হৃদয় সংলগ্ন ত্রিশটি আমল
হৃদয় সংলগ্ন ত্রিশটি আমল
১- আল্লাহ তাআলার উপর ঈমান আনা
আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনার অর্থ শুধু আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব স্বীকার করা নয়; বরং অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে অনাদি, অনন্ত, চিরঞ্জীব তা স্বীকার করা। তার সিফাত অর্থাৎ মহৎ গুণাবলি স্বীকার করা এবং তিনি যে এক, অদ্বিতীয়, সর্বশক্তিমান ও দয়াময় এটাও স্বীকার করা এবং তিনি ব্যতীত অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য নয় একথা বিশ্বাস করা।
২- সবই আল্লাহ তাআলার সৃষ্ট এর উপর ঈমান রাখা
প্রত্যেক মুসলমানকে এ বিষয়ে অকাট্য বিশ্বাস ও ঈমান রাখতে হবে যে, ভাল-মন্দ ছোট বড় সমস্ত বিষয় ও বস্তুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা। সৃষ্টিকর্তা হিসেবে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ নেই।
৩- ফেরেশতা সম্পর্কে ঈমান রাখা
ফেরেশতাগণ নিস্পাপ, তারা আল্লাহর প্রিয় ও ফরমাবরদার বান্দা। কোন কাজেই তারা বিন্দুমাত্র নাফরমানি করেনা এবং তাদের আল্লাহপ্রদত্ব ক্ষমতাও অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা তাদের উপর অনেক জিম্মাদারি অর্পণ করেছেন।
৪- আল্লাহর কিতাব সম্বন্ধে ঈমান রাখা
পবিত্র কুরআন সম্পর্কে এরূপ ঈমান রাখতে হবে যে, এ মহান কিতাবটি কোন মানুষের রচিত নয়; বরং তা আদ্যোপান্ত আল্লাহ তাআলার কালাম বা বাণী। পবিত্র কুরআন অক্ষরে অক্ষরে অকাট্য সত্য। এতদ্ভিন্ন পূর্ববর্তী নবীগণের প্রতি যেসব বড় বা ছোট কিতাব নাযিল হয়েছিল, সবই অক্ষরে অক্ষরে সত্য ও অকাট্য ছিল। অবশ্য পরবর্তী কালে লোকেরা ঐসব কিতাব বিকৃত ও পরিবর্তন করে ফেলেছে। কিন্তু কুরআন শরীফকে শেষ পর্যন্ত অপরিবর্তিতরূপে সংরক্ষণ করার ভার স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই নিয়েছেন। সেই হিসেবে পবিত্র কুরআনকে কেউ বিকৃত করতে পারবে না।
৫- নাবীদের সম্বন্ধে ঈমান রাখা
বিশ্বাস রাখতে হবে যে, নবী বা পয়গাম্বর বহু সংখ্যক ছিলেন। তারা সকলেই নিষ্পাপ ও বেগুণাহ ছিলেন। তারা স্বীয় দায়িত্ব যথাযথ আদায় করে গিয়েছেন। আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার আনীত শরীয়তই আমাদের পালনীয়।
৬- আখিরাত সম্বদ্ধে ঈমান রাখা
আখেরাতের উপর ঈমান রাখার অর্থ এই যে, কবরের সাওয়াল-জওয়াব ও ছাওয়াব-আযাব বিশ্বাস করা, হাশরের ময়দানে আদি হতে অন্ত পর্যন্ত পৃথিবীতে আগত সকল মানুষ একত্রিত হবে, নেকি ও গুণাহ পরিমাপ করা হবে ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। অর্থাৎ কিয়ামত সম্বন্ধে যত কথা কুরআন ও হাদীসে এসেছে, সব বিশ্বাস করা জরুরী।
৭- তাকদীর সম্বন্ধে ঈমান রাখা
তাকদীর সম্বন্ধে কখনো তর্ক-বিতর্ক করবে না, বা মনে সংশয় সন্দেহ স্থান দিবেনা। দুনিয়াতে যা কিছু হয়েছে, হচ্ছে বা হবে সবই মহান আল্লাহর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণাধীন ও হুকুমের তাবেদার। আল্লাহ তাআলার ক্ষমতায়ই সবকিছু হয়। অবশ্য আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছা ও কাজের ইখতিয়ার দিয়েছেন। মানুষ নিজের ইখতিয়ার ও ইচ্ছায় ভাল-মন্দ যা কিছু করবে, আল্লাহ তার প্রতিদান দিবেন।
৮- জান্নাতের উপর ঈমান রাখা
পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে বেহেশতের কথা উল্লেখ আছে। আল্লাহ তাআলা নেককার মুমিন বান্দাদেরকে বেহেশতে তাদের আমলের যথার্থ প্রতিদান ও পুরস্কার দিবেন। তারা ঈমান ও নেক আমলের বদৌলতে চিরকাল বেহেশতের অফুরন্ত নেয়ামত ও শান্তি ভোগ করবেন। বেহেশতের বাস্তবতা সম্পর্কে দৃঢ় ঈমান রাখতে হবে।
৯- জাহান্নামের উপর ঈমান রাখা
পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে দোযখের উল্লেখ আছে। আল্লাহ তাআলা কাফির, ফাসেক ও বদকারদেরকে জাহান্নাম তথা দোযখে তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত পরিনাম বা শাস্তি দিবেন। কাফিররা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। আর গুণাহগার ঈমানদাররা জাহান্নামে নির্দিষ্ট মেয়াদের শাস্তি ভোগের পর ঈমানের বদৌলতে জান্নাতে যাবে। দোযখের বাস্তবাতার উপর ঈমান রাখতে হবে।
১০- অন্তরে আল্লাহর মুহাব্বত রাখা
অন্তরে মহান আল্লাহর প্রতি সর্বদা মহব্বত বদ্ধমূল রাখতে হবে। এমনকি দুনিয়ার সবকিছু থেকে আল্লাহ তাআলার মহব্বত বেশি হতে হবে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন মজিদে ইরশাদ করেন –
والذين آمنوا أشد حباً لله
যারা মুমিন আল্লাহর প্রতি তাদের মুহাব্বত প্রকট।
১১- কারো সাথে মহব্বত-ভালোবাসা ও শত্রুতা পোষণ কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই রাখা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে, সে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে।
(ক) যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সর্বাধিক মহব্বত করবে।
(খ) কোন ব্যক্তি বা বস্তুর সাথে মহব্বত করতে হলে আল্লাহর উদ্দেশ্যেই করবে। অন্য কোন উদ্দেশ্যে করবেনা।
(গ) কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে মন্দ জানতে হলে শুধুমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তেই মন্দ জানবে। (মুসনাদে আহমাদ)
১২- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ভালোবাসা রাখা, তার সুন্নাতকে ভালোবাসা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ভালোবাসা রাখা ঈমানের বিশেষ অংশ। এর অর্থ শুধু মহব্বতের দাবি করা বা নাত-গজল পড়া নয়, বরং এর সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কর্তব্য পালন করতে হবে। যথা:
১. অন্তর দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভালোবাসতে হবে।
২. বাহ্যিকভাবে তার আদব বা তাজীম রক্ষা করতে হবে।
৩. রাসূলের উপর দুরূদ ও সালাম পড়তে হবে।
৪. রাসূলের সুন্নাত তরীকার অনুসরণ করতে হবে।
১৩- ইখলাসের সাথে আমল করা
যে কোন নেক কাজ খালিসভাবে আল্লাহকে রাজি-খুশি করার নিয়্যতে করা ঈমানের দাবি। নিয়্যত খাটি হবে, মুনাফেকি ও রিয়া থাকতে পারবে না। মুমিনের সকল কাজ একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই হতে হবে।
১৪- গুনাহ থেকে তাওবা করা
তাওবা শুধু গদবাধা কতগুলো শব্দ উচ্চারণের নাম নয়; বরং গুণাহর কারণে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়ে তা থেকে সম্পূর্ণরূপে পরহেজ করা জরুরী। এক বুযুর্গ আরবীতে অতি সংক্ষেপে তওবার ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন-
التوبة تحرق الحشا على الخطأ
গুণাহের কারণে মনের ভিতর অনুতাপের আগুন জলাকেই তাওবা বলে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন :
الندامة توبة
অনুতাপের নামই তওবা।
১৫- অন্তরে আল্লাহর ভয় রাখা
হযরত মুআয রা. থেকে বর্ণিত: ঈমান ওয়ালার দিল কখনও আল্লাহর ভয় ছাড়া থাকেনা, সব সময়ই তা আল্লাহর ভয়ে কম্পমান থাকে। কোন সময়ই সে আল্লাহ থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে পারেনা।
১৬- আল্লাহ তাআলার রাহমাতের আশা করা
কুরআন শরীফে আছে :
إنه لا ييأس من روح الله إلا القوم الكافرون
যারা কাফের তারাই শুধু আল্লাহর রাহমাত হতে নিরাশ হয়। আল্লাহর রহমতের আশা রাখা ঈমানের একটি বিশেষ অংশ।
১৭- লজ্জাশীল হওয়া
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
الحياء شعبة من الإيمان
লজ্জাশীলতা ঈমানের একটি বড় শাখা। (বুখারী, মুসলিম)
১৮- শোকরগুজার হওয়া
শোকর দুই প্রকার। (ক) আল্লাহর শোকর আদায় করা যিনি প্রকৃত দাতা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
واشكروا لي ولا تكفرون
তোমরা আমার শোকর আদায় কর, কুফরি করোনা।
(খ) মানুষের শোকর আদায় করা। অর্থাৎ যাদের হাতের মাধ্যম হয়ে আল্লাহ তাআলার নেয়ামত পাওয়া যায়, তাদের শোকর আদায় করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেন,
من لم يشكر الناس لم يشكر الله
যে ব্যক্তি মানুষের শোকর আদায় করলনা সে আল্লাহ তাআলার শোকর করলনা।
১৯- অঙ্গীকার রক্ষা করা
আল্লাহ তাআলা বলেন,
يأيها الذين آمنوا أوفوا بالعقود
হে ঈমানদারগণ, তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। (অর্থাৎ কাউকে কোন কথা দিয়ে থাকলে তা রক্ষা কর। )
২০- ধৈর্য ধারণ করা
আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
إن الله من الصابرين
যারা সবর করে আল্লাহ তাআলা তাদের সঙ্গে আছেন।
২১- নম্রতা অবলম্বন করা
নম্রতা অর্থ নিজেকে সকলের তুলনায় অন্তর থেকে ছোট মনে করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেন:
من تواضع لله رفعه الله
যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে নম্রতা অবলম্বন করে আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। (বাইহাকী)
২২- স্নেহশীল হওয়া
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি দুর্ভাগা তার থেকেই দয়া ছিনিয়ে নেয়া হয়।
২৩- তাকদীরে সন্তুষ্ট থাকা
তাকদীরে সন্তুষ্ট থাকাকে رضى بالقضاء বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহর সকল ফয়সালা সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করা। তবে আল্লাহর হুকুমে বিপদ আপদ বা দুঃখ-কষ্ট আসলে অসন্তুষ্ট না হওয়ার অর্থ এই নয় যে, মনে কষ্ট লাগতে পারবে না, পেরেশানও হবেনা। কষ্টের বিষয়ে কষ্ট লাগাটাইতো স্বাভাবিক। তবে আসল কথা হচ্ছে কষ্ট লাগলেও বুদ্ধির দ্বারা ও জ্ঞানের দ্বারা তার মধ্যে কল্যাণ আছে এবং এটা আল্লাহ তাআলারই হুকুমে হয়েছে মনে করে সেটাকে পছন্দ করা।
২৪- তাওয়াক্কুল অবলম্বন করা
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وعلى الله فليتوكل المؤمنون
আর আল্লাহ তাআলার উপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিৎ।
২৫- অহংকার না করা
অহংকার না করা অর্থাৎ অন্যের তুলনায় নিজেকে নিজে ভাল এবং বড় মনে না করা ঈমানের অঙ্গ। তবরানী নামক হাদীসের কিতাবে একটি হাদীস বর্ণিত আছে, তিনটি জিনিষ মানুষের জন্য সর্বনাশকারী :
(ক) লোভ (খ) নফসানি খাহেশ ও (গ) অহংকার।
২৬- চোগলখুরী ও মনোমালিন্য তরক করা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: চোগলখুরী ও কিনা মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। অতএব, কোন মুমিনের অন্তরেই এ গর্হিত খাসলত না থাকা উচিৎ। (তাবারানী)
২৭- হিংসা-বিদ্বেষ বর্জন করা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন :
إياكم والحسد، فإن الحسد يأكل الحسنات كما تأكل النار الحطب
খবরদার! তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাক, কেননাঅগ্নি যেমন কাঠকে ভস্ম করে ফেলে তদ্রূপ হিংসাও মানুষের নেকিকে ভস্ম করে ফেলে। । (তাবারানী)
২৮- ক্রোধ দমন করা
আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে ক্রোধ দমনকারীর প্রশংসা করেছেন। অনর্থক রাগ করা মারাত্মক গুণাহ। রাগ-ক্রোধ দমনে হাদীসে তাকীদ এসেছে। তবে ইসলামের উপর কোন আঘাত আসলে সেখানে ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি প্রদর্শনই ঈমানের দাবি।
২৯- অন্যের অনিষ্ট সাধন ও প্রতারণা না করা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করে অর্থাৎ পরের মন্দ চায়, অপরকে ঠকায়, ধোকা দেয় তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। (মুসলিম)
৩০- দুনিয়ার প্রতি অত্যধিক মায়া-মহব্বত ত্যাগ করা
নাবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি দুনিয়াকে ভালবাসবে, তার আখেরাতের লোকসান হবে এবং যে আখেরাতকে ভালবাসবে তার দুনিয়ার কিছু ক্ষতি হবে। হে আমার উম্মত! তোমাদের মঙ্গলের জন্যই বলছি, তোমরা অস্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াকে ভালবেসে চিরস্থায়ী আখেরাতকে নষ্ট করে দিওনা। তোমরা সকলে চিরস্থায়ী পরকালকেই শক্তভাবে ধর এবং বেশি করে ভালবাস। (অর্থাৎ দুনিয়ার মহব্বত পরিত্যাগ করে আখেরাতের প্রস্তুতিতে আমলের প্রতি যথাযথ ধাবিত হও। (আহমাদ, বায়হাকী)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে উল্লেখিত সিফাতগুলো অর্জন করার তাওফীক দান করুন।
সমাপ্ত
Thanks for usefull post.
Salam