٱلنَّاسُ أَشۡتَاتٗا لِّيُرَوۡاْ أَعۡمَٰلَهُمۡ ٦ فَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٍ خَيۡرٗا يَرَهُۥ ٧ وَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ شَرّٗا يَرَهُۥ ٨ ﴾ [الزلزلة: ١، ٨]
‘যখন প্রচণ্ড কম্পনে যমীন প্রকম্পিত হবে, আর যমীন তার বোঝা বের করে দেবে, আর মানুষ বলবে, ‘এর কী হল?’ সেদিন যমীন তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে, যেহেতু তোমার রব তাকে নির্দেশ দিয়েছেন। সেদিন মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে বের হয়ে আসবে যাতে দেখানো যায় তাদেরকে তাদের নিজদের কৃতকর্ম। অতএব, কেউ অণু পরিমাণ ভালকাজ করলে তা সে দেখবে, আর কেউ অণু পরিমাণ খারাপ কাজ করলে তাও সে দেখবে।’ {সূরা আয-যিলযাল, আয়াত : ১-৮}
আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখেও আমরা সে বিচার দিবসের বিবরণ শুনতে পাই। ‘আদী ইবন হাতেম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« مَا مِنْكُمْ أَحَدٌ إِلاَّ سَيُكَلِّمُهُ رَبُّهُ ، لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهُ تَرْجُمَانٌ ، فَيَنْظُرُ أَيْمَنَ مِنْهُ فَلاَ يَرَى إِلاَّ مَا قَدَّمَ مِنْ عَمَلِهِ ، وَيَنْظُرُ أَشْأَمَ مِنْهُ فَلاَ يَرَى إِلاَّ مَا قَدَّمَ ، وَيَنْظُرُ بَيْنَ يَدَيْهِ فَلاَ يَرَى إِلاَّ النَّارَ تِلْقَاءَ وَجْهِهِ ، فَاتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ » .
‘তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে আল্লাহ তাআলা সরাসরি কথা বলবেন, মাঝখানে কোনো দোভাষী থাকবে না। তখন সে তার ডান দিকে তাকাবে এবং সেখানে সে তার কৃত আমল ছাড়া আর কিছুই দেখবে না। সে বাম দিকে তাকাবে, সেখানেও সে তার কৃত আমল ছাড়া অন্যকিছু দেখবে না। সে তার সামনের দিকে তাকাবে এবং আগুন ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। সুতরাং আগুন থেকে বাচোঁ যদিও শুকনো খেজুরের এক টুকরো অথবা একটি ভালো কথা ব্যয় করে হয়।’ [বুখারী : ৭৫১২]
মনে রাখতে হবে, মৃত্যু মানে শুধু পরপারে পাড়ি জমানো নয়, মৃত্যু মানে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। আজ যার মৃত্যু হল, এতদিন সে পৃথিবীতে স্বাধীন ছিল। যখন যা ইচ্ছা করার শক্তি ছিল, ন্যায়-অন্যায়, ফরমাবরদারী-নাফরমানী সবকিছুর সমান ক্ষমতা ছিল। সে কি আল্লাহর পূর্ণ ফরমাবরদার ছিল, না অনেক নাফরমানীও তার দ্বারা হয়েছে? প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে গুনাহর কাজ হয়েছে? আজ আল্লাহ তাকে ডাক দিয়েছেন হিসাবের জন্য। এ ডাকে সাড়া না দেওয়ার উপায় নেই। স্বজন-প্রিয়জনদের সাধ্য নেই, তাকে কোথাও লুকিয়ে রাখে।
আজ তাকে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। এখন তাকে কবরে নামানো হবে, ফেরেশতারা আসবে, তাকে প্রশ্ন করা হবে- তোমার রব কে, তোমার দীন কী এবং যিনি তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছিলেন তিনি কে? তার গোটা জীবনের কর্মই হবে এসব প্রশ্নের জবাব। সে কি সারা জীবন ঈমানে অবিচল ছিলো? সুন্নতে অটল ছিলো? ইসলামের ফরয বিধান সালাত, সাওম, হজ, যাকাত, পর্দা-পুশিদা, লেনদেন, সততা, অন্যের হক আদায় ইত্যাদি বিধান কি সে যথাযথভাবে পালন করেছে?
এরপর সম্পূর্ণ ইসলামী রীতিতে এবং আল্লাহর নির্দেশিত ও নবীজি ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো পদ্ধতিতে শয্যা গ্রহণ করা এবং তার সুন্নত মতো নিদ্রা থেকে জাগ্রত হওয়া। সহীহ হাদীসসমূহে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নিদ্রার পূর্বাপর বেশ কিছু আদব ও আমল এবং বহু দু‘আ ও যিকরের শিক্ষা পাই, প্রতিটি ঈমানদারের কর্তব্য হবে হক্কুল্লাহ ও হক্কুল ইবাদ তথা আল্লাহ ও তাঁর বান্দাদের হকসমূহ আদায়ের পাশাপাশি এসব আমল যথাসম্ভব বেশি বেশি সম্পাদন করা।
যেমন,
১- অপ্রয়োজনে রাত না জেগে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার সালাতের আগে ঘুমানো এবং সালাতের পর অহেতুক গল্প-গুজব করা খুব অপছন্দ করতেন। অথচ দুঃখজনক সত্য হলো, আমরা আজকাল টেলিভিশনে ইন্ডিয়ান সিরিয়াল কিংবা রাজনৈতিক আলাপের টক শো শুনে মধ্য রাতে ঘুমাতে যাই।
২- আরেক দরকারী আমল আয়াতুল কুরসি পড়া। হাদীসের একটি চমৎকার ঘটনা না লেখার লোভ সামলাতে পারছি না। আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
وَكَّلَنِى رَسُولُ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – بِحِفْظِ زَكَاةِ رَمَضَانَ ، فَأَتَانِى آتٍ فَجَعَلَ يَحْثُو مِنَ الطَّعَامِ ، فَأَخَذْتُهُ ، وَقُلْتُ وَاللَّهِ لأَرْفَعَنَّكَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – . قَالَ إِنِّى مُحْتَاجٌ ، وَعَلَىَّ عِيَالٌ ، وَلِى حَاجَةٌ شَدِيدَةٌ . قَالَ فَخَلَّيْتُ عَنْهُ فَأَصْبَحْتُ فَقَالَ النَّبِىُّ – صلى الله عليه وسلم – « يَا أَبَا هُرَيْرَةَ مَا فَعَلَ أَسِيرُكَ الْبَارِحَةَ » .
قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ شَكَا حَاجَةً شَدِيدَةً وَعِيَالاً فَرَحِمْتُهُ ، فَخَلَّيْتُ سَبِيلَهُ . قَالَ « أَمَا إِنَّهُ قَدْ كَذَبَكَ وَسَيَعُودُ » . فَعَرَفْتُ أَنَّهُ سَيَعُودُ لِقَوْلِ رَسُولِ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – إِنَّهُ سَيَعُودُ . فَرَصَدْتُهُ فَجَاءَ يَحْثُو مِنَ الطَّعَامِ فَأَخَذْتُهُ فَقُلْتُ لأَرْفَعَنَّكَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – . قَالَ دَعْنِى فَإِنِّى مُحْتَاجٌ ، وَعَلَىَّ عِيَالٌ لاَ أَعُودُ ، فَرَحِمْتُهُ ، فَخَلَّيْتُ سَبِيلَهُ فَأَصْبَحْتُ ، فَقَالَ لِى رَسُولُ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – « يَا أَبَا هُرَيْرَةَ ، مَا فَعَلَ أَسِيرُكَ » .
قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ شَكَا حَاجَةً شَدِيدَةً وَعِيَالاً ، فَرَحِمْتُهُ فَخَلَّيْتُ سَبِيلَهُ . قَالَ «أَمَا إِنَّهُ قَدْ كَذَبَكَ وَسَيَعُودُ » . فَرَصَدْتُهُ الثَّالِثَةَ فَجَاءَ يَحْثُو مِنَ الطَّعَامِ ، فَأَخَذْتُهُ فَقُلْتُ لأَرْفَعَنَّكَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – ، وَهَذَا آخِرُ ثَلاَثِ مَرَّاتٍ أَنَّكَ تَزْعُمُ لاَ تَعُودُ ثُمَّ تَعُودُ . قَالَ دَعْنِى أُعَلِّمْكَ كَلِمَاتٍ يَنْفَعُكَ اللَّهُ بِهَا.
قُلْتُ مَا هُوَ قَالَ إِذَا أَوَيْتَ إِلَى فِرَاشِكَ فَاقْرَأْ آيَةَ الْكُرْسِىِّ ( اللَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ ) حَتَّى تَخْتِمَ الآيَةَ ، فَإِنَّكَ لَنْ يَزَالَ عَلَيْكَ مِنَ اللَّهِ حَافِظٌ وَلاَ يَقْرَبَنَّكَ شَيْطَانٌ حَتَّى تُصْبِحَ . فَخَلَّيْتُ سَبِيلَهُ فَأَصْبَحْتُ ، فَقَالَ لِى رَسُولُ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – « مَا فَعَلَ أَسِيرُكَ الْبَارِحَةَ » . قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ زَعَمَ أَنَّهُ يُعَلِّمُنِى كَلِمَاتٍ ، يَنْفَعُنِى اللَّهُ بِهَا ، فَخَلَّيْتُ سَبِيلَهُ . قَالَ « مَا هِىَ » .
قُلْتُ قَالَ لِى إِذَا أَوَيْتَ إِلَى فِرَاشِكَ فَاقْرَأْ آيَةَ الْكُرْسِىِّ مِنْ أَوَّلِهَا حَتَّى تَخْتِمَ ( اللَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ ) وَقَالَ لِى لَنْ يَزَالَ عَلَيْكَ مِنَ اللَّهِ حَافِظٌ وَلاَ يَقْرَبَكَ شَيْطَانٌ حَتَّى تُصْبِحَ ، وَكَانُوا أَحْرَصَ شَىْءٍ عَلَى الْخَيْرِ . فَقَالَ النَّبِىُّ – صلى الله عليه وسلم – « أَمَا إِنَّهُ قَدْ صَدَقَكَ وَهُوَ كَذُوبٌ ، تَعْلَمُ مَنْ تُخَاطِبُ مُنْذُ ثَلاَثِ لَيَالٍ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ » . قَالَ لاَ . قَالَ « ذَاكَ شَيْطَانٌ » .
(একবার) রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে রমযানের জাকাত (ফিৎরার মাল-ধন) দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেন। বস্তুত (আমি পাহারা দিচ্ছিলাম ইত্যবসরে) একজন আগমনকারী এসে আঁজলা ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল। আমি তাকে ধরলাম এবং বললাম, ‘তোকে অবশ্যই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পেশ করব।’ সে আবেদন করল, আমি একজন সত্যিকারের অভাবী। পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব আমার ওপর, আমার দারুণ অভাব।’ কাজেই আমি তাকে ছেড়ে দিলাম।
সকালে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে হাযির হলাম) রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে আবূ হুরাইরা! গত রাতে তোমার বন্দী কী আচরণ করেছে’? আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সে তার অভাব ও (অসহায়) পরিবার-সন্তানের অভিযোগ জানাল। সুতরাং তার প্রতি আমার দয়া হলে আমি তাকে ছেড়ে দিলাম।’ তিনি বললেন, ‘সতর্ক থেকো, সে আবার আসবে’।
আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুরূপ উক্তি শুনে সুনিশ্চিত হলাম যে, সে আবার আসবে। কাজেই আমি তার প্রতীক্ষায় থাকলাম। সে (পূর্ববৎ) এসে আঁজলা ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল। আমি বললাম, ‘অবশ্যই তোকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পেশ করব।’ সে বলল, ‘আমি অভাবী, পরিবারের দায়ত্ব আমার ওপর, (আমাকে ছেড়ে দাও) আমি আর আসব না।’ সুতরাং আমার মনে দয়া হল। আমি তাকে ছেড়ে দিলাম।
সকালে উঠে যখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম তখন) রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘‘আবূ হুরাইরা! গত রাতে তোমার বন্দী কী আচরণ করেছে’? আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সে তার অভাব ও অসহায় সন্তানের-পরিবারের অভিযোগ জানাল। সুতরাং আমার মনে দয়া হলে আমি তাকে ছেড়ে দিলাম’। তিনি বললেন, ‘সতর্ক থেকো, সে আবার আসবে’।
সুতরাং তৃতীয়বার তার প্রতীক্ষায় রইলাম। সে (এসে) অঞ্জলী ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল। আমি তাকে ধরে বললাম ‘‘এবারে তোকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাযির করবই।’ এটা তিনবারের মধ্যে শেষবার। ‘ফিরে আসবো না’ বলে তুই আবার ফিরে এসেছিস।’’ সে বলল ‘তুমি আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমাকে এমন কতকগুলি শব্দ শিখিয়ে দেব, যার দ্বারা আল্লাহ তোমার উপকার করবেন।’ আমি বললাম ‘সেগুলি কী?’ সে বলল, ‘যখন তুমি (ঘুমাবার জন্য) বিছানায় যাবে, তখন আয়াতুল কুরসী পাঠ করে (ঘুমাবে) তাহলে তোমার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রক্ষক নিযুক্ত হবে। আর সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে শয়তান আসতে পারবে না’।
সুতরাং আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। আবার সকালে (রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম) তিনি আমাকে বললেন, ‘‘তোমার বন্দী কী আচরণ করেছে?’’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সে বলল, ‘‘আমি তোমাকে এমন কতিপয় শব্দ শিখিয়ে দেব, যার দ্বারা আল্লাহ আমার কল্যাণ করবেন।’’ বিধায় আমি তাকে ছেড়ে দিলাম তিনি বললেন ‘‘সে শব্দগুলি কী?’’ আমি বললাম, ‘সে আমাকে বলল, ‘‘যখন তুমি বিছানায় (শোয়ার জন্য) যাবে, তখন আয়াতুল কুরসী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে নেবে।’’ সে আমাকে আর বলল, “তার কারণে আল্লাহর তরফ থেকে সর্বদা তোমার জন্য একজন রক্ষক নিযুক্ত থাকবে। আর সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে শয়তান আসতে পারবে না’’।
(এ কথা শুনে) তিনি ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘শোনো! সে নিজে ভীষণ মিথ্যাবাদী; কিন্তু তোমাকে সত্য কথা বলেছে। হে আবূ হুরাইরা! তুমি জান, তিন রাত ধরে তুমি কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’’ আমি বললাম, ‘জী না ।’ তিনি বললেন, ‘‘সে ছিল শয়তান’’। [বুখারী : ৩০৩৩)।
৩- সর্বোপরি ঘুমানোর আগে-পরের দু‘আ পড়া। বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَانَ إِذَا أَخَذَ مَضْجَعَهُ قَالَ: «اللهُمَّ بِاسْمِكَ أَحْيَا، وَبِاسْمِكَ أَمُوتُ» وَإِذَا اسْتَيْقَظَ قَالَ: «الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَانَا بَعْدَمَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النُّشُورُ»
‘নবী ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন শয্যা গ্রহণ করতেন, তিনি বলতেন, আল্লহুম্মা বিসমিকা আহইয়া ও বিসমিকা আমূতু। (অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনার নামে মৃত্যুবরণ করলাম এবং আপনার নামেই জীবিত হব।) আর ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর বলতেন, ‘আলহামদুলিল্লাহিল্লাজি আহইয়ানা বাদা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন্নুশুর।’ (অর্থ যাবতীয় প্রশংসা ওই আল্লাহর জন্য যিনি আমাকে মৃত্যু দেয়ার পর জীবিত করে দিয়েছেন এবং তার কাছেই ফিরে যাব।) [মুসলিম : ২৭১১]
আমাদের ইসলাম হাউজেই ঘুমানোর আগে-পরের যিকর ও দু‘আসমূহ এবং আদব বিষয়ে একাধিক লেখা রয়েছে, হিসনুল মুসলিম গ্রন্থেও বিভিন্ন যিকর ও দু‘আ রয়েছে আমরা সেগুলো সংগ্রহ করে আমল করতে পারি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন।

লেখকঃ আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনাঃ  ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member