মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এর জীবনী

মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ (১৯০০-১৯৮৬)

বাংলার বিশিষ্ট আলিম, নির্ভীক ও আপোসহীন রাজনীতিক, সংগঠক, কৃষক-প্রজা আন্দোলনের অন্যতম দিশারী, আযাদী আন্দোলনের সেরা নকীব, ইসলামী চিন্তাবিদ

জন্ম : ১৯০০ সালের ২৭ নভেম্বর মুতাবিক ১৩০৭ সনের ১১ অগ্রহায়ণ সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার অন্তর্গত তারুটিয়া (রশিদাবাদ) গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পীর বংশে। পিতা : শাহ সৈয়দ আবূ ইসহাক বিশিষ্ট মুর্শিদ ছিলেন।

সাত দশকের রাজনৈতিক জীবনে মওলানা তর্কবাগীশ বৃটিশ বিরোধী খিলাফত- অসহযোগ আন্দোলন, ঋণ-সালিসি বোর্ড গঠন-আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, বায়ান্নর বাংলাভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচন, বাষট্টির গণমুখী শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের আইয়ুব বিরোধী গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের স্বাধিকার আন্দোলন ও নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ তথা স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মানসপুত্র। তাঁর উপর হোসেন শহীদ সুহরাওয়ার্দীরও বিশেষ প্রভাব ছিল। খিলাফত আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি একবার এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করার দায়ে দ্বিতীয়বার কারাবরণ করেন।

বাল্যকালে মওলানা সাহেব মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। পরে স্কুলে ভর্তি হন ৷ ১৪ বছর বয়সে (১৯১৪ খৃ.) কিশোর আবদুর রশীদ বগুড়া জেলার শেরপুর ডায়মন্ড জুবিলী ইংলিশ স্কুলের ছাত্র থাকাকালে সেই এলাকার পরাক্রমশালী অত্যাচারী জমিদারের অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে শেরপুর বাজারের দুধ-বিক্রেতা কৃষকদের সংঘবদ্ধ করে প্রতিবাদের ঝড় তোলেন।[1] জমিদারের নির্দেশে তাঁর ম্যানেজার দুধের দাম বেঁধে দেয়। ফলে দুধ বিক্রেতা কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। মওলানার হস্ত ক্ষেপের ফলে ঐ অত্যাচার বন্ধ হয়। পরের বছর (১৯১৫ খৃ.) সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় রোধের উদ্দেশ্যে তিনি বগুড়ার প্রখ্যাত কেল্লাকুশি মেলায় স্থাপিত খিলিপট্টি ও কুঁড়ে পট্টির দুটি পতিতালয় উচ্ছেদ করেন।[2]

শেরপুর ডায়মন্ড জুবিলী হাইস্কুলে এনট্রান্স ক্লাসে পড়ার সময় কংগ্রেসী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মওলানা তর্কবাগীশ পড়াশোনা ত্যাগ করে খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং কলিকাতা প্রেসিডেন্সী জেলে ১ বছর (১৯২২-২৩ খৃ.) সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেন। কারামুক্তির পর তিনি ধর্মীয় শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ১৯২৩ সালে দেওবন্দ দারুল উলূম মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে এক বছর অধ্যয়ন করেন।

মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উদ্দেশ্যে তিনি সেখান থেকে ফিরে আসেন। কিন্তু পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে না পারায় তাঁর মিসর যাওয়া সম্ভব হয় নি এরপর তিনি ১৯২৪ সালে লাহোরের ইশাআতুল ইসলাম কলেজে ভর্তি হয়ে তিন বছর (১৯২৪-২৭ খৃ.) অধ্যয়ন করে ধর্মীয় শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ঐ সময় তিনি সেখানে হিন্দুদের শুদ্ধি অভিযানের বিরুদ্ধে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। সেখানে অবস্থানকালে তিনি রাজপাল প্রকাশিত ‘রংগীলা রসুল’ গ্রন্থের বিরুদ্ধে পরিচালিত (১৯২৭ খৃ.) আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।[3]

শিক্ষা-শেষে মওলানা দেশে ফিরে এলেন (১৯২৭ খৃ.)। যোগ দিলেন ‘জমিয়ত- এ-উলামা-এ-হিন্দ’ প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রচারকরূপে।[4] ১৯৩৩ সালে হোসেন শহীদ সুহরাওয়ার্দীর সহযোগিতায় বঞ্চিত রায়ত-খাতকের দুর্দশা ও ঋণভার লাঘবের জন্য তিনি ‘নিখিল বংগ রায়ত-খাতক সমিতি’ গঠন করেন। এর সভাপতি ও সেক্রেটারি ছিলেন যথাক্রমে শহীদ সুহরাওয়ার্দী ও মওলানা তর্কবাগীশ স্বয়ং। শহীদ সুহরাওয়ার্দীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমিতির চাঁচকৈর (নাটোর) সম্মিলনে মওলানা তর্কবাগীশ ঋণ সালিসি বোর্ড গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন (ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩ খৃ.)।[5] এই দাবির সূত্র ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো আন্দোলন। বংগীয় প্রাদেশিক পরিষদে খাজা নাজিমুদ্দীন পাস করলেন ঋণ সালিসি আইন (১৯৩৫-৩৬ খৃ.)। ১৯৩৭ সালে ঋণ সালিসি বোর্ড স্থাপিত হয় এবং ১৯৩৮ সালে কৃষি-খাতক আইন পাস করা হয়।[6]

১৯৩৫ সালে মওলানা তর্কবাগীশ মুসলিম লীগে যোগদান করেন এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালে তিনি মুসলিম লীগের অন্যতম সংগঠকরূপে বাংলা, আসাম ও ভারতের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করে ব্যাপক সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা চালান। বংগীয় প্রাদেশিক আইনসভার একটি শূন্যপদ পূরণের জন্য ১৯৪২ সালে নাটোরে যে উপ-নির্বাচন হয়, তাতে শহীদ সুহরাওয়ার্দী ও তর্কবাগীশের চেষ্টায় মুসলিম লীগ প্রার্থী কাজী আবুল মাসুদ বিপুলভোটে জয়লাভ করেন।[7] ১৯৪০ সালে পাকিস্তান প্রস্তাব পাস হলে মওলানা ঐ প্রস্তাবের সমর্থনে জোরালো আন্দোলন করেন। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থীরূপে উল্লাপাড়া এলাকা থেকে বংগীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন।

সিলেটের রেফারেন্ডামের সময় (জুলাই ১৯৪৭ খৃ.) মুসলিম লীগের তরফ থেকে বংগীয় ছাত্রনেতা শামসুল হককে ছাত্রদের সঙ্ঘবদ্ধ করে ঐ গণভোটে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। মওলানা তর্কবাগীশ তাঁর সহায়তা করেন। তদানীন্তন মুসলিম লীগের অফিস সুপার জনাব তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিঞা) ও ফরমুজল হকসহ চারশ’ ছাত্রকর্মীকে নিয়ে মওলানা সাহেব সিলেটে গিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে আন্দোলন করেন।[8]

১৯৪৯ সালে তিনি পূর্ববংগীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন, পতিতাবৃত্তি উচ্ছেদ, বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৪১ সালের শেষভাগে চাঁচকৈড়ের কয়েকটি গণিকালয় তাঁর কল্যাণে উচ্ছেদ হয়। ১৯৫১ সালে তিনি মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ ও ইসলামের সাম্যনীতি প্রবর্তনের দাবি তুলে ধরেন।[9]

১৯৪৯ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সেক্রেটারি করে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে মুসলিম লীগের বিপরীতে একটি বিরোধী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শহীদ সুহরাওয়ার্দী এবং বলিষ্ঠ ভূমিকায় ছিলেন মওলানা তর্কবাগীশ।[10]

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভংগ করে ঢাকায় মিছিল করে। বর্তমানে যেখানে শহীদ মিনার অবস্থিত, সেখানে তরজার তৈরি মেডিক্যাল কলেজের একটি ছাত্রাবাস ছিল। মিছিলটি সলীমুল্লাহ মুসলিম হলের দিক থেকে সেখানে গিয়ে পৌঁছলে পুলিস কর্তৃক মিছিলের উপর গুলী চালানো হয় ৷ আমি তখন এস.এম. হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। ঐ মিছিলে আমি নিজেও ছিলাম। গুলিবর্ষণের ফলে কয়েকজন ছাত্র শহীদ হন। হোস্টেলের ভিতরেও দুইজন ছাত্র শহীদ হন। সেদিন সাড়ে তিনটায় আগেকার জগন্নাথ হলে[11] পূর্ববংগের প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন আরম্ভ হয়। অধিবেশন শুরু হলে মওলানা তর্কবাগীশ গুলিবর্ষণের ঘটনার জন্য তদন্তের দাবি করেন এবং প্রতিবাদস্বরূপ বাংলাভাষার সমর্থনে আইন পরিষদ ভবন থেকে ওয়াক-আউট করেন। তাঁকে ওয়াক-আউট করতে আমি নিজেও দেখেছি। ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি দিনগত রাত ৩টায় তাঁকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয় এবং কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।[12] দীর্ঘ ১৮ মাস কারাবরণের পর তিনি ১৯৫৩ সালের ৩১ জানুয়ারি মুক্তি লাভ করেন।[13]

১৯৫৩ সালে মওলানা নিখিল পাকিস্তান কৃষক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।[14] ইতিপূর্বেই তাঁকে আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য করে নেয়া হয়। একই বছর (১৯৫৩ খৃ.) ময়মনসিংহের আওয়ামী মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির ৩ দিনব্যাপী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই অধিবেশনে মওলানা যে ভাষণ দেন, তাঁর আলোকেই যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার রূপরেখা প্রণীত হয়। ঐ নীতিমালায় প্রথমেই লিখিত হয়েছিল যে, কুরআন ও সুন্নাহ্ বিরোধী কোন আইন রচিত হবে না।[15] ১৯৫৪ সালে মওলানা যুক্তফ্রন্ট (আওয়ামী মুসলিম লীগ ) থেকে পূর্ববংগের প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন।

২১ দফা অনুসারে আওয়ামী মুসলিম লীগ সরকার চালাতে ব্যর্থ হওয়ায় মওলানা ভাসানী ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ত্যাগ করেন। শেখ মুজিব, সুহরাওয়ার্দী-তর্কবাগীশ কর্তৃক[16] ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়াও (১৯৫৫ খৃ.) ছিল মওলানা ভাসানীর পদত্যাগের অন্যতম একটি কারণ। তখন আওয়ামী লীগের চরম সংকটের দিন। ঐ মুহূর্তে মওলানা তর্কবাগীশ আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ বরণ করায় (১৯৫৫ খৃ.) তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এ দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব টিকে যায়।[17] ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি সভাপতির পদে বহাল ছিলেন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এর উভয় অংশের প্রতিনিধিদের পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়েই পাকিস্তান গণপরিষদ গঠিত হয়। মওলানা পুনর্গঠিত গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন (১৯৫৫ খৃ.)। ১৯৫৫ সালের ১২ আগস্ট তিনি গণপরিষদে সর্বপ্রথম বাংলায় বক্তৃতা করে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেন।[18] আইয়ুব খাঁ প্রণীত ১৯৬২ সালের মৌলিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচন তর্কবাগীশ সাহেব প্রত্যাখান করেন। ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (২রা জানুয়ারি) আওয়ামী লীগ সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন করে। ঐ সময় মিস ফাতেমা জিন্নাহর ঢাকায় আগমন উপলক্ষে পল্টন ময়দানে মওলানা তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে বিশাল নির্বাচনী সভা অনুষ্ঠিত হয়।[19]

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় মওলানা তর্কবাগীশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পাকিস্তান সরকারের প্রতি পুরোপুরি সমর্থন জ্ঞাপন করেন।[20]

১৯৬৮-র দিকে পি ডি এম (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট) গঠিত হলে মওলানা তর্কবাগীশ নেতৃবর্গের অনুরোধে এর নিতৃত্ব দিতে সম্মত হন।[21] শুরু হলো আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়। বন্দী হন অজস্র নেতা। ঊনসত্তরের জানুয়ারিতে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা করে ঐতিহাসিক ১১ দফা। সারা পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ সে আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। পি.ডি.এম-এর পক্ষ থেকে ঢাকার বায়তুল মুকাররম হতে মিছিলের মধ্য দিয়ে ১৪৪ ধারা ভংগের কর্মসূচী নেওয়া হয় ৷ ঐ মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন মওলানা তর্কবাগীশ ও এয়ার মার্শাল আসগর খাঁ।[22]

পাকিস্তানের উভয় অংশে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া খান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে তদানীন্তন পাকিস্তানের সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ নির্বাচনে তর্কবাগীশ উল্লাপাড়া এবং রায়গঞ্জ ও তাড়াশের দু’টি আসন থেকে আওয়ামী লীগের টিকেটে বিপুল ভোটে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।[23]

পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপল্স পার্টি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। ইয়াহিয়া ও ভূট্টোর মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে পরামর্শ হয়। পাকিস্তান এ্যাসেম্বলীতে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর কাজে গড়িমসি শুরু হয়। ক্ষমতাসীন দল শেখ মুজিবকে অগ্রাহ্য করতে লাগলো। ঘোষিত সংসদ অধিবেশন বন্ধ করা হলো। অমনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত সভায় শেখ মুজিবের বক্তৃতাশেষে মওলানা তর্কবাগীশ মুনাজাত পরিচালনা করেন। ২০ মার্চ ইয়াহিয়া খান আলোচনার জন্য ঢাকায় পৌছেন। তিনি ২৫ মার্চ পর্যন্ত আলোচনার ছলে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের নীল নকশা তৈরি করে ঢাকা ত্যাগ করেন। শুরু হয় অঘোষিত যুদ্ধ। মওলানা তর্কবাগীশ ঢাকার বনগ্রামের বাড়ি থেকে পরিবারসহ চলে যান। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর-এ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৭২-এর ১লা জানুয়ারি তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন।[24]

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে (১৯৭১ খৃ.) মওলানা তর্কবাগীশ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তিনি ‘উলামা পার্টি’ গঠন করে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। তিনি ছিলেন ঐ পার্টির সভাপতি।

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের গণপরিষদের ১ম বৈঠকে মওলানা তর্কবাগীশ সভাপতিত্ব করেন। এখান থেকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হয়।[25] তাঁর সভাপতিত্বেই সংসদের স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার ইত্যাদি নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে মওলানা তর্কবাগীশকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয় (১৯৭২ খৃ.)। তিনি দেশের ইসলামী শিক্ষাকে আধুনিক শিক্ষার সাথে সংগতিপূর্ণ করার ব্যবস্থা করেন। ঐ সময় গঠিত হয় মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি। সমিতিরও প্রথম সভাপতি ও সেক্রেটারি হন যথাক্রমে মওলানা তর্কবাগীশ ও মওলানা খন্দকার নাসির উদ্দিন। ১৯৭৩ সালে বাংলাভাষাকে মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমরূপে পরিগণিত করা হয়।[26]

১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর এক শিক্ষক প্রতিনিধি দল নিয়ে মওলানা তর্কবাগীশ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। ঐ বছর হজ্জ প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে তিনি সউদী আরব গমন করেন।

১৯৭৪ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকার মওলানা তর্কবাগীশের পরামর্শ গ্রহণ করেন। তাঁকে বায়তুল মুকাররম মসজিদ ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়।[27] তাঁরই প্রচেষ্টায় ইসলামিক একাডেমি ও বায়তুল মুকাররম সোসাইটিকে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে একীভূত করে প্রতিষ্ঠা করা হয় বর্তমান ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।[28]

১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষিত হয় এবং ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী এনে প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম চালু করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ‘বাকশাল’ গঠন করা হয়। মওলানা তর্কবাগীশকে বাকশালে যোগদানের জন্য অনুরোধ করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ১৯৭৬ সালে ‘গণআজাদী লীগ’ গঠন করে ঐ দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।[29]

১৯৭৮-এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে মওলানা তর্কবাগীশের নেতৃত্বে দশ দলীয় ঐক্য জোট গঠিত হয় এবং কর্নেল উসমানীকে সেই জোটের তরফ থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী করা হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তাঁকে শহীদ করা হয় ১৯৮১ সালের ৩০ মে। আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। এরপর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়।[30] ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে মওলানা তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে তাঁর বনগ্রামের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয় এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৫ দলীয় মোর্চা গঠন করা হয়। এটা ছিল তাঁর জীবনের শেষ সংগঠন।[31]

এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট মুতাবিক ১৩৯৩ সনের ৩ ভাদ্র বুধবার ঢাকার পি.জি. হাসপাতালে ইন্তিকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। সে দিন বাদ আসর বায়তুল মুকাররম মসজিদে তাঁর নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় বনানীতে তাঁকে দাফন করা হয়।

মওলানা তর্কবাগীশ একজন নামজাদা যুক্তিবাদী ও বাগ্মী ছিলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল জলদগম্ভীর। তাই তাঁকে বলা হতো ‘তর্কবাগীশ’। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের নিকট থেকেই তিনি প্রথম জীবনে এই আখ্যা লাভ করেছিলেন।[32] তিনি কেবল গণতন্ত্রপ্রবণ রাজনীতিকই নন, চিন্তাশীল লেখকও ছিলেন। তাঁর কয়েকটি বইয়ের মধ্যে ‘সমকালীন জীবনবোধ’ ও ‘শিরাজী স্মৃতি’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

মওলানা আবদুর রশীদ ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলিম ও ইসলামী চিন্তাবিদ। কিন্তু তিনি কোন সময় নিজেকে আলিম বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চান নি। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণের হিতার্থে তিনি কাজ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষা-দর্শন ছিল দীন-দুনিয়ার সমন্বয়ধর্মী। তিনি মনে করতেন : “বাস্তববর্জিত ধর্মশিক্ষা কোন জাতি গঠনে সমর্থ নয় এবং ধর্মবর্জিত বাস্তব শিক্ষাও কোন জাতিকে নিষ্কলুষ চরিত্র দান করতে পারে না।[33] তাঁর বিশ্বাস ছিল, কেবল কুরআনের নীতিমালার বাস্তবায়নের মাধ্যমেই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।[34] তিনি শ্রেণীহীন ও শোষণহীন সমাজ কামনা করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, প্রাথমিক যুগেও খলীফাদের শাসনকালে ইসলামে যথার্থ সামাজিক সহঅবস্থান বিদ্যমান ছিল। তাই আমাদেরকেও সেই আদর্শ ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বক্ষণ চেষ্টা করতে হবে।[35] তিনি মুসলমানের জীবনকে কোনমতেই ইসলাম থেকে পৃথক করে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি পীরবংশে পয়দা হন কিন্তু পীর-মুরীদীকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেছেনঃ

শুধু মাত্র ধর্মীয় শিক্ষার ফলস্বরূপ, আধ্যাত্মিক জীবন উন্নয়নের জন্য, স্রষ্টার সংগে সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য একদল মাধ্যম দাঁড়িয়ে যায়। অথচ ইসলামের মৌলিক শিক্ষা স্রষ্টা অর্থাৎ আল্লাহর সংগে মানুষের আত্মিক উন্নয়নে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে। এ ক্ষেত্রে কোন মাধ্যম নেই। কিন্তু অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামেও পৌরহিত্য প্রথা সৃষ্টি করা হয়েছে।[36]

মওলানা তর্কবাগীশ মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কার কামনা করেন এবং ‘বাংলাদেশ ইসলামী শিক্ষা সংস্থার সভাপতি এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড’-এর সভাপতিরূপে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের প্রয়াস পান। তিনি দেশে বিভিন্ন পদ্ধতির শিক্ষা না রেখে সামগ্রিকভাবে একই পদ্ধতির শিক্ষা প্রবর্তনের প্রয়াসী ছিলেন।[37] তাঁর রাজনীতি ধর্মবিবর্জিত ছিল না। তিনি বলেছেনঃ

ধর্মের সংগে রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। রাজনীতির মর্মকথা : নিজের অধিকারকে যেমন সুপ্রতিষ্ঠিত করা, তেমনি অন্যের অধিকারকে স্বীকার করে নেয়া। নিজের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অন্যের অধিকার বিন্দুমাত্র খর্ব করা চলবে না। এই সত্য যদি দুনিয়ার সকলেই পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতো, তাহলে দুনিয়ায় পরস্পরের মধ্যে বিরোধ ও যুদ্ধ ঘটতো না।

তথ্যসূত্রঃ

[1] আবুল কাসেম, ডঃ মাসিক মোহাম্মদী, ৪র্থ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, মাঘ ১৩৩৭/১৯৩০, পৃ. ২৫৭।

[2] আবুল কাসেম, ডঃ মাসিক মোহাম্মদী, ৪র্থ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, মাঘ ১৩৩৭/১৯৩০, পৃ. ২৫৭।

[3] ঐ।

[4] সৈয়দ আসগর আলী শাহ্‌ জাফরী, তারীখ-এ-ইরান (উর্দু), উর্দু বাজার, লাহোর, ১৯৬৭, পৃ. ৭১৮-৭২০।

[5] আবুল কাসেম, মোহাম্মদ, ডঃ।

[6] ঐ।

[7] The Mussalmans, Friday December, 19, 1930.

[8] Ibid.

[9] Ibid.

[10] The Hablul Matin, Calcutta, December 1, 192.

[11] Ibid. 15, 1915

[12] আবুল কাসেম, মোহাম্মদ, ডঃ এ।

[13] সওগাত (সম্পাদকীয়), ৪র্থ বর্ষ ২য় সংখ্যা, শ্রাবণ ১৩৩৩/৯২৬, পৃ. ১২০।

[14] সওগাত (সম্পাদকীয়), ৪র্থ বর্ষ ২য় সংখ্যা, শ্রাবণ ১৩৩৩/৯২৬, পৃ. ১২০।

[15] মোহাম্মদী, ৫ম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, ফাল্গুন, ১৩৩৮/১৯৩১।

[16] ঐ।

[17] ঐ।

[18] ওহীদ, মুহাম্মদ, মির্যা (সম্পা), দায়েরা-এ-মাআরিফ-এ-ইসলামিয়া, ৭ম খণ্ড, লাহোর, ১৯৭১, পৃ.- ৩৭৭-৭৮।

[19] মোহাম্মদী, ৪র্থ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, মাঘ ১৩৩৭/১৯৩০, পৃ. ২৫৭।

[20] হুমায়ুন আবদুল হাই, মুসলিম সংস্কারক ও সাধক, ঢাকা ১৯৭৬, পৃ. ১০৩।

[21] ঐ, পৃ.১০৪।

[22] ঐ, পৃ. ১০৪।

[23] রুহল আমিন, মোহাম্মদ, হজরত পীর সাহেব, পৃ. ২৭২।

[24] আবদুল হাকীম সম্পাদিত বাংলা বিশ্বকোষ (১), ঢাকা ১৯৭২, পৃ. ১৮১।

[25] রুহল আমিন, মোহাম্মদ, পৃ. ৬৯, ২৭২।

[26] শরিয়তে এসলাম, ১০ম বর্ষ, ৮ম সংখ্যা, ভাব্ব ১৩৪২/১৯৩৫ খৃ.।

[27] হুমায়ুন আবদুল হাই ,পৃ. ১০৪।

[28] বার্ষিক সওগাত ১৩৩৩, আশ্বিন ১৩৮৩, পৃ. ১৩৮৩।

[29] রুহল আমিন, মোহাম্মদ, পৃ. ৪০৬।

[30] ইসলাম দর্শন, ১ম বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, কার্তিক ১৩২৭/১৯২০, পৃ. ২৯১।

[31] শরিয়তে এসলাম, ৫ম বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা, আষাঢ় ১৩৩৭ বাংলা/ ১৯৩০ খৃ. পৃ. ১৪২-৪৩.

[32] ছুন্নত অল-জামায়াত, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, চৈত্র ১৩৪৫/ ১৯৩৯ খৃ. পৃ. ১৮৭।

[33] ঐ, ৪র্থ বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ১৩৪৪ বাং/১৯৩৭ খৃ, পৃ. ৫৬।

[34] আবু ফাতেমা মোহাম্মদ ইসহাক , ফুরফুরা শরীফের গীর হযরত মওলানা শাহ সুফী আবু বকর সিদ্দিকী, ঢাকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৮, পৃ. ১০৪।

[35] ইসলাম দর্শন, ১ম বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, কার্তিক ১৩২৭/১৯২০, পৃ. ২৯৬।

[36] মাসিক মোহাম্মদী, বৈশাখ ১৩৪৬/ ১৯৩৯, পু. ৫১৮।

[37] আবু ফাতেমা মোহাম্মদ ইসহাক, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৫।

সূত্র: বঙ্গীয় রাজনীতিতে উলামার ভূমিকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে সংগৃহীত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan