জাবির ইবনে হাইয়ান এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

জাবির ইবনে হাইয়ান এর পূর্ণ নাম হল আবু আবদুল্লাহ জাবির ইবনে হাইয়ান। তিনি আবু মুসা জাবির ইবনে হাইয়ান নামেও পরিচিত। কেউ কেউ তাঁকে “আল হাররানী’ এবং ‘আস সুফী’ নামেও অভিহিত করেন। ইউরোপীয় পন্ডিতগণ তাঁর নামকে বিকৃত করে জিবার (Geber) লিপিবদ্ধ করেছে। তিনি কবে জন্মগ্রহণ করেন তা সঠিক ভাবে নির্ণয় করা যায় না। যতদূর জানা যায়, তিনি ৭২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হচ্ছে হাইয়ান। আরবের দক্ষিণ অংশে জাবিরের পূর্ব পুরুষগণ বাস করতেন। তাঁরা ছিলেন আজাদ বংশীয়।

স্থানীয় রাজনীতিতে আজাদ বংশীয়রা বিশেষ ভাবে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে জাবিরের পিতা হাইয়ান পূর্ব বাসস্থান ত্যাগ করে কুফায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তিনি ছিলেন চিকিৎসক ও ঔষধ বিক্রেতা। জানা যায়, উমাইয়া বংশের খলিফাগণের নিষ্ঠুর ও অমানবিক কার্যকলাপের দরুন হাইয়ান উমাইয়া বংশের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করতেন। সেহেতু তিনি পারস্যের কয়েকটি প্রভাবশালী বংশের সঙ্গে পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করাবার জন্যে আব্বাসীয়দের দূত হিসেবে কুফা ত্যাগ করে তুস নগরে গমন করেন। এ তুস নগরেই জাবিরের জন্ম হয়। হাইয়ানের ষড়যন্ত্রের কথা অতি শীঘ্রই তৎকালীন খলিফার দৃষ্টিগোচর হয়।

খলিফা তাঁকে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং হাইয়ানের পরিবার পরিজনদের পুনরায় দক্ষিণ আরবে প্রেরণ করেন। দক্ষিণ আরবেই জাবির ইবনে হাইয়ান শিক্ষা লাভ করেন। শিক্ষা লাভের প্রতি ছিল পরম আগ্রহ। যে কোন বিষয়ের বই পেলেই তিনি তা পড়ে শেষ করে ফেলতেন এবং এর উপর গবেষণা চালাতেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি এখানে গণিতের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ পারদর্শী বলে খ্যাত হয় ওঠেন। শিক্ষা সমাপ্তির পর জাবির ইবনে হাইয়ান পিতার কর্মস্থান কুফা নগরীতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন।

সেখানে তিনি প্রথমে চিকিৎসা ব্যবসা আরম্ভ করেন এবং এ সূত্রেই তৎকালীন বিখ্যাত পণ্ডিত ইমাম জাফর সাদিকের অনুপ্রেরণায় তিনি রসায়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণা শুরু করেন। কারো কারো মতে জাবির ইবনে হাইয়ান খলিফা খালিদ বিন ইয়াজিদের নিকট রসায়ন বিদ্যা শিক্ষা লাভ করেছিলেন। কিন্তু এ কথার কোন সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ জাবির ইবনে হাইয়ানের কার্যাবলীর সময়কাল ছিল খলিফা হারুন অর রশিদের রাজত্বকালে। অথচ খলিফা খালিদ বিন ইয়াজিদ হারুণ অর রশীদের বহু পূর্বেই ইন্তেকাল করেন। যতদূর জানা যায়, জাবির ছিলেন ইমাম জাফর সাদিকেরই শিষ্য। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রসায়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ছিল আব্বাসীয় খলিফা হারুণ অর রশীদের রাজত্বকাল। কিন্তু খলিফা হারুণ অর রশীদের সাথে তার তেমন কোন পরিচয় ও সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু খলিফার বারমাক বংশীয় কয়েকজন মন্ত্রীর সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ইমাম জাফর সাদিকই জাবিরকে বারমাক বংশীয় কয়েকজন মন্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।

একবার ইয়াহিয়া বিন খালিদ নামক জনৈক বারমাক মন্ত্রীর এক প্রিয় সুন্দরী দাসী মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তৎকালীন দেশের সুপ্ৰসিদ্ধ চিকিৎসকগণ তার চিকিৎসা করে ব্যৰ্থ হন। এ সময় মন্ত্রী প্রাসাদে চিকিৎসার জন্যে ডাক পড়ে জাবির ইবনে হাইয়ানের। জাবির মাত্র কয়েক দিনের চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ করে তোলেন। এতে ইয়াহিয়া বিন খালিদ খুব সন্তুষ্ট হন এবং জাবিরের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বারমাক বংশীয় কয়েকজন মন্ত্রীর মধ্যস্থতায় তিনি রাষ্ট্রীয় কিছু সুযোগ সুবিধা লাভ করেন। এর ফলে তিনি রসায়ন বিজ্ঞান সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করার সুযোগ পান। মন্ত্রী ইয়াহিয়া এবং তাঁর পুত্র জাবিরের নিকট রসায়ন বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য ও বিভিন্ন পদার্থ আবিষ্কার করতে আরম্ভ করেন। খুব অল্প দিনের মধ্যেই তিনি শ্রেষ্ঠ রসায়ন বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত হন। জাবির ইবনে হাইয়ান প্রতিটি বিষয়ই যুক্তির সাহায্যে বুঝবার ও অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন। আধ্যাত্মিকতার দোহাই দিয়ে তিনি কোন কাজে অগ্রসর হননি। তিনি সর্বদা হাতে কলমে কাজ করতেন। প্রতিটি বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে পর্যবেক্ষণ করে তার ফলাফল লিখে রাখতেন। তিনি তাঁর ‘কিতাবুত তাজে’ পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, “রাসায়নিকের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কাজ হলো হাতে কলমে পরীক্ষা চালানো। যে হাতে কলমে কিংবা পরীক্ষামূলক কাজ করে না, তার পক্ষে সামান্যতম পারদর্শিতা লাভ করাও সম্ভবপর নয়”।

জাবির তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়ই বাগদাদে কাটিয়েছেন। কিতাবুল খাওয়াসের ঘটনাবলী থেকে বুঝা যায় যে, অষ্টম শতাব্দীর শেষ দিকে বাগদাদেই তিনি রসায়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাঁর গবেষণা চালিয়ে ছিলেন। বাগদাদেই তাঁর রসায়নাগার স্থাপিত ছিল। উল্লেখ্য যে, জাবিরের মৃত্যুর ১০০ বছর পরে কুফায় অবস্থিত দামাস্কাস গেটের নিকট রাস্তা নতুন করে তৈরি করতে কতকগুলো ঘর ভেঙ্গে ফেলার সময় একটি ঘরে ২০০ পাউন্ডের একটি সোনার থা ও একটি খল পাওয়া যায়। ফিহারিস্তের মতে এটি ছিল জাবিরের বাসস্থান ও ল্যাবরেটরী। ঐতিহাসিক হিট্টিও ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন।

জাবির ইবনে হাইয়ানের অবদান মৌলিক। তিনি বস্তুজগতকে প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত করেন। প্রথম ভাগে স্পিরিট, দ্বিতীয় ভাগে ধাতু এবং তৃতীয় ভাগে যৌগিক পদার্থ। তাঁর এ আবিষ্কারের উপর নির্ভর করেই বিজ্ঞানীরা বস্তুজগৎকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন । যথা-বাষ্পীয়, পদার্থ ও পদাৰ্থ বহির্ভুত। জাবির এমন সব বস্তু বিশ্ব সভ্যতার সামনে তুলে ধরেন, যেগুলোকে তাপ দিলে বাষ্পায়িত হয়। এ পর্যায়ে রয়েছে কর্পূর, আর্সেনিক ও এমোনিয়া ক্লোরাইড়। তিনি দেখান কিছু মিশ্র ও যৌগিক পদার্থ, যেগুলোকে অনায়াসে চুর্ণে পরিণত করা যায়। নির্ভেজাল বস্তুর পর্যায়ে তিনি তুলে ধরেন সোনা, রূপা, তামা, লোহা, দস্তা প্রভৃতি।

জাবির ইবনে হাইয়ানই সৰ্ব্ব প্রথম নাইট্ৰিক এসিড আবিষ্কার করেন। সালফিউরিক এসিডও তাঁরই আবিষ্কার। তিনি ‘কিতাবুল ইসতিতমাস’ এ নাইট্ৰিক এসিড প্রস্তুত করার ফর্মুলা বর্ণনা করেন। নাইট্রিক এসিডে স্বর্ণ গলানোর ফর্মুলা তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন। নাইট্ৰিক এসিড ও হাইড্রোক্লোরিক এসিডে স্বর্ণ গলানোর পদার্থটির নাম যে “একোয়া রিজিয়া” এ নামটিও তাঁর প্রদত্ত। জাবির ইবনে হাইয়ান নানাভাবেই তাঁর রাসায়নাকি বিশ্লেষণ বা সংশ্লেষণের নামকরণ বা সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন। পাতন, উর্ধ্বপাতন, পরিস্রাবণ, দ্রবণ, কেলাসন, ভ্ৰষ্মীকরণ, গলন, বাষ্পীভবন ইত্যাদি রাসায়নিক সংশ্লেষণ বা অনুশীলন গবেষণার কি কি রূপান্তর হয় এবং তার ফল কি তিনি তাও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি চামড়া ও কাপড়ে রং করার প্রণালী, ইস্পাত প্রস্তুত করার পদ্ধতি, লোহা, ওয়াটার প্রুফ কাপড়ে বার্নিশ করার উপায়, সোনার জুলে পুস্তকে নাম লেখার জন্য লৌহের ব্যবহার ইত্যাদি আবিষ্কার করেন।

জাবির ইবনে হাইয়ান স্বর্ণ ও পরশ পাথর তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি স্বর্ণ কিংবা পরশ পাথরের লোভী ছিলেন না। ধন সম্পদের লোভ লালসা তাঁকে সভ্যতা উন্নয়নে ও গবেষণার আদর্শ থেকে বিন্দু মাত্রও পদস্থলন ঘটাতে পারেনি। দুর্দান্ত সাহসী জাবির ইবনে হাইয়ান স্বর্ণ ও পরশ পাথর তৈরি করতে গিয়ে আজীব যেখানেই গিয়েছেন দুৰ্যোগ, দুশ্চিন্তা ও মৃত্যুর সাথে লড়াই ছাড়া সুখ শান্তির মুখ দেখতে পারেননি। জাবিরের মতে সোনা, রূপা, লোহা প্রভৃতি যত প্রকার ধাতু আছে কোন ধাতুরই মৌলিকতা নেই। এসব ধাতুই পারদ আর গন্ধকের সমন্বয়ে গঠিত। খনিজ ধাতু খনিতে যে নিয়মে গঠিত হয় সে নিয়মে মানুষও ঐসব ধাতু তৈরি করতে পারে। অন্য ধাতুর সংগে মিশ্ৰ স্বৰ্গকে Cupellation পদ্ধতিতে অর্থাৎ মীগারের সংগে মিশিয়ে স্বর্ণ বিশুদ্ধ করার পদ্ধতি তিনিই আবিষ্কার করেন।

জাবির এপোলিয়ানের আধ্যাত্মিকবাদ, প্লেটো, সক্রেটিস, এরিস্টটল, পিথাগোরাস, ডেমোক্রিটাস প্রমুখের গ্রন্থের সংগে পরিচিত এবং গ্ৰীক ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। তিনি চিকিৎসা শাস্ত্র, ইউক্লিড ও আল মাজেস্টের ভাষ্য, দর্শন, যুদ্ধবিদ্যা, রসায়ন, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও কাব্য সম্পর্কে বিভিন্ন গ্ৰন্থ প্রণয়ন করেন। তিনি দুই হাজারেরও বেশী গ্ৰন্থ রচনা করেন। তবে তাঁর অধিকাংশ গ্ৰন্থই মাত্র কয়েক পৃষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তিনি বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যা পেয়েছেন, তার ফলাফলই ছিল গ্রন্থের বিষয়বস্তু। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর প্রণীত গ্রন্থাবলীর মধ্যে রসায়ন ২৬৭টি, যুদ্ধাস্ত্ৰাদি ৩০০টি, চিকিৎসা ৫০০টি, দর্শনে ৩০০টি, কিতাবুত তাগদির ৩০০টি, জ্যোতির্বিজ্ঞান ৩০০ পৃষ্ঠার ১টি, দার্শনিক যুক্তি খণ্ড ৫০০টি উল্লেখযোগ্য। এসব গ্ৰন্থ সংখ্যায় অধিক হলেও পৃষ্ঠা সংখ্যায় ছিল কম।

বিশ্ব বিখ্যাত এ মনীষীর মৃত্যুর তারিখ নিয়েও মতভেদ রয়েছে। যতদূর জানা যায়, তিনি ৮০৩ খ্রিস্টাব্দে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন বটে, কিন্তু বিজ্ঞানে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা চির স্মরণীয়। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই তাঁর নাম জানে না; অথচ বিজ্ঞানে তাঁর মৌলিক আবিষ্কারের উপরই বর্তমান বিজ্ঞানের অধিষ্ঠান।

সূত্র

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88