অধ্যাপক আ ত ম মুছলেহ উদ্দিন: জ্ঞান গবেষণার এক মূর্ত প্রতীক

অধ্যাপক আ ত ম মুছলেহ উদ্দিন: জ্ঞান গবেষণার এক মূর্ত প্রতীক
(মৃত্যু: ২৩.২.২০১৪)
লিখেছেন : ডঃ আবম সাইফুল ইসলাম সিদ্দিকী
অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক আমার পিএইচডি এর সম্মানিত তত্ত্বাবধায়ক। ট্রিপল এমএ ( আরবি উর্দু ও ফার্সি) ডিগ্রিধারী আমার স্যার বিভাগের চেয়ারম্যান ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনো প্রশাসনিক পদে ছিলেন না।
ওস্তাদের প্রভাব সাগরেদের উপরে কিছু না হলেও কিছুটা পরে। আমি অন্তত এ বিষয়ে তার যোগ্য উত্তরসূরী।

তিনি নিজে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ছিলেন না কিন্তু বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে যত বিভাগের সাথে জড়িত ছিলেন আর দ্বিতীয় কোন শিক্ষক ছিলেন এমনটি আমার জানা নেই।
আমরা পাঁচজন তার কাছে মাস্টার্সে পাঁচজন এমফিল এবং চারজন পিএইচডি গবেষণা করি। তন্মধ্যে আমি তার কাছে প্রথম পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করি আলহামদুলিল্লাহ।
তিনি আরবি উর্দু এবং ফার্সি এই তিনটি সাহিত্যের ডিগ্রিধারী সুপণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। যার কারণে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই তিনটি বিভাগে তার বিচরণ ছিল অবাধ। তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগ ছাড়াও থিওলজি অনুষদের তিনটি বিভাগের সাথে জড়িত ছিলেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, বৃহৎ ইসলামী বিশ্বকোষ, আল কুরআন বিশ্বকোষ, সীরাত বিশ্বকোষ, আরবি বাংলা অভিধান সব কটিতে তিনি সদস্য এবং সভাপতি ছিলেন।
তিনি ছিলেন ইসলামী ফাউন্ডেশনের book reviewer. তিনি কত বই এবং কত থিসিস রিভিউ করেছেন এ পরিসংখ্যান ইসলামিক ফাউন্ডেশনও দিতে পারবে না।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি, স্টাডিস, ইসলামের ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান সহ বিভিন্ন বিভাগের থিসিস যেগুলো ফাউন্ডেশনে প্রকাশের জন্য জমা দেওয়া হতো অধিকাংশই মূল্যায়নের জন্য তাকে দেওয়া হতো।
বড় বড় থিসিস আমি তার পড়ার টেবিলে দেখতাম কিন্তু কোনদিন ছুয়ে ধরার সাহস পেতাম না। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে জমা দেওয়া আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সহকর্মীর থিসিসও দেখেছি স্যারের কাছে। তাদের কেউ কেউ আমাকে একটু সুপারিশের কথা বলেছেন। কিন্তু আমি সাহস পাইনি। কারন তিনি এগুলো পছন্দ করতেন না।
তার আলমারিতে আমার গবেষণার কাজে লাগবে এমন বেশ কিছু গ্রন্থ ছিল। কিন্তু আমি কোনদিন স্যারের কষ্ট হবে এজন্য ওই গ্রন্থের কথা বলি নি।
তার বাসায় কেউ কিছু নিয়ে যাক এটা তিনি পছন্দ করতেন না । আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে একজন সিনিয়র অধ্যাপক তিনি কিছু ফল নিয়ে গিয়েছিলেন আমার সামনে তিনি ফেরত দিয়েছেন।
সুদীর্ঘ 27 বছর আমি তার বাসায় যাতায়াত করেছি। ওস্তাদের বাসায় যেতে যতোটুকু না হলে অভদ্রতা দেখায় ঠিক ততটুকু নিয়ে যেতাম। কিন্তু তিনি আমাকে কখনো নিষেধ করতেন না।
আমার পিএইচডি ডিগ্রী হওয়ার পর স্যারের জন্য একটি পাঞ্জাবির কাপড় ভালো একটা লুঙ্গি এবং একটি অফিসিয়াল ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি পাঞ্জাবীর কাপড়টা ফেরত দিয়ে বললেন আমার অনেক পাঞ্জাবি এটা তোমার আব্বাকে দিও।
গবেষক হিসেবে তত্ত্বাবধায়কের অফিশিয়াল ছেঁড়া ব্যাগটি গোপনে সেলাই করে এনে দিয়েছিলাম কোন একদিন। গবেষক হিসেবে তত্ত্বাবধায়কের জন্য করে দেওয়া এটাই আমার প্রথম কাজ ছিল। অথচ আমার জানামতে আমরা অনেক তত্ত্বাবধায়কই গবেষককে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে থাকি। নানা অজুহাতে আমরা তাদেরকে আর্থিক কষ্ট দিয়ে থাকি।
গবেষণায় তার স্বভাব ছিল
قراءه عليه وانا اسمع
তার কাছে ফ্রেশ করে লেখে নিয়ে যেতে হতো। তিনি আমাকে বিকেল 5 টা থেকে রাত 10 টা পর্যন্ত সময় দিতেন। আসর মাগরিব এশার এই তিন ওয়াক্ত নামাজ আমাকে সাথে নিয়ে পড়তেন।( এলাকার লোকদের ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়ার জন্য স্যারের একটি বড় কক্ষ নির্ধারিত ছিল।) নাস্তাও এক-দুবার খাওয়া হতো। আমি পড়তাম আর তিনি অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। যেখানে সন্দেহ হতো সেখানে দ্বিতীয় বার পড়িয়ে নিতেন। ভুল থাকলে তিনি সংশোধন করে দিতেন। রেফারেন্সের সন্দেহ হলে তাকে বই খুলে সঠিক তথ্যটি দেখাতে হত। এজন্য আমি একাধিকবার কুষ্টিয়া থেকে ব্যাগ ভরে বই নিয়ে সঠিক তথ্য দেখিয়ে নিস্তার পেয়েছি।
আমি তার দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হই তৃতীয় বর্ষে একটি টিউটোরিয়ালে। ক্লাস শেষে একদিন তিনি আমাকে তার চেম্বার ডাকেন। টিউটোরিয়ালটা বের করে সামনে মেলে ধরেন। রেফারেন্সে بلوغ الارب গ্রন্থটির নাম ছিল। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন , তুমি এই বইটি কোথায় দেখেছো? কারণ তার জানামতে গ্রন্থটি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে ছিলনা। আমি বললাম, স্যার! ঢাকা আলিয়া লাইব্রেরীতে বইটি আমি পড়েছি। আমি সেখান থেকে রেফারেন্স করেছি। আমি তাকে ফাঁকি দেই নি এজন্য তিনি খুব খুশি হলেন। সেদিন থেকে আমার প্রতি তার বিশেষ একটা টান আমি অনুভব করতে লাগলাম।
তিনি টিউটরিয়ালে একটি বিন্দু, দাড়ি কমাও সংশোধন করে দিতেন লাল কালিতে। আর পিএইচডি তিনি এমনি ছেড়ে দেবেন এটা তার কাছে কল্পনাও করা যায় না। একটি করে হরফ না শোনা পর্যন্ত তিনি সামনে অগ্রসর হতে দিতেন না।
একবার তিনি আমাকে আট দিন আটকে রেখেছিলেন। সেজন্যই হয়তো আমার পিএইচডি থিসিসটি without any correction ইসলামিক ফাউন্ডেশন দু-দুবার প্রকাশ করে।
বিভাগে এমফিল পিএইচডির বিজ্ঞপ্তি হয়েছে। অন 95 সাল থেকে 99 পর্যন্ত সিরিয়ালী পাঁচজন ফার্স্ট বয় আমার কাছে চলে আসে গবেষণার জন্য। আমি স্যারের কাছে চলে যাই। তার কাছে অনুমতি চাই তত্ত্বাবধায়ক হওয়ার। তিনি আমাকে এজাজত দেন। তারপরে এসে আমি তত্ত্বাবধান এর কাজ শুরু করি।
আমার ডিগ্রী হয় 99 সালে আর স্যার মারা যান 2014 সালে। এই15 বৎসরে যখনই ঢাকায় গিয়েছি স্যারের বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি । একান্ত না যেতে পারলে ফোনে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি।
আমরা অনেক গবেষকই তত্ত্বাবধায়কের খোঁজ খবর রাখি না। জীবনে কোনদিন একটি ফোনও করি না। গবেষক তত্ত্বাবধায়কের সম্পর্ক আত্মিক। গবেষক তত্ত্বাবধায়কের একজন পারিবারিক সদস্য। তাই সকল গবেষকের উচিত তত্ত্বাবধায়ক এর সাথে আমৃত্যু সম্পর্ক বজায় রাখা। আলহামদুলিল্লাহ আমার তত্ত্বাবধায়কের সাথে সম্পর্ক অটুট ছিল।
স্যার একবার বিভাগের কাজে এসেছিলেন কুষ্টিয়ায়। বাস অনেক লেট করায় স্যার শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। ড. ফারুক ঢাকা থেকে তাকে সাথে নিয়ে এসেছিলেন । স্বভাবতই তিনি তার বাসায় উঠেন। আমি স্যারকে আনতে গেলাম । কিন্তু ডক্টর ফারুক বাধা দিলে তিনি বললেন, তুমি কি বলো আমি ওর বাসায় যাব না! তিনি 5/6 কেজি আঙ্গুর আপেল নিয়ে আমার বাসায় এসেছিলেন।
স্যারের পিএইচডি না থাকায় তিনি 17 বছর নিয়মিত চাকরিতে প্রফেসর হতে পারেননি এটা হয়তো তার কষ্ট ছিল। তাই তার গবেষকের পিএইচডি হওয়ার পর পদোন্নতি হবে না এটা মানতে পারেন নি। প্রফেসর পদের জন্য আবেদন করে 16 মাস বসে থাকি। কেন দেরি হয়েছে তৎকালীন প্রশাসন ভালো বলতে পারবে।
এটা নিয়ে আমি খুব একটা দুশ্চিন্তা করতাম না। কিন্তু স্যার খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তিনি মাঝেমধ্যে খোঁজ নিতেন ধৈর্যধারণ করতে বলতেন। আমি বলতাম স্যার! আপনি এসোসিয়েট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। আমি আপনার ফেলো । আমি আজীবন এসোসিয়েট থাকলে আমার কোন আফসোস নেই।আপনার কাছে আমি পিএইচডি ডিগ্রি করতে পেরেছি এটি আমার জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি আমার জীবনে আর কিছুই চাই না।
তিনি ছিলেন দল-মত ধর্ম বর্ণ এলাকা ইজম থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। এমন নির্লোভ নিরহংকার উন্মুক্ত শিক্ষক আজকের দিনে বিশ্ববিদ্যালয় বড়ই অভাব। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসের উচ্চ মাকাম নসিব করুন আমিন।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88