ইসলামে শাফাআত ও তার শর্ত

শাফাআতের মালিক কে?
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের আকীদার অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, শাফাআতে বিশ্বাস করা। আল্লাহ্ তাআলা তাঁর কিতাবের অনেক জায়গায় কঠিন শর্তসাপেক্ষে শাফাআতের কথা বর্ণনা করেছেন। কিয়ামতের দিন এই শাফআত সংঘটিত হবে। মুতাযেলা সম্প্রদায় এবং কিছু বাতিল ফির্কা ব্যতীত অন্য কেউ এই শাফাআতকে অস্বীকার করে নি। কুরআনে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, শাফাআতের একমাত্র মালিক হলেন তিনি। তাতে কারো সামান্যতম অধিকার নেই। যাকে তিনি শাফআত করার অধিকার ও অনুমতি দিবেন, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ শাফাআত করার অধিকার রাখেন না।
আল্লাহ্ তাআ’লা বলেনঃ

قُلْ لِلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا

“হে নবী আপনি বলে দিনঃ সমস্ত সুপারিশ একমাত্র আল্লাহর অধিকারভুক্ত”। (সূরা যুমারঃ ৪৪)

shafayat in islam
কে সুপারিশ করবেন? শাফাআতের শর্ত কি?
কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহর অনুমতি পেয়ে আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুপারিশ করবেন। অন্যান্য নবী-রাসূল, সত্যবাদীগণ, শহীদগণ এবং নেককারগণ ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ সুপারিশ করবেন।
কিন্তু এই প্রকার শাফায়াতের জন্য ৩টি শর্ত রয়েছে। যথাঃ

১) শাফায়াতকারীর উপর আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকা।
২) যার জন্য সুপারিশ করা হবে, তার উপরও আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকা। আর তাওহীদ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তরীকায় প্রতিষ্ঠিত থাকা ব্যতীত করো উপর আল্লাহ্‌ সন্তুষ্ট হবেন না।
৩) শাফায়াতকারীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে শাফায়াত করার অনুমতি থাকা।
আল্লাহ তাআ’লা আরও বলেনঃ
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ

“কে আছে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার তাঁর অনুমতি ব্যতীত?” (সূরা বাকারাঃ ২৫৫)

আল্লাহ্ তাআ’লা আরও বলেনঃ
مَا مِنْ شَفِيعٍ إلاَّ مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ

“আল্লাহর অনুমতির পূর্বে কেউ সুপারিশ করতে পারবে না”। (সূরা ইউনুসঃ ৩)
আল্লাহ্ তাআ’লা আরও বলেনঃ

وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَوَاتِ لاَ تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلاَّ مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى

“আকাশে অনেক ফেরেশতা আছে। তাদের সুপারিশ কোন কাজে আসবে না। যতক্ষণ আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন”। (সূরা আন-নাজমঃ ২৬)
আল্লাহ্ তাআ’লা আরও বলেনঃ

وَلاَ تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إلاَّ لِمَنْ أَذِنَ لَهُ

“যার জন্যে অনুমতি দেয়া হয়, তার সুপারিশ ব্যতীত আল্লাহর কাছে কারো সুপারিশ ফলপ্রসু হবে না”। (সূরা সাবাঃ ২৩)
আল্লাহ্ তাআ’লা বলেনঃ
يَوْمَ يَقُومُ الرُّوحُ وَالْمَلاَئِكَةُ صَفًّا لاَ يَتَكَلَّمُونَ إِلاَّ مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَقَالَ صَوَابًا“

যেদিন রূহ অর্থাৎ জিবরীল (আঃ) ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। দয়াময় আল্লাহ্ যাকে অনুমতি দিবেন, সে ব্যতীত অন্য কেউ কথা বলতে পারবে না এবং সে সত্য বলবে”। (সূরা আন-নাবাঃ ৩৮)
আল্লাহ্ তাআ’লা আরও বলেনঃ

لاَ يَمْلِكُونَ الشَّفَاعَةَ إِلاَّ مَنِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمَنِ عَهْدًا

“যিনি দয়াময় আল্লাহর নিকট হতে প্রতিশ্র“তি নিয়েছেন, তিনি ব্যতীত অন্য কারো সুপারিশ করার ক্ষমতা থাকবে না”। (সূরা মারইয়ামঃ ৮৭)
সুতরাং বুঝা গেল যে, সুপারিশ শুধু তারাই করবেন, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা তা করার অনুমতি দিবেন। কুরআন মাজীদে তিনি এই সংবাদও দিয়েছেন যে, যার উপর তিনি সন্তুষ্ট থাকবেন, কেবল তার জন্যেই সুপারিশের অনুমতি দিবেন।
আল্লাহ্ তাআ’লা বলেনঃ
وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنْ ارْتَضَى

“তারা কেবল তাদের জন্যই সুপারিশ করবেন, যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট আছেন”। (সূরা আম্বীয়াঃ ২৮)
আল্লাহ্ তাআ’লা আরও বলেনঃ

يَوْمَئِذٍ لاَ تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلاَّ مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلاً

“দয়াময় আল্লাহ্ যাকে অনুমতি ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ব্যতীত কারো সুপারিশ সেদিন কোন কাজে আসবে না”। (সূরা তোহাঃ ১০৯)
যারা শির্ক করবে তাদের জন্য কিয়ামতের কোন সুপারিশকারী থাকবে নাঃ
ইহা জানা কথা যে, সঠিক তাওহীদের অনুসারী ব্যতীত আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কারও প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না।
আল্লাহ্ তাআ’লা বলেনঃ
مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلاَ شَفِيعٍ يُطَاعُ

“যালিমদের জন্যে কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু নেই এবং এমন কোন সুপারিশকারী নেই, যার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে”। (সূরা গাফেরঃ ১৮)
আল্লাহ্ তাআ’লা আরও বলেনঃ

فَمَا لَنَا مِنْ شَافِعِينَ وَلا صَدِيقٍ حَمِيمٍ

“পরিণামে আমাদের কোন সুপারিশকারী নেই এবং কোন অন্তরঙ্গ বন্ধুও নেই”। (সূরা শুআরাঃ ১০০-১০১)
আল্লাহ্ তাআ’লা আরও বলেনঃ

فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ

“সেদিন সুপারিশ কারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না”। (সূরা মুদ্দাচ্ছিরঃ ৪৮)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফাআতঃ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁকে সুপারিশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন যে, তিনি আরশের নীচে সিজদায় পড়ে তাঁর প্রতিপালকের এমন প্রশংসা করবেন, যা সেই সময় বিশেষভাবে তাঁকে শেখানো হবে। তিনি প্রথমেই সুপারিশ করবেন না। যতক্ষণ না তাঁকে বলা হবেঃ আপনি মাথা উঠান। কথা বলুন। আপনার কথা শ্রবণ করা হবে। আপনি প্রার্থনা করুন। আপনাকে প্রদান করা হবে। সুপারিশ করুন। আপনার সুপারিশ কবুল করা হবে।
তিনি আরো বলেছেন যে, সকল তাওহীদপন্থী গুনাহ্গারদের জন্যে তিনি একবারই সুপারিশ করবেন না; বরং তিনি বলেছেনঃ আমার জন্যে নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে। তাদেরকে আমি জান্নাতে প্রবেশ করাবো। তিনি পুনরায় ফেরত গিয়ে অনুরূপভাবে সিজদায় পড়বেন। পুনরায় তাঁর জন্যে নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া হবে। এভাবে হাদীছের শেষ পর্যন্ত। আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলেনঃ
مَنْ أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِكَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ
“কোন্ ব্যক্তি আপনার শাফাআত পেয়ে সবচেয়ে বেশী ধন্য হবে? তিনি বললেনঃ যে ব্যক্তি অন্তর থেকে একনিষ্ঠভাবে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করবে, সেই হবে আমার শাফাআত লাভ করে সবচেয়ে বেশী ধন্য”।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে শাফাআত চাওয়া শির্কঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু কিয়ামতের দিন শাফাআত করবেন, তাই মুসলিমদের বিরাট একটি অংশ তাঁর কাছে শাফাআত প্রার্থনা করে থাকেন। অনেকেকেই তাঁর কবরের কাছে গিয়ে বলতে শুনা গেছেঃ

يا رسول الله أسألك الشفاعة

অর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার কাছে শাফাআত প্রার্থনা করছি। এভাবে রাসূলের কাছে শাফাআত চাওয়া শির্ক। এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আমাদের বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ শাইখুল হাদীছ আযীযুল হকের হজ্জ ও যিয়ারত সংক্রান্ত একটি বইয়ে উপরের কথাটি দেখেছি। তিনি বলেছেনঃ অতঃপর রাসূল (সাঃ)এর কবরের কাছে গিয়ে বলবেঃ يا رسول الله أسألك الشفاعة
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি সেই বইটি হাতে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আকীদাহ বিষয়ক প্রফেসরের আব্দুর রাহমান আশ-শিবলকে বইটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, এই কথাটি কি শির্ক? তিনি বললেনঃ এটি সুস্পষ্ট শির্ক। এতে কোন সন্দেহ নেই। আমি আবার প্রশ্ন করলামঃ কোনভাবে এটিকে অন্য অর্থে ব্যবহার করা যায় কি না? কারণ এই বইয়ের লেখক আমাদের দেশের একজন বিজ্ঞ আলেমের অন্তর্ভূক্ত এবং তিনি বুখারী শরীফের বাংলা অনুবাদ করেছেন। শাইখ শিবিল বললেনঃ অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার কোন সুযোগ নেই।
আর যদি এভাবে দুআ করা হয় যে হে আল্লাহ! আমাকে কিয়ামতের দিন রাসূলের শাফাআত থেকে বঞ্চিত করো না কিংবা এভাবে বলা হয় যে, হে আল্লাহ আমাকে কিয়ামতের দিন রাসূলের শাফাআত নসীব করো, তাহলে খুবই সুন্দর হবে সে দুআ।
এখন কেউ যদি প্রশ্ন করে যে, আমি রাসূলের কাছে এমন একটি বিষয় চাচ্ছি, যার অধিকার তাঁকে দেয়া হয়েছে এবং তিনি অবশ্যই শাফাআত করবেন।

এর উত্তর হল, তিনি অবশ্যই শাফাআত করবেন এবং তাঁকে সেই অধিকার দেয়া হবে। কিন্তু আল্লাহ তআলা তাঁর কাছে শাফাআত করতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدْعُوا مَعَ اللَّهِ أَحَدًا

মসজিদসমুহ (সিজদার স্থানসমূহ) আল্লাহর জন্য। অতএব, তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডেকো না। (সূরা জিনঃ ১৮)
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَلا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لا يَنْفَعُكَ وَلا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِينَ

“তুমি আল্লাহ্ ব্যতীত এমন বস্তুকে ডাকবে না যে তোমার উপকার কিংবা ক্ষতি কোনটিই করতে পারে না। যদি তুমি তাই কর তবে তুমি নিশ্চিত ভাবেই জালেমদের মধ্যে গন্য হবে। (ইউনুসঃ ১০৬)।
আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেন:
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَنْ لا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُون

এবং ঐ ব্যক্তির চেয়ে আর কে বেশী পথভ্রষ্ট যে আল্লাহ্ ব্যতীত এমন ব্যক্তিদেরকে আহবান করে যারা কিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবে না এবং তারা তাদের ঐ আহবান থেকে সম্পূর্ণ বেখবর রয়েছে? (আহকাফঃ ৫)
পরিশেষে সকল মুসলিম ভাই ও বোনদের প্রতি হৃদয়ের আহবান হল, আসুন আমরা শির্ক ও বিদআত মুক্ত এবাদত করে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াব হই।

-আবদুল্লাহ শাহেদ

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan