রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আদর্শে সৌন্দর্য, সুরুচি ও পরিমিতিবোধ
রচনায়: সৈয়দ আলী আহসান
আমরা সংস্কৃতিবান মানুষ বলতে তাঁকেই বুঝি যিনি সত্যবাদী, পরিচ্ছন্ন, পরিশুদ্ধ, বিনয়ী এবং কল্যাণব্রতের অধিকারী। একজন সংস্কৃতিবান পুরুষ কখনও অপসংস্কৃতির দ্বারা আক্রান্ত হবেন না। সত্যপথ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কখনও দ্বিধাগ্রস্ত থাকবেন না এবং মানুষের কল্যাণের জন্য সর্বদা সচেতন থাকবেন। তিনি প্রজ্ঞার দ্বারা চালিত হবেন এবং শুভকর্মের জন্য সর্বদা নিজেকে প্রস্তুত রাখবেন। তিনিই যথার্থ সংস্কৃতিবান পুরুষ যিনি জীর্ণতাকে দূর করবেন এবং যিনি মানুষের মধ্যে সৎকর্মের জন্য চৈতন্য আনবেন। কোন প্রকার অহমিকা এবং ঔদ্ধত্য তাঁর জীবন সাধনায় থাকবে না।
ঔদ্ধত্য অসম্মাননা আনে এবং জীবনের যাত্রাপথে বিশ্বাসকে বিনষ্ট করে। আমরা যখন মহামানব মহানবী (সা) সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই তখন যথার্থ সংস্কৃতিবান মানুষের সমস্ত গুণ তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করি। তিনি ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ)-এর বংশধর। হযরত ইবরাহীম (আ) একজন অসম্ভব প্রজ্ঞাবান পুরুষ ছিলেন। তিনি অন্ধভাবে কোন সংস্কারকে গ্রহণ করেন নি। তিনি যুক্তির সাহায্যে বিবেচনাগত নিরীক্ষণের মাধ্যমে সত্যকে আবিষ্কার করবার চেষ্টা করেছিলেন এবং সফলকাম হয়েছিলেন। তিনি আকাশের তারকা দেখেছেন, চন্দ্রের দীপ্তি দেখেছেন, সূর্যের ঔজ্জ্বল্য দেখেছেন, ঝড়-ঝঞ্ঝার ক্ষুব্ধতা দেখেছেন এবং এগুলো সবকিছুই তাঁর কাছে অস্থির মনে হয়েছে। অবশেষে পরম সহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে এবং বিবেচনার মধ্য দিয়ে যাত্রা করে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, সবকিছুর পিছনে একজন নিয়ন্তা আছেন। সেই নিয়ন্তাই নিখিল বিশ্বের চালিকা শক্তি। ইবরাহীম (আ)-এর বিশ্বাসের এই ধারাক্রমের মধ্যে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবদুল্লাহর কপালে একটি দীপ্তি দেখা যেত। এ দীপ্তির অর্থ ছিল যে, তিনি একজন অসাধারণ দীপ্তিমান পুরুষের পিতা হতে যাচ্ছেন। তাঁর স্ত্রী আমিনার গর্ভে মহানবী (সা)-র জন্ম হয়। বলা হয়ে থাকে যে, এই জন্মের সঙ্গে সঙ্গে পৌত্তলিকদের প্রতিমাগুলো ভূলুণ্ঠিত হয় এবং পারসিকদের পূজার অগ্নি নির্বাপিত হয়। প্রতীকগত এ কথাগুলোর অর্থ হচ্ছে-তিনি এসেছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের আলোকবর্তিকারূপে এবং অসদ্ভাবের বিরুদ্ধে ন্যায়ের প্রত্যয়রূপে। তাঁর আবির্ভাব ছিল পরিচ্ছন্নতার দ্যুতির মত। পৃথিবীতে যত অকল্যাণ ছিল সেসব অকল্যাণের বিরুদ্ধ-শক্তিরূপে তাঁর আবির্ভাব ছিল। হযরত ইবরাহীম (সা) এক বিশ্বপ্রভুর উপর বিশ্বাসের যে অঙ্গীকার এনেছিলেন, মহানবী (সা)-এর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সেই বিশ্বাসের নতুন প্রভায় পৃথিবী প্রভাময় হয়ে উঠেছিল।
শৈশব থেকে মহানবী (সা) সত্যবাদী এবং ন্যায়নিষ্ঠ ছিলেন। তাই সকলে তাঁকে আখ্যা দিয়েছিল ‘আল আমীন’। স্বাভাবিকভাবেই সত্যের প্রেরণা এসেছিল, কোনরূপ অপসংস্কৃতি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। আরব দেশের লোকেরা দীর্ঘ রাত্রি জেগে গল্পের আসর বসাতো। এসব গল্পের আসরে পান-ভোজন চলতো, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ চলতো এবং অশ্লীল বিনোদন চলতো। বালক মুহাম্মদের একবার ইচ্ছা হয়েছিল এরকম একটি গল্পের আসরে যোগ দেয়ার। কিন্তু তাঁর যোগ দেয়া হয়নি। যে গৃহে গল্পের আসর বসেছিল সে গৃহ পর্যন্ত আসতে আসতে তাঁর নিদ্রা আসে এবং নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে তিনি পথিমধ্যে শুয়ে পড়েন।
আর একটি ঘটনার কথা আমরা বলতে পারি, যখন কা’বাঘর সংস্কারের সময় বালক মুহাম্মদ নিযুক্ত হয়েছিলেন। সে সময়কার প্রথামত নির্মাণ কাজে যারা নিযুক্ত হত তারা উলঙ্গ হয়ে নির্মাণের উপকরণ বহন করে আনতো। যখন বালক মুহাম্মদকেও উলঙ্গ হতে বলা হল তখন তিনি চৈতন্য হারিয়ে ফেললেন। এর ফলে তাঁকে আর উলঙ্গ হতে হয়নি। দেখা যাচ্ছে যে, প্রতিটি অবস্থায় আল্লাহ তা’আলা তাঁকে পবিত্র রেখেছিলেন। কোনও প্রকার অন্যায় কর্ম তাঁর দ্বারা সংঘটিত হয়নি এবং স্থানীয় অপসংস্কৃতি তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। যেহেতু তিনি মহান আল্লাহ কর্তৃক নিয়োজিত ছিলেন কল্যাণের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য, তাই আল্লাহ্ তা’য়ালা কখনও অকল্যাণ ও অপবিত্রতার স্পর্শ তাঁর দেহে এবং মনে লাগতে দেন নি।
শৈশব থেকে মহানবী (সা) আল্লাহ্ তৌহিদ বা একত্ববাদের পরিপন্থী কোন প্ৰথা অনুসরণ করেন নি। আল্লাহ্ সব সময় তাঁকে পরিচ্ছন্ন রেখেছিলেন এবং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, নবুয়ত প্রাপ্তির ফলেই নানাবিধ বিষয়ে তাঁর ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন সাধিত হয়নি; নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বেই তাঁর মধ্যে মূর্তিপূজার বিরোধিতা ছিল। তাছাড়া তিনি কুরায়শ সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত খাদ্য কখনও গ্রহণ করেন নি। আরবের লোকেরা মরুভূমির বালুর মধ্যে বিচরণকারী এক ধরনের চতুস্পদ জন্তু আহার করতো। এই জন্তুগুলো দাঁতালো ছিল এবং ইঁদুরের সমগোত্রীয় ছিল। নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে বাল্যে ও যৌবনে রাসূল (সা) কখনও এ ধরনের ইঁদুরের মাংস ভক্ষণ করেন নি। আগেই বলেছি যে, দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত খাদ্য তিনি গ্রহণ করতেন না।
রাসূল (সা)-এর আবির্ভাবের সময় এবং তাঁর নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে মূর্তিপূজা করতেন না এ রকম কিছু লোক ছিলেন। তারা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর অনুসারী ছিলেন। এদেরকে হানিফ সম্প্রদায় বলা হত। রাসূলে খোদা (সা) এদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং এদের আচার ও নিষ্ঠার সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছিলেন। কয়েকজনের নাম আমরা ইতিহাসে পেয়েছি। সুস্পষ্টভাবে না হলেও তাঁরা তৌহিদপন্থী ছিলেন। তাঁদের কয়েকজনের নাম হচ্ছে: কায়েস ইবনে সায়েদ্, ওয়ারাকা ইবনে নওফেল, ওবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশ, ওসমান ইবনে আল হুয়ায়রেস, যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল প্রমুখ।
এঁদের মধ্যে কারও কারও সঙ্গে মহানবী (সা)-এর সাক্ষাত হয়েছে। নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে যারা রাসূলে খোদার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন তাদের প্রত্যেকেই নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন এবং তাঁরা প্রত্যেকেই সম্মানিত ও মর্যাদাবান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এঁদের মধ্যে হযরত আবূ বকর (রা) ছিলেন সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। তিনি বহুকাল যাবত মহানবী (সা)-এর সংসর্গী ছিলেন। এ ছাড়া কুরায়শ বংশের বিশিষ্ট নেতা হাকিম ইবনে হাজাম তাঁর অন্যতম বন্ধু ছিলেন। আমরা জানি, রাসূল (সা) যৌবনকালে ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবনযাপন করতেন। ব্যবসা ক্ষেত্রে তাঁর সততা বিশ্ববিখ্যাত হয়ে আছে। ব্যবসায়ে অংশীদারদের সঙ্গে রাসূলে খোদার ব্যবহার ছিল অত্যন্ত উদার, পরিচ্ছন্ন এবং যথাযথ। এদের সঙ্গে তাঁর কখনও বিরোধ কিংবা মনোমালিন্য তৈরি হয়নি।
কোন প্রকার নিরর্থক এবং উদ্দেশ্যহীন কাজে মহানবী (সা) কখনই অংশগ্রহণ করেন নি। খ্রিস্টান পণ্ডিতগণও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, মহানবীর চালচলন, রীতিনীতি এবং পবিত্রস্বভাব মক্কাবাসীর জন্য দুর্লভ ছিল। তিনি বৈষয়িক বহুবিধ কর্মে জড়িত ছিলেন এটা সত্য এবং ব্যবসা উপলক্ষে তাঁকে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ভ্রমণ করতে হত, কিন্তু তিনি কখনও পরিপূর্ণভাবে বৈষয়িক কর্মে জড়িয়ে পড়েন নি আল্লাহ তা’আলা তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য যার কারণে পার্থিব আকর্ষণ তাঁকে কখনও পথভ্রষ্ট করতে পারেনি। আমরা জানি মক্কা নগরীর তিন মাইল দূরে হেরা নামক একটি পাহাড়ের গুহা ছিল। এই হেরা গুহায় তিনি মাসের পর মাস ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। হেরাগুহায় তিনি যে উপনাসায় থাকতেন সেই উপাসনার প্রকৃতি কি ছিল? বলা হয়ে থাকে যে, সেই উপসানার প্রকৃতি ছিল মানবজন্মের পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা। আমরা পূর্বেই বলেছি, মহানবী (সা)-এর পূর্বপুরুষ হযরত ইবরাহীম (আ) প্রায় একই ধরনের চিন্তা-ভাবনায় নিমগ্ন থাকতেন। তিনি আকাশের তারকারাজি দেখে মনে করেছিলেন সেগুলোই উপাসনার যোগ্য। পরে আকাশে চাঁদের শান্ত দীপ্তি দেখে ভেবেছিলেন যে, এটাই হয়তা আমার প্রভু। কিন্তু দিবসের সূর্যোদয় দেখে ভেবেছিলেন, সূর্য তো অনেক বড় এবং এর দীপ্তিও অসাধারণ। সুতরাং তিনি ভাবলেন সূর্যই হয়তো তার রব। কিন্তু সূর্য যখন অস্তমিত হল তখন তিনি সিদ্ধান্তে এলেন যে, যিনি নভোমণ্ডলের ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টিকর্তা তাঁর প্রতি আমি মনোনিবেশ করছি। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত লেখক কার্লাইল এ সম্পর্কে লিখেছেন : “স্বদেশে ও বিদেশে প্রত্যেক স্থানেই মুহাম্মদ (সা)-এরই মনে অসংখ্য প্রশ্নের উদয় হত, আমি কে? এ অসীম ভূমণ্ডলই বা কি? কে আমার সৃষ্টিকর্তা? তাঁকে পাওয়ার কোন পথ, কোন সূত্র তিনি মানুষকে দান করেন? হেরা পাহাড়ের কঠিন পাথর, তূর পর্বতের আকাশস্পর্শী শৃংগ, জনমানবহীন জঙ্গল এবং উষর মরুপ্রান্তর ইত্যাদির মধ্যে কোনটি কি? এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে? না। নিশ্চয়ই নয়। বরং চলমান সূর্য, দিবারাত্রির আবর্তন, উজ্জ্বল তারকারাজি ও বর্ষণরত মেঘমালা কোনটিই এ প্রশ্নের সমাধান দিতে পারবে না।”
সংস্কৃতির শোভমান প্রকাশ ঘটে মানুষের আচরণে, প্রাত্যহিক কর্মব্যবস্থাপনায়, পোশাক-পরিচ্ছদে, পর্যটনে এবং পরিচ্ছন্ন ইচ্ছার বিকাশে। এসব কিছুই সাধারণভাবে একজন মানুষের চরিত্রে ধরা পড়া কঠিন। কোন না কোন ক্ষেত্রে কোন একটি বিষয়ে মানুষের খর্বতা থাকতে পারে এবং তা থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু রাসূলে খোদা (সা) এমন একজন পূর্ণাঙ্গ পুরুষ ছিলেন যে, কোন ক্ষেত্রেই তাঁর খর্বতা ছিল না। তিনি পরিচ্ছন্ন পুরুষ ছিলেন এবং তাঁর পরিচ্ছন্নতা তাঁর সকল কর্মে প্রকাশ পেত। তিনি একবার বলেছিলেন, মানুষের জীবনে প্রতিটি কর্মের জন্য সময় থাকে। সর্বসময় একই কর্মে মানুষ নিযুক্ত থাকবে এটা ঠিক নয়। ইবাদতের জন্য সময় নির্ধারিত আছে, খাদ্য গ্রহণের সময় নির্ধারিত আছে, বিশ্রামের জন্য সময় নির্বাচিত করে নিতে হয়, নিদ্রার জন্যও সময় আছে। সর্বসময় যে ইবাদতে মগ্ন থাকে সে-ও যেমন পরিপূর্ণতা পায় না, তেমনি সর্বসময়ে যে সাংসারিক কর্মে নিজেকে ব্যতিব্যস্ত রাখে সে-ও পরিপূর্ণতা পায় না। মদীনা শরীফে উসমান বলে রাসূলের এক সাহাবী ছিলেন, ইনি কিন্তু খলিফা হযরত উসমান নন। তিনি সর্বসময়ে ধর্মকর্মে নিযুক্ত থাকতেন। তাঁর মধ্যে এক ধরনের সংসার-বৈরাগ্য উপস্থিত হয়েছিল। তাঁকে লক্ষ্য করে রাসূলে খোদা (সা) সময়ের শাসনের কথা বলেছিলেন। সংসার ত্যাগ করতে চাইলেই মানুষ সংসার ত্যাগ করতে পারে না, বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য গ্রহণ করতে হয়, একজন সন্ন্যাসীও আহারের অন্বেষণে ঘুরে বেড়ায়, বনাঞ্চলে থাকলেও সন্ন্যাসীকেও আত্মরক্ষার জন্য চেষ্টা করতে হয়। সুতরাং রাসূল (সা) ঠিক কথাই বলেছিলেন যে, তুমি সংসার ত্যাগ করতে চাইলেও সংসার তোমাকে জড়িয়ে রাখবে। সে জন্য সকল প্রকার কর্মের জন্য সময় নির্ধারিত রাখা ভাল। এটাই হচ্ছে সৌজন্য, এটাই হচ্ছে সংস্কৃতি। রাসূলে খোদা (সা) একজন পূর্ণাঙ্গ বোধের মানুষ ছিলেন এবং এই পূর্ণাঙ্গ বোধই হচ্ছে সংস্কৃতির পৃষ্ঠভূমি।
রাসূলে খোদা (সা) মিতাহারি ছিলেন। অর্থাৎ তিনি সর্বদাই অল্প আহার করতেন এবং শরীরকে লঘু রাখতেন। তিনি যে আহার করতেন তা যেমন সংক্ষিপ্ত ছিল, তেমনি পরিচ্ছন্ন ছিল। স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এবং শরীরকে গ্লানিমুক্ত রাখার জন্য তিনি যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই আহার করতেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি দ্বিপ্রহরে আহার করেছিলেন সিরকায় ভেজানো রুটি। বিভিন্ন সময় তিনি মধু পান করেছেন এবং একটি-দু’টি খেজুর গ্রহণ করেছেন। গোশ্ত তিনি খেতেন, কিন্তু তাতে প্রবল কোন আসক্তি ছিল না। কালোজিরা খেতেন এবং জীবনে কখনও শরীরকে দূষিত করে এমন খাদ্য গ্রহণ করেন নি। আমরা দেখতে পাই, খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সংস্কৃতিবান পুরুষ।
দৈনন্দিন জীবনে মদীনা শরীফে অবস্থানকালে তিনি পদব্রজে হাঁটতেন, পথে মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত হলে তাদের কুশল জিজ্ঞেস করতেন। শিশুদের কাছে পেলে তাদের নিয়ে আনন্দ করতেন। একবার তিনি যখন হাঁটছেন তখন সামনে দেখলেন যে, একদল বালিকা সম্মিলিতভাবে গান গাইছে। তিনি খুশিমনে তাদের কাছে গেলেন। তারা তাঁকে ঘিরে বেষ্টনী রচনা করে নতুন একটি গান গাইতে লাগলো। গানের বাণীতে ছিল: “আল্লাহ তা’আলাকে অশেষ ধন্যবাদ, তিনি আমাদের মধ্যে এমন একজন পয়গম্বর দিয়েছেন’ যিনি ভবিষ্যত বলতে পারেন।” রাসূল (সা) তাদেরকে এ গানটি গাইতে নিষেধ করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন তারা পূর্বে কি গান গাইছিল। তারা উত্তরে বলল, তারা একটি ফুলের গান গাইছিল। তিনি তাদেরকে ফুলের গান গাইতে বলে হাসিমুখে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি ফুল পছন্দ করতেন এবং সুগন্ধি পছন্দ করতেন। তিনি একবার বলেছিলেন: “তোমার কাছে যদি একটি পয়সা থাকে তাহলে তা দিয়ে খাবার কিনে খেয়ো; কিন্তু যদি দু’টি পয়সা থাকে তাহলে একটি পয়সা খাবারের জন্য রেখে অন্য পয়সাটি দিয়ে ফুল কিনে নিও।” এ কথার মধ্যে রাসূলের বিস্ময়কর সাংস্কৃতিক উদ্ভাসন ধরা পড়ে।
মক্কা বিজয়ের পর বিভিন্ন লোক রাসূলে খোদার (সা) হাতে হাত রেখে শপথ গ্রহণ করে, মহিলারাও শপথ গ্রহণ করে। কিন্তু রাসূল (সা) মহিলাদের হস্ত স্পর্শ করেন নি। তাঁর সামনে পানি ভরা একটি পাত্র ছিল। তিনি সেই পানিতে নিজের ডান হাত ডুবিয়ে তুলে নেন এবং মহিলারা একে একে সেই পানিতে হাত রেখে রাসূলল্লাহ্র কাছে বায়’আত বা দীক্ষা গ্রহণ করেন। পানিতে হাত রাখবার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ পানিতে যেহেতু রাসূলুল্লাহ্ হাত রেখেছিলেন, সুতরাং যারাই এ পানিতে হাত রেখেছেন তাঁরাই রাসূলুল্লাহ্ হাতের স্পর্শ পেয়েছেন এটাই ধরে নিতে হবে। এভাবে পানি ব্যবহার করার ফলে সমস্ত ঘটনাটি একটি কাব্যিক মর্যাদা পায়। পৃথিবীর কোন ধর্মের ইতিহাসে এহেন মধুর দীক্ষা গ্রহণ-পদ্ধতি কখনও ঘটেনি। তিনি যে সংস্কৃতিবান পুরুষ ছিলেন এবং তাঁর যে কাব্যিক অনভূতি ছিল এতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
একটি রেওয়ায়েতে আছে যে, মদীনা শরীফে একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন যে, সামনে রাস্তার পাশে একটি খেজুর গাছের আড়ালে, আবেদনপত্রসহ একটি হাত বেরিয়ে এসেছে। তিনি থমকে দাঁড়ালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন: “এ হাতটি কার, পুরুষের না মহিলার?” খেজুর গাছের আড়াল থেকে উত্তর এলো: “মহিলার”। রাসূল (সা) তখন মন্তব্য করলেন: “মহিলার হাত! তাহলে মেহেদী নেই কেন?” এ কাহিনীতে বোঝা যায় যে, রাসূল (সা) সকল বিষয়ে সঙ্গতি খুঁজতেন এবং সকল ক্ষেত্রেই সুন্দরের প্রতিষ্ঠা ঘটুক এটা চাইতেন। আরবের প্রতিটি মানুষকে তিনি একই সঙ্গে বিশ্বাসে এবং সৌন্দর্য-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।
তিনি যখন তায়েফে গিয়েছিলেন তখন একাকী একটি উষ্ট্রীর পিঠে চড়ে একজন অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। তায়েফবাসীদের হাতে তিনি নির্যাতিত হন। এই কারণে রাসূল (সা) তাদের প্রতি বিরূপ হয়ে কোন অভিসম্পাতবাণী উচ্চারণ করেন নি। তিনি একটি দ্রাক্ষাকুঞ্জে আশ্রয় গ্রহণ করে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করেন, যেন তায়েফবাসী সৎপথে আসে এবং বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়। তিনি বরঞ্চ দুঃখ করেছিলেন নিজের জন্য যে, আল্লাহ তা’আলা তাঁকে কি পরিত্যাগ করেছেন! তিনি একবারও তায়েফবাসীদের কোন ক্ষতি হোক তা চান নি। এখানে যে বিনয় লক্ষ্য করি তা অসাধারণ। তিনি অসাধারণ সংস্কৃতিবান ছিলেন, তাই তাঁর মধ্যে কোন ক্রোধ ছিল না। যত কঠিন শত্রুই হোক না কেন তাদের জন্যও তিনি মুক্তির কথা ভেবেছেন। কেন তিনি একাকী তায়েফে গিয়েছিলেন এর কারণ আমরা জানি না। কিন্তু একটি কথা স্পষ্ট যে, তিনি তায়েফবাসীদের মানসিকতা পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছিলেন এবং যুদ্ধ করে তায়েফ জয় করতে চান নি। অনেক পরে তায়েফ যখন ইসলামের অঙ্গীকারে চলে আসে তখনও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়নি।
যিনি সংস্কৃতিবান তিনি কখনও সংঘর্ষ কামনা করেন না। তিনি সৎ বিবেচনার মাধ্যমে সকলকে অঙ্গীকারে আবদ্ধ করতে চান। রাসূলের জীবন এমনই একটি সংস্কৃতিবান জীবন ছিল। তিনি চাইতেন, যেন সহজ-সরল মানুষগুলো ভয়ে ভীত না হয় এবং তারা যেন নিৰ্ভয় থাকে; শোকার্তগণ যেন প্রীতিলাভ করে এবং যারা উদ্বিগ্ন তারা যেন উদ্বিগ্ন না থাকে। তিনি চাইতেন, যেন মানুষ পাপপরায়ণ না হয়, হীন না হয় এবং মিথ্যাবাদী না হয়। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর ছিলেন। সর্বদাই চাইতেন, যেন অন্যায়কারীর চিত্তশুদ্ধি ঘটে। সংসারযাত্রা নির্বাহের মধ্যে, সামাজিক জীবন প্রবাহের মধ্যে মানুষের সান্নিধ্যে এবং কর্মপ্রবাহের সকল গতিপথে রাসূলে খোদা (সা) পরিচ্ছন্নতা এবং বিশুদ্ধতা কামনা করেছেন। যার ফলে শত্রুও মিত্র হয়েছে এবং অসদ্ভাব থেকে তাঁর মুক্তি ঘটেছিল।
সংস্কৃতিবান তাকেই বলে যিনি বিশুদ্ধতা এবং পরিচ্ছন্নতার সন্ধান করেন। ইসলামে সালাত কায়েম করা বিশুদ্ধতার একটি নিদর্শন। প্রতিবার নামাযের পূর্বে ওযূ করা অর্থাৎ পানি দিয়ে হস্তপদ প্রক্ষালন করা শুচিতা এবং পরিচ্ছন্নতার একটি দিক-নির্দেশনা। ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মের মধ্যে এটা নেই। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা শুধু নামাযের জন্যই নয়, প্রয়োজনবোধে সকল সময়ের জন্যই শরীর এবং মনকে পরিচ্ছন্ন রাখতে বলেছে। এই পরিচ্ছন্নতার মধ্য দিয়েই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।
রাসূলে খোদা (সা) ব্যক্তিগত জীবনে বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন বিবেকবান পুরুষ ছিলেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল এমন এক জায়গায়, যেখানে শুদ্ধতার কোন চিহ্নই ছিল না। যেখানে মানুষে-মানুষে প্রতি মুহূর্তে পাস্পরিক বিরোধিতা ছিল; যেখানে মানুষ নিজের শক্তির উপর নির্ভর না করে দেবতাদের সাহায্য কামনা করতো, সে রকম একটি দেশে রাসূল (সা)-এর আবির্ভাব একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। তিনি সকল অন্যায়কে পরাভূত করে, সকল অপসংস্কৃতিকে দূরীভূত করে একটি ন্যায়শাসিত সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আরবের মানুষ তাদের নিজেদের হাতে তৈরি প্রতিমাগুলোর কাল্পনিক ক্ষমতার কাছে দায়বদ্ধ ছিল। তারা নিজেদের বিচার-বিবেচনার দ্বারা সমস্যার সমাধান করতে জানতো না। তারা প্রতিমার কাছে সাহায্য ভিক্ষা করে পাশব শক্তির সাহায্যে একে অন্যের মুখোমুখী হত। একটি অমানবিক নিষ্ঠুরতার মধ্যে তাদের জীবন পরিচালিত হত। সেই মানুষগুলোর মধ্যে এমন এক পুরুষের আবির্ভাব ঘটলো, যিনি একই সঙ্গে লৌকিক এবং অলৌকিক। লৌকিক এই অর্থে যে, তিনি একজন মানুষ ছিলেন; তাঁর একটি পারিবারিক জীবন ছিল এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড ছিল। অলৌকিক এই অর্থে যে, তাঁর কাছে ফেরেশতা আসতেন এবং মহান প্রভুর মহিমাময় বাণী তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হত। সুতরাং আমরা একথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, তিনি ছিলেন পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা সংস্কৃতিবান, বিবেকবান এবং পরিচ্ছন্ন পুরুষ এবং তা অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ-সকল কালের জন্যই।
***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।