মার্কিন মুলুকে ইসলামের জয়যাত্রা
নাইন ইলেভেনের পর সারা বিশ্বে মুসলমানদের সন্ত্রাসী ও উগ্রবাদী হিসেবে পরিচিত করার অপচেষ্টা কম হয়নি। আল কায়েদার দোহায় দিয়ে মুসলিম বিশ্বের ওপর আরোপ করা হয়েছে নানা চাপ। তবে এত বাধা-বিপত্তি ও চাপ সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের অগ্রগতি অব্যাহত আছে। ইসলাম গ্রহণের প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এমনকি নাইন ইলেভেনের পর আমেরিকায়ও মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুতগতিতে। সারা বিশ্বের নিয়ন্ত্রক এ দেশটির মূলধারার সঙ্গে অনেকটাই মিশে গেছেন মুসলমানরা। আমেরিকায় নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা সত্ত্বেও ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি সেখানকার মানুষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলমানদের মধ্যেও ধর্মের প্রতি অনুরাগ আগের চেয়ে বেড়েছে বহুগুণ। এজন্য সেখানে ইসলামিক সেন্টার ও মসজিদ নির্মাণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
গত এক দশকে দেশটিতে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ বেড়েছে। গত ১ মে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় শুমারির ফলাফলে এ হিসাব দেয়া হয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব স্ট্যাটিস্টিশিয়ান্স অব আমেরিকান রিলিজিয়াস বডিস এ শুমারির উপাত্ত সঙ্কলন করেছে এবং অ্যাসোসিয়েশন অব রিলিজিয়ন ডাটা আর্কাইভ তা প্রকাশ করেছে। শুমারিতে দেখা যায়, ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলমানের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ, ২০১০ সালে দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা বেড়ে ২৬ লাখে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ দশ বছরে দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ মুসলমান৷ সেখানকার মুসলমানদের মধ্যে ‘গ্যালাপ সেন্টার ফর মুসলিম স্টাডিজ’ পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমেরিকায় বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের চেয়ে মুসলমানরা বেশি ধার্মিক এবং উচ্চশিক্ষিত৷ অপরদিকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অন্যান্যদের চেয়ে মুসলমানরা কম জড়িত। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের ৮০ শতাংশই বলেছে, ধর্ম তাদের জীবনযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ এজন্য তারা ধর্মকর্ম পালন করেন।
আমেরিকার মুসলমানদের ৪১ শতাংশ জানিয়েছে যে, তারা বেশ স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করছেন৷ তবে, পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কারণে মুসলমানরা অহেতুক নিগৃহীত হওয়ার ঘটনাও বিশ্ব মিডিয়ায় এসেছে। তবে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। প্রশাসনিকভাবে মুসলমানদের ওপর বাড়তি কিছু চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে না বলেই মনে করেন সেখানকার অধিবাসীরা।
সম্প্রতি আরেক জরিপে দেখা গেছে, দেশটিতে বর্তমানে মসজিদ রয়েছে ২১০৬টি। এ সংখ্যা ২০০০ সালের চেয়ে শতকরা ৭৪ ভাগ বেশি। এর মধ্যে নিউইয়র্ক শহরে রয়েছে ১৯২টি মসজিদ, দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়াতে ১২০টি, ফ্লোরিডায় ১১৮টি এবং টেক্সাসে রয়েছে ১৬৬ টি মসজিদ। এমনকি মন্টানা যেখানে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বাইরের জনসংখ্যা শতকরা এক ভাগেরও কম, সেখানেও দু’টি মসজিদ রয়েছে। ২০০২ সালে মসজিদের সংখ্যা ছিল এক হাজার ২০৯টি। আর ২০০২ সালে যেখানে ঈদের জামাতে অংশ নিয়েছিলেন ২০ লাখ মুসল্লি সেখানে ২০১১ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬ লাখে।
বর্তমানে আমেরিকায় ২.৬ মিলিয়ন মুসলমান শুক্রবার মসজিদে যান। ৪০ ভাগ আমেরিকান মুসলমান নিয়মিত মসজিদে যান। শুধু পুরুষই নয় নারীরাও মসজিদে যান। প্রতিটি মসজিদেই নারীদের জন্য আলাদা নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। আমেরিকার মসজিদগুলোর ইমামরাও ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। যে কোনো ধর্মীয় সমস্যার সমাধান দিতে তারা সক্ষম। ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে এখানকার মুসলমানরা দিন দিন মসজিদমুখী হচ্ছেন। বর্তমানে আমেরিকায় ইসলাম সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন ধর্ম। এছাড়া মুসলমানরাও আস্তে আস্তে নিজেদের ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হচ্ছেন। ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে যে ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে তা নিরসনের চেষ্টা করছেন। এ ক্ষেত্রে তরুণরা ইন্টারনেটকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর কমপক্ষে বিশ হাজার মানুষ মুসলমান হচ্ছে এবং ইসলাম গ্রহণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কারণ তারা এটা বুঝতে পেরেছেন, কয়েকটি উগ্র গোষ্ঠীর সঙ্গে ইসলামকে এক করে দেখানোর যে অপচেষ্টা করা হচ্ছে বাস্তবতার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। ইসলামে আল্লাহর ওপর নির্ভরতা, এক খোদার প্রতি আনুগত্য, যে কোনো কুসংস্কার থেকে দূরে থাকা ও মানবিয় মূল্যবোধ রক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়ায় এবং সর্বোপরি পবিত্র কুরআন শরীফে আজ পর্যন্ত কোনো বিকৃতি না ঘটায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে ক্রমেই ইসলামের প্রতি মানুষের ঝোঁক বাড়ছে। এসব দেশে কোরআনসহ ধর্মীয় গ্রন্থের বিক্রিই বেড়ে গেছে।
আমেরিকায় বসবাসরত মুসলমানের মধ্যে বিরাটসংখ্যক তরুণ নিয়মিত মসজিদে যায়। এসব তরুণ সম্পর্কে কোনো কোনো গণমাধ্যম অপপ্রচার চালাচ্ছে-তারা মৌলবাদ ও চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পডছে। কিন্তু দেশটির শতকরা ৮৭ ভাগ মুসলিম নেতা ও ইমাম তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছেন, মুসলিম তরুণদের মধ্যে চরমপন্থা বাড়ছে না। মার্কিন কংগ্রেসে মুসলমানের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন কিথ এলিসন। তিনি মুসলমানদের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন।
তিনি প্রমাণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জীবন উৎসর্গ করেও মুসলমানরা অপবাদের শিকার হচ্ছে। গত বছরের মার্চে মার্কিন কংগ্রেসে তিনি জোরালো ভাষায় বলেছেন, গুটিকয়েক মানুষের কর্মকান্ডের দায়ভার গোটা মুসলিম সমাজের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার ঘটনায় মুসলমান প্যারামেডিক সুলেমান হামদানির আত্মত্যাগের কথা উলে¬খ করে তিনি বলেন, ধসে পড়া টুইন টাওয়ারে অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন সুলেমান। অথচ শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই তাকে হামলাকারীর একজন হিসেবে অপবাদ দেয়া হয়েছিল। এক পর্যায়ে তিনি আপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলমানদের মনের কথা তার বক্তব্যে উঠে এসেছে বলে সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করা হয়।
মূলত ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে আমেরিকান মুসলমানরা। যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার মাত্র এক ভাগ মুসলমান। তাছাড়া আমেরিকান কিছু ইসলামবিরোধী পক্ষ মুসলমানদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের টার্গেটে পরিণত হন মুসলমানরা। এভাবে আমেরিকার মুসলমানদের নানাভাবে নিগৃহীতও হতে হয়েছে। তবে এই প্রতিকূলতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের প্রতি মমতা ও দরদ অনেক গুণ বেড়ে যায়। ইসলামি অনুশাসনগুলো তারা আগের চেয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে পালন করতে থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী মুসলমানরা অপেক্ষাকৃত ধার্মিক। সামাজিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা নিজেদের ধর্মে অটুট থাকার চেষ্টা করছেন। আমেরিকার বিভিন্ন শহরে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাগুলোতে মুসলমানদের ছেলেমেয়েরা দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করছে। বাইরে থেকে তাবলিগ ও দাওয়াতি কাজে যারা আমেরিকায় যান তারাও নির্বিঘ্নে ইসলামের শান্তির বাণী ছড়াচ্ছেন। এককথায় সভ্যতার চরম উৎকর্ষে অবস্থান করা সুপার পাওয়ার দেশটিতেও ইসলামের সজীব ধারাটি বয়ে চলেছে তার নিজস্ব গতিতে।