ভয় ও সাহস-২১ জন সাহসী ব্যক্তির উদাহরণ

আবু হুরাইরা বর্ণনা করেন, “একজন দুর্বল মুমিন অপেক্ষা একজন শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট বেশি প্রিয়’। (মুসলিম)

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়শই দুয়া করতেন, “ইয়া আল্লাহ ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দুশ্চিন্তা ও দুঃখবোধ থেকে; উদাসীনতা ও অলসতা  থেকে;  কাপুরুষতা, কৃপণতা এবং বার্ধক্যের চরম পর্যায় থেকে, এবং আরও আশ্রয় চাই কবরের আযাব হতে’ (বুখারী-মুসলিম)

লক্ষ্য করুন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতে গিয়ে  দুশ্চিন্তা এবং দুঃখবোধ দুটি বিষয়কে একত্রিত করেছেন। দুশ্চিন্তা হচ্ছে এমন কিছুর কারণে ভীত হওয়া যা এখনো আসেনি, ভবিষ্যতে আসতে পারে, আর দুঃখবোধ হচ্ছে অতীতে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা, যা চলে গেছে তার কারণে মন খারাপ করে থাকা, বিষণ্ণতা। কাজেই, একজন মুসলিম সে বিষন্ন হতে পারে না, হোক সে ঘটনা অতীতের কোন কিছু কিংবা ভবিষ্যতের।  এবং তিনি আরও একত্রিত করেছেন, উদাসীনতা ও অলসতাকে। কারণ, উদাসীনতা হচ্ছে মানসিক অকর্মণ্যতা, আর অলসতা হচ্ছে দৈহিক অকর্মণ্যতা। তিনি একত্রিত করেছেন, কৃপণতা ও কাপুরুষতাকে; কৃপণতা হচ্ছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সংকীর্ণতা অনুভব করা, আর কাপুরষতা হচ্ছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজেকে, নিজের আত্মাকে বিলিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সংকীর্ণতা অনুভব করা।

কিভাবে ভয়কে জয় করবেনঃ

কাপুরুষতা হচ্ছে সাহসিকতার বিপরীত। সাহসিকতা হচ্ছে অন্তরের দৃঢ়তা। আর মানুষের অন্তর বা কলব হচ্ছে সকল ভালো কাজের উৎস, আর অন্তর দৃঢ় থাকতে পারে না যদি মন সুস্থ না থাকে। যদি অন্তর দুর্বল হয় তাহলে এটা কাপুরুষতার দিকে নিয়ে যায়, আর যদি অন্তর বেশি কঠিন হয় তাহলে তা মানুষকে বেপরোয়া করে তুলে।

কাপুরুষদের কাপুরুষিতা দূর করার সবচেয়ে বড় চিকিৎসা হল ভয়ের কারণকে দূর করা। কি কারণে সে ভীত, সেই কারণকে খুঁজে বের করে তা দূর করা। যদি ভয়ের কারণ হয় অজ্ঞতা, তাহলে অজ্ঞতার প্রতিষেধক হচ্ছে ইলম অর্জন করা। যদি অজানা কোন কিছুর ভয়ে কেউ ভীত হয়, তাহলে তা দূর করার উপায় হচ্ছে সেই পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করা, অজানা বিষয়কে বা পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার মাধ্যমে একটি অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়, ফলে সে বিষয়টি আর নতুন বা অজানা থাকে না।

আমরা দেখেছি, জনতার সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শুরুর দিকে অনেকেই একটি ভীতিতে আক্রান্ত হন, কিন্তু বার বার এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মাধ্যমে এই অজানা ভীতি দূর হয়ে যায়। অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই অজানা বিষয়ের ভীতির প্রতিষেধক। আমরা দেখেছি, যখন কোন একজন ব্যক্তি প্রথমবারের মত রাজা বা প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাত করে, তারা সেই আয়োজনকে ভয় পায়, তাদের জিভ আড়ষ্ট হয়ে আসে, এবং বডি ল্যাংগুয়েজ পরিবর্তিত হয়ে যায়। এর কারণ হচ্ছে, একটি অজানা নতুন পরিস্থিতির কারণে উদ্বিগ্নতা। কিন্তু, যদি সেই ঘটনাটি বারবার ঘটতে থাকে তাহলে সেই বিষয় থেকে ভয় চলে যায়। মানুষের অরিজিনাল স্বভাব বা ন্যাচার পরিবর্তন করা সম্ভব।

প্রমাণ হিসেবে এই উদাহরণটিই যথেষ্ট হবে বলে মনে করি যে, একটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিশু (সার্কাস বা অন্যান্য ট্রেনিং যেখানে সাপের খেলা দেখানো হয়) একটি বড় সাপ দেখে ভয় পায় না, কিন্ত  একজন সাহসী যুবকও ভয় পেতে পারে, আবার সেই একই শিশুটি হয়তো একটি ব্যাং দেখে ভয় পেতে পারে, কারণ সে এভাবে এই বিষয়ে অভিজ্ঞ নয়। সে হয়তো আগে কখনো ব্যাং দেখেনি। অরিজিনাল ন্যাচার বা আদি স্বভাব পরিবর্তনের একটি ভালো উদাহরণ হলো, বন্য পশুকে পোষ মানানো, বন্য পশুকে পোষ মানানোর মাধ্যমে তার স্বাভাবিক ন্যাচারকে পরিবর্তন করা যায়, এর জন্য প্রশিক্ষণ দরকার। একটা নেকড়ে ভেড়ার সাথে খেলা করতে পারে, বিড়াল পারে ইদুরের সাথে খেলতে, কুকুর বিড়াল একসাথে থাকতে পারে; যদি তাদের স্বভাবের বিপরীতে তারা আচরণ করতে পারে, অথচ এগুলো তো তাদের আদি স্বভাবের বিপরীত !

এখন, একটা পশু যদি তার নিজের স্বভাব প্রকৃতি পরিবর্তন করতে পারে, তাহলে মানুষ কেন পারবে না?

একটি দৃঢ়চেতা অন্তর বিজয়ের দিকে নিয়ে যায়। আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘কিভাবে আপনি আপনার শত্রুদের পরাজিত করেন?’ তিনি বলেছিলেন, ‘যখন আমি আমার শত্রুর সাথে মোকাবেলা করি, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে নেই যে, আমিই তাকে পরাজিত করব,  আর যখন সেও বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, আমি তাকে পরাজিত করব, তখন আমার এবং তার উভয় সত্তা আমাকে সাহায্য করে, তার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করতে  ’

কেউ কেউ এই উপদেশ দিয়ে থাকেন, ‘বিজয়ের উপর বিশ্বাস রাখ, তুমিই হবে বিজয়ী’।

অন্যেরা বলেন, ‘তুমি যদি তোমার শত্রুকে ভয় পাও, তাহলে তুমি নিজেই তোমার অন্তরে এক বিশাল বাহিনীকে অনুপ্রবেশ করিয়ে দিলে’।

আমরা দেখেছি, যারা নিজেদের সাহসিকতার কারণে মৃত্যুবরণ করেছে তাদের থেকে যারা ভয়ের কারণে মৃত্যু বরণ করেছে তাদের সংখ্যাই বেশি ।

আল তারতুসী বলেন, সাহস তিন প্রকার;

১- এমন ব্যক্তি যে বিপক্ষ দলের সামনে দাঁড়িয়ে আহবান করে একজন প্রতিপক্ষের জন্য যে বের হয়ে আসবে এবং তাঁর সাথে লড়বে।

২ এমন ব্যক্তি যে শান্ত থাকে, মনোযোগী থাকে, প্রশান্ত থাকে যখন যুদ্ধ উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে। আর যখন বাকিদেরকে ভয় গ্রাস করে নেয়, তখনো সে তার অবস্থান হারায় না, দ্বিধাগ্রস্ত হয় না, এবং এমনভাবে আচরণ করে যা প্রমাণ করে সে নিজের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে।

৩ এমন ব্যক্তি যখন সে দেখে বাকি সবাই পরাজিত হয়েছে, এবং পিছু হটছে, তখন সে দৃঢ় থাকে এবং তাদেরকে আহবান করে, তাদেরকে উৎসাহ দেয় এবং লড়াই চালিয়ে যেতে বলে।

আল তারতুসী বলেন, তৃতীয় ব্যক্তিই হল সবার চেয়ে বেশি সাহসী।

মূলঃ শাইখ ইবন নুহাস(মৃত্যু ৮১৪ হিজরী) এর মাশারী আল আশউয়াক্ব ইলা মাশারী আল-উশাক্ব ,অধ্যায় ১৫

c2a9tree-silhouette-by-cherie-roe-dirksen

এই উম্মতের  ২১ জন সাহসী ব্যক্তিদের উদাহরণঃ

মানব জাতির শ্রেষ্ঠ সাহসী ব্যক্তি হলেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি সবচেয়ে সাহসী অন্তরের মানুষ ছিলেন, সবচেয়ে কঠিন অবস্থাগুলো তিনি মোকাবেলা করেছেন। যখন তিনি দৃঢ়তা প্রদর্শন করতেন এরপর তার পাশে এসে অন্যান্য বীর যোদ্ধারা দাঁড়াত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধের ময়দানে কখনো পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেননি।

বুখারী এবং মুসলিমে আনাস বিন মালিক বর্ণনা করেন, ‘আল্লাহর রাসূল লোকদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ব্যক্তি ছিলেন, তিনি ছিলেন সবার চেয়ে বেশি দয়ালু এবং সবার চেয়ে বেশি সাহসী’
আলী রা) বলেন, ‘যখন যুদ্ধের ময়দানে লড়াই ভয়াবহ আকার ধারণ করতো এবং এর চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যেত, চোখ লাল হয়ে যেত (ময়দানের ধূলাবালির কারণে) তখন আমরা এসে রাসূলুল্লাহর পিছনে আশ্রয় নিতাম। আমাদের মধ্যে তিনিই শত্রুদের সবচেয়ে নিকটে থাকতেন (মুসলিম) ’

এক ব্যক্তি বারাহ বিন আযিবকে প্রশ্ন করলো, ‘ কখনো কি আপনি ময়দান থেকে পলায়ন করেছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময়ে?” তিনি বলেন, ‘আমরা করেছি, কিন্তু তিনি করেননি’ (বুখারী,মুসলিম)
উহুদের দিনে, উবাই বিন খালাফ, ঘোড়ায় চড়ে, রাসূল সা) এর দিকে আক্রমণ করতে আসল, হাতে বর্শা নিয়ে। কিছু মুসলিম উঠে দাঁড়াতে চাইলেন তাকে প্রতিরোধ করার জন্য, কিন্তু রা সা) সবাইকে বারণ করলেন, বললেন, সরে যাও। রাসূল সা) একটি বর্শা উঠিয়ে নিলেন, এবং সেটা উবাই এর দিকে ছুঁড়ে মারলেন, যে পা থেকে মাথা পর্যন্ত লোহার বর্মে ঢাকা ছিল। তার চোখ এবং ঘাড়ের দিকের একটি ছোট্ট অংশ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আর ঘাড়ের ঠিক সেখানেই বর্শাটি আঘাত করে গেল এবং সে ঘোড়া থেকে পড়ে গেল। যদিও বর্ম পড়ে থাকার কারণে খুব সামান্য একটা আঁচড়ের বেশি আঘাত লাগেনি,  কিন্তু সে ষাঁড়ের মত চেঁচাতে লাগল এবং বলতে লাগল, ‘মুহাম্মাদ আমাকে মেরে ফেলল!’ কুরাইশের লোকেরা তাকে পরীক্ষা করে দেখল, এবং বলল, ‘ আমরা কোন বড় আঘাত দেখতে পেলাম না। তুমি ঠিক হয়ে যাবে! সে বলল, ‘মুহাম্মাদ বলেছিল, সে আমাকে হত্যা করবে, কাজেই এটা সত্যি হবেই!’, পরে সে ফিরতি পথে মক্কার পথে মারা যায়।

এই উম্মাহর সাহসী ব্যক্তিদের সংখ্যা অনেক, এই লিস্টের উপরের দিকে যারা আছেন, তারা হলেন সাহাবা, যাদের প্রশংসা আল্লাহ কুরআনে করেছেন :
আল্লাহর রসূল মুহাম্মদ এবং তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। সূরা ফাতাহ ২৯
এই উম্মতের বিখ্যাত সাহসী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আছেনঃ

১ আবু বকরঃ

আবু বকরের সাহসিকতার সাক্ষী এই উম্মতের আরেক বীর, আলি ইবন আবি তালিব। যখন আলী খলিফা হলেন, তাকে প্রশ্ন করা হল, “মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী কে?
তারা বলল, ‘আপনি’
তিনি বললেন, ‘আমি কখনো কারও সাথে দৈতযুদ্ধে হারিনি। কিন্তু লোকদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী হলেন আবু বকর। বদরের যুদ্ধে আমরা রাসুলুল্লাহ সা) এর জন্য একটি ছাউনি নির্মান করেছিলাম এবং আমাদের প্রশ্ন করা হল, কে হবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেহরক্ষী? আবু বকর তাঁর তরবারী খাপ মুক্ত করে সেখানে এলেন, এবং সারাদিন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রক্ষা করলেন। মক্কাতে একবার, কুফফাররা রাসূল সা) কে আক্রমণ করেছিল, যেই কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, তাকেই অন্যেরা আটক করছিল এবং মারধর করছিল, আর বলছিল, ‘তোমরা কি সব দেব দেবীর পরিবর্তে একজন দেবতা স্থির করেছ?’ কেউই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যাওয়ার সাহস করছিলেন না, একমাত্র আবু বকর ব্যতিক্রম। তিনি গেলেন, এবং তাদের সাথে লড়াই বাঁধিয়ে দিলেন, এবং বলছিলেন, ‘তোমরা কি একজন লোককে শুধুমাত্র এই কারণে হত্যা করতে যাচ্ছ যে সে বলে, ‘আল্লাহ আমার রব!’

এরপর আলী প্রশ্ন করলেন, ‘কে উত্তম, আবু বকর না ফেরাউনের সভাসদের সেই ব্যক্তিটি?’ (ফিরাউনের সভাসদদের মধ্যেও এক ব্যক্তি অনুরূপ মন্তব্য করেছিল যখন ফিরাউন সিদ্ধান্ত নিল মূসাকে হত্যা করবে)

লোকেরা নীরবতা অবলম্বন করলো। তিনি বললেন, ‘তোমরা উত্তর করছ না কেন? আল্লাহর নামে, আবু বকরের জীবনের একটি মুহুর্ত উত্তম, সারা দুনিয়া যদি ভর্তি হয়ে যায় সেই ফিরাউনের সভার ঈমানদার ব্যক্তিদের মত ব্যক্তি দিয়ে। ফিরাউনের সভাসদের সেই ব্যক্তিটি নিজের ঈমানকে গোপন রেখেছিল, আর আবু বকর তাঁর ঈমানকে প্রকাশ করেছিলেন’।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পর এই উম্মতের সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তি হলেন আবু বকর। বদরের যুদ্ধের ঘটনা থেকে, উহুদ, খন্দক, হুদায়বিয়া,হুনাইন ইত্যাদি থেকে একজন ব্যক্তির উচিত তার অন্তরের দৃঢ়তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা। সব বিপর্যয়ের বড় বিপর্যয়, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর তিনি যে ভূমিকা পালন করেছিলেন

সেটাই যথেষ্ট তার অবিচলতা, দৃঢ়তা, এবং মুসলিম উম্মাহকে শক্তিশালী করার ক্ষমতা সম্পর্কে জানান দেয়ায় জন্য। সেটা ছিল এমন এক মুহুর্ত যখন অন্তর বিচলিত ছিল, উম্মাহ বিপর্যস্ত ছিল। যখন সবার অন্তর কাঁপছিল, সিদ্দিকের অন্তর সুদৃঢ় ছিল। যদি দাড়িপাল্লার একদিকে আবু বকরের অন্তর আর বিপরীত দিকে সমস্ত উম্মাহর অন্তর স্থাপন করা হয়, তাহলে আবু বকরের অন্তরই ভারী হবে। মুরতাদদের সাথে আবু বকরের যুদ্ধ ঘোষণার সাহসী সিদ্ধান্ত, এই সাহসিকতাকে যদি সারা পৃথিবীর সমস্ত কাপুরুষদের অন্তরে বন্টন করে দেয়া যায়, সেটা তাদেরকে সাহসী করে তুলবে।

২. খাত্তাবের পুত্র উমর

এটা উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে যে, উমরের ভয়ে ভীত হয়ে শয়তান সেই পথ পরিহার করে চলত। আল্লাহর রাসূল সা) উমরকে বলেছিলেন, ‘হে খাত্তাবের পুত্র, যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, শয়তান তোমাকে এক রাস্তায় দেখলে সে অন্য রাস্তা ধরে’। (বুখারী) তার ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলিমদের শক্তি বৃদ্ধি পেল। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেন, ‘উমর মুসলিম হবার আগ পর্যন্ত আমরা প্রকাশ্যভাবে কাবার কাছে সালাত আদায় করতে পারতাম না’।
৩. আলি বিন আবি তালিব

তিনি ছিলেন এই উম্মাহর একজন সিংহপুরুষ। তিনি একমাত্র তাবুক যুদ্ধ ছাড়া আর কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেননি, কারণ সেই সময়ে রাসূল সা) তাঁর অনুপস্থিতিতে তাকে মদীনার দায়িত্বে নিয়োজিত রাখেন। খায়বারের যুদ্ধের সময় রাসূল সা বলেন, ‘আগামীকাল আমি যুদ্ধের ব্যানার এমন এক ব্যক্তির হাতে তুলে দিব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালোবাসেন। তিনি যুদ্ধের ময়দানে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন না, এবং আল্লাহ তাঁর হাতেই আমাদের বিজয় দান করবেন’। সব সাহাবাই সেই সম্মান মনে মনে চেয়েছিলেন। পরের দিন, রাসূল সা) আলীকে ডাকলেন এবং তাকে যুদ্ধের ব্যানার তুলে দিলেন। মুস’আব আল যুবাইরি বলেন, ‘আলি যুদ্ধের ময়দানে খুব সতর্ক  থাকতেন। তিনি তার শত্রুর প্রতি ক্ষিপ্র গতিতে ঘুরতেন আর যখন তিনি তাঁর শত্রুর দিকে হামলা করতেন, তিনি নিজের চতুর্দিক থেকে নিজেকে রক্ষা করতেন, আর যখন ফিরে আসতেন তখন তিনি নিজেকে আরও সতর্কতার সাথে রক্ষা করতেন। কেউ তাঁর কাছে যাওয়ার সাহস করতো না, তার ঢাল একমুখী থাকত। এটা শুধুমাত্র সামনের দিক থেকে তাকে রক্ষা করতে পারতো। যখন তাকে প্রশ্ন করা হল, ‘আপনি কি এই ভয় করেন না যে, আপনার পিছন দিক থেকে হামলা হতে পারে?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘আমি আমার শত্রুকে কখনো এই সুযোগই দেই না যে, সে আমার পিছন থেকে এসে হামলা করতে পারবে’।

৪. তালহা বিন উবায়দুল্লাহ

তিনি জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজনের একজন। তিনি উহুদের যুদ্ধে নিজের দেহকে ঢাল বানিয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রক্ষা করেছিলেন এবং ৭০ টির বেশি আঘাত পেয়েছিলেন। এমনকি যখনই রাসুলুল্লাহ সা) কুফফারদের দিকে তাকাতে চাইতেন তালহা তাকে অনুরোধ করতেন বিরত থাকার জন্য এবং নিজের দেহ দিয়ে আড়াল করে রাখতেন।

৫. আল যুবাইর আল আওয়াম

তিনিও জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজনের একজন। তিনিই প্রথম মুসলিম যিনি তরবারী খাপমুক্ত করেছিলেন। মক্কার ইসলামের প্রাথমিক যুগে একটি গুজব রটানো হল যে, আল্লাহর রাসূলকে অপহরণ করা হয়েছে। আল যুবাইর তার তরবারী কোষমুক্ত করলেন এবং তাঁর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি রাসুলুল্লাহর দিকে দৌড়ে গেলে, রাসুল সা) তাকে প্রশ্ন করেন, “যুবায়ের, কোন সমস্যা?”
তিনি বলেন, “আমি শুনেছিলাম, আপনাকে অপহরণ করা হয়েছে, তাই আমি তাদের সাথে লড়াই করতে এসেছিলাম’। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্য দুয়া করেন।

৬. সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস
তিনি জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজনের একজন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্য দুয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ ! তার তীরগুলোকে লক্ষ্যভেদ করিয়ে দাও, তার দুয়া কবুল করে নাও’। উমর তাকে কাদিসিয়াহ’র যুদ্ধের সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন। মুসলিমরা বিজয়ী হয়েছিল, এবং তিনি তাদেরকে পারস্যে নেতৃত্ব দিতে থাকেন যতক্ষণ না তিনি অধিকাংশ এলাকা বিজয় লাভ করেন এবং রাজধানীতে প্রবেশ করেন, আল মাদায়েন। সাদ , তিনি কুফা এবং বাসরা নগরী প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। যখন তিনি মৃত্যুশয্যায় তিনি ওসীয়ত করেছিলেন যেন তার দেহকে একটি পুরনো ঊলের কাপড়ে কাফন দেয়া হয়। তিনি বলেন, এটা পরেই আমি বদরের যুদ্ধ করেছিলাম এবং এই দিনের জন্য তা সংরক্ষণ করে রেখেছি।

৭. আবু উবাইদাহ বিন আল যাররাহ
তিনিও জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজনের একজন। উমার তাকে শাম বিজয়ী বাহিনীর দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। তিনিই ছিলেন ইয়ারমুকের সেই বিখ্যাত যুদ্ধের সেনাপতি। তিনি শামে যখন প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে সেই রোগে মৃত্যুবরণ করেন।

৮. হামযা বিন আবদুল মুত্তালিব

তিনি আসাদুল্লাহ- আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের সিংহ। যখব বদর যুদ্ধের পর উমাইয়া বিন খালাফ যে বন্দী হয়েছিল সে আব্দুর রহমান বিন আউফকে প্রশ্ন করল, ‘তোমাদের মধ্যে ঐ লোকটী কে ছিল যার বুকে উট পাখির পালক লাগানো ছিল?’
আব্দুর রহমান বলেন, ‘তিনি ছিলেন হামযাহ’। উমাইয়া বললো, ‘সেই আজকে আমাদের সর্বনাশ করে ছেড়েছে’। তিনি উহুদ যুদ্ধে শহীদ হন।

৯. জাফর বিন আবি তালিব
তিনি তাঁর ভাই আলির থেকে বছর দশেকের বড়। মু’তার যুদ্ধে তিনি পর্যায়ক্রমে ২য় ব্যক্তি হিসেবে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যখন যায়িদের পর দায়িত্ব বুঝে পান, তিনি ডানহাতে যুদ্ধের ব্যানার বহন করছিলেন, এরপর যখন ডান হাতটী কাটা গেল তিনি বাম হাতে সেই পতাকা তুলে ধরেন, আর বাম হাত কাটা পড়লে  তিনি দুই বাহু দিয়ে পতাকাকে আঁকড়ে ধরে রাখেন, যতক্ষণ না তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এরপর লোকেরা তাঁর দেহে ৯০টিরও বেশি আঘাতের চিহ্ন খুঁজে পায়।

১০ মুয়ায বিন আমর বিন আল যামুহ
তিনি ছিলেন এই উম্মাহর ফেরাউন আবু জাহেলের জবাইকারী। তিনি বলেন, আমি বদর যুদ্ধের দিন আবু জাহেলকে আমার টার্গেট স্থির করে নেই। যখন আমি তাকে পাই, আমি তাকে আক্রমণ করি, এবং আমার তরবারী দিয়ে হামলা করি আর তার পা দ্বিখন্ডিত করে দেই। এরপর তার সন্তান ইকরিমাহ আমার ঘাড়ে আঘাত হানে এভাবে আমার বাহু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শুধু একটি চামড়ার উপর সেই কাটা বাহু ঝুলে থাকে। কিন্তু, এতে আমার যুদ্ধ করতে অসুবিধা হচ্ছিল, দিনের অধিকাংশ সময় সেটা আমার পিছনে ঝুলতে থাকে। কিন্তু, বেশি অসুবিধা দেখে দিলে, আমি পা দিয়ে চেপে ধরে আমার সেই বাহুকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি।

১১ আল বারাহ বিন মালিক

তিনি আনাস বিন মালিকের ভাই, যিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাদেম ছিলেন। তিনিই এই উম্মাহর বীর পুরুষদের একজন। আনাস একদিন দেখলেন তাঁর ভাই বারাহ কি যেন কবিতা গুনগুন করছেন, তাই তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘ও আমার ভাই, কবিতা পড়ছো নাকি? কেমন হয় যদি এটাই তোমার শেষ কথা হয়ে যায়? ’ [যখন কুর’আন নাযিল হচ্ছিল, তখন সাহাবারা কুর’আন বাদে অন্য কিছু তিলাওয়াত কিংবা আবৃত্তি করাটা অপছন্দ করতেন। এ কারণেই আনাস তাঁর ভাইকে সতর্ক করে বলছিলেন, ভাই এই কবিতা আবৃত্তি করা অবস্থায় যদি আপনার মৃত্যু হয়ে যায় তাহলে কিভাবে তুমি আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে? আরেকটি বর্ণনায় তিনি বলছিলেন যে আল্লাহকে স্মরণ করো ]
আল বারাহ বলেন, ‘না ! আমার মত লোক বিছানায় মরতে পারে না, আমি ৯৯জন কাফির মুনাফিককে হত্যা করেছি’। (মুসান্নাফ ইবন বিন শাইবা)

উমার তাঁর মিলিটারি জেনারেলদের কাছে লিখে পাঠালেন যে বারাহ বিন মালিককে কখনো নেতৃত্বের কোন পদ দিও না, কারণ সে মুসলিমদের মধ্যে একটু বেশি বেপরোয়া (অর্থাৎ এত আক্রমণাত্বক যে সাধারণ মুসলিমদের বিপদ হতে পারে !) (আল হাকিম)

একটি উদাহরণ, মুসায়লামা মিথ্যুক নবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি অবরুদ্ধ ফটক খোলার জন্য অপর মুসলিমদের বললেন, তোমরা আমাকে একটি ঢালের উপর বসিয়ে দাও, এরপর বর্শার মাথার ঢাল বহন করে দেয়ালের উপর দিয়ে ঢাল সহ আমাকে ছুঁড়ে মার ! এরপর তাকে ছুঁড়ে মারা হল, তিনি সেই দূর্গের ফটক খুললেন ঠিক, কিন্তু এরপর তার দেহে ৮০টিরও বেশি জখম হল। (আল ইসাবাহ)

তাস্তুরের যুদ্ধে, আল বারাহকে বললেন, আপনি বাইয়াত গ্রহণ করুন বিজয় পর্যন্ত
আল বারাহ বলেন, ‘ইয়া আল্লাহ !  আমি এই মর্মে বাইয়াত গ্রহণ করছি যে, আপনি আমাদেরকে তাদের কাঁধের উপর স্থাপন করুন, (আমাদের বিজয় দান করুন) এবং আমাকে আপনার নবীর পথে নিয়ে নিন (মৃত্যু)। তিনি শত্রুদের আক্রমণ করলেন, এবং মুসলিমরা তাকে অনুসরণ করল, পারস্যবাসীরা পরাজিত হল। এবং আল বারাহ শহীদ হলেন। আল্লাহ তাঁর বাইয়াতকে তাঁর শপথকে পূর্ণ করে দিলেন।

আনাস বলেন, যখন আবু মূসাকে আল বাসরার গভর্ণর পদে নিযুক্ত করা হয়েছিল তিনি আল বারাহকে বলেন যেকোন নেতৃত্বের পদ নির্বাচন করে নিতে, এবং তার সরকারের সেই পদেই তাকে নিযুক্ত করা হবে। আল বারাহ বলেন, ‘আমি এসব কিছু চাই না। বরং আমি চাই, আমাকে আমার ঘোড়া, বর্শা, ঢাল, তরবারী এগুলো দিয়ে দিবেন এবং আমাকে জিহাদে প্রেরণ করবেন। সেই বাহিনীর প্রথম নিহত ব্যক্তি হলেন আল বারাহ ’ (ইমাম আবু শাইবাহ)
১২ আবু দুজানা (সাম্মাক বিন খারশাহ)

উহুদ যুদ্ধের পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি তরবারী বের করলেন এবং বললেন, ‘কে আছ এই তরবারী দিয়ে লড়াই করবে এবং একে প্রাপ্য হক দিবে?’
কিছু লোক উঠে দাঁড়াল এবং এটা চাইল, কিন্তু আল্লাহর রাসূল তাদের কাউকেই দিলেন না। এরপর আবু দুজানা উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ ! এর হক কি ?’ তিনি বলেন, ‘আর তা হল তুমি এটা দিয়ে শত্রুদের মুখে আঘাত করবে যতক্ষণ না তা বাঁকা হয়ে যায়’।

আবু দুজানা বলেন, ‘আমি এটা গ্রহন করব ইয়া রাসুলুল্লাহ’। এবং তিনি তাকে সেটা দিলেন। আল যুবাইর বিন আল আওয়াম বলেন, ‘আমি কিছুটা মন খারাপ করেছিলাম, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুপাতো ভাই। আমি চাইলাম, আর তরবারীখানা পেলাম না, কিন্তু আবু দুজানা পেয়ে গেল। কাজেই আমি আবু দুজানাকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং সে কি করে তা দেখার জন্য। আবু দুজানা একটি লাল পট্টি নিয়ে মাথায় বাঁধলেন, আনসাররা বলেন, ‘আবু দুজানা তার মৃত্যুর রুমাল বেঁধে নিয়েছে! এরপর তিনি শত্রুদের আক্রমণ করলেন এবং যাকে সামনে পেলেন তাকেই হত্যা করলেন’।

এবং যুদ্ধের পূর্বে তিনি শত্রুসারির সামনে গর্বের সাথে হাঁটলেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘এটা এমন হাঁটা যা আল্লাহ ঘৃণা করেন, কিন্তু এই অবস্থা ব্যতিক্রম’।

ইয়ামামার যুদ্ধে, তিনি নিজেকে একটি দেয়ালের উপর দিয়ে ছুঁড়ে দেন যা শহরকে ঘিরে রেখেছিল এবং পড়ে গিয়ে  নিজের পা ভেঙ্গে ফেলেন। তিনি সেই ভাংগা পা নিয়েই যুদ্ধ চালিয়ে যান যতক্ষণ না শাহাদাত বরণ করেন।

১৩ খালিদ বিন আল ওয়ালিদ
তিনি আল্লাহর নির্বাচিত তলোয়ার। যখনই তিনি মুসলিম হলেন, রাসূলুল্লাহ সা) তাকে শত্রুদের সাথে লড়াই এর কাজে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি জীবনে কোন যুদ্ধে পরাজিত হননি। খালিদ বিন আল ওয়ালিদ বলেন, ‘যদি আমার একজন সুন্দরী নারী যাকে আমি ভালোবাসি তাকে বিয়ে করার অবস্থা সামনে থাকে, অথবা যদি আমাকে এই সুসংবাদ প্রদান করা হয় যে, তোমার একজন পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করেছে, এটাই আমার নিকট কম প্রিয় হবে এবং আমার অন্তরে কম পছন্দের হবে, বরং এক বরফের ন্যায় শীতল রাত্রিতে যদি আমাকে বলা হয়, একটি বাহিনী তোমার শত্রু হিসেবে আগামীকাল সকালে তোমার অপেক্ষায় আছে আমি সেটাই বেশি পছন্দ করব।
আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি, জিহাদে যাও !’ এই কথাগুলো ছিল খালিদের মৃত্যুশয্যায় বলা।
১৪ সালামাহ বিন আল আকওয়া
আমরা তাঁর ঘটনা ইতোপুর্বে আলোচনা করেছি, যেখানে তিনি একাই কুফফারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্পর্কে বলেন, “আমাদের পদাতিকদের মধ্যে আজকের দিনের সেরা সালামাহ বিন আল আকওয়া’।

১৫ উকবাহ বিন মাহসিন
যুদ্ধের ময়দানে তাঁর বীরত্ব সবার কাছেই সুপরিচিত। গাবাহ’র যুদ্ধে তিনি দেখলেন আমর বিন আবার তার পিতার সাথে একই উটের উপর বসে আছে, তিনি সেদিকে লক্ষ্য করে তাঁর বর্শা ছুঁড়ে মারলেন এবং একই আঘাত একই বর্শায় দুজনকে নিহত করে দিলেন।

১৬ আমর বিন মাআদি ইয়াকরিব.

তিনি ইয়েমেনের একজন রাজা ছিলেন, যিনি তাঁর সাহসীকতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি পরবর্তীতে মুসলিম হলেন। উমার তাকে এক হাজার লোকের সমান মনে করতেন। আল তারতুসী  তার সিরাজ আল মালুক কিতাবে বলেন, আমর বিন মায়াদি ইয়াকরিব নদীর তীরে গেলেন এবং লোকদের বললেন, ‘আমি সেতু পার হতে যাচ্ছি। যদি তোমরা এতটুকু সময় পরে আমাকে অনুসরণ কর যতটুকু সময় একটা উট জবাই করতে লাগে, তাহলে তোমরা আমাকে পাবে আমার তরবারী সহ লড়াইরত অবস্থায়, আমার সামনে যেই আসুক না কেন, আমার চারপাশে শত্রু ঘিরে থাকা অবস্থায়, আর আমি তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকব। আর এর পরে যদি তোমরা আস, তাহলে আমাকে মৃত অবস্থায় পাবে’। এবং এরপর তিনি সেতু পার হলেন এবং শত্রুদের শিবিরে পৌঁছে গেলেন, এরপর তাঁর লোকেরা চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘হে জাবিদের বেটারা ! আমরা কি আমাদের লোকটাকে একলা তাদের মাঝে ছেড়ে দিব? দেরি করলে আমরা তাকে জীবিত অবস্থায় আর পাব না’ কাজেই এরপর তারা সেতু পার হল এবং সেখানে গিয়ে দেখল সে ঘোড়াবিহীন অবস্থায় লড়ছে আর শত্রুদের একটি ঘোড়ার পিছনের দুইটি পা এমনভাবে ধরে আছে যে সেই ঘোড়াটি নড়তে পারছে না !  ঘোড়ার উপরে বসে থাকা যোদ্ধাটি আমরের কাছে আসার চেষ্টা করছিল কিন্তু সে নাগাল পাচ্ছিল না, তার তরবারী কোন কাজে আসছিল না। যখন যোদ্ধাটি দেখল আমরা সবাই তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছি, তখন সে ঘোড়া থেকে নেমে পালিয়ে গেল। তখন আমর সেই ঘোড়ার উপরে চড়ে বসলেন। এরপর তিনি আমাদের বললেন, ‘তোমরা আর একটু পরে এলেই আমাকে আর পেতেনা’। তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার ঘোড়াটি কই’? তিনি বলেন, ‘একটা তীর এসে ওটাকে মেরে ফেলে আর আমি ওর পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছিলাম’।


১৭ ইকরামা, আবু জাহেলের পুত্র

তিনি ইসলাম পূর্ব জীবন থেকেই দুঃসাহসী ছিলেন, এবং ইসলাম গ্রহণের পর তা কেবল বৃদ্ধিই পেল। ইয়ারমুকের যুদ্ধে তিনি দুর্ধর্ষ লড়াই করেন। তাকে বলা হল, ধীরে, সাবধানে ! তিনি জবাব দিলেন, ‘আমি লাত আর উযযাকে (দুইটি মূর্তি) রক্ষার জন্যে এক সময় লড়াই করেছি, আর তখনো আমি নিজের জন্য কোন খেয়াল করতাম না। আর আজকে যখন আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য লড়াই করছি, আমাকে বলছো সাবধান হতে!’ এরপর তিনি বলেন, ‘কে আছো, মৃত্যুর উপর বাইয়াত দিবে?’

আল হারিথ বিন হিশাম, দিহার বিন আল আযওয়ার এবং আরও ৪০০ জন দুঃসাহসী মুসলিম বের হলেন এবং বাইয়াত করলেন। তারা রোমানদের উপর আক্রমণ করলেন, এবং তাদের র‍্যাংককে অদৃশ্য করে দিলেন। ইকরিমাহ আর ফিরে আসেননি, তাঁর দেহ যখন খুঁজে পাওয়া গেল, তার মধ্যে সত্তরটিরও বেশি জখম দেখা গেল।

১৮- তুলাইহা আল আযদি-
যখন সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস পারস্য অভিযানে ছিলেন তখন তিনি যুদ্ধের ময়দান থেকে খলিফা উমরের কাছে রি ইনফোর্সমেণ্ট এর আবেদন পাঠালেন, উমর জবাব দিলেন, ‘আমি তোমার কাছে দুই হাজার পুরুষ পাঠালাম, আমর বিন মা’দি ইয়াকরিব এবং তুলাইহা আল আযদি। তাদের প্রত্যেকে এক হাজার জনের সমান’। তুলাইহা, আমর এবং কায়েস বিন মাকসুহ  তিনজনের দলটিকে একটি তদন্ত করতে স্কাউট হিসেবে পাঠানো হল, শত্রুদের বাহিনীর কাছে। আমর এবং কায়েস দুইজনে মিলে কয়েকজন পারস্য সেনাকে অপহরণ করলেন, এবং তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য মুসলিম ক্যাম্পে নিয়ে আসলেন। তুলাইহা আরও বড় কাজ করে দেখালেন, তিনি শত্রু সেনাদের ঘাঁটিতে প্রবেশ করলেন এবং অগ্রসর হতে লাগলেন এভাবে যতক্ষণ না সরাসরি কমাণ্ডারের তাঁবুতে প্রবেশ করলেন !
তিনি রাত ঘনিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, এরপর সরাসরি তিনি কমাণ্ডারের তাঁবুতে প্রবেশ করলেন, এবং তার ঘোড়া ছিনিয়ে নিলেন, যা তাঁবুর সাথে বাঁধা ছিল এবং এরপর সেখান থেকে চলে এলেন। কিন্তু একজন পারসী সেনা তাকে দেখে ফেললেন এবং ধাওয়া করলেন।তুলায়হা তাকে হত্যা করলেন, এবং কমাণ্ডারের ঘোড়ার সাথে তার ঘোড়াটিকেও নিয়ে আসতে লাগলেন,  আরেকটি ঘোড়সওয়ার তাকে দেখে ফেলে এবং ধাওয়া করলো, তুলায়হা তাকেও হত্যা করে তার ঘোড়াটিকেও ছিনিয়ে নেন, এরপর তৃতীয় আরেকজন ঘোড়সওয়ার তাকে ধাওয়া করে এবং তুলায়হার কাছে সে ভয়ে আত্মসমর্পণ করে।  তুলায়হা ঘোড়াগুলোর সাথে তাকেও আটক করে নিয়ে আসতে থাকেন, অর্থাৎ একজন বন্দী ও চারটি ঘোড়া নিয়ে তিনি মুসলিম শিবিরে চলে আসেন, মুসলিম নেতাগণ সেই পারসী সেনার দিকে মনোযোগ দিলেন তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য, দেখলেন সেনাটি তাদের একজন নেতা !

সেই পারসী সেনা পরবর্তীতে মুসলিম হন এবং আসুন তাঁর জবানীতেই সেই লোমহর্ষক ঘটনাটি শুনি, তিনি বলেন,

‘ আমি অসংখ্য যুদ্ধ লড়েছি, কিন্তু এই ব্যক্তিটির মত দ্বিতীয়টি দেখিনি ! তিনি শুধু আমাদের সীমানাতেই  প্রবেশ করেননি, এমন এক স্থানে প্রবেশ করেছেন, যেখানে বীর সাহসী ব্যক্তিরা পর্যন্ত সাহস করে না, আমাদের সেনাদের কমাণ্ডারের তাঁবুতে !  সেখানে ৭০,০০০ সৈন্য ছিল। যেন তাঁর জন্যে এটাও যথেষ্ট হল না, তিনি আরও সামনে এগিয়ে গেলেন, এমনকি কমাণ্ডারের ঘোড়াটিকেই ছিনিয়ে নিলেন, আর আমাদের প্রথম যে ব্যক্তি তাকে ধাওয়া করেছিল তাকে আমরা ১০০০ জনের সমকক্ষ বলে মনে করতাম, আর তিনি কিনা তাকে কতল করে দিলেন। দ্বিতীয় একজন তাকে ধাওয়া করলো, আর তিনি তাকেও শেষ করে দিলেন,   এবং এরপর আমি ধাওয়া দিলাম, আর আমি মনে করিনা বাহিনীতে আমার মত শক্তিশালী এবং সাহসী আর কেউ আছে, কিন্তু আমি তাঁর হাতে মৃত্যু দেখতে পেলাম, আত্মসমর্পণ করলাম !’ সেই পারসী সেনানায়ক পরবর্তীতে মুসলিম হন এবং মুসলিমদের সাথে জিহাদ করেন।

১৯ আব্দুল্লাহ বিন আল যুবাইর
তিনি ছিলেন বীরের পুত্র বীর। তাঁর পিতা ছিলেন আল যুবাইর বিন আল আওয়াম। আবদুল্লাহ উত্তর আফ্রিকা বিজয়ে অংশ গ্রহণ করেছিলেন এবং জানজিরকে হত্যা করেছিলেন, যিনি ছিলেন বারবার এর রাজা।
২০ আব্দুল্লাহ বিন আবি আল সারহ-
তিনি আফ্রিকার অন্যতম বিজেতা। তিনি মুসলিমদের প্রথম নৌবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। রোমানদের বিরুদ্ধে আল সায়ারি এর যুদ্ধ, তিনি উসমান রা) এর সময়ে মিশরের গভর্ণর পদে নিযুক্ত ছিলেন। যখন ফিতনা শুরু হল তখন তিনি অবসর নিয়ে রামাল্লা ফিলিস্তিনে চলে যান এবং সেখানেই মৃত্যু পর্যন্ত অবস্থান করেন।
২১ আমরের পুত্র আল কাকা
বদর যুদ্ধের পূর্বে যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের সাথে পরামর্শ করছিলেন, তখন আল কা’কা বলে উঠেন, ‘সামনে এগিয়ে যান এবং লড়াই করুন, আর আমরাও বনী ইসরাইলের লোকেরা মূসাকে যা বলেছিল সেটা বলব না, ‘আপনি এবং আপনার রব গিয়ে লড়াই করুন, আমরা এখানে বসে রইলাম’ বরং আমরা বলব, ‘আপনি সামনে এগিয়ে যান এবং আপনার রবকে সাথে নিয়ে লড়াই করুন, আমরাও সমানতালে আপনার সাথে লড়াই করব’।
আবু বকর তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘যুদ্ধের ময়দানে আল কা’কার কন্ঠের আওয়াজ এক হাজার লোকের থেকেও উত্তম’।

মূলঃ শাইখ ইবন নুহাস(মৃত্যু ৮১৪ হিজরী) এর মাশারী আল আশউয়াক্ব ইলা মাশারী আল-উশাক্ব ,
অধ্যায় ১৫

সূত্রঃ সরল পথ

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan