
এবং হিমু যখন প্র্যাকটিসিং মুসলমান (পর্ব-১২)
রাতের অনিদ্রাজনিত ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা ও আতংক ভোরবেলা একটা হট শাওয়ার দিয়ে রেশমা খালা দুর করে দেন । প্রতিবারের মতো এবারও গোসলের পর তিনি হিজাবটা মাথায় দিলেন। খানিকটা সাজ গোজ করে আমার ঘরে এসে বললেন, কি রে হিমু জেগে আছিস ? গুড মর্নিং।
আমি বললাম, আসসালামু আলাইকুম খালা
চা দিতে বলেছি হাত মুখ ধুয়ে আয়।
তোমাকে তো হিজাবে ভালোই লাগে খালা। বোরখা পড়া শুরু করে দিবা নাকি!
কি সব বলিস হিমু । এখন সামান্য সাজগজ করছি। দু দিন পরে তো মরেই যাব । কবরে গিয়ে তো আর সাজতে পারব না। কবরে তোরা তো আর ক্রিম লিপস্টিক দিয়ে আসবি না।
সেটা খাঁটি কথা বলেছ খালা । কবরে ক্রিম লিপস্টিক দেয়ার সুযোগ নেই।
বয়সকালে সাজতে পারিনি। এমন এক লোকের হাতে পড়েছিলাম যার কাছে সাজা না সাজা এক। তাকে একবার ভাল একটা ক্রিম আনতে বলেছিলাম, সে দেশি তিব্বত স্নো নিয়ে চলে এসেছে। তারপরেও আফসোস– এত নাকি দাম।
এখন তো পুশিয়ে নিচ্ছ।
তা নিচ্ছি। আয় চা খাবি । আজ ইংলিশ ব্রেকফাস্ট ।
আলহামদুলিল্লাহ। ভালো তো …
চায়ের টেবিলে রেশ্মা খালাকে বললাম, খালা অদ্য শেষ সকাল।
খালা বললেন, তার মানে কি?
তার মানে হচ্ছে নাশতা খেয়েই আমি ফুটছি।
ফুটছি মানে কি?
ফুটছি মানে বিদায় হচ্ছি । লম্বা লম্বা পা ফেলে পগারপার।
আশ্চর্য কথা — চলে যাবি কেন? এখানে কি তোর কোন অসুবিধা হচ্ছে?
কোনই অসুবিধা হচ্ছে না। বরং সুবিধা হচ্ছে। আমার ভুড়ি গজিয়ে গেছে। আর কদিন থাকলে মেদ ভুরি কি করি ওয়ালাদের খুঁজে বের করতে হবে।
ঠাট্টা করবি না হিমু। খবর্দার ঠাট্টা না।
আমি মোটেও ঠাট্টা করছিনা খালা চা খেয়েই আমি ফুটবো।
খালা বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। চা এর কাঁপে চুমুক দিয়ে বলেলেন, আমার এই ভয়ংকর অবস্থা দেখেও তোর দয়া হচ্ছে না? রাতে এক ফোটা ঘুমুতে পারি না। ঐ বদমায়েশ লোকটার যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে ছাদ থকে লাফিয়ে পড়ে মরে যেতে ইচ্ছে করে। আর তুই চলে যাবি?
খালু সাহেব কি কালও এসেছিল?
হু।
খালা গতকাল খালু সাহেবকে আমি স্বপ্নে দেখেছি ,
কি বলিস– সত্যি?
হু
হু — হ্যাঁ করিস না । ঠিক মত বল তুই দেখেছিস?
হু
আবার হু। আরেকবার হু বললে কেতলির সব চা মাথায় ঢেলে দেব। কি দেখেছিস ঠিক মত বল।
দেখলাম খালু সাহেব আমার খাঁটের সাইডে বসে আছে।
দেখে ভয় পেয়েছিলি?
ভয় পাব কেন? জীবিত অবস্থায় উনার সঙ্গে আমার ভাল খাতির ছিল। একবার হেঁটে হেঁটে সদরঘাটের দিকে যাচ্ছি । তিনি তার প্রাইভেট রিকশায় যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে রিকশা থামিয়ে তুলে নিলেন। পথে এক জায়গায় আঁখের শরবত বিক্রি হচ্ছিল। রিকশা থামিয়ে আমরা আখের শরবত খেলাম। আরেকটু এগিয়ে দেখি ডাব বিক্রি করছে— রিকশা থামিয়ে দুজন ডাব খেলাম। তারপর খালু সাহেব আইসক্রিম কিনলেন। খেতে খেতে আমরা তিনজন যাচ্ছিলাম।
তিনজন হল কিভাবে?
রিকশাওয়ালাও খাচ্ছিল। তিনজন মিলে রীতিমত এক উৎসব। বুঝলে খালা, তখনই বুঝলাম উনি একজন অসাধারণ মানুষ। প্রায় মহাপুরুষ পর্যায়ের। ব্যবসায়ীরাও মহাপুরুষ হতে পারে কোনদিন ভাবিনি।
তুই এক কথা থেকে আরেক কথা চলে যাচ্ছিস। আসল কথা বল। খাটের নিচে বসেছিল?
খাটের নিচে না খাটের সাইডে।
তারপর?
আমি বললাম, খালু সাহেব কেমন আছেন ?
সে কি বলল?
কিছু বললেন না। মনে হল লজ্জা পেলেন। তখন আমি বেশ রাগ রাগ ভাব নিয়ে বললাম –আপনার মত একটা ভদ্রলোক মেয়েছেলেকে ভয় দেখাচ্ছেন , এটা কি ঠিক হচ্ছে? ছি ছিঃ
তুই কি সত্যি এইসব দেখেছিস?
হ্যাঁ দেখেছি।
তারপর কি হল?
মনে হল উনি আমার কথায় আবারও লজ্জা পেলেন খুব। মাথা নিচু করে ফেললেন। আমার তখন মোনটা একটু খারাপ হল । আমি বললাম , এসব করছেন কেন?
সে কি বলল?
কথা বার্তা তার খুব পরিষ্কার না। মনে হল তোমার ওপর তিনি রেগে আছেন , আমার মনে হয় তুমি যে তাকে দেখছো এটা তোমার জন্যে একটা শিক্ষা হতে পারে আল্লাহর তরফ থেকে ।
রেশমা খালা ফস করে বললেন , শিক্ষা? কিসের শিক্ষা? আমি কি করেছি যে আমাকে শিক্ষা দেবে? সারাজীবন যন্ত্রণা করেছে। মরার পরও যন্ত্রনা দিচ্ছে। আর কিছু না। লোকটা ছিল হাড় বদমাশ।
স্বপ্নে আমিও খালু সাহেবকে এরকমই কিছু একটা বললাম তবে বদমাইশ টা মনে হয় বললাম না। তখন খালু সাহেবের মুখ থেকে একটা শব্দ খুব স্পষ্ট শুনলাম ‘বিষ’ । ভাব ভঙ্গি দেখে যা বুঝলাম তাতে মনে হল তার মৃত্যুতে তোমার কোন একটা ইনভল্ভমেন্ট আছে । খালা তুমি কি খালুকে বিষ টিষ খাইয়েছিলে?
এত বড় মিথ্যা কথা আমার নামে ? এত সাহস? ব্যথায় তখন ওর দম যায় যায় অবস্থা। আমার মাথার নেই ঠিক দৌড়ে ওষুধ নিয়ে এসে খাওয়ালাম…
খালা যেটা খাওয়ানোর কথা সেটা না খাইয়ে ভুলটা খাইয়েছ। পিঠে মালিশের ওষুধ দু চামচ খাইয়ে দিয়েছ তাই না ।
ইচ্ছে করে তো খাওয়াই নেই ভয়ে আমার মাথা এলো মেলো।
আমিও তাই ভেবেছি — এটা অনিচ্ছাকৃত একটা ভুল ।
স্বপ্নে আমি খালু সাহেবকে বললাম , আপনি বিষ এর কথা বলছেন কেন, আপনি কি বলতে চাইছেন রেশমা খালা ইচ্ছাকৃত বিষ খাইয়েছে আপনাকে ? রেশমা খালা মানুষ খুন করার মত মহিলা না। অতি দয়ার্দ্র মহিলা।
এটা শুনে কি বলল?
খিক খিক করে অনেক্ষণ হাসল। তারপর আমি বললাম এখন আপনার প্রতি তো খালার গভীর ভালবাসা। আপনার স্মৃতি রক্ষার্থে গনি মিয়া ইন্সটিটিউট অব মর্ডান আর্ট করবে।
শুনে কি বলল?
শুনে তোমাকে লানত দিয়েছে খালা।
রেশমা খালা এখন আর চা এর কাঁপে চুমুক দিচ্ছেন না । স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন। চোখের দৃষ্টি আগের মত নেই। অন্যরকম।
আমি শান্ত গলায় বললাম খালা যা হবার হয়ে গেছে … এখন তোমার বাঁচার একটা উপায় আছে ।।
সেটা কি?
সেটা হল তুমি আবার তোমার রবের দিকে ফিরে যাবে। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে কান্না কাটি করবে। ঠিক মত নামায পড়বে , পর্দা করবে। তোমার যে সহায় সম্পদ আছে তা দান করে দেবে মাসজিদ , মাদ্রাসা , এতিমখানা নির্মানের জন্য । এবং তার যত গরিব আত্মীয় স্বজন আছে তাদের সবাইকে সাহায্য করবে। এবং আল্লাহর কাছে তোমার গুনাহর জন্যে ক্ষমা চাইবে … আল্লাহ হয়তো তোমাকে ক্ষমা করেও দিতে পারেন।
হিমু
জ্বি খালা
তুই অসম্ভব বুদ্ধিমান। তুই কিছুই দেখিসনি। কারো সঙ্গেই তোর কথা হয় নি। পুরোটা আমাকে বানিয়ে বানিয়ে বলেছিস। অন্ধকারে ঢিল ছুড়েছিলি –ঢিল লেগে গেছে। তোর খালু যেমন বোকা ছিল, আমিও ছিলাম বোকা। শুধু ছিলাম না। — এখনো আছি কথা দিয়ে তুই আমাকে প্যাঁচে ফেলেছিস। তোর ধারনা তোর কথা শুনে তার কোটি কোটি টাকা আমি দান খয়রাত করে নষ্ট করব? রাতে ভুত হয়ে আমাকে ভয় দেখায় তাতে কি হয়েছে ? দেখাক যত ইচ্ছা বদমায়েশ এর বদমাইশ।
আমি মিথ্যা বলছি না খালা । আমি কিন্তু সত্যি দেখেছি।
বেশি চালাকি করতে যাস না হিমু। তোর চালাকির আমি পরোয়া করি না। খবর্দার তোকে যেন আর কোনদিন এই বাড়ির আসে পশে না দেখি।
আর দেখবে না খালা। এই যে আমি ফুটব , জন্মের মতই ফুটব। খালা শোন, আমি যে স্বপ্নের কথা তোমাকে বললাম তা কিন্তু এক বিন্দুও মিথ্যে না। পুরোটাই আমি দেখেছি ।
চুপ থাক হারামজাদা। শুয়োরের বাচ্চা চুপ।
রেশমা খালা ভয়ানক হৈ -চৈ শুরু করলেন। বাবুর্চি , দারওয়ান , মালী সবাই ছুটে এল। রেশমা খালা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, এই চোরটাকে লাথি মেরে বের করে দাও।
রেশমা খালার কর্মচারিরা ম্যাডামের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল। শুধু লাথিটা দিল না।কিছুদিন এক সাথে দ্বীন শিক্ষা করেছি । এর একটা তাসির তো আছেই। আমাকে গেঁটের বাইরে বের করে দিয়ে , কিছুক্ষণ পর দুই বাবুর্চি আর মালী বাইরে এসে লাফ দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল। আমি রাস্তায় চারিদিকে তাকাচ্ছি। মানুষজন জড়ো হয়ে যাচ্ছে। কি মুশকিল ।
কেয়ামতের দিন যেই সাত ধরনের ব্যক্তিদের আল্লাহর আরশের নিচে ছায়ায় স্থান দেয়া হবে এদের মধ্যে তারাও থাকবে যারা আল্লাহর জন্যই পরস্পরের কাছে আসে আবার আল্লাহর জন্যেই দুরে সরে যায়। আল্লাহর জন্যে একজন আরেকজনকে ভালো বাসার ব্যপারটা খুব অদ্ভুত। এই ভালোবাসা হয় নিঃস্বার্থ। পৃথিবীতে কি এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর কোথাও আছে। না কোথাও নেই।
ঝিনুক স্যুপ বাবুর্চির চোখ নাক দিয়ে পানি বের হচ্ছে। তার নাকের পানিটা আমার জোব্বায় লেগে যাবে নিশ্চিত। অন্যদিন হলে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতাম। আজকে ধাক্কা দিতে মন চাইছে না। লাগুক নাকের পানি। নাকের পানি দীয়ে জোব্বা ভিজে যাক।
(চলবে ইন শা আল্লাহ … )
আগের পর্বগুলোর লিংক
রচনায় : আলী আবদুল্লাহ