আল-তুশি : জিজ-ইলখানি উপাত্তের উদ্ভাবক
১২৫৮ খৃস্টাব্দে বাগদাদ নগরীতে এক মহা লুণ্ঠনযজ্ঞ চলে। তার নেতৃত্ব দেন হালাকু খান। মূলত এই লুণ্ঠনযজ্ঞের মাধ্যমে বাগদাদ নগরীকে এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত কর হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম নগরী হিসেবে তখন সুপরিচিত ছিল এই বাগদাদ নগরী। হালাকু খান বাগদাদ নগরীতে ঢুকে সেই জ্ঞান বিজ্ঞানের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান দুমড়ে-মুচড়ে দেন। বিপুল সংখ্যক মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য বই সে সময় নষ্ট হয় বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। কিন্তু তার পরেও এই হালাকু খান ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রজ্ঞার একজন পৃষ্ঠপোষক। তাঁর প্রত্যক তত্ত্বাবধানে ও পৃষ্ঠপোষকতায় একজনস বিজ্ঞানীর উন্মেষ ও বিকাশ হয়েছিল। এই বিখ্যাত পন্ডিত তাঁর জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক আবিষ্কার উদ্ভাবনার মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতাকে আরও সমৃদ্ধতর স্তরে নিয়ে পৌঁছান।
তিনি জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক একটি উপাত্ত উদ্ভাবন করেন। এই উপাত্ত ভবিষ্যৎ জ্যোতির্বিদ্যার জন্যে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে। এমনকি কপারনিকাসকেও তাঁর এই উপাত্তের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। এর উদ্ভাবক এই উপাত্ত উৎসর্গ করেছিলেন এর পৃষ্ঠপোষকের নামে। অদম্য হালাকু খান ইল খান নামেও পরিচিত ছিলেন। সে জন্যে এই উপাত্ত বা টেবিল-এর নাম দেয়া হয় ‘Jij-Ilkhani।
এই মহান উদ্ভাবকের পুরো নাম আবু জাফর মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আল-হাসান নাসির উদ্দিন আল-তুশি। আল-তুশি’র জন্ম ১২০১ খৃষ্টাব্দে। খোরাশানের তুশ প্রদেশে তিনি জন্মান। তিনি আল-তুশি নামেই সমধিক পরিচিত। আল-তুশি অনুপম জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তার অসাধারণ জ্ঞানার্জনের জন্যে। তিনি গণিত জগতের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। চিকিৎসা বিদ্যায়ও তিনি অর্জন করতে সক্ষম হন অগাধ জ্ঞান। আইনবিদ্যা ও নীতি-দর্শন বিদ্যায়ও তার জ্ঞান ছিল অগাধ। জীবনের শেষ প্ৰান্তে তিনি অর্জন করেন অসাধারণ সাফল্য। জ্যোতির্বিদ্যায় তার অবদান অপরিমেয়। ত্রিকোণোমিতিতেও তার অবদান একই ধরনের। তিনি সে সময়ের বিখ্যাত পণ্ডিত কামাল উদ্দিন ইবনে ইউসূফ ও সমসাময়িক বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের কাছে শিক্ষা লাভের সুযোগ পান।
তুশি’র কর্মজীবন শুরু নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। তিনি অন্যান্যের সাথে হাসান বিন সাবাহ এজেন্টদের হাতে গ্রেফতার হন। তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় হাসানের সুরক্ষিত দুৰ্গ আলমাত-এ। তুশি’র ভাগ্য নির্ধারিত হওয়ার আগেই আলামাত দুর্গ দখল করে নেয় মোঙ্গলেরা। সে সময়টা ছিল ১২৫৬ খৃষ্টাব্দ। তুশি চাকরি পেলেন হালাকু খানের অধীনে। তুশি’র গুণাগুণ ও অসাধারণ জ্ঞানে বিমোহিত হলেন হালাকু খান। হালাকু খান আ-তুশিকে নিয়ে সত্যিই বিস্মিত হয়ে পড়েন। তিনি আল-তুশিকে একজন মন্ত্রীর মর্যাদায় উন্নীত করলেন। হালাকু খানের রাজ্যের ওয়াকফ এস্টেটের দেখা শোনার দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। তুশি তাঁর নিজের উদ্দেশ্য সাধনেও মনোযোগী হলেন। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মারামাতে একটি মানমন্দির গড়ে তোলা হলো। এটি রূপ নেয় এক অসাধারণ মানমন্দিরে। এই মানমন্দির জ্যোতির্বিজ্ঞানে এক অনন্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়। এই মানমন্দিরে সমাবেশ ঘটেছিল সে সময়ে সর্বোত্তম যন্ত্রপাতির।
মোঙ্গল সেনাবাহিনী বাগদাদ থেকে যেসব যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিল, সেগুলো এই মানমন্দিরকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। তুশি নিজে উদ্ভাবন করেছিলেন ‘টু টায়ার ইনস্ট্রমেন্ট’। তার নাম দেয়া হয়েছিল ‘তারাগুয়ায়েত’। একটানা বারো বছর তুশি সে মানমন্দিরে কাজ করেন। তাঁর ছিল বেশ ক’জন সহযোগী। লেখার সাধনা বৃথা যায়নি তাঁর। তিনি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন জ্যোতির্বিদ্যার এক অনন্য উপাত্ত। তুশি ৩০ বছর সাধনা করে এই উপাত্তের কাজ সম্পন্ন করেন। হালাকু খান চেয়েছিলেন আল-তুশি এই উপাত্ত বা টেবলটি ১২ বছরে সম্পাদন করুন।
তুশিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি টলেমীয় জ্যোতির্বিদ্যার ভুল-ত্রুটি ধরতে সক্ষম হন। তিনি এগুলো সংশোধনও করেন। কোপারনিকাস তা অনুসরণ করেন। তুশি’র আইন বিদ্যা বিষয়ক বই আল-তুশির নাম ব্যাপকভাবে পরিচিত করে তোলে। এই বইটির নাম ছিল : Akhlak-E-Namiree। কয়েক শতাব্দী ধরে এই বইয়ের জ্ঞান ছিল শিক্ষার্থীদের জ্ঞানাধার। এটি ছিল একটি বিখ্যাত বই। বইটি অসাধারণ জনপ্রিয়তাও লাভ করেছিল। তিনি ইসলামী দর্শন সম্পর্কে একটি সৃজনশীল বই লিখে গেছেন। এর নাম : Tajrid-al-Akhlak। এই বইটিও খুব জনপ্রিয় ছিল।
তার আবিষ্কার ও উদ্ভাবনা সম্পর্কিত বইয়ের সংখ্যা অজানা। ব্ৰুকম্যানের মতে, তাঁর বইয়ের সংখ্যা ৫৬। শার্টন বলেছেন, এ সংখ্যা ৬৪। এর চার ভাগের এক ভাগই জোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত। বাকিগুলো অন্যান্য বিষয়ের। বইগুলো আরবিতে ও ফার্সিতে। এগুলোর অনুবাদ হয়েছে লাতিন ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায়। এগুলো ছাপা অবস্থায় পাওয়া যেতো।
তুশিকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞান ও দর্শনের আলোচনা চলতে পারে না। তিনি শেষ জীবনে বাগদাদ গিয়েছিলেন। এই নগরী একদিন তার পৃষ্ঠপোষক হালাকু খানই লুণ্ঠন করে নিয়ে যান। সম্ভবত তিনি ১২৭৪ খৃষ্টাব্দে মারা যান। তার মৃত্যুতে যেনো একটি আলোকবর্তিকার পতন ঘটলো।