অদেখা স্রষ্টা
“ভাই, আপনারা তো বলেন আল্লাহ বলে একজন আছেন। উনিই নাকি এই সমগ্র বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন, দেখেশুনে রেখেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, আজ পর্যন্ত তো ওনার দেখা পেলাম না। যদি উনি চান যে আমরা ওনাকে বিশ্বাস করি, তাহলে কি একবার দেখা দিয়ে গেলে হত না? না দেখে কোনকিছু বিশ্বাস করা কি বুদ্ধিমানের কাজ? হয়ত বলবেন, বাতাস তো আমরা না দেখেও বিশ্বাস করি। কিন্তু বাতাস না দেখলেও অনুভব তো করতে পারি। যে জিনিসটাকে দেখা যায় না, শোনা যায় না, স্পর্শ করা যায় না, মাইক্রোস্কোপের নিচে আনা যায় না, টেস্টটিউবে বন্দী করা যায় না, টেলিস্কোপে ধরা পড়ে না, মোটকথা ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের আওতায় যেটা পড়ছে না, সেটাকে বিশ্বাস করা কি খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার না?”
এরকম একটা প্রশ্ন অনেক অবিশ্বাসীই করে থাকেন, বিশ্বাসীদের মনে থাকাও অসম্ভব নয়। আসলেই তো- স্রষ্টা তো চান আমরা তাঁকে বিশ্বাস করি, তাঁকে ভালবাসি, ভয় করি, আদেশ-নির্দেশ মেনে চলি, তাঁর ওপর আস্থা রাখি, নিভৃতে তাঁর কাছে প্রার্থনা করি- ইত্যাদি। কিন্তু তাঁকে তো দেখাই যায় না। না দেখে এতখানি বিশ্বাস রাখা কি অত্যন্ত অযৌক্তিক একটা ব্যাপার নয়? চলুন বিষয়টা একটু নেড়েচেড়ে দেখি।
না দেখে বিশ্বাস বনাম প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস
প্রথমেই এই পার্থক্যটা বুঝে নেওয়া দরকার- অনেকেই “না দেখে বিশ্বাস” আর “কোনরকম প্রমাণ ছাড়া অন্ধ বিশ্বাস” এর মধ্যে একটা সরলীকরণ করে ফেলেন। দু’টো কিন্তু আলাদা জিনিস। ইসলামে অনেক ব্যাপারেই- আল্লাহর অস্তিত্ব তার মধ্যে একটা- না দেখে বিশ্বাস রাখতে বলা হয়েছে। সূরা বাক্বারার একদম প্রথমেই মুত্তাকীদের (বেশ ব্যাপক অর্থবোধক একটা শব্দ, সাধারণভাবে আল্লাহভীরু ও সৎকর্মশীল বলা যেতে পারে) সংজ্ঞা এসেছে এভাবেঃ
অদেখা বিষয়ে বিশ্বাস রাখাটা তাই ইসলামের (এবং অধিকাংশ ধর্মেরই) বেশ মৌলিক একটা কনসেপ্ট। অন্যদিকে, ইসলাম কিন্তু মানুষকে প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস করতে বলেনি। নবীজী (সাঃ) এর মক্কার জীবনী দেখুন- উনি কিন্তু মানুষকে যুক্তিতর্ক জ্ঞানবুদ্ধি সব আস্তাকুঁড়ে ফেলে চোখকান বুঁজে মানতে বলেননি, বরং প্রায়ই তিনি মানুষকে যুক্তি দেখিয়েছেন, কারণ বুঝিয়েছেন, আবার কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা অলৌকিক নিদর্শন প্রকাশ করেছেন। এখন ইসলামের পক্ষে কী এমন প্রমাণ এসেছে, তা যুক্তিতর্কের ধোপে টেকে কি না- এসব প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বর্তমান আলোচনার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। ফুটনোটের কিছু কথাবার্তা ছাড়া প্রশ্নগুলো অন্য কোন দিনের জন্য তোলা থাকল।২ পয়েন্ট যেটাঃ ইসলাম না দেখে বিশ্বাস অ্যাডভোকেট করলেও প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস অ্যাডভোকেট করে না।
কিন্তু ইসলাম যদি আল্লাহর অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ দিয়েই থাকে, সেটা নিশ্চয়ই ইন্দ্রিয়লব্ধ প্রমাণ নয়। এটা তো আমাদেরকে শেষ পর্যন্ত না দেখেই বিশ্বাস করতে হচ্ছে। এরকম “প্রমাণ” এর কতটুকুই বা মাহাত্ম্য?
উত্তরটা জানতে একটু বিজ্ঞানের কাছে ধর্ণা দেই- আজকাল এর চেয়ে বেশি ভরসা আর কিসে আছে বলুন?
অদেখা বিজ্ঞান
বিবর্তনবাদের নাম শুনেছেন তো?৩ পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ (এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে উৎপত্তি) সম্পর্কে বর্তমান বিজ্ঞানের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য থিওরী। বিবর্তনবাদ ঠিক একটা থিওরী- এরকম বলা ভুল হবে। বিবর্তনের ব্যানার বেশ বড়সড়, তার আওতায় একাধিক কনসেপ্ট জায়গা করে নিয়েছে। যেমন ধরুন, কখনো কখনো একই প্রজাতির মধ্যে ছোটখাট পরিবর্তন চলে আসে। এর উদাহরণ আমরা সবাই জানি- মশার ওষুধ কিছু দিন পর পর বদলাতে হয়, আমরা বলি মশারা ওষুধের প্রতি resistant হয়ে গেছে। এর কারণ কী? এর কারণ হচ্ছে adaptation বলে একটা অদ্ভুত ব্যাপার। ওষুধের মুখে তো মশাদের অবস্থা কাহিল, সে অবস্থায় কালেভদ্রে এমন দুই-একটা মশা জন্ম নেয়, যাদের মধ্যে এই প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকার কারিগরি থাকে। তো এই দুই-একটা মশা যে কাচ্চাবাচ্চা রেখে যায়, তাদের অনেকের মধ্যেও ঐ টিকে থাকার বৈশিষ্ট্যটা চলে আসে। প্রকৃতি এই টিকতে-পারা মশাগুলোর প্রতিই বেশি সহায়, কাজেই ওষুধের তোপের মুখেও এই সুপার-মশাদের দল ভারি হতে থাকে। এমন একটা সময় আসে যখন মশাদের পুরো পপুলেশানই ওষুধকে কলা দেখিয়ে বাঁচতে শিখে যায়, আর তখনই দরকার পড়ে ওষুধ বদলানোর। এরকম উদাহরণ অসংখ্য আছে। গত শতাব্দীর মাঝামাঝির দিকে মানুষ যখন পেনিসিলিনের ব্যবহার শিখে গেল, তখন সবাই নিঃশ্বাস ছেড়ে ভেবেছিল- যাক, একগাদা রোগবালাইকে তবে যমের বাড়ি পাঠানো গেল। ১৯৬৯ এর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সার্জেন জেনারেল বলে ফেললেন- সংক্রামক অসুখের বইপুস্তক বন্ধ করার সময় এসেছে। আজকে সেসব কথা হাস্যকর শোনায়, AIDS মার্কা নতুন বিভিন্ন অসুখ তো আছেই, এর ওপর পুরোন একগাদা অসুখও আবার নতুন করে ফিরে এসেছে। কাহিনী আর কিছুই না- বিবর্তন, জীবাণুগুলো ওষুধের চাপের মুখেও adaptation শিখে গিয়েছে, আগের সেই পেনিসিলিন এই resistant জীবাণুদের কোন এফেক্টই করছে না। বিশাল গ্রেট ডেন থেকে পুঁচকে চিহুয়াহুয়া পর্যন্ত কুকুরের হাজারটা জাত বিবর্তনের আরেকটা উদাহরণ- যেরকম বৈশিষ্ট্য চাই, সেরকম বৈশিষ্ট্যওয়ালা কুকুরদেরকে একসাথে breed করার ফলে আস্তে আস্তে নতুন নতুন জাত চলে আসে। একই ব্যাপার করে দ্রুতগামী ঘোড়া থেকে অধিক ফলনশীল ধানও উৎপন্ন করা সম্ভব হয়েছে।
এই যে এই উদাহরণগুলো- এগুলোর প্রত্যেকটাতেই একটা ব্যাপার লক্ষ্য করুন। প্রত্যেকটাতেই বংশধরদের মধ্যে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হচ্ছে, কোনটায় বেশি ফলন, কোনটায় সুস্বাস্থ্য, কোনটায় রোগ প্রতিরোধ- কিন্তু প্রজাতি কিন্তু সেই একই থেকে যাচ্ছে। মশাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে গেছে মানলাম, কিন্তু মশা সেই মশাই থেকে যাচ্ছে- সে বোলতা কিংবা প্রজাপতি হয়ে যাচ্ছে না। এরকম বিবর্তন- যেটা হওয়ার ফলে প্রজাতির পরিবর্তন হয় না- এদেরকে বলে microevolution.
Micro থাকলে macro থাকতে হবেই। বিবর্তনবাদীরা বলেন, microevolution এর ফলে যে ছোটখাট বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তনগুলো হয়, সেগুলো জমতে জমতে জমতে জমতে একদিন এমন অবস্থা হয় যে আগের প্রজাতি আর থাকে না, নতুন প্রজাতি সৃষ্টি হয়ে যায়। এরকম প্রজাতি-পরিবর্তনকারী বিবর্তনকে বলে macroevolution. স্তন্যপায়ীরা একসময় ছিল সরীসৃপ। বিবর্তন যতই এগোতে লাগল, কিছু সরীসৃপ ততই স্তন্যপায়ী-মার্কা হয়ে উঠল। এভাবে আস্তে আস্তে প্রথমে microevolution এর মাধ্যমে বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন, তারপর macroevolution- প্রজাতির পরিবর্তন, তারপর গোটা শ্রেণীর পরিবর্তন ঘটে গেল (সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী)।
বিবর্তনের big picture টা তাহলে এরকমঃ প্রথমে ধূলিকণার মত একটু পরিবর্তন, তারপর সেগুলো জমা হতে হতে এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতি, তারপর আরো পরিবর্তন ঘটতে ঘটতে এখন জীববৈচিত্র্যের দ্বীপ দেশ সাগর মহাসাগর উপস্থিত। বর্তমান বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগুলোর মধ্যে এর নাম করতেই হবে, জীববিজ্ঞানের general theory of relativity বলতে পারেন।
মজার ব্যাপার জানেন? Macroevolution অর্থাৎ প্রজাতির পরিবর্তন- এই ব্যাপারটার কোন চাক্ষুস প্রমাণ নেই। কেউ কোনদিন দেখেনি একটা প্রজাতি অন্য আরেকটা প্রজাতিতে পরিণত হচ্ছে। এটা নিয়ে কোনরকম এক্সপেরিমেন্টও করা সম্ভব নয়।৪ কারণটা সহজ- macroevolution এর মাধ্যমে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতি সৃষ্টির জন্য প্রচুর, প্রচুর সময় দরকার। অত সময় স্রষ্টা মানুষকে এই পৃথিবীতে দেননি। শতাব্দীর পর সহস্রাব্দ ল্যাবে বসে বসে প্রজাতির পরিবর্তন লক্ষ্য করা দেওদানোর কাজ, মানুষের নয়। Microevolution খুব সহজ- প্রতি জেনারেশানেই ঘটে থাকে। জেনেটিক্স বা মাইক্রোবায়োলজির আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছেলেপেলে ল্যাবের মধ্যেই অ্যান্টিবায়োটিক resistant ব্যাকটেরিয়া ডেভেলাপ করে। কিন্তু এক ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতি থেকে আরেক ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতি তৈরি- অতক্ষণ বসে থাকার সহ্যশক্তি দধীচিরও নেই।
কিন্তু তাই বলে কি বিজ্ঞানীরা বিবর্তন বিশ্বাস করেন না? অবশ্যই করেন। Macroevolution এর চাক্ষুস, ইন্দ্রিয়লব্ধ বা experimental প্রমাণ নেই বটে, কিন্তু তা বলে কি প্রমাণ আদৌ নেই? ফসিল রেকর্ড, জিনগত মিল (molecular homology), দেহগঠনে মিল (anatomical homology) ইত্যাদি হাজারো রকম প্রমাণ বিবর্তনের পক্ষে আছে। বিজ্ঞানীদের কথাবার্তা এখানে খুব সোজাসাপ্টাঃ বিবর্তন সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়, কিন্তু জীবপ্রকৃতিতে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, যার সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যা হচ্ছে বিবর্তন। লক্ষ্য করুন, বিজ্ঞানীরা কিন্তু এখানে না দেখেই বিশ্বাস করছেন বিবর্তন ঠিক- কারণ তাদের বিশ্বাস প্রমাণসাপেক্ষ। সেই প্রমাণ ইন্দ্রিয়লব্ধ না হতে পারে, কিন্তু তারপরও তাকে যথার্থ মেনে নিয়েছেন।
বিবর্তন আপনার খুব বেশি পছন্দ না? সমস্যা নেই, মহাবিশ্বতত্ত্ব বা cosmology এর দিকে তাকান। বিগ ব্যাং থিওরীর নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই- মহাবিশ্বের একদম গোড়ার অবস্থার ব্যাপারে সবচেয়ে বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় থিওরী।
বিগ ব্যাং থিওরী সম্পর্কে অনেকগুলো প্রচলিত ভুল ধারণা আছে। অনেকে মনে করেন, বিগ ব্যাং হচ্ছে মহাবিশ্বের সৃষ্টি বা origin সম্পর্কিত থিওরী- শূন্য থেকে কিভাবে মহাবিশ্ব এলো, সেই ব্যাপার ব্যাখ্যা দেওয়া এর কাজ। কিন্তু আসলে বিগ ব্যাং এর আলোচনার বিষয় মহাবিশ্বের সৃষ্টি নয়, মহাবিশ্বের development- সময়ের সাথে সাথে এর ক্রমবিবর্তন। “ব্যাং” শুনে অনেকের বিস্ফোরণের কথা মনে হয়, কিন্তু বিগ ব্যাং এর মূল কথা বিস্ফোরণ নয়, প্রসারণ। ২০০১ এর Scientific American এ এরকম একটা কথা এসেছিলঃ
“বিগ ব্যাং থিওরীর মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে এইঃ মহাবিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে আর ঠাণ্ডা হচ্ছে। লক্ষ্য করবেন, আমি কিন্তু “বিস্ফোরণ” নিয়ে কিছুই বলিনি- কারণ বিগ ব্যাং থিওরী যে জিনিসটা ব্যাখ্যা করে তা হচ্ছে আমাদের মহাবিশ্বের বিবর্তন, সৃষ্টি নয়।”৫
আরেকটা ভুল ধারণা এরকম- মহাবিশ্বটাতে স্পেস বা স্থান গোড়া থেকেই ছিল, তারপর এই বিশাল স্পেসের কোথাও ধুম করে একটা বিস্ফোরণ হল, সেই বিস্ফোরণের মাধ্যমের পদার্থ শক্তি ইত্যাদি স্থানের সবটায় আস্তে আস্তে ছড়িয়ে গেল। স্রেফ বাজে কথা। বিগ ব্যাং এর সময় থেকে স্পেস নিজেই ক্রমাগত বাড়ছে। বেলুনের ওপর ফুটকির উদাহরণটা খারাপ না- বেলুনের বাইরের গা যদি স্থান হয় আর এর ওপর আঁকা ফুটকিগুলো যদি পদার্থ হয়, তাহলে বেলুনটা যত ফুলবে, স্থান তত বাড়বে, আর ফুটকিগুলো তত দূরে সরে যাবে। মহাবিশ্বের পদার্থগুলো যদি একে অপরের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে তাহলে এর ঘনত্ব কমে আসবে। এক কথায় খুব সহজ করে বললে বিগ ব্যাং থিওরীর বক্তব্য এরকমঃ মহাবিশ্ব একটা সময় প্রচণ্ড উত্তপ্ত আর ঘন হয়ে ছিল, কিন্তু সময় যতই যাচ্ছে তা ততই ঠাণ্ডা আর কম ঘন হয়ে আসছে।
তো এই বিগ ব্যাং থিওরীর পক্ষে কি ইন্দ্রিয়লব্ধ বা experimental কোন প্রমাণ আছে? কিছুটা হয়ত আছে, যেমন সুইজারল্যাণ্ডের CERN এর বিজ্ঞানীরা তাদের Large Hadron Collider এর মধ্যে মহাবিশ্বের একদম গোড়ার দিকের পরিবেশ তৈরির চেষ্টায় আছেন। আশা করা হচ্ছে এখান থেকে বিগ ব্যাং এর সময় আসলে কি হয়েছিল, সেই ব্যাপারে মোটামুটি একটা প্রত্যক্ষ ধারণা পাওয়া যাবে। হিগস-বোজন কণার খোঁজ পাওয়া গেছে বেশিদিন হয়নি, বিগ ব্যাং থিওরীর একটা ভবিষ্যৎ বাণী ছিল এটা। কিন্তু সেখান থেকে তথ্য যা পাওয়া যাচ্ছে তা এখনও বেশ সীমিত। তার চেয়ে বড় কথা, Large Hadron Collider এর কাজ শুরু হয়েছে ১৯৯৮ সালে, ২০০৮ সালে শেষ হয়েছে। তাহলে এর আগে বিজ্ঞানীরা বিগ ব্যাং সহ্য করেছেন কেন, আর এখনই বা কেন করছেন? কারণ চাক্ষুস প্রমাণ না থাকলেও বিগ ব্যাং এর পক্ষে অনেক, অনেক পরোক্ষ প্রমাণ আছে। যেমন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণগুলোর একটা হল Cosmic Microwave Background Radiation. মহাবিশ্বের গোড়ার দিকে পদার্থ এত ঘন অবস্থায় ছিল যে আলো স্বাধীনভাবে চলতেই পারত না। পরে আস্তে আস্তে স্থান যখন একটু বাড়ল, ঘনত্ব একটু কমে এল, তখন নিউক্লিয়াস-ইলেকট্রন জোড়া লেগে পরমাণু সৃষ্টি করল। একটা পরমাণুতে নেট কোন চার্জ থাকে না, ইলেকট্রনের নেগেটিভ আর নিউক্লিয়াসের ভেতরে থাকা প্রোটনের পজিটিভে কাটাকাটি হয়ে যায়। কাজেই আলোর স্বাধীন চলাচলে পরমাণু আর সেরকম বাধা সৃষ্টি করতে পারল না। আলোকে এতদিন গা বাঁচিয়ে চলতে হত, এখন মুক্তি পেয়ে সে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুট লাগাল। এভাবে স্বাধীনভাবে দৌড়ানোর ফলে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্যও বেড়ে গেল অনেকখানি। এই কথাগুলো যদি ঠিক হয়, তাহলে নিশ্চয়ই মহাবিশ্বের সবজায়গায় দৃশ্যমান আলোর চেয়ে বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ সমানভাবে ছড়িয়ে আছে। যন্ত্রপাতি ভাল পাওয়া গেলে হয়ত সেই বিকিরণ ধরা যেতে পারে। ১৯৬৪ এর দিকে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির কিছু বিজ্ঞানী এমনটাই ভাবছিলেন।
এর থেকে ষাট মাইল দূরে ঘটছিল আরেক কারবার। নিউ জার্সির বেল ল্যাবরেটরিতে দুই বিজ্ঞানী রেডিও তরঙ্গ ডিটেক্ট করার কাজ করছিলেন। তারা লক্ষ্য করলেন, তাদের রিসিভারের মধ্যে রহস্যময় একটা শব্দ ধরা পড়েছে। খালি ধরাই পড়েনি, আকাশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে রাত নেই দিন নেই ক্রমাগত বেজেই চলেছে। বিজ্ঞানীরা অ্যান্টেনা নেড়েচেড়ে দেখলেন, যন্ত্রপাতি গোলমাল করছে নাকি বাজিয়ে দেখলেন, তবু ঘোড়ার ডিমের সেই শব্দ থামে না। এটা ধরা গেল না ভেবেই যে প্রিন্সটনের বিজ্ঞানীরা আক্ষেপ করছেন, সেটা জানতে অবশ্য বেল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীদের একটু সময় লাগল। জানার পর অবশ্য তাদের এই আকস্মিক আবিষ্কারের তাৎপর্য বুঝতে কষ্ট হয়নি একদম। পুরো মহাবিশ্বের সবটা সমানভাবে ছড়িয়ে আছে, তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলোর চেয়ে একটু বেশি- বিগ ব্যাং থিওরীর সাথে একদম খাপে খাপে বসানো। এরকম আরো অনেক প্রমাণই বিগ ব্যাং থিওরীর পক্ষে আছে, কোনটাই প্রত্যক্ষ বা ইন্দ্রিয়লব্ধ নয়।৬ কিন্তু তারপরেও বিজ্ঞানী মহলে এর সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্নমাত্র নেই, আর তা সঙ্গত কারণেই।
বিজ্ঞান থেকেই এরকম উদাহরণ আরো অজস্র দেওয়া যায়- জীবাশ্মবিদ্যা বা paleontology- যেখানে বিজ্ঞানীরা ফসিল বা জীবাশ্ম দেখে পৃথিবীতে প্রাণের বিবর্তন আর ইকোলজি সম্পর্কে ধারণা করতে চেষ্টা করেন, ভূতত্ত্ব বা geology এর অন্তত কিছু অংশ- যেখানে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের ইতিহাস উদ্ধারের চেষ্টা করেন, বিজ্ঞানের এরকম আরো অনেক শাখাতেই ইন্দ্রিয়লব্ধ বা experimental প্রমাণ পাওয়া সম্ভব নয়। এরকম ডিসিপ্লিনগুলো নিয়ে একটা আলাদা রকম বিজ্ঞানই আছে- historical sciences (experimental science এর সম্পূরক)। চাক্ষুস প্রমাণ নেই তা বলে কি বিজ্ঞান থেমে থাকবে নাকি? আর এই historical sciences কিছুতেই experimental sciences এর থেকে কম “বৈজ্ঞানিক” নয়। আমেরিকার National Center for Science Education এর ওয়েবসাইটে experimental science আর historical science সম্পর্কে এরকম একটা কথা এসেছেঃ
“বিজ্ঞানের প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে দু’টো অ্যাপ্রোচই যথার্থ, বিজ্ঞানের কোন শাখা এ দু’টোর যেকোনটার ওপরেই নির্ভর করতে পারে, আর কোন অ্যাপ্রোচই অন্যটার চেয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে “বেশি গ্রহণযোগ্য” নয়।”৭
বিজ্ঞানীদের বক্তব্যঃ ইন্দ্রিয়লব্ধ হোক বা না হোক, প্রমাণ মাত্রই তার মাহাত্ম্য থাকবে।
চেনা জগত
এই যে এই ব্যাপারটা- চাক্ষুস বা ইন্দ্রিয়লব্ধ প্রমাণ নেই তারপরও পরোক্ষ প্রমাণের উপর নির্ভর করে কাজ করা- একে বলে abductive অথবা inferential reasoning। বিজ্ঞানের অনেক শাখায় এর ব্যবহার আছে ঠিকই, কিন্তু পদ্ধতিটা বিজ্ঞানের কেনা নয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও আমরা হরহামেশাই এর ওপর নির্ভর করি। যেমন ধরুন- সকালে উঠে আপনি দেখলেন, সামনের বাড়ির গাড়িটা রাস্তার ওপর, আশেপাশের পথঘাট ভেজা, আর গাড়ির পাশে সাবান-পানির একটা বালতি রাখা হয়েছে। আপনি বুঝে ফেলবেন, কিছুক্ষণ আগে গাড়ি ধোয়া হয়েছে। আপনি কিন্তু ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখেননি- কিন্তু এই যে ভেজা রাস্তা, বাইরে বের হওয়া গাড়ি আর সাবান-পানির বালতি, এই ব্যাপারগুলোর সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যা হল কিছুক্ষণ আগে গাড়ি ধোয়া হয়েছে। ছাতা বন্ধ করতে করতে আপনার বন্ধু যখন ভিজে একসা হয়ে বাসায় আসল- আপনি না দেখেও বুঝে নিলেন বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, এছাড়া ঐ আধখোলা ছাতা আর ভেজা জামাকাপড়ের যৌক্তিক ব্যাখ্যা কি দেবেন? আপনি নিজেও চিন্তা করলে অজস্র উদাহরণ বের করতে পারবেন, যেখানে আপনি চাক্ষুস না দেখেও অনেক কিছু বিশ্বাস করে নিয়েছেন। পদ্ধতিটা আমাদের সবারই চেনা, বিজ্ঞানীরা এর আরেকটু sophisticated প্রয়োগ করেন, পার্থক্য এটুকুই।
সত্যি কথা বলতে কি, দৈনন্দিন জীবনে আমরা যদি শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়লব্ধ প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে চলি, জীবন ভীষণ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আপনি ক্লাস ফোর থেকে জেনে এসেছেন আপনার বন্ধুর নাম মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইসলাম তনয়, এই ব্যাপারটার পক্ষে আপনি ইন্দ্রিয়লব্ধ প্রমাণ কি দেবেন? বন্ধুর বাবা-মা যখন অনেক কায়দা করে নানা-দাদা দুইপক্ষকেই খুশি রাখার জন্য ভেবেচিন্তে নাম দিচ্ছিলেন, তখন কি আপনি ওখানে ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে উপস্থিত ছিলেন? বাচ্চাকাল থেকে ডিসকাভারিতে দেখেছেন অ্যান্টার্কটিকা বলে বরফে ঢাকা পেঙ্গুইন-টেঙ্গুইন ওয়ালা একটা জায়গা আছে, আপনি কি দেখে এসেছেন? সম্ভাবনা খুব বেশি মনে হচ্ছে না। এরকম অনেক কিছুতেই আমরা বিশ্বাস করি বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষীর ভিত্তিতে- সাক্ষী হতে পারেন পরিবার কিংবা আত্মীয়স্বজন, লাইব্রেরির বই, জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল। কেন এগুলো বিশ্বাস করেন? কারণ এতগুলো মানুষ এত হাঙ্গামা করে অকারণে খামোখা মিথ্যা বলবে- এরকম বিশাল কন্সপিরেসি থিওরী বিশ্বাসের পেছনে যুক্তি সেরকম নেই। এরকম testimony-ভিত্তিক বিশ্বাস আমাদের জীবনে ভূরি ভূরি আছে, এগুলো বাদ দিতে গেলে পাগল হয়ে যেতে হবে।
সারকথা
বিজ্ঞান আর চেনা জগত থেকে একটু পেছনে সরে এবার একটু বিগ পিকচারটা দেখার চেষ্টা করি। মানুষ আসলে কোনকিছু বিশ্বাস করার পেছনে বিভিন্ন ব্যাপারকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে। নামগুলো বাংলায় অনুবাদ করে করে লিখতে গেলে কিম্ভূত দেখাবে, কাজেই লিস্টে ইংরেজি নামগুলোই ব্যবহার করছি।
১।Self-evidence: সবচেয়ে সহজ উদাহরণ পাটিগণিত আর সাধারণ যুক্তিবিদ্যা। ২+২=৪ জিনিসটা আমাদের মাথায় এতই তাৎক্ষণিকভাবে আসে, যে আমরা কল্পনাই করতে পারি না দুই আর দুইয়ে পাঁচ হওয়া কীভাবে সম্ভব। একই কথা খাটে “সকল মানুষ মরণশীল, সক্রেটিস একজন মানুষ, কাজেই সক্রেটিস মরণশীল” অথবা “বিবাহিত ব্যাচেলর বলে কিছু নেই” জাতীয় সহজ যুক্তিনির্ভর বাক্যগুলো ক্ষেত্রেও। এগুলো তর্কের অতীত সত্য, কোনভাবেই এদের এড়িয়ে চিন্তা করা সম্ভব নয়।
২।Introspection: একটা লাল চাদর দেখার সময় আপনি যদি মনে করেন “আমি বিশ্বাস করি আমি এই মুহূর্তে একটা লাল চাদর দেখছি” তাহলে এই কথাটাকে ভুল প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এমন হতে পারে আপনি বর্ণান্ধ, অথবা কোন ড্রাগের প্রভাবে সবুজ জিনিসকে লাল দেখছেন, কিন্তু আপনি যে বিশ্বাস করেন আপনি লাল কিছু দেখছেন- সেটা কিন্তু ধ্রুব সত্য। আপনি আপনার নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যা বিশ্বাস করেন, সেটা এড়িয়েও আপনার পক্ষে চিন্তা করা সম্ভব নয়।
৩।Perception: এবার আসছে সেই ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের কথা। একটা লাল চাদর দেখার সময় আপনি যদি মনে করেন “চাদরটা লাল”, তবে তা হবে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের উদাহরণ (আগেরটা আর এটার পার্থক্য লক্ষ্য করুনঃ perception বলে- অভিজ্ঞতাই ঠিক; introspection বলে- আমার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমার যা বিশ্বাস, তা ঠিক)।
৪।Induction: আমরা হয়ত খেয়ালও করি না এটা, কিন্তু আমাদের মধ্যে সবসময় এই বিশ্বাস কাজ করে যে প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো এতদিন যেভাবে ঘটছিল, ভবিষ্যতে সেভাবেই ঘটবে। নিউটনের সামনে একটা আপেল পড়ার পর উনি ভাবেন নি- যাক, একটা আপেল তো মাটিতে পড়ল, এখন দেখি এর পরেরটাও তাই করে কিনা। সূর্য পূর্ব দিকে এতকাল উঠেছে তার মানে অবশ্যই কালকেও উঠবে, হঠাৎ মত বদলিয়ে পৃথিবী উল্টো দিকে ঘোরা শুরু করবে না। অন্যভাবে বলতে গেলে, প্রাকৃতিক কার্যকারণ আর নিয়মকানুনের repetition এর ওপর আমাদের আস্থা আছে। এটাই induction.
৫।Testimony: ওপরে আলোচনা এসেছে।
৬।Inference: ওপরে আলোচনা এসেছে।
লিস্টটা সম্পূর্ণ নয়, আরো যোগ করা যায় memory বা স্মৃতিনির্ভর বিশ্বাস, ভাল-মন্দের জ্ঞান, ঈশ্বর সঙ্ক্রান্ত বেসিক কিছু বিশ্বাস- মুসলিমদের এবং অন্তত কিছু ক্রিশ্চানদের বিশ্বাস অনুসারে যা মানুষের মধ্যে এমনিতেই থাকে, ইত্যাদি। সবগুলোই যে বিতর্কের উর্ধ্বে দাবি করছি না আদৌ। কিন্তু লক্ষ্য করুন, প্রথম তিনটা (এমনকি চারটা) বাদ দিলেও কিন্তু আরো কিছু ব্যাপার থেকে যাচ্ছে, যাদের ভিত্তিতে আমরা অনেক কিছুকেই বিশ্বাস করে থাকি। এরকম বিশ্বাস আদৌ দুর্বল নয়। আল্লাহকে দেখা না গেলেই যে তাঁকে বিশ্বাসের কোন যুক্তি নেই, ব্যাপারটা তাই আদৌ সেরকম নয়।
আমার তাই মনে হয় লেখার শুরুতে করা প্রশ্নটা বেশি ইন্টারেস্টিং নয়। অনেকেই প্রশ্নটাকে একটু পরিবর্তন করে এভাবে করতে চাইবেনঃ ঠিক আছে, আল্লাহকে দেখতে চাইছি না আপাতত। কিন্তু তাঁর পক্ষ থেকে শক্ত কোন চাক্ষুস প্রমাণ নেমে আসলেও তো পারে। আল্লাহর লাখো কোটি ফেরেশতা, একজন পট করে মাটিতে নেমে আসছেন না কেন? এই কয়েকদিন আগে সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসে পড়ল, আল্লাহ এটাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেই তো তাঁর শক্তি বোঝা যেত, অবিশ্বাসের জায়গা থাকত না কারো। Skeptics ম্যাগাজিনের সম্পাদক Michael Shermer TED এর একটা অনুষ্ঠানে বলেছিলেনঃ এই যে যুদ্ধে এত মানুষের হাত-পা কাটা যাচ্ছে, বিশ্বাসীরা যদি একযোগে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন আর তার উত্তরে ঈশ্বর যদি একজনেরও হাত আমাদের চোখের সামনে গজিয়ে দেন, তাহলেই সব সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু তা আজ পর্যন্ত একবারও হয়নি, কাজেই ঈশ্বরের বিশ্বাসের সেরকম কারণ নেই।
এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা কথা বলব আসছে লেখায়।
——————————————————————————–
ফুটনোটঃ
১. সূরা বাক্বারা, ২:২-৩
২. “প্রমাণ” কথাটা বলতে এখানে শুধুমাত্র দার্শনিক বা যুক্তিতর্কের প্রমাণ বোঝানো হচ্ছে না। ইসলামের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে নবীজী ﷺ কয়েকটা জিনিস আমাদের দিয়ে গেছেন। মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী, তাঁর সময়কার মানুষের জন্য উনি বিভিন্ন অলৌকিক নিদর্শন দেখিয়েছিলেন, যেমন চাঁদ দু’ভাগ করে ফেলা, যুদ্ধপ্রস্তুতির সময় সামান্য একটু খাবার থেকেই গোটা সৈন্যদলের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে ফেলা, ইত্যাদি। এগুলোর প্রভাব শুধুমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীদের জন্য, আমাদের জন্য অতটা নয়। সমগ্র মানবজাতির জন্য যে অলৌকিক নিদর্শনটা রয়েছে তা হচ্ছে কুর’আনের সাহিত্য। এর সমতুল্য কিছু তৈরি করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, কাজেই এটা নিঃসন্দেহে আল্লাহরই বাণী- এরকম দাবী কুর’আনে বেশ কয়েকবার এসেছে (যেমন ২:২৩-২৪)। ইসলামের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আরেকটা প্রমাণ হচ্ছে মহানবীর জীবনঃ তাঁর আন্তরিকতা, সত্যবাদিতা, বিশ্বাসযোগ্যতা, বুদ্ধিবৃত্তিক স্থিতিশীলতা, কবিতা ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে অজ্ঞতা- ইত্যাদি বিষয়ের প্রেক্ষিতে কুর’আন কেন বা কীভাবে রচিত হল, তার ব্যাখ্যা দেওয়া অসম্ভব (এর উল্লেখ কুর’আনে অসংখ্যবার এসেছে, একটা উদাহরণ হচ্ছে ১২:১০২-১০৪)। অন্যান্য প্রমাণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কুর’আন এবং হাদীসে আসা বিভিন্ন ভবিষ্যৎ বাণী যেগুলো পরবর্তীতে সত্য প্রমাণিত হয়েছে (৩০:১-৪ খুব জনপ্রিয় উদাহরণ)। ইসলামী বিশ্বাসের যৌক্তিকতা আর সহজবোধ্যতাও মহানবী প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এখন আসলেই প্রমাণ বা নিদর্শনগুলো যৌক্তিক কি না, সে আলোচনার জায়গা এখানে করা সম্ভব নয়। আপাতত পয়েন্ট এরকমঃ ইসলাম তার নিজের পক্ষে আসলেই বেশ কিছু প্রমাণ দাবি করে, যদিও সেই প্রমাণগুলো কতটা যথার্থ সেটা আলাদা প্রশ্ন। এখানে উল্লেখ্য যে, এসব যৌক্তিক প্রমাণ ছাড়াও কারো বিশ্বাস যথার্থ হতে পারে। ইসলামের মতে, মানুষের মনস্তত্ত্বে এমন একটা চেতনা থাকে, যার দ্বারা মানুষ কোন যুক্তিতর্ক ছাড়াই বুঝতে পারে- আল্লাহ আছেন, বা ইসলাম সত্য। বেশ কিছু সাহাবা ছিলেন, যারা নবীজীর চেহারা দেখেই কীভাবে কীভাবে বুঝে ফেলেছিলেন- এই ব্যক্তি অতি অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছেন। নবীজীর জীবনীতে এরকম উদাহরণ কম নেই, যেখানে কেউ তাঁর মুখ থেকে দু-একটা কথা শুনেই মুসলিম হয়ে গেছেন। এসব ক্ষেত্রে সেখানে যুক্তির স্থান হয়ত ছিল, কিন্তু বিশ্বাসের সত্যিকার trigger ছিল সেই মনস্তত্ত্বে গোঁজা চেতনাটুকু। এখন কেউ যদি বলেন- আমার খুব তীব্রভাবে মনে হচ্ছে ইসলাম সত্য (ঠিক যেভাবে কেউ বুঝতে পারে যে অতীত আসলেই আছে, অ্যারিস্টটলের ঈশ্বর দেখুন), সেক্ষেত্রে ইসলাম বিশ্বাস করার ফলে তিনি অযৌক্তিক কিছু করেন নি, বরং তার মনস্তত্ত্বের দাবিই পূরণ করেছেন। অর্থাৎ তাঁর নিজের জন্য ঐ তীব্র বিশ্বাসটাই যথেষ্ট প্রমাণ। প্রমাণ কথাটা এই সবকিছু মিলিয়ে খুব ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে।
৩. ইসলামের সাথে বিবর্তনের সবকিছু খাপ খায় না, হয়ত জেনে থাকবেন। এখানে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উদাহরণ হিসেবে বিবর্তন ব্যবহার করা হচ্ছে, মানুষের বিবর্তনে বিশ্বাস অ্যাডভোকেট করা হচ্ছে না। এ ব্যাপারে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছা আছে।
৪. একটু কন্ট্রোভার্সি আছে দাবিটার মধ্যে। কেউ কেউ দাবি করেছেন, macroevolution এর প্রমাণ নাকি পাওয়া গেছে- Michigan University এর Richard Lenski ২০ বছর ধরে E. coli নিয়ে পরীক্ষা করে অবশেষে macroevolution এর প্রমাণ পেয়েছেন ( এখানে দেখুন )। এর বিরুদ্ধেও অবশ্য লেখালেখি করেছেন কেউ কেউ, যেমন Lehigh University এর Michael Behe। তথ্যগত কন্ট্রোভার্সি এড়িয়ে আসল পয়েন্টটা দেখার অনুরোধ থাকলঃ যদি এরকম experimental প্রমাণ পাওয়া নাও যেত, তারপরও কি বিবর্তনের পক্ষে অন্যান্য প্রমাণগুলো যথেষ্ট হত না? Richard Lenski এর পরীক্ষার আগে কি তবে বিবর্তনের মূল্য ছিল না? অবশ্যই ছিল।
৫. P. J. E. Peebles, Scientific American, 2001 issue, p. 44
৬. বিস্তারিত জানতে এখানে দেখুন আর Cosmic Microwave Background Radiation এর আকস্মিক আবিষ্কার সম্পর্কে আরো জানতে এখানে দেখুন
——————————————————————
Collected from: https://ahobaan.wordpress.com/2013/04/13/aristotler-isshor/