তওবাহ

লেখক : মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন

অনুবাদক : সানাউল্লাহ বিন নজির আহমদ

সম্মানিত ভাইসব! সকল প্রকার গুনাহ থেকে আল্লাহর কাছে তাওবা করার মাধ্যমে মাহে রমযান সমাপ্ত করুন। আল্লাহ যে কাজে সন্তুষ্ট তাই সম্পাদন করুন। কোন মানুষই অপরাধ ও ত্রুটি মুক্ত নয়, সমস্ত আদম সন্তানই ভুলের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। তবে ভুলকারীদের মধ্যে সেই উত্তম, যে আল্লাহর কাছে তওবা করে। মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআনের মাধ্যমে এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসের মাধ্যমে গুনা থেকে ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَاسْتَقِيمُوا إِلَيْهِ وَاسْتَغْفِرُوهُ(فصلة: من الآية৬)

‘বল, আমি কেবল তোমাদের মত একজন মানুষ। আমার কাছে ওহী পাঠানো হয় যে, তোমাদের ইলাহ কেবল মাত্র এক ইলাহ। অতএব তোমরা তার পথে দৃঢ়ভাবে অটল থাক এবং তার কাছে ক্ষমা চাও।’[1]

আল্লাহ আরো বলেন,

وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعاً أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ(النور: من الآية৩১)

হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবাহ কর। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।[2]

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحاً عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَار (الةحريم: من الآية৮)

‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাটি তাওবাহ; আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত।’[3]

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন-

إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ (البقرة: من الآية২২২)

‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তাওবাকারীদেরকে ভালবাসেন এবং তিনি পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকেও ভালবাসেন।’[4]

আম্মার বিন ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

হে মানবজাতি তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর, আমি প্রতি দিন একশতবার তাওবা করি।[5]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূল-কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয় আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, আমি তার কাছে দৈনিক সত্তরবারের বেশি তাওবা করি।[6]

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তার বান্দার তাওবার কারণে খুব খুশি হন। যখন বান্দা তার কাছে তাওবা করে তখন বান্দা যে অবস্থায় থাকুক না কেন আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দেন।

আনাস এবং ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আদম সন্তান একটি স্বর্ণের উপত্যকার মালিক হলে, আরো দু’টি স্বর্ণের উপত্যকার মালিক হওয়ার আশা পোষণ করবে, তবুও তার মুখ পূর্ণ হবে না একমাত্র মাটি ছাড়া। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক তাওবাকারীকে ক্ষমা করে দেন।[7]

তাওবা হল আল্লাহর অবাধ্যচারণ থেকে ফিরে গিয়ে আল্লাহর আনুগত্যের পথে ধাবিত হওয়া। যেহেতু একমাত্র আল্লাহ হলেন প্রকৃত ইবাদতের যোগ্য। প্রকৃত ইবাদতের অর্থ হল মাবুদের প্রেম, ভালবাসা ও মহত্বে নিমজ্জিত হওয়া।

দ্রুত তাওবা করা আবশ্যক, বিলম্ব করা কোনক্রমেই সমিচীন নয়। আল্লাহ তায়ালা এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওবার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ দ্রুততার সাথে পালন করা উচিত। কারণ, বান্দা জানেনা দেরি করলে তার তাওবা করার সুযোগ হবে কি না, যেহেতু যে কোন সময় মৃত্যু এসে যেতে পারে, তওবার সুযোগ নাও হতে পারে। অন্যায় কাজ বারবার করার মাধ্যমে অন্তর কঠিন হয়ে যায় এবং আল্লাহর হুকুম পালনে দূরত্বের সৃষ্টি হয়, ঈমান দুর্বল হয়ে যায়। কারণ, ঈমান আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় এবং অন্যায় করার মাধ্যমে ঈমান কমে যায়। বারবার অপরাধ করার দ্বারা অপরাধ করার মানসিকতা তৈরী হয়। কোন আত্মা কোন বস্তুর ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করে ফেললে, তার থেকে ফিরে আসা কঠিন হয়ে পড়ে, তার ওপর শয়তান বিজয়ী হয়ে যায়, বড় বড় অপরাধ করার প্রেরণা দেয়। এ জন্য ওলামায়ে কেরাম বলেন, সকল ধরনের অপরাধ কুফুরী বৃদ্ধি করে। মানুষ ধাপে ধাপে একটি অপরাধ থেকে আরেকটি অপরাধে লিপ্ত হয়ে যায়। এক পর্যায়ে দ্বীন থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে।

তাওবাহ কবুল হওয়ার জন্য পাঁচটি শর্ত রয়েছে :

এক. একনিষ্ঠতার সাথে তাওবা করা। তাওবাতে আল্লাহর প্রতি ভালবাসা, তার মহত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, তাঁর কাছে কল্যাণের আশা করা এবং তাঁর শাস্তি থেকে ভয় পাওয়ার প্রতিফলন জরুরি। এ তাওবা দ্বারা পার্থিব কোন বস্তু কামনা অথবা কোন সৃষ্ট জীবের কাছে কিছু প্রার্থনা না করা। যদি কেউ এমনটি করে তাহলে তার তাওবা কবুল হবে না, সে অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তাওবা করেছে। সে আল্লাহর কাছে তাওবা করেনি বরং সে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে তাওবা করেছে।

দুই. তার পূর্বকৃত গুণার জন্য লজ্জিত ও হীন হওয়া চাই এবং তার এ আশা করা যে, তার এ তওবা কবুল না হলে সে কিছুই অর্জন করতে পারবে না। তার এ তওবা হবে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়া এবং তার কৃত অপরাধের শাস্তির ভয় স্মরণ করা। তবেই তার তওবা কবুল হবে।

তৃতীয়. অতি তাড়াতাড়ি গুণাহর কাজ থেকে দূরে সরে যাওয়া। খুব সম্ভব দেরি করলে অপরাধে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি কোন ফরজ বা ওয়াজিব ছেড়ে দিয়ে থাকে, তবে অবশ্যই তা সম্পাদন করে নিবে। যেমন যাকাত, হজ ইত্যাদি। বারবার কোন অপরাধে লিপ্ত থেকে তওবা করে লাভ নেই। যেমন কেউ সুদ খাওয়া থেকে তওবা করে সর্বদা সুদের কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকে, এ ধরনের তওবা দ্বারা কোন লাভ হবে না। বরং তার তওবা হবে হাসি-ঠাট্টা ও বিদ্রুপ করার ন্যায়। এর দ্বারা সে আল্লাহ ও তাঁর আয়াতসমূহের সাথে তাচ্ছিল্যপুর্ণ আচরণ করল। যা তাকে আল্লাহর রহমত থেকে আরো দূরে সরিয়ে দিবে। কিংবা কেউ তওবা করল যে, কখনো জামাতের সাথে নামায ত্যাগ করবে না, তার পরেও সে জামাত ত্যাগ করে চলে, তবে তার এ তওবায় কোন লাভ হবে না।

মানুষের কোন হক নষ্ট করে যদি সে অপরাধ করে থাকে, তবে তাকে মানুষের হক আদায় করেই তাওবা করতে হবে, অন্যথায় তার তাওবা সঠিক হবে না। যদি কোন ব্যক্তি অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে হস্তগত করে অথবা কারো সম্পদ নিয়ে অস্বীকার করে, তবে উক্ত ব্যক্তির সম্পদ ফিরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত তওবা সঠিক হবে না। যদি উক্ত সম্পদের মালিক মারা যায়, তবে তার উত্তরাধিকারীদের কাছে ফিরিয়ে দিবে। যদি তার কোন উত্তরাধিকারী জীবিত না থাকে, তবে বাইতুল মালে জমা করে দিবে। কোন উপায় না থাকলে তার নামে সাদকাহ করে দিবে। যদি কোন মুসলমানের গীবত করে অপরাধ করে থাকে, তবে তার গীবত ত্যাগ করে তাওবা করা আবশ্যক।

চার. এ অপরাধ পুনরায় না করার সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত নিবে। যেহেতু এটা সঠিক তাওবার ফল এবং সত্যিকারের তাওবার আলামত। যদি কেউ বলে, আমি তাওবা করেছি এবং সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আর কখনো এ অপরাধ করব না, তার পরেও সে বারবার ঐ অপরাধ করে চলে, তবে তাওবা কবূলযোগ্য হবে না। কারণ, তার এ তাওবা হচ্ছে সাময়িক, যার দ্বারা দ্বীন বা দুনিয়ার কোন উপকারের সম্ভাবনা নেই।

পাঁচ. তওবা কবূলের সময় শেষ হওয়ার পর আর কোন গুণাহর কাজ না করা। তাওবা কবূলের সময় শেষ হয় দু’ভাবে। সবার জন্য এক সাথে। নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির জন্য এককভাবে।

(ক) পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদয় হলে সবার তাওবার করার সময় শেষ হয়ে যাবে। তখন আর কারো তাওবা কাজে আসবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

يَوْمَ يَأْتِيَ بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ لا يَنْفَعُ نَفْساً إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْراً(الأنعام: من الآية১৫৮)

‘অথবা প্রকাশ পাবে তোমার রবের নিদর্শনসমূহের কিছু? যেদিন তোমার রবের নিদর্শনসমূহের কিছু প্রকাশ পাবে, সেদিন কোন ব্যক্তিরই তার ঈমান উপকারে আসবে না, যে পূর্বে ঈমান আনেনি, কিংবা সে তার ঈমানে কোন কল্যাণ অর্জন করেনি।’[8]

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি পশ্চিম দিকে সূর্য উদয় হওয়ার আগ পর্যন্ত তাওবা করবে তার তওবা আল্লাহ কবুল করবেন।[9]

(খ) ব্যক্তির মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে। মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে তাওবা কবুলের সুযোগ থাকে না। সে তাওবায় কোন লাভ হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآن(النساء: من الآية১৮)

আর তাওবা নাই তাদের, যারা অন্যায় কাজ করতে থাকে অবশেষে যখন তাদের কারো মৃত্যু এসে যায়, তখন সে বলে, আমি এখন তাওবা করলাম।[10]

আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বান্দার তওবা কবুল করে থাকেন যতক্ষণ না তার রুহ অবশিষ্ট থাকে।[11]

তাওবার এসব শর্ত মুতাবেক তাওবা করলে আল্লাহ তার তাওবা করবেন এবং এর দ্বারা বড় ধরনের অপরাধও ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعاً إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ (الزمر:৫৩)

বল, ‘হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দিবেন, নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’[12]

এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, অপরাধী ব্যক্তি মুসলমান। মহান আল্লাহ বলেন-

وَمَنْ يَعْمَلْ سُوءاً أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللَّهَ يَجِدِ اللَّهَ غَفُوراً رَحِيماً(النساء:১১০)

আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে কিংবা নিজের প্রতি যুলম করবে তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে, সে আল্লাহকে পাবে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।[13]

অতএব, তোমরা অতি দ্রুত তাওবা কর। আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করবেন এবং তোমাদের মৃত্যু আসার আগেই তওবার তাওফিক দিয়ে অনুগ্রহ করবেন। এ ছাড়া গুনাহ থেকে মুক্ত হওয়ার আর কোন পথ নেই।

হে আল্লাহ, আমাদেরকে মাকবুল তাওবা করার তাওফিক দান কর। যে তাওবার দ্বারা আমাদের পূর্ববর্তী সব গুনাহ মোচন হয়ে যায়। আমাদের সব কাজকর্ম সহজ করে দাও। হে আল্লাহ আমাদেরকে, আমাদের মাতা-পিতাকে এবং সব মুমিনকে ইহকালে ও পরকালে ক্ষমা করে দাও। আমীন

তথ্যসূত্র :

[1] ফুসসিলাত : ৬

[2] নূর : ৩১

[3] তাহরিম : ৮

[4] সূরা তওবা : ২২২

[5] মুসলিম

[6] বুখারী

[7] বুখারী ও মুসলিম

[8] আনআম : ১৫৮

[9] মুসলিম

[10] নিসা : ১৮

[11] তিরমিযী

[12] জুমার : ৫৩

[13] নিসা : ১১০

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button