হযরত মারিয়াম (আলাইহিস সালাম) এর নিষ্কলঙ্কময় পবিত্র জীবনী থেকে শিক্ষা

ইমরান (আ:) এর কন্যা মারইয়াম (আ:) কে আল্লাহ্‌ তাআলা সতীত্ব ও পবিত্রতার উচ্চ আসনে বসিয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে আল্লাহতাআলা বলেন, “ইমরান কন্যা মরিয়ম তার লজ্জাস্থানকে পবিত্র রেখেছে। অত:পর আমি তাতে আমার পক্ষ থেকে রূহ (জীবন) ফুঁকে দিলাম। সে তার পালনকর্তার বাণী ও কিতাবসমূহকে সত্যে পরিণত করলো। বস্তুত: সে অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।” (সুরা আত তাহরীম:১২)

প্রিয় মুসলিম বোনেরা! অনুগ্রহ করে বলবেন না যে, ” আমি মারইয়াম ( আ:) নই, আমার পরিবার ইমরান (আ:) এর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয় বা আমার কাছে কোন ফেরেশতা এসে আমার সতীত্ব, পবিত্রতার ঘোষণা দেননি। আমার সাথে কোন অলৌকিক ঘটনা ঘটেনি যা মারইয়াম (আ:) এর সাথে ঘটেছিল। তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া অতি অলৌকিক ঘটনা ছিল ব্যতিক্রম এক দৃষ্টান্ত।” আল্লাহ্‌তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন, “তাদের কাহিনিতে অবশ্যই জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় আছে। এগুলো তো কাল্পনিক কাহিনি নয়। বরং কুরআন হচ্ছে পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যায়নকারী ও প্রত্যেক বস্তুর বিস্তৃত বিবরণ এবং মুমিনদের জন্য হেদায়ত ও রহমত।” (সুরা ইউসুফ: ১১১)

প্রিয় মুসলিম বোনেরা! আমরা বর্তমানে এমন এক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে বাস করি যেখানে অতি প্রাকৃতিক ঘটনার কোন স্থান নেই। তবুও আমরা মনের সাহায্যে বুঝে নিই যে কেন আল্লাহ্‌ তাআলা মারইয়াম (আ:) কে ঈসা (আ:) এর মা হওয়ার জন্য নির্বাচিত করেছিলেন।

আসুন আমরা জেনে নিই সতীত্ব ও পবিত্রতার উজ্জ্বল নক্ষত্র মারইয়াম (আ:) এর ঘটনাটি।

মারইয়াম (আ:) এর মা হান্নাহ ছিলেন একজন অতি আল্লাহ্‌ভীরু ও কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ্‌ তাকে যখন সন্তানের সুসংবাদ দিলেন তখন হান্নাহ আল্লাহ্‌কে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করলেন এই বলে যে, গর্ভের সন্তানটিকে তিনি আল্লাহ্‌র জন্য উৎসর্গ করবেন। আল্লাহ্‌ বলেন, ” ইমরানের স্ত্রী যখন বললো হে আমার পালনকর্তা! নিশ্চয় আমার পেটে যা আছে তাকে সবার থেকে মুক্ত করে আমি মানত (উৎসর্গ) করেছি তোমার জন্য। অতএব তুমি তাকে আমার পক্ষ থেকে কবুল কর। তুমিই তো মহান শ্রোতা ও জ্ঞানময়।” (সুরা আল ইমরান: ৩৫)
এই আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি যে স্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ধার্মিক ও ন্যায়বান নারী অতিব জরুরী। কেননা সৎ ও ন্যায়বান স্ত্রীই পারে সন্তানদের আদর্শবান করে গড়ে তুলতে। ইমরান(আ:) এর স্ত্রী হান্নাহ ছিলেন তেমনই একজন মহিলা।

হান্নাহ যখন মারইয়াম (আ:) এর জন্ম দিলেন তখন দেখলেন যে এটি একটি কন্যা সন্তান। যদিও তিনি মনে করেছিলেন যে পুত্র সন্তান হলে তাকে আল্লাহ্‌র ঘরে উৎসর্গ করবেন। যাইহোক, এটি ছিল মহান আল্লাহ্‌র ইচ্ছা যে শিশুটি কন্যা হবে। হান্নাহ শিশুটিকে কোলে নিয়ে মসজিদে আসলেন তাঁর ওয়াদা পূরণ করতে। আল্লাহ্‌ বলেন, ” অত:পর আল্লাহ্‌ তাকে উত্তমভাবে কবুল করলেন, আর তাকে উত্তমভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত করলেন এবং তাকে জাকারিয়া (আ:) এর তত্তাবধানে সমর্পণ করলেন। যখনি জাকারিয়া (আ:) মিহরাবে প্রবেশ করতো তখন তার নিকট খাদ্য দেখতে পেত। তিনি বললেন, হে মারইয়াম এটি কোথায় পেলে? তিনি বললেন এটি আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছা তাকে বেহিসাব রিজিক দান করেন।” (সুরা আল ইমরান :৩৭)

আপনি মহান! হে আল্লাহ আপনি কতই না দয়াময়! সন্তানের জন্য মায়ের যে ভালবাসা আপনার ভালবাসা তার চেয়েও বেশি।

বোনেরা! একথা বলবেন না যে পর্দা মেনে চললে কিভাবে আমি আমার জীবনসঙ্গী খুঁজে পাবো? সাজসজ্জা, মেকআপ ইত্যাদি না করলে কে আমাকে প্রপোজ করবে?

আল্লাহ্‌র কসম! এটি ভুল ধারণা। এমনটি করবেন না বোনেরা। সৎ ও ন্যায়পরায়ণ থাকুন। মহান রব আপনার জন্য উত্তম সঙ্গী নির্বাচন করে রেখেছেন আপনি যা কল্পনাও করতে পারবেন না। আপনার পর্দা, শালীনতা, লজ্জাশীলতা, বিনয় ও সতীত্ব আপনাকে নিশ্চয় ন্যায়বান সঙ্গী মিলিয়ে দিবে অর্থাৎ আপনি যা পাওয়ার যোগ্য।

সুগন্ধিযুক্ত পোশাক পরিধান করে বের হওয়া, চড়া মেকআপ প্রসাধনী ব্যবহার, অশালীন পোশাক নির্বাচন বা পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ (যা নারী স্বাধীনতা নামে ব্যাপক পরিচিত) আপনাকে জান্নাত থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। এটি কোন অতি প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। মারিয়াম (আ:) ব্যতীতে অনেক মেয়ের জীবনেরই অভিজ্ঞতার অংশ। ফলস্বরূপ, পর্দা মেনে চলার দরুন আপনি পাবেন আল্লাহ্‌র রহমত, শান্তি, খাঁটি ও বিশুদ্ধ আনন্দময় বৈবাহিক সম্পর্ক।

মারইয়াম (আ:) যখন বয়:প্রাপ্ত হলেন তখন তিনি কি করতেন?
আসুন জানি :

তিনি মসজিদের এক গৃহকোণে সালাত আদায় করতেন দিনের বেশিরভাগ সময়, মহান আল্লাহ্‌র দরবারে মিনতি করতেন, পর্দা রক্ষা করে চলতেন এবং অত্যন্ত শালীনতার সাথে চলাফেরা করতেন। ফলে আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় জিবরীল (আ:) তাঁর কাছে ঘনঘন আসতে লাগলেন এই সুসংবাদ নিয়ে যে মহান আল্লাহ্‌ তাআলা পৃথিবীর আর সকল নারীর মধ্য থেকে তাঁকে নির্বাচিত করেছেন ঈসা (আ:)এর মা হবার জন্য।

“ফেরেশতারা বললো, হে মারইয়াম! আল্লাহ তোমাকে মনোনীত ও পবিত্র করেছেন এবং বিশ্বের নারীদের মধ্য থেকে তোমাকে মনোনীত করেছেন। হে মারইয়াম! অনুগত হও তোমার রবের প্রতি আর সিজদা কর ও রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।” (সুরা আল ইমরান : ৪২, ৪৩)

মারইয়াম (আ:) কেন এতটা যোগ্য ছিলেন আল্লাহ তায়ালার কাছে? কারণ তিনি যখন কেবল মাত্র একটি ভ্রুণ তখনই তাঁর মা তাঁকে মহান আল্লাহ্‌র দরবারে সঁপে দিয়েছিলেন। তাঁর মায়ের এই অকৃত্তিম আন্তরিক সদ্বিচ্ছার কারণেই আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁকে মনোনীত করলেন। তিনি ছিলেন সৎ, স্বতী, শালীন ও পূণ্যবতী একজন নারী। নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারিণী।

মারইয়াম (আ:) ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ, আল্লাহ্‌ভক্ত বান্দা যিনি কিনা আল্লাহ্‌র ঘরের এককোণে ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। তাঁর কোন বন্ধুবান্ধব বা প্রশংসাকারী (পুরুষ) ছিল না অন্যান্য মহিলাদের মত। পাপ কি জিনিশ তিনি তাই জানতেন না। তিনি যেই কক্ষে ইবাদতে মশগুল থাকতেন কেবল সেই কক্ষ এবং পর্দা ব্যতীত কিছু তিনি জানতেন না।তিনি ছিলেন আল্লাহর দৃস্টিতে অশেষ যোগ্যতা সম্পন্ন একজন নারী যিনি কিনা বিশ্বের সমস্ত নারীকুলের মধ্য থেকে মনোনীতা।

চলুন দেখি আল্লাহ্‌ সুবহানআল্লাহ মারইয়াম (আ:) কে সম্মানের এত উচ্চস্তরে কেন আসন দিলেন।

সর্বদা সালাত, যিকির বা আল্লাহ্‌র স্মরণ, পর্দা রক্ষা, শালীনতা ইত্যাদি যা কিনা মারইয়াম (আ:) এর কাছে কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু সাধারণ নারীদের কাছে হয়ত কিছুটা কঠিন। তবে যদি কোন নারী এইসব মেনে চলতে পারেন তবে আল্লাহ্‌ সুবহানআল্লাহ নিশ্চয়ই আপনাকে মনোনীত করবেন অন্যান্য নারীদের মধ্য থেকে। আপনি পেতে পারেন একজন আদর্শবান স্বামী, সুন্দর গৃহ, নির্ভেজাল ভালোবাসা। আপনাকে মারইয়াম (আ:) এর মত মসজিদের কোণে থাকতে হবে না।

আপনি আপ্রাণ চেষ্টা করুন নিজেকে পাপমুক্ত রাখতে। ন্যায়ের পথে থাকুন, এটি অনেকভাবেই হতে পারে। মহান আল্লাহ্‌ তাআলা সর্ষে দানা পরিমাণ ভালো কাজের প্রতিদান দিবেন। আমাদের লক্ষ্য থাকবে স্বদিচ্ছা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও উত্তম চরিত্রের দিকে।

আল্লাহ্‌ তাআলা পবিত্র কুরআনে মারইয়াম (আ:) এর সচ্চরিত্রের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। যদিওবা অনেককাল আগের ঘটনা কিন্তু কুরআনের বর্ণনায় মনে হবে জীবন্ত একটি দৃশ্য:–

একদিন মারইয়াম (আ:) তাঁর গৃহকোণে অবস্থান করছেন। এমতাবস্থায় জীব্রিল (আ:) আল্লাহ্‌ তাআলার নির্দেশে উপস্থিত হলেন। ফেরেশতা জীব্রিল (আ:) অত্যন্ত সুর্দশন যুবকের বেশে এসেছিলেন। মারইয়াম (আ:) কে তিনি তার আগমণের উদ্দেশ্য জানালে তিনি আল্লাহ্‌র ভয়ে কেঁপে উঠলেন এবং আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইলেন। তিনি বললেন, “প্রকৃতপক্ষে আমি মহান আল্লাহ্‌র কাছেই আশ্রয় চাই সুতরাং আমি তোমার থেকেও আশ্রয় চাই যদি তুমি আল্লাহ্‌কে ভয় কর।” (সুরা মারইয়াম : ১৮)

জীব্রিল (আ:) তাঁকে এবার বুঝিয়ে বললেন যে তিনি আসলে আল্লাহ্‌র হুকুমেই এসেছেন (যে মন্দ উদ্দেশ্যের ভয় তিনি পাচ্ছিলেন সে উদ্দেশ্যে তিনি এখানে আসেন নি)। উত্তরে মারইয়াম (আ:) বললেন, “কিভাবে আমার পুত্র সন্তান হবে? যেখানে কোন মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি? আর আমি তো ব্যভিচারিণীও নই।” (সুরা মারইয়াম : ২০)

জীব্রিল(আ:) বললেন যে এটা মহান আল্লাহ্‌র ইচ্ছা। কেউ তা অগ্রাহ্য করতে পারে না।

মেয়েদের স্বাভাবিক প্রবণতা হল তারা নিজের স্বতীত্ব রক্ষা করে চলে। মারইয়াম (আ:) ছিলেন এইক্ষেত্রে আরও এক ধাপ এগিয়ে।

ঈসা (আ:) যখন তাঁর গর্ভে জানান দিচ্ছেন এবং যখন প্রসব বেদনা শুরু হল সে বললো, “হায়! এর আগেই যদি আমি মরে যেতাম এবং সব ভুলে যেতাম।” (সুরা মারইয়াম : ২৩)

তিনি এতটাই নিষ্কলুষ, পবিত্র ও নিষ্পাপ ছিলেন যে তিনি যেই পাপ করেন নি তার জন্যও আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা চাইলেন। যদিও তিনি জানতেন যে এটি মহান আল্লাহ্‌র একান্ত ইচ্ছা।

অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই, আধুনিকতার নামে বর্তমানে কিছু নারী তাদের সতীত্ব তথাকথিত ‘নারী স্বাধীনতা’ র নামে গর্বের সাথে বিসর্জন দিচ্ছে। সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতির বেহায়াপনায় নগ্ন অপসংস্কৃতিকে তারা অন্ধ অনুসরণ করছে।

কিছু মুসলিম নারী আছেন যারা পথভ্রষ্ট। স্বাধীনতা বলতে তারা বোঝে একাধিক বয়ফ্রেন্ড, ফ্রিমিক্সিং। ফলস্বরূপ, সমাজে বিস্তার লাভ করছে যেনা-ব্যভিচার, নগ্ন মডেলিং।

শালীনতা, পর্দার পরিবর্তে কিছু নারী বেহায়াপণা ও আকাশ সংস্কৃতির (টিভি সিরিয়াল, সিনেমার অভিনেত্রী, মডেল) অনুকরণ করছে। পর্দাপ্রথাকে তারা পুরানো ধ্যান-ধারণার প্রতীক বা নারী স্বাধীনতার পথে বাঁধা হিসেবে দেখছে। তারা আল্লাহ্‌র বিধানকে সেকেলে, পিছিয়ে পড়া ইত্যাদি নেতিবাচক দৃস্টিতে দেখছে।

শালীনতা, পবিত্রতা ইমরান কন্যা মারইয়াম (আ:) এর একচেটিয়া চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়, এটি প্রত্যেকটি মুসলিম নারীর মূল্যবান চারিত্রিক সম্পদ। যেসকল নারী তাদের শালীনতা, সতীত্ব, পর্দা রক্ষা করে চলে তারা হন সম্মানিত, আত্মবিশ্বাসী ও কোমল। উপরন্তু, আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি রহমত নাযিল করেন। দুনিয়া ও আখিরাতে তারা পান কল্যাণ।

“উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম ছাড়া আর কি হতে পারে?” (৫৫: ৬০)

অপরদিকে, যেসকল নারী তাদের সতীত্ব বিলিয়ে দেন তাদের আত্মমর্যাদা ম্লান হয়ে যায় সময়ের সাথে সাথে। যৌবন ফুরিয়ে গেলে তাদের আর কদর থাকে না। তারা হয়ে পড়ে অকেজো, পৃথিবীর বুকে সম্মানহীন, হতাশ ও অশান্তিময়জীবন। পরকালের পুঁজিও তাঁদের শূণ্য।

আল্লাহরব্বুল আলামিন বলেন, “আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়।” (২০ : ১২৪)

—————————————————-
অনুবাদঃ সারাহ ইসলাম

সম্পাদনাঃ ISB TEAM

সোর্সঃ http://www.islamweb.net/

Original Source

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button