
পাঠ-পর্যালোচনা : অপরাজিতা
পাঠ-পর্যালোচনা : অপরাজিতা
বর্ষ: ০১। সংখ্যা: ০১। বৈশাখ ১৪২৪
ধরণ: পত্রিকা
সংখ্যার নাম: সাহাবিয়া সংখ্যা
সম্পাদনা: আফিফা মারজানা
সম্পাদনা সহযোগী : নাঈমা তামান্না ও সুমাইয়া ইয়াসমিন তামান্না
প্রচ্ছদ: জুবায়দা ফারজানা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৬০
মূল্য : ১৫০ টাকা
বিন্যাস:
ইতিহাসের ঐশ্বর্য – হাসানাত মাহিয়াত
হযরত খাদীজা রা. বাগানের প্রথম ফুল – সুমাইয়া তাসনীম
বিনতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম – জান্নাতুল নাঈম মনি
আহাদা আশারা কাওকাবান – মাজিদা রিফা
শাহযাদী – সুমাইয়া ইয়াসমিন তামান্না
হুমাইরা – নাঈমা তামান্না
কবি খানসা ও তাঁর কবিতা – আফিফা মারজানা
মহিয়সী উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহান রা. – ইশরাত জাহান রুবাইয়া
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহাবিয়াদের অবদান – সাবিহা মুশতারী রেশমী
এসো সাহাবিয়াদের মত হই – মারইয়াম উম্মে মাবরুরা
রণাঙ্গনে বীরাঙ্গনা – মাহমুদা খাতুন তামান্না
মহাগ্রন্থের পাতায় আঁকা – সাদিয়া খান
যাদের লালন করি হৃদয়ে হতে চাই যাদের মত – উম্মে হাবিবা
নবীপ্রেম – নাহিদা সুলতানা
অমিয় সুধা পানকারী – সুমাইয়া বিনতে শওকত
সাহাবিয়াদের নাম – সাহারা মুমতাজ মারজান
দিলরুবায়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম – সুমাইয়া ইয়াসমিন তামান্না
পূর্বকথা:
কাগজের পাতায় অঙ্কিত হরফগুলো যখন চোখের তারায় এক বুক ভালোবাসা নিয়ে হাজির হয়, তখন সেই ভালোবাসাকে কে ফিরিয়ে দিতে পারে বলেন। অপরাজিতা শুধুমাত্র একটি পত্রিকা নয় বরং আরো কিছু। অপরাজিতা দরদ মাখানো ভালোবাসার কথন। অপরাজিতা এমন আলোর পথের কথা বলে – যে পথ পাওয়াটা মানুষের জীবনের পরম আরাধ্য। অপরাজিতা মানুষের জীবনপট পরিবর্তনের জন্য দাওয়াতের একটি মাধ্যম। অপরাজিতা একটি আন্দোলনের নাম। অপরাজিতা বাঁধা ভেঙে দেয়ার একটি ইতিহাসের নাম। অপরাজিতা বাঙলা ভাষায় আমার দেখা প্রথম পত্রিকা যার লেখিকাবৃন্দ সবাই নারী। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ কাজ করেছেন নারীগণ। পত্রিকাটির প্রচ্ছদ হয়েছে এক কথায় চমৎকার। পত্রিকাটির অঙ্গসজ্জা, বর্ণ-বিন্যাস, জলরঙের ব্যবহার ইত্যাদি সবকিছুই এক আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের পরিচয় বহন করে।
প্রাসঙ্গিক অভিব্যক্তি:
এটি পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা। এ সংখ্যাটি সাহাবিয়া (রাযি.) দের কে নিয়ে লেখা। বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর। আর বাঙলা ভাষায় এ বিষয়ে মৌলিক বই এবং অনুবাদকৃত বই যা আছে তা খুবই অপ্রতুল। তো এ জায়গাতে একটা শূন্যস্থান ছিলো। অপরাজিতা সে শূন্যস্থান পূরণ করেছে। কোরান-হাদীস-সীরাত-তারীখের বইগুলো থেকে অভিজ্ঞ ডুবুরির মত মণি-মুক্তা-হীরা-জহরত এর সম্ভার গড়ে তুলেছে পত্রিকাটি। ঝিনুক থেকে মুক্তো খুঁজে বের করা যতটা কঠিন- অপরাজিতার কাজ হয়েছে ঠিক ততটাই কঠিন। পত্রিকাটি হলো লেখিকাগণের তিন বছর পরিশ্রমের ফসল। আমার মনে হয় যখন কলব, কলম এবং অশ্রু এক হয়ে রবের দরবার থেকে ফরিয়াদ করে, তখনই কলমের রব এমন একটি নেয়ামত দান করে ধন্য করেন।
পর্যালোচনা:
১৭ টি রচনার সমন্বয়ে পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা। প্রথম রচনাটি ইতিহাসের ঐশ্বর্য নামে। এতে মূলত সাহাবিয়া (রাযি.) দের ইতিহাস থেকে বিভিন্ন স্বর্ণখচিত ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে যে, ইতিহাসে তাদের অবদান কী সে সম্পর্কে। অনেকটা পদ্যের ভাষায় আলোচনা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় রচনাটি হযরত খাদীজা (রাযি.) কে নিয়ে লেখা। এই মহীয়সী নারী তাঁর স্বামীর জন্য, দ্বীনের জন্য কতপ্রকার কষ্ট করেছেন। তাঁদের দাম্পত্য কতটা সম্মানের ছিলো। খাদীজা (রাযি.) এর ত্যাগের চিত্র, তার মৃত্যুসহ বিভিন্ন দিক উল্লেখ করা হয়েছে এ লেখাটিতে।
তৃতীয় রচনাটি নবীজীর কন্যাদের সম্পর্কে। তাঁর কন্যা কতজন ছিলেন, তাঁদের জীবনযাপনের বর্ণনা, তাঁদের বিয়ে-শাদির চিত্র, দ্বীনের ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান সম্পর্কে।
চতুর্থ রচনা নবীজীর স্ত্রীগণ সম্পর্কে। তাঁদের জীবনচরিতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এতে স্থান পেয়েছে।
পঞ্চমটি হলো ফাতিমা (রাযি.) কে নিয়ে। যিনি ছিলেন শাহযাদী। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের কন্যা। কিন্তু তার জীবন-যাপন ছিলো অতিসাধারণ। নবীজী তাকে কেমন করে গড়ে তুলেছেন। জন্ম-বিয়ে-মৃত্যুসহ তাঁর জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এ অধ্যায়ে লেখা হয়েছে।
ষষ্ঠ রচনা আয়েশা (রাযি.) কে নিয়ে। আয়েশা (রাযি.) ছিলেন নবীজীর একমাত্র কুমারী স্ত্রী। তাঁর সাথে নবীজীর আচরণ। তাঁদের ভালোবাসাময় দাম্পত্য জীবনসহ আয়েশা রাযি. এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, ভাষার শুদ্ধতা, কাব্য, চিকিৎসা ইত্যাদিতে তার পারদর্শিতা, হাদীস বর্ণনায় তাঁর অবদান, ফিকাহের ব্যাপারে তাঁর যোগ্যতা। তাঁর কারণে তাইম্মুম এর বিধান নাযিল হওয়া। কুরআনে তার পবিত্রতার ঘোষণাসহ তাঁর জীবনের অনেক দিক এ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে।
সপ্তম রচনা হযরত খানসা (রাযি.) এর কাব্যপ্রতিভা নিয়ে। এ রচনাটিতে খানসা (রাযি.) কাব্যপ্রতিভার পাশাপাশি তাঁর জীবনের কিঞ্চিত দিক আলোচনা করা হয়েছে। অনুবাদক খানসা (রাযি.) রচিত চারটি কবিতার অনুবাদ করেছেন এ রচনায়।
অষ্টম রচনা উম্মে সুলাইম (রাযি.) কে নিয়ে। যিনি ছিলেন আনাস (রাযি.) এর মা। তিনি মক্কার সম্ভ্রান্ত বীরপুরুষ আবু তালহা (রাযি.) কে বিয়ে করেন। আবু তালহার ইসলাম গ্রহণই ছিলো তাঁর বিয়ের মোহর। উম্মে সুলাইম (রাযি.) এর জীবনচরিতের কিছু চমকপ্রদ ঘটনা এ রচনায় উল্লেখিত হয়েছে।
নবম রচনাটি বিভিন্নক্ষেত্রে সাহাবিয়াদের অবদান সম্পর্কে। ইসলামি ফিকাহ্শাস্ত্র, হাদীস বর্ণনা, যুদ্ধক্ষেত্র, কাব্য, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের অবদানের ইতিহাস লেখা হয়েছে।
দশম রচনাটি হলো নিজেদেরকে সাহাবিয়াদের মত গড়ে তোলার প্রেরণামূলক কথন।
একাদশ রচনাটি রণাঙ্গের ময়দানে সাহাবিয়াদের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে। সাহাবিয়াদের মধ্যে অনেকেই রণাঙ্গনে বীরত্ব দেখিয়েছেন। সে বিষয়ের কিছু ইতিহাস এ রচনাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
দ্বাদশ রচনাটি হলো কুরানুল কারীমে সাহাবিয়াদের সম্মানার্থে যে আয়াতসমূহ নাযিল হয়েছে সেটার বর্ণনা।
ত্রয়োদশ রচনাটি হচ্ছা সাহাবিয়াদেরকে ভালোবাসার এক নির্জলা বহিঃপ্রকাশ।
চতুর্দশ রচনা হলো নবীজীর প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে।
পঞ্চদশ রচনায় ইসলামের প্রথম শহীদ সুমাইয়া (রাযি.) এর শাহাদাত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে।
ষোড়শ রচনাটি হলো সাহাবিয়াদের নাম নিয়ে। এখানে সর্বমোট ১০৯ জন সাহাবিয়া (রাযি.) এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
সর্বশেষ অর্থ্যাৎ সপ্তদশ রচনা হলো উম্মে সালামা (রাযি.) জীবনচরিত নিয়ে। উম্মে সালামা (রাযি.) এর জীবনী এত বিস্তারিতভাবে এর আগে আমার মত অনেকেই পড়েন নি সেটা আমি বেশ ভালোভাবে বলতে পারি।
রচনাগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর শব্দচয়ন, প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপনা এবং প্রত্যেকটি রচনার শেষে রেফারেন্স গ্রন্থের উল্লেখ। আরেকটা ব্যাপার হলো পত্রিকাটির প্রভাব পাঠককে আচ্ছন্ন করে রাখবে। অপরাজিতা আমাদের বৃষ্টিহীন বন্ধ্যা আকাশে একটি বিনয়ী ‘না’।
পাঠ-প্রতিক্রিয়া:
লেখা আসলে কী! বই বা কাকে বলে।
কলমের কালিকে সাদা কাগজের বুকে আঁচড় দিলেই কি একটি লেখা হয়ে যায়। নাকি লেখা আরো কিছু! লেখা কী লেখকের আত্মজা নয়? আর বই কি তাকেই বলে না, যা একজন লেখক সাদা কাগজের কিছু পৃষ্ঠায় কালো হরফের সমষ্টিকে এক করেন। একজন লেখকের হৃদয়ের উপলব্ধি, ভাবাবেগ, দুঃখ-কষ্ট, বাস্তবতা, কল্পনা, হাসি-কান্না, অতীত-ভবিষ্যত ইত্যাদির প্রতিচ্ছবি কী লেখা নয় ? একটা বই কি একজন লেখকের কাছে তার সন্তানের চেয়ে কম মূল্যের? একদিন লেখক হারিয়ে যাবেন। দুনিয়াতে তার পদচিহ্ন থাকবে না। তাঁর সন্তান-সন্ততিও কালের গহ্বরে বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু বেঁচে থাকবে লেখা, বেঁচে থাকবে বই হয়ে। শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) যথার্থ বলেছিলেন “আমার একটা পুত্র সন্তান হলে আমি যত খুশি হই; তার চেয়ে বেশি খুশি হই আমার একটা বই ছাপা হলে”।
পৃথিবীর সমস্ত অত্যাচারী রাজা-বাদশাহ্ বিলীন হয়ে গেছে। সাধু লোকেরা পরপারের পথে যাত্রা করেছে। কিন্তু যারা মরে গিয়েও পৃথিবীর বুকে বেঁচে আছেন তারা এই লেখার মাধ্যমেই বেঁচে আছে। পৃথিবীর অতীত এখনও টিকে আছে লেখার মাধ্যমে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেটা উপলব্ধি করে লিখেছিলেন:
“আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহলভরে”।
সত্যিই তো পাঠক শতবছর পরে এখনও তার কবিতা পড়ে কৌতুহলভরে। নজরুল বাঙলা সাহিত্যে এক বিদ্রোহীর মাধ্যমেই অমর হয়ে রইবেন। ফররুখ জ্বলবেন তাঁর পাঞ্জেরিতে। ঠিক তেমনি আজ থেকে ১০০ বছর পর যখন হিসেব করা হবে বাঙলা সাহিত্যে মুসলিম রমণীদের অবদান সম্পর্কে। তখন প্রথম দিকে উঠে আসবে অপরাজিতার নাম। শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে; কিন্তু তাঁর অনুবাদ করা বেহেশতি জেওর বই এখন বাঙলার মুসলমানদের ঘরে ঘরে। অথচ কেউ কী জানে তাঁর একজন পুত্রের নাম। সন্তানকে যেমন পরিচর্যা করতে হয়। পত্রিকাটিকেও তেমনি পরিচর্যা করতে হবে। পত্রিকাটিকে অন্তত এমনভাবে প্রচার করা প্রয়োজন, যাতে করে যে পত্রিকাটি চায় সে যেন পত্রিকাটি পায়। যত্ন করে পত্রিকাটির কলেবর বৃদ্ধি করে, আরো সম্পাদনা করে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছানোর সহজ পন্থা বের করতে হবে। পুনঃপুনঃ সম্পাদনা করে পত্রিকাটিকে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে হবে। পত্রিকাটি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করতে হবে। এ বিষয়টা অবশ্যই মনে রাখতে হবে অপরাজিতা শুধুমাত্র বাঙলা ভাষার সম্পদ নয়। এটা পুরো মুসলিম জাহান, এমনকি সম্পূর্ণ পৃথিবীর সম্পদ। আর এ সম্পদের যত্ন না করা হলে তা কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে।
প্রস্তাবনা:
১। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যার ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন। যাতে পাঠক অন্তত জানতে পারে পত্রিকাটির নাম।
২। পর্যাপ্ত প্রিন্টেড কপি সরবরাহ করা প্রয়োজন। যাতে পাঠক পত্রিকাটি কিনতে চাইলে কিনতে পারে। আমরা আওয়াম এর মূল্য বুঝি। চোখ বন্ধ করে পত্রিকাটি যে কাউকে উপহার দেয়া যাবে। দাওয়াত এবং হেদায়েতের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয় উঠতে পারে পত্রিকাটি।
৩। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতে হবে। তথ্যের মধ্যে কিছু জায়গায় ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়ে গেছে। আবার বাইরের বিন্যাসের শিরোনামের সাথে ভিতরের শিরোনাম এক হওয়া প্রয়োজন। বেশকিছু জায়গায় অনেক বেশি স্পেস পড়ে গেছে। তা না হলে পত্রিকাটির সৌন্দর্য আরো বাড়তো। এ বিষয়গুলোর কিছু সম্পাদনা করা প্রয়োজন।
৪। পত্রিকাটি যদি সম্পাদিকা আর ছাপাতে না চান। তবে কলেবর বৃদ্ধি করে একটি স্বতন্ত্র বই হিসেবে প্রকাশ করুন। যে কোন বড় প্রকাশনা এগিয়ে আসবে এ কাজে। তাদেরকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাপানোর অনুমতি দেয়া যেতে পারে। অথবা নিজেরা ছাপানোর উদ্যোগ নিতে পারেন। এ কাজে উম্মাহের ফায়দা ইনশাআল্লাহ।
শেষকথা:
পরিশেষে দু’আর মাধ্যমে সমাপ্ত করি —“মেয়েদের ব্যবস্থাপনা ও মেয়েদের লেখা নিয়ে প্রচলিত বৃত্তের বাইরে অপরাজিতা পরাজয় না মানার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাক দূর-বহুদূর…”
For PDF Download