ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দুদুমিয়ার লড়াই
দুদমিয়ার জীবনী
রচনায়: মুনতাসীর মামুন
১
দুদুমিয়ার পুরো নাম মুহসিন উদ্দিন আহমদ। জন্ম মাদারীপুরের মুলফতগঞ্জ থানায়, ১৮১৯ সালে। পিতার একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি৷ হাজী শরীয়তউল্লাহ ছেলের পড়াশোনার ব্যাপারে বেশ মনোযোগ দিয়েছিলেন। বারো বছর পর্যন্ত তিনি দুদুমিয়াকে নিজের কাছে রেখে ফার্সি ও আরবি শিখিয়েছেন। তারপর তাঁকে উচ্চ শিক্ষার জন্যে পাঠিয়ে দিলেন মক্কায়।
দুদুমিয়া মক্কা যাওয়ার পথে কলকাতায় ছিলেন কয়েকদিন এবং সে সময় তিতুমীরের সঙ্গে দেখা করার জন্যে কলকাতা থেকে তিতুমীরের গ্রামে যান। তিতুমীর আদর করে কিশোর দুদুমিয়াকে উপহার দিয়েছিলেন এক ছড়া তসবী। শোনা যায়, এ উপহার নাকি দুদুমিয়া কখনও হাত ছাড়া করেননি।
পাঁচ বছর মক্কায় থাকার পর তিনি ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। শরীয়তউল্লাহ তখন আবার ছেলের লেখাপড়ার ভার তুলে নেন নিজের হাতে।
ইতোমধ্যে ফরায়েযী আন্দোলন দানা বাধছে। জমিদারদের সঙ্গে মাঝে মাঝে বিরোধ বাধছে। আর দুদুমিয়াও আন্দোলন সংগঠনে সাহায্য করছেন পিতাকে। আস্তে আস্তে জমিদারদের সঙ্গে ফরায়েযীদের বিরোধ আরো তীব্র হয়ে উঠল। দুদুমিয়া চাইলেন এর প্রতিকার করে জমিদারদের সমুচিত শাস্তি দিতে এবং তাই তিনি বেশি মনোযোগ দিলেন আন্দোলন সংগঠনে। কারণ বিশৃঙ্খল কোন কিছুই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না।
জমিদারদের সঙ্গে লড়াই করতে হলে বা জমিদারদের লাঠিয়ালদের মোকাবিলা করতে হলে ফরায়েযীদের নিজেদের লাঠিয়াল থাকতে হবে। সুতরাং দুদুমিয়া ফরায়েযীদের অনেককে লাঠি চালনা শিক্ষা দিলেন, শুরু করলেন তাদের নিয়ে নিয়মিত শরীর চর্চা এবং কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল বেশ বড়সড় একটি ফরায়েযী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে উঠেছে।
১৮৪০ সালে মারা গেলেন শরীয়তউল্লাহ। ফরায়েযী আন্দোলনের নতুন নেতা কে হবেন? ফরায়েযীরা সবাই একত্রিত হয়ে বৈঠক করে ঠিক করল তাদের নতুন নেতা বা ওস্তাদ হবেন দুদুমিয়া।
ওস্তাদ নির্বাচিত হওয়ার পর দুদুমিয়া দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আন্দোলনে। মন দিলেন সংগঠনের দিকে। ঠিক করলেন জমিদারের শোষণ, উৎপীড়ন থেকে মুক্তি দিতে হবে কৃষকদের। এ সময় থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত দুদুমিয়া শুধু সংগ্রাম করে গেছেন। শুধু তাই নয়, এ সময় থেকেই আমরা দেখি ফরায়েযী আন্দোলনের রূপ বদলে গেছে। ধর্মীয় আন্দোলন থেকে হয়ে উঠছে তা কৃষক আন্দোলন৷
২
কানাইপুরের শিকদার এবং ফরিদপুরের ঘোষ—এই দুই পরিবার ছিল তখন ফরিদপুর জেলার দুই জবরদস্ত জমিদার পরিবার। তাদের সঙ্গেই দুদুমিয়ার প্রথম বিরোধ শুরু হল। এই দুই জমিদার পরিবার অকারণে ফরায়েষীদের ওপর অত্যাচার চালাত। ফরায়েযী রায়তদের কাছারিতে ডেকে এনে বেত মারত বা শরীরে ডেঁয়ো পিঁপড়ের বাসা ভেঙে দিত। অনেক সময় বুক পর্যন্ত কাঁদায় ডুবিয়ে রাখত। কিন্তু তাতেও তারা দমাতে পারেননি ফরায়েযী প্রজাদের। যারা একবার ফরায়েযী হয়েছে বা দুদুমিয়ার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে তাদের দমানো এত সহজ ছিল না। জমিদারদের এ অত্যাচার থেকে তাঁর সাগরেদদের বাঁচানোর জন্যে দুদুমিয়া ভাবলেন—না এবার জমিদারদের ছেড়ে দেয়া যায় না। ১৮৪১-৪২ সালে তাই তিনি পর পর আক্রমণ করলেন এই দুই জমিদার পরিবারকে।
শিকদার আর ঘোষ পরিবার জোট বেঁধেছিল দুদুমিয়ার বিরুদ্ধে। ফরায়েযীরা ঈদের সময় কোরবানী দিত। জমিদাররা এটা আবার পছন্দ করত না। কালীপূজা বা দুর্গাপূজার সময় অন্যায়ভাবে কর আদায় করত রায়তদের থেকে। কিন্তু ফরায়েযীরা জমিদারদের এ দুটি কর দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষেপে গেল জমিদাররা। রায়তদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্যে তাদের ওপর বাড়িয়ে দিল অত্যাচারের মাত্রা। যেমন একবার, দু’জন ফরায়েযী ধরে এনে পরস্পরের দাড়ি বেধে দিয়ে তাদের নাকের ভেতর ঢেলে দিল মরিচগুঁড়ো। ভাবো একবার।
দুদুমিয়া প্রথমে ঠিক করলেন, কানাইপুরের জমিদারকে শায়েস্তা করবেন। ১৮৪১ সনে তিনি তাঁর প্রধান সাগরেদ জালাল উদ্দিন মোল্লা ও প্রায় একশো ফরয়েযী স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে আস্তানা গাড়লেন কানাইপুরের জমিদারের বসতবাড়ির সামনে। তারপর জমিদারকে খবর পাঠিয়ে বললেন, জমিদার যদি প্রজাদের সঙ্গে আপোষ না করেন তাহলে তার বাড়ির প্রতিটি ইট খুলে নেয়া হবে। বেদম ভয় পেয়ে শিকদাররা দুদুমিয়ার কথা মেনে নিলেন। ঠিক হল কানাইপুরের জমিদার প্রজাদের ওপর আর অত্যাচার করবেন না বা তাদের কাছে অন্যায় কোন করও চাইবেন না।
শিকদারদের শায়েস্তা করার পর উল্লসিত হয়ে উঠল ফরায়েযীরা। পরের বছর আটশো ফরায়েযী আক্রমণ করল ফরিদপুরের জমিদার জয়নারায়ণ ঘোষের বাড়ি। জমিদার বাড়ি লুট করে ফেরার সময় তারা সঙ্গে নিয়ে যায় জয়নারায়ণের ভাই মদন ঘোষকে। মদন ঘোষকে পরে হত্যা করে ফেলে দেয়া হয় পদ্মায়। ইংরেজরা পর্যন্ত তাদের নথিপত্রে স্বীকার করেছে—লুটপাট বা হত্যার জন্যে আসলে ফরায়েযীরা ঘোষদের বাড়ি আক্রমণ করেনি। জমিদারের এতদিনের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যেই তারা আক্রমণ করেছিল জমিদার বাড়ি।
এ ঘটনার পর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ১১৭ জন ফরায়েজীকে গ্রেফতার করেন। পরে আদালতে হাজির করেন ১০৬ জনকে। এদের মেধ্য ২২ জনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
এর পর বিদ্যুতের মতো গরিবের রক্ষক হিসেবে দুদুমিয়ার নাম ছড়িয়ে পড়ে। ফরিদপুর, পাবনা, বাখরগঞ্জ, ঢাকা, নোয়াখালীতে দুদুমিয়ার নাম জানত না এমন লোক তখন খুব কম ছিল। ফরায়েযীদের প্রভাব প্রতিপত্তিও বেড়ে গেল। এক হিসাবে জানা গেছে ১৮৪৩ সালে পূর্ব বঙ্গে ফরায়েযীদের সংখ্যা ছিল প্রায় আশী হাজার।
৩
দুদুমিয়া শুধু জমিদারদের অত্যাচার থেকে কৃষকদের বাঁচাতে চাননি। ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করে স্বাধীন এক রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও তিনি দেখতেন। এ জন্যে শুধু ফরায়েযীদের সংগঠন করাই নয়, গ্রামের গ্রামে ঘুরে ঘুরে তাঁর মতামত প্রচার করতেন, ফরায়েযীদের মধ্যে এক ধরনের শাসন ব্যবস্থাও চালু করেছিলেন তিনি।
দুদুমিয়া বলতেন, মানুষ সবাই সমান এবং আল্লাহ্ এই দুনিয়াতে কর বসানোর অধিকার কোন মানুষেরই নেই। তিনি আরো বলতেন, জমি আল্লাহর দান। সুতরাং তা শুধু ব্যক্তিগত কাজের জন্যে কেউ দখল রাখতে পারে না। সুতরাং কৃষকরা যে তাঁকে মানবে এ আর অস্বাভাবিক কি !
তিনি ফরায়েযীদের গ্রামে গ্রামে পঞ্চায়েতের মতো এক ধরনের সভা চালু করেন। গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক ফরায়েযীর অধীনে একটি আদালত বসত। সেই আদালত সব ধরনের বিরোধের বিচার করত এবং এর রায় ফরিয়াদী আসামী, দু’পক্ষকেই মেনে নিতে হত। কোম্পানী সরকারের আদালতে কেউ গেলে তাকে দেয়া হতো কঠিন শাস্তি।
দুদুমিয়া পুরো পূর্ব-বাংলাকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করেছিলেন। প্রতি অঞ্চলে নিযুক্ত করেছিলেন তাঁর একজন প্রতিনিধি বা খলিফা। প্রত্যেক খলিফা তাঁর নিজ নিজ অঞ্চলের ফরায়েযীদের সংগঠিত করতেন, তাঁদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করতেন আন্দোলন চালাবার জন্যে। দরকার পড়লে কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের ফরায়েযীদের সাহায্য করা হতো। কোন জমিদার যদি কোন ফরায়েজীর বিরুদ্ধে ইংরেজ আদালতে মামলা করত তাহলে ঐ অঞ্চলের খলিফা সেই ফরায়েজীর মামলা চালানোর বন্দোবস্ত করতেন। দরকার হলে পাঠাতেন লাঠিয়াল। এছাড়া ছিল গুপ্তচর বাহিনী। তারা বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত। কোথাও কেউ প্রজাদের বিরুদ্ধে অত্যাচার করলে সঙ্গে সঙ্গে তারা দুদুমিয়াকে জানাত। দুদুমিয়াও সঙ্গে সঙ্গে সাহায্যের বন্দোবস্ত করতেন।
দুদুমিয়া শুধু জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাননি। তিনি চেয়েছেন নীলকরদের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে। কারণ নীলকররাও ভয়ানক অত্যাচার চালাত প্রজাদের ওপর। তাদের নীল বুনতে বাধ্য করত। যা হোক নিজের সংগঠন গুছিয়ে দুদুমিয়া কৃষকদের নির্দেশ দিলেন তারা যেন জমিদার ও নীলকরদের খাজনা না দেয়। মহাজনদের ঋণও যেন শোধ না করে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজন হলে যেন জমিদারের জমি ছেড়ে সরকারি খাস জমিতে চলে যায়৷
প্রমাদ গুণলেন জমিদার নীলকর সবাই। জোট বাঁধলেন তারা। তাদের সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে এলো ইংরেজ জজ-ম্যাজিস্ট্রেট এবং হিন্দু মুসলমান ধনীরা। অন্যদিকে দুদুমিয়ার পক্ষে ছিলেন শুধু ফরায়েযীরাই নয়, অন্য সম্প্রদায়ের কৃষকরাও। কারণ তারা সবাই চেয়েছিল জমিদার নীলকরের অত্যাচার থেকে বেঁচে থাকতেন। দু’মুঠো খেতে আর মোটা কাপড় পরে ছেলে মেয়েদের নিয়ে শান্তিতে থাকতে।
এর পরে যেসব ঘটনা ঘটল তার সঙ্গে তোমরা দেখবে তিতুমীরের ঘটনার কত মিল।
৪
মাদারীপুরে এন্ড্রু এন্ডারসন ডানলপ নামে ছিলেন এক নীলকর। জমিদারদের সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন তিনি। ডানলপ ও তার কর্মচারীরা বাধা দিত ফরায়েযীদের তাদের ধর্মেকর্মে। ফরায়েযীরা এর প্রতিবাদ জানাত। ডানলপ হয়ে উঠেছিলেন দুদুমিয়ার প্রধান শত্রু।
ডানলপের গোমস্তার নাম ছিল কালীপ্রসাদ কাঞ্জিলাল। জমিদারদের মত ব্যবহার করত সে। ধানক্ষেতে সে জোর করে কৃষকদের নীল বুনিয়েছিল। শুধু তাই নয় যেসব ফরায়েযী কৃষক দাড়ি রেখেছিলেন তাদের দাড়ির ওপর কর বসিয়েছিল। ডানলপের কুঠি ছিল মুলাফতগঞ্জের পাঁচচরে। দুদুমিয়া ডাকসাইটে দু’জন জমিদারকে শায়েস্তা করার পর এবার নজর দিলেন ডানলপের দিকে। অবশ্য ঘটনার জন্যে ডানলপই দায়ী। কারণ (বাংলা সন) ১২৫৩-এর ২১ অগ্রহায়ণ কালীপ্রসাদ তার সাত আটশো সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আক্রমণ করেছিল দুদুমিয়ার বাড়ি। তারা দুদুমিয়ার বাড়ির দেড় লাখ টাকার জিনিসপত্র লুট করে, খুন করে চারজন রক্ষীকে, আহত করে কয়েকজনকে। দুদুমিয়ার পক্ষ থেকে ম্যাজিস্ট্রেটকে সব জানানো হল কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনা তদন্ত করার ব্যাপারে কোন উৎসাহ দেখালেন না।
অন্যদিকে ডানলপ দারোগার কাছে এক অভিযোগ জানালো যে, দুদুমিয়ার অনুচররা তার কুঠির চারপাশে ঘুর ঘুর করছে, বিনা অনুমতিতে আস্তানা গড়ছে। শুধু তাই নয় দারোগাকে ঘুষ খাইয়ে দুদুমিয়াকে অপহরণ করে নিয়ে গেল পাঁচচড়ে। আটকে রাখল দুদুমিয়াকে সেখানে দু’দিন যাতে তিনি কোথাও কোন জবানবন্দী দিতে না পারেন। দু’দিন পর মুক্তি পেয়ে দুদুমিয়া এলেন ফরিদপুরে সব কিছু জানিয়ে ঘটনা তদন্তের আবেদন জানালেন ম্যাজিস্ট্রেটকে। ম্যাজিস্ট্রেট দুদুমিয়াকে পরামর্শ দিলেন আপোষে সব কিছু মিটিয়ে ফেলতে। রাজি হলো না দুদুমিয়া। তখন ম্যাজিস্ট্রেট বললেন ঠিক আছে, ঘটনা তিনি তদন্ত করবেন।
প্রায় আড়াই মাস দুদুমিয়া ম্যাজিস্ট্রেটের পিছে পিছে ঢাকা-ফরিদপুর ঘুরলেন, শুধু এ কারণে যে, ঘটনার যেন সুষ্ঠু তদন্ত হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ঘুরে বেড়ান, মহিষ শিকার করতে যান, কিন্তু তদন্তের কথা কিছু বলেন না। কিন্তু দুদুমিয়াও ছাড়েন না। ইতোমধ্যে অবশ্য দুদুমিয়া তাঁর এক সাগরেদকে পাঠিয়েছেন, নারায়ণগঞ্জে কাদের বক্সের কাছে। কাদের বক্স দুদুমিয়ার একজন প্রধান সাগরেদ। খবর পাঠানোর অর্থ কাদের বক্স যেন শীঘ্রি কোন ব্যবস্থা নেন। দুদুমিয়া যখন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ঘোরাঘুরি করছেন কাদের বক্স তখন ফরায়েযীদের এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলেন পাঁচচড়ের নীলকুঠি। তচনচ করে দিলেন কুঠি এবং ফেরার সময় তুলে নিলেন অত্যাচারী গোমস্তা কালিচরণ কাঞ্জিলালকে। তারপর কাঞ্জিলালকে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেয়া হলো নদীতে।
ডানলপ নালিশ জানালেন দুদুমিয়া ও তাঁর সাগরেদদের বিরুদ্ধে। ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ম্যাজিস্ট্রেটের এখন একদিনও সময় লাগলো না। তিনি দুদুমিয়া ও তাঁর তেষট্টি জন সাগরেদকে আদালতে হাজির করলেন। আদালতের বিচারকরা আসামীদের কোন কথায়ই কর্ণপাত করলেন না। দোষী সাব্যস্ত হল তাঁরা সবাই। বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেয়া হলো তাঁদের। কিন্তু দুদুমিয়ার পক্ষ থেকে কলকাতার উচ্চ আদালতে আপীল করা হলো। উচ্চ আদালত কিন্তু তাঁদের মুক্তি দিলেন। দুদুমিয়ার কথা ফিরতে লাগলো সবার মুখে মুখে। তাঁকে নিয়ে লেখা হলো পুঁথি, রচিত হলো ছড়া। এ ঘটনা সম্পর্কে একটি পুঁথিতে লেখা হয়েছিল—
“ফরিদপুর জিলাধীন পাঁচচড় পর।
বাঙ্গালার নীলকুঠি ছিল তথা বড়৷।
কালী কাজলিয়া ছিল কর্মচারী বড়।
উৎপীড়ন করিত বর মোসলমান পর৷।
একদিন মিঞার শিষ্য কাদের বক্স জান।
দুদুমিঞার এসারায় লিয়া মুরিদান॥
বেইমানের তরে সবে মারিয়া ফেলিল।”
৫
ডানলপের সঙ্গে দুদুমিয়ার লড়াই বেঁধেছিল ১৮৪৭ সালে। এর পর দশ বছর বলা যেতে পারে দুদুমিয়ার গায়ে আর কেউ হাত ছোঁয়াতে পারেনি। জমিদার নীলকররাও মোটামুটি থাবা গুটিয়েছিল। দুদুমিয়া তখন পূর্ব-বাংলায় পরিচিত গরিবের বন্ধু হিসেবে। দেশের ভালোর জন্যেই শুধু তিনি লড়াই করেন। তাঁর সম্পর্কে গ্রামের লোকেরা তখন বলত-‘দুদুমিয়া তাম দিয়া রাজ্য ভালা করে’।
১৮৫৭। সিপাহীরা বিদ্রোহ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। দুদুমিয়ার ওপর ইংরেজরা তীব্র নজর রেখেছে। কে জানে কখন তিনি আবার তাঁর সাগরেদদের নিয়ে বিদ্রোহ করেন। এরি মধ্যে নাকি দুদুমিয়া একদিন বলেছিলেন যে, তিনি যে কোন সময় ডাক দিলে পঞ্চাশ হাজার লোক নিমিষে জড়ো হবে। এ কথা শুনেই ইংরেজরা কাবু। জলদি তাঁকে গ্রেফতার করে পাঠানো হলো কলকাতায়। সিপাহী বিদ্রোহ চুকেবুকে গেলে ১৮৫৯ সনে মুক্তি দেয়া হলো তাঁকে। কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরছেন, কিন্তু বিনা কারণে পথে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হলো এবং আটক করে রাখা হলো ফরিদপুর জেলে। ১৮৬০ সালে মুক্তি পেলেন তিনি।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে দুদুমিয়া সোজা চলে এলেন ঢাকায়। ঢাকায় ১৩৭, বংশাল রোডে থাকতেন তিনি। এ সময় শরীরও তেমন ভালো ছিল না। কারণ দীর্ঘদিন জেলে থাকার ফলে শরীরও তাঁর সুস্থ ছিল না৷ বংশাল রোডের বাড়িতেই ১৮৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুদুমিয়া পরলোক গমন করেন। বাড়ির উঠোনেই কবর দেয়া হয় তাঁকে তোমরা যদি কেউ বংশাল রোডের ঐ বাড়িতে যাও, তাহলে এখনও অনাড়ম্বর দুদুমিয়ার মাজারটি দেখতে পাবে।
তিতুমীরের ওয়াহাবী আন্দোলন আর শরীয়তউল্লাহ বা দুদুমিয়ার ফরায়েযী আন্দোলনের মধ্যে ধর্মীয় পার্থক্য অবশ্য কিছুটা ছিল কিন্তু প্রাথমিকভাবে দুটি আন্দোলনের লক্ষ্যই ছিল ইসলাম ধর্মকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে শুদ্ধ করে তোলা। ধর্মের নামে তাঁরা গরিব কৃষককে খানিকটা হলেও একতাবদ্ধ করে তুলতে পেরেছিলেন।
ফরায়েযী আন্দোলন প্রথম দিকে ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু আর সম্পূর্ণ ধর্মীয় থাকেনি। এর সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যও যুক্ত হয়েছিল। জমিদার ও নীলকরের অত্যাচার থেকে যেহেতু ফরায়েযীরা নিজেদের মুক্ত করতে চেয়েছে সেহেতু আমরা দেখি হিন্দু কৃষকদের একটা অংশও ফরায়েযীদের সাহায্য করেছিল। কারণ গরিব কৃষকের কাছে ধর্ম থেকেও অন্ন বড়। পেট পুরে দু’বেলা খেতে পারলেই সে অন্য কথা চিন্তা করতে পারে। আর দুদুমিয়া তো শুধু জমিদারি অত্যাচার নয় তিনি স্বাধীন সরকার পর্যন্ত গঠন করেছিলেন। যা আবার কৃষকদের ইংরেজদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল।
কিন্তু তিতুমীরের আন্দোলনের মত ফরায়েযী আন্দোলন সফল হয়নি। কারণ নেতৃত্বের অভাব। দুদুমিয়ার মৃত্যুর পর ফরায়েযীদের মধ্যে এমন কোন নেতা ছিলেন না যিনি এই আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখতে পারেন বা নেতৃত্ব দিতে পারেন। এছাড়া কৃষকদের মুক্তি কামনা করলেও ফরায়েযীদের ধর্মীয় গোঁড়ামি অনেক সময় আন্দোলনের জন্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্দোলনের সময় দরকার ছিল কৃষকদের সাধারণ শত্রু জমিদার নীলকর আর ইংরেজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে সব সম্প্রদায়ের কৃষকের একতা। কিন্তু ফরায়েযীরা ধর্মীয় কারণে সব সময় সব সম্প্রদায়ের কৃষকদের একতাবদ্ধ করতে পারেনি। তাছাড়া আন্দোলনের যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তারা কি চান- সে সম্পর্কে তাদের কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। সুতরাং উদ্দেশ্যহীন আন্দোলনের অবস্থা তো দাঁড় ছাড়া নৌকার মতই হবে এবং সে কারণে এ আন্দোলন আর টিকে থাকেনি৷
তবে ফরায়েযী বা তিতুমীরের আন্দোলনের অনেক দোষত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু এ কথাতো সত্যি যে, তাদের আন্দোলন অগণিত কৃষকের মনে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছিল যা কখনও কখনও ইংরেজদের হতচকিত করেছে। তারা এমন এক সময়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন যখন সাদা চামড়ার একজন লোক দেখলেই সবাই ভয়ে নুয়ে পড়ত। আর সে জন্যে তিতুমীর বা দুদুমিয়া আমাদের কাছে সংগ্রামের প্রতীক। সাহসের প্রতীক।