ইমামত বা নেতৃত্ব সম্পর্কে শিয়া ধারণা

শিয়া আলেমগণ বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করার মত তথাকথিত ইমামত বা নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বাস রাখাটা ঈমানের অন্যতম রুকন। অর্থাৎ শিয়া আলেমগণের নিকট ইমামত মানে গোটা মুসলিম জাতির জন্য আধ্যাত্মিক, শিক্ষা, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বংশগত শাসনব্যবস্থা কায়েমের জন্য ধারাবাহিকভাবে বার ইমামের ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করবে। আর এই ক্ষমতা সীমাবদ্ধ থাকবে ফাতেমা যাহরার স্বামী এবং তার দুই ছেলে হাসান ও হোসাইনের মধ্যে। অতঃপর সীমাবদ্ধ থাকবে হোসাইনের বংশের একাংশের মধ্যে, যিনি পারস্য সম্রাট এযদাজারদের কন্যা শাহবানুকে বিয়ে করেছেন; যে পারস্য সম্রাটের সিংহাসনকে খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাবের আমলে মুসলিম সৈন্যবাহিনী বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল।( তাবতাবায়ী, পৃ. ১৯০ – ২১১।) আর উদাহরণস্বরূপ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানের ভাষ্য হল: “ইরানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হল ইসলাম এবং দ্বাদশ জা‘ফরী মাযহাব; আর এই ধারাটি চিরস্থায়ীভাবে অপরিবর্তনীয়।” (ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান, বারতম ধারা।)


আর ইমামতের রুকনটি তাদের বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে এইভাবে যে, ঐসব ইমামগণ নিষ্পাপ এবং তারা আল্লাহর মত অদৃশ্য জগতের জ্ঞান রাখে; এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তাদের মৃত্যুর সময় সম্পর্কে তাদের (আগাম) জ্ঞান। আর ইমামদের অন্ধ আনুগত্য করা একান্ত জরুরি; “মর্যাদার বিষয়টি এমন যে, যখন এই বিষয়টি ইমামের নির্দেশ বা কাজ হয়, তখন আল্লাহর ইবাদত (আল-মাকতাবাতুল-ইসলামীয়া আল-‘উযমা (المكتبة الإسلامية العظمى), পৃ. ৬।) আর এই ক্ষেত্রে খোমেনী বলেন: “ইমামগণ এমন মর্যাদাসম্পন্ন, যাদের মধ্যে ভুল-ত্রুটি অথবা অবহেলা আছে বলে আমরা কল্পনা করি না এবং আমরা বিশ্বাস করি মুসলিমদের স্বার্থ ও কল্যাণ সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন …” ;(ইমাম খামেনী, আল-হুকুমাতুল ইসলামীয়া (الحكومة الإسلامية), পৃ. ৯১।) আর এই আকিদাটিও ঈমানের আবশ্যকীয় বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত এইভাবে যে, “ইমামদের জন্য রয়েছে আধ্যাত্মিক অবস্থান ও সকল সৃষ্টির উপর সৃজনশীল খেলাফত বা রাজত্ব, এমনকি সৃষ্টির সকল অণু-পরমাণু তাদের বশ্যতা স্বীকার করে; আর শিয়া আকিদার অন্যতম বুনিয়াদী বিষয় হল, ইমামদের আধ্যাত্মিক অবস্থানে আল্লাহর নিকটতম কোন ফেরেশতা, নবী ও রাসূল পৌঁছাতে পারে না।”(ইমাম খামেনী, আল-হুকুমাতুল ইসলামীয়া (الحكومة الإسلامية), পৃ. ৬৪।) আর এই বিশ্বাসের অধীনে আরও যা অন্তর্ভুক্ত হয়, তা হল: মুসলিমদের সকল খলিফা, প্রশাসক ও বিচারকগণ তাগুত, যতক্ষণ না তারা জা‘ফরী মতবাদের অনুসারী হবে; এমনকি তাদের নিকট বিচার প্রার্থনা করে মামলা-মকদ্দমা করাও বৈধ নয়।(ইমাম খামেনী, আল-হুকুমাতুল ইসলামীয়া (الحكومة الإسلامية), পৃ. ৮৬ – ৮৭।) এই জন্য আমরা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানকে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টকে উদ্বুদ্ধ করতে দেখতে পাই যে, “ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মূলনীতিমালা ও রাষ্ট্রের সরকারী মাযহাবের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসভাজন হয়ে …” যেমনিভাবে এর উপর বক্তব্য প্রদান করে সংবিধানের ১১৫তম ধারা এবং শপথে পড়া হয়, “আমি সরকারী মাযহাবের সংরক্ষক হব” যার বিবরণ সংবিধানের ১২১তম ধারায় এসেছে।
জা‘ফরীয়দের বাইরের বিচারকদের নিকট অথবা জা‘ফরীয় ব্যতীত অন্যের শরীয়তের নিকট নিরাপত্তাহীনতার কারণে সংবিধানের ৭২ নং ধারার ভাষ্য হল: “রাষ্ট্রের সরকারী মাযহাবের হুকুম-আহকাম ও বিধি-বিধানের বিপরীত কোন নিয়ম-কানুন জারি করার ক্ষমতা (রাষ্ট্রীয় মজলিসে শুরা) সংরক্ষণ করে না …।”
আর যখন জা‘ফরীয় একাদশ ইমাম আনুমানিক ১১শ শতাব্দীর দিকে মারা যায়, আর জা‘ফরী আকীদার মতে, দ্বাদশ ইমাম হলেন মাহদী, শিয়া আলেমদের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতে যিনি তার পাঁচ বছর বয়সে আত্মগোপন করে আছেন এবং তিনি মারা যাননি। আর অচিরেই তিনি শেষ যামানায় আত্মপ্রকাশ করবেন এবং তার অদৃশ্যমান থাকাবস্থায়ই ক্ষমতার উত্তরাধিকারে তার হক প্রতিষ্ঠিত আছে, এ জন্যই ইরানের সংবিধানের পঞ্চম ধারার সুস্পষ্ট বক্তব্য হল: “ইমাম মাহদীর অবর্তমানে (খুব তাড়াতাড়ি আল্লাহ তা‘আলা তাকে মুক্ত করুন) ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতির শাসনক্ষমতা ‘ন্যায়পরায়ণ ফকিহ’ এর হাতে থাকবে …।”
এই হল শিয়া আলেমগণের বক্তব্য; কিন্তু মুসলিম আলেমগণের অধিকাংশ আলেম বলেন, শাসনব্যবস্থায় উত্তরাধিকারতন্ত্রের দ্বারা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করাটা একটি বিরোধপূর্ণ বিষয়। তাহলে যে ব্যবস্থার মধ্যে আধ্যাত্মিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সব ক্ষমতা উত্তরাধিকার ভিত্তিতে হয় এবং তার উত্তরাধিকারী হয় নয়, আট বা পাঁচ বছরের শিশু সেটা কেমন করে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? এই জন্য তারা [আহলে সুন্নাতের আলেমগণ] এই ধরনের ব্যবস্থাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে, আল-কুরআনের কোন একটি আয়াত অথবা কোন একটি বিশুদ্ধ হাদিসে এর ভিত্তি নেই। বরং তা শুরা বা পরামর্শ করে নেতৃত্ব (ইমামত) নির্বাচন নীতির সাথে সাংঘর্ষিক, আল্লাহ তা‘আলা যে নীতির প্রশংসা করেছেন এবং আল-কুরআনুল কারীমের মধ্যে যার নির্দেশ দিয়েছেন। (সূরা আশ-শুরা: ৩৮ ; সূরা আলে ইমরান: ১৫৯।)
আর মুসলিম আলেমগণ দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই সকল প্রকার ভুল-ত্রুটি ও অবহেলা থেকে পবিত্র এবং সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি, অপূর্ণতা ও অভাব থেকে মুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা যাকে পাপমুক্ত রেখেছেন সে ব্যতীত সৃষ্টির মধ্যে কেউ নিষ্পাপ নয়; সুতরাং নিষ্পাপ হলেন নবী ও রাসূলগণ, যাঁদের নিষ্পাপ হওয়াটা সীমাবদ্ধ আমানতের সাথে তাঁদের রিসালাতের দায়িত্ব পালন করার উপর; আর তাঁরা রিসালাতের দায়িত্ব পালনের সাথে সম্পৃক্ত গুনাহ থেকে নিষ্পাপ এবং তাঁরা যে দিকে মানুষকে আহ্বান করে, তার বিরোধিতা করা বা বিপরীত চলা থেকে মুক্ত। এগুলো ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে রাসূলের ইজতিহাদী তথা গবেষণাগত ভুল হতে পারে, যেমনিভাবে আল-কুরআন আমাদেরকে বর্ণনা করে শুনাচ্ছে যে, আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সূরা ‘আবাসা’র মধ্যে তিরস্কার করেছেন, যখন তিনি তাঁর অন্ধ সাহাবীকে উপেক্ষা করেছেন।
(সহীহ মুসলিম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৭৮২।)
আর ‘ইলমে গায়েব তথা অদৃশ্য বিষয় সংক্রান্ত জ্ঞানের বিষয়টি যার জন্য নির্দিষ্ট সে বিষয়ে কথা হল, যদি মুসলিম ব্যক্তি আল-কুরআনুল কারীম পাঠ করে, তবে সে বহু আয়াত পাবে যেগুলো এই প্রকারের জ্ঞানকে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ সূরা আ‘রাফের ১৮৮ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
﴿قُل لَّآ أَمۡلِكُ لِنَفۡسِي نَفۡعٗا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَآءَ ٱللَّهُۚ وَلَوۡ كُنتُ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ لَٱسۡتَكۡثَرۡتُ مِنَ ٱلۡخَيۡرِ وَمَا مَسَّنِيَ ٱلسُّوٓءُۚ إِنۡ أَنَا۠ إِلَّا نَذِيرٞ وَبَشِيرٞ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ١٨٨ ﴾ [سورة الأعراف: 188]
“বল, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা ব্যতীত আমার নিজের ভাল-মন্দের উপরও আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি অদৃশ্যের খবর জানতাম, তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো শুধু মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা ব্যতীত আর কিছুই নই।” (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৮৮।)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতের প্রতিনিধিত্ব করে ইমাম ত্বাহাবী এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে কাফির বলে ফতোয়া দিয়েছেন, যারা কোন একজন মানুষকেও নবীদের চেয়ে উত্তম বলে বিশ্বাস করে।(আল-‘আকিদাতুত ত্বহাবীয়া (العقيدة الطحاوية), পৃ. ৫৭৭।) সুতরাং তাদের ব্যাপারে বিধানগত অবস্থা কী হবে, যারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার জন্য এককভাবে নির্ধারিত গুণাবলীর অংশবিশেষ মানুষের জন্য দাবি করে; যেমন ‘ইলমে গায়েব তথা অদৃশ্য বিষয় সংক্রান্ত জ্ঞান, পরিপূর্ণভাবে নিষ্পাপ হওয়া এবং আল্লাহর ইবাদতের প্রয়োজন নেই বলে নির্দেশ দেয়ার পরও তাদের আনুগত্য করা?!
আর বিশেষ করে দ্বাদশ ইমাম যার ব্যাপারে শিয়া আলেমদের বিশ্বাস হল, তার হায়াতের সীমাবদ্ধতা প্রায় ১১শ শতাব্দী পর্যন্ত!!!; অথচ অধিকাংশ ঐতিহাসিক দৃঢ়তার সাথে বলেন, শিয়াদের একাদশ ইমামের কোন সন্তান বা বংশধরও নেই।(আহমদ ইবন তাইমিয়্যা, মিনহাজুস্ সুন্নাহ আন-নববীয়া ফী নকযে কালামেশ্ শিয়া ওয়াল কাদরিয়া (منهاج السنة النبوية في نقض كلام الشيعة و القدرية), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭।) এমনকি যেসব হাদিস মাহদী ও শেষ যামানায় তার আত্মপ্রকাশ সম্পর্কে ইমাম তিরমিযী ও আবূ দাঊদ বর্ণনা করেছেন এবং বিশুদ্ধ হাদিসের গ্রন্থকারগণ বর্ণনা করেন নি, সেসব হাদিসসমূহের ভাষ্য হল: তার নাম হবে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামের মত এবং তার পিতার নাম হবে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতা আবদুল্লাহর নামের মত; অথচ তাদের নিকট দ্বাদশ ইমামের নাম হচ্ছে, মুহাম্মদ আল-মাহদী ইবন হাসান। আর ঐসব হাদিস এ কথাও বলে যে, তার আগমন ঘটবে হাসানের বংশ থেকে; হোসাইনের বংশ থেকে নয়।(ইবনু আছীর আল-জাযারী, জামে‘উল উসূল ফী আহাদীসের রাসূল (جامع الأصول في أحاديث الرسول), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩০ – ৩৩২।) তাছাড়া সেখানে এমন কোন দলিল নেই যে, মাহদী প্রায় ১২ শতাব্দী পর্যন্ত জীবন পাবেন।
হে ভাই ও বোনেরা! শিয়া আলেমগণ তথাকথিত ‘ইমামত’ তথা নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাকে ঈমানের অন্যতম রুকন বলে বিবেচনা করে। অর্থাৎ যে মুসলিম ব্যক্তি এর প্রতি বিশ্বাস রাখবে না, সে কাফির হয়ে যাবে। অপরদিকে তাদের তথাকথিত ‘ইমামত’-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার যে বিভিন্ন মাত্রা ও পর্যায় রয়েছে তার উপর ঈমান আনলে তা শীঘ্রই মুসলিম ব্যক্তিকে কাফিরে পরিণত করবে (আল্লাহ আমাদেরকে শিরক ও কুফর থেকে আশ্রয় দিন); অধিকাংশ মুসলিম আলেম আল-কুরআন ও সুন্নাহর উপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্তের উপর ঐক্যমত পোষণ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, অধিকাংশ মুসলিম আলেম কর্তৃক এই হুকুম প্রদানের পেছনে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই এবং তারা এর দ্বারা নির্দিষ্ট কোন পরিবার অথবা কোন দলের পক্ষাবলম্বন করেন না।
হে মুসলিম ভাই ও বোনেরা! জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাত দ্বারা সফলতা লাভের পথ নির্বাচনে জোরদার হও ঐ দিন আগমনের পূর্বে, যেই দিনে জাতীয়তাবাদ উপকার করতে পারবে না কোন জাতির; আর কোন সৃষ্টিও উপকার করতে পারবে না কোন সৃষ্টির।
সূত্রঃ শিয়া আলেম ও অধিকাংশ মুসলিম আলেমের মধ্যে বিরোধের বাস্তব চিত্র
লেখকঃ সা‘ঈদ ইসমাঈল
অনুবাদ : মো: আমিনুল ইসলাম

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88