সলাতে মুবাশ্‌শির (পর্ব ১৯)

রচনায় : আব্দুল হামীদ ফাইযী

ক্বিবলার বিধান

সমগ্র মুসলিম-জাতির জন্য রয়েছে একই ক্বিবলার বিধান। মহান আল্লাহ বলেন,

ومِنْ حَيْثُ خَرَجْتَ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ، وَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوْا وَجُوْهَكُمْ شَطْرَه।

অর্থাৎ, আর তুমি যেখান হতেই বের হও না কেন, মসজিদুল হারাম (কা’বা শরীফের) দিকে মুখ ফিরাও এবং তোমরা যেখানেই থাক না কেন, ঐ (কা’বার) দিকেই মুখ ফিরাবে। (সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত নং-১৫০)

আল্লাহর নবী (সাঃ) যখন নামাযে দাঁড়াতেন, তখন (ফরয-নফল সকল নামাযেই) কা’বা শরীফের দিকে মুখ ফিরাতেন। (ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২৮৯নং) তিনি এক নামায ভুলকারীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “যখন নামাযে দাঁড়াবার ইচ্ছা করবে তখন পরিপূর্ণরুপে ওযু কর। অতঃপর ক্বিবলার দিকে মুখ করে তকবীর বল—।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৯০নং)

নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য ক্বিবলাহ্‌-মুখ করা হল অন্যতম শর্ত। নামাযের সময় বান্দার থাকে দু’টি অভিমুখ; একটি হল হৃদয়ের এবং অপরটি হল দেহের। তার হৃদয়ের অভিমুখ থাকে আল্লাহর প্রতি। আর দেহ্‌ ও চেহারার অভিমুখ হয় আল্লাহরই এক বিশেষ নিদর্শন কা’বাগৃহের প্রতি। যে গৃহের তা’যীম করতে এবং যার প্রতি অভিমুখ করতে বান্দা আদিষ্ট হয়েছে। সারা বিশ্বের মুসলমানদের হৃদয় যেমন আল্লাহর অভিমুখী, তেমনিই নামাযে তাদের সকলের দেহ্‌-মুখও একই গৃহের প্রতি অভিমুখী হয়। এতে রয়েছে সারা মুসলিম জাতির ঐক্য ও সংহ্‌তির বহিঃপ্রকাশ এবং তাদের সকল বিষয়ে একাত্মতা অবলম্বন করার প্রতি ইঙ্গিত।

ক্বিবলার অভিমুখ

যারা কা’বার আশেপাশে নামায পড়ে এবং কা’বা তাদের দৃষ্টির সামনে থাকে, তাদের জন্য হুবহু কা’বার প্রতি মুখ ফেরানো জরুরী। পক্ষান্তরে যারা কা’বা দেখতে পায় না তাদের জন্য হুবহু কা’বার প্রতি মুখ ফেরানো জরুরী নয়। যেহেতু মহানবী (সাঃ) বলেন, “পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝামাঝি হল ক্বিবলার দিক।” (তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৭১৫ নং)

তিনি বলেন, “প্রস্রাব-পায়খানা করার সময় তোমরা ক্বিবলাহ্‌কে সামনে বা পিছন করে বসো না; বরং পূর্ব অথবা পশ্চিম দিককে সামনে বা পিছন করে বস।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৩৩৪নং)

উক্ত হাদীস দু’টি হতে এ কথা বুঝা যায় যে, মদীনাবাসীদের জন্য ক্বিবলাহ্‌ হল পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে (দক্ষিণ) দিকে। যেহেতু মদীনা শরীফ থেকে কা’বার অবস্থান হল দক্ষিণে। সুতরাং যদি মদীনায় কেউ দক্ষিণ মুখে নামায পড়ে তবে তার ক্বিবলাহ্‌-মুখে নামায পড়া হবে। যদিও হুবহু কা’বা থেকে তার অভিমুখ একটু ডানে-বামে সরেও হয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উসাইমীন ২/২৬৭)

অতএব পৃথিবীর মানচিত্রে যারা কা’বার যে দিকে অবস্থান করে তার ঠিক বিপরীত দিকে হবে তাদের ক্বিবলাহ্‌। ভারত-বাংলাদেশ পড়ছে কা’বার পূর্বে, তাই এ দেশের লোকেদেরকে পশ্চিম দিকে মুখ করে নামায পড়তে হয়। বলা বাহুল্য, মাহাত্ম হল ক্বিবলার; পশ্চিম দিকের কোন মাহাত্ম নয়।

ক্বিবলাহ জানতে না পারলে

কোন অচেনা-অজানা স্থানে অন্ধকার বা মেঘের কারণে চাঁদ, সূর্য, তারা দেখতে না পাওয়ার ফলে ক্বিবলার দিক কোন্‌টা নির্ণয় করতে না পারলে এবং জানার মত সে রকম কোন যন্ত্র বা উপায় না থাকলে, মনে মনে সঠিক ধারণার উপর ভিত্তি করেই নামায পড়তে হবে। অবশ্য নামাযের পর ক্বিবলার সঠিক দিক অন্য বুঝতে পারলেও নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। পুনরায় ঐ নামায সঠিক ক্বিবলাহ্‌-মুখে আর পড়তে হবে না।

হযরত জাবের (রাঃ) বলেন, আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর সঙ্গে কোন এক সফর বা অভিযানে ছিলাম। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে (নামাযের সময়) আমরা ক্বিবলার দিক নির্ণয়ে মতভেদ করলাম। এতে প্রত্যেকে নিজ নিজ মতে পৃথক পৃথক নামায পড়ে নিল। (তখন নবী (সাঃ) সেখানে ছিলেন না।) সঠিক ক্বিবলার দিকে নামায হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করার জন্য প্রত্যেকে নিজের নিজের সামনে দাগ দিয়ে রাখল। সকাল হলে সে দাগগুলো আমরা দেখলাম; দেখলাম, আমরা ক্বিবলার ভিন্ন দিকে মুখ করে নামায পড়ে ফেলেছি। অতঃপর ব্যাপারটি নবী (সাঃ) এর নিকট উল্লেখ করলে তিনি আমাদেরকে ঐ নামায পুনরায় পড়তে আদেশ করলেন না। বরং তিনি বললেন, “তোমাদের নামায শুদ্ধ হয়ে গেছে।” (দারাক্বুত্বনী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২৯৬নং)

নামায পড়া অবস্থায় যদি কারো বা কিছুর মাধ্যমে ক্বিবলার সঠিক দিক জানা যায়, তাহলে সাথে সাথে সেদিকে ফিরে যাওয়া জরুরী। মহানবী (সাঃ) শুরুতে বাইতুল মাক্বদেসের দিকে মুখ করে নামায পড়তেন।  তিনি মনে মনে চাইতেন যে, কা’বাই তাঁর ক্বিবলাহ্‌ হোক। সে সময় এই আয়াত অবতীর্ণ হল,

قَدْ نَرَىٰ تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ ۖ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا ۚ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ ۚ وَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ ۗ وَإِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّهِمْ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُونَ

অর্থাৎ, আকাশের দিকে তোমার বারবার তাকানোকে আমি প্রায় লক্ষ্য করি। সুতরাং আমি তোমাকে এমন ক্বিবলার দিকে ফিরিয়ে দেব, যা তুমি পছন্দ কর। অতএব তুমি (এখন) মাসজিদুলহারামের দিকে মুখ ফেরাও। (সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত নং-১৪৪)

এরপর থেকে তিনি কা’বার দিকে মুখ ফিরিয়ে নামায পড়তে লাগলেন। কুবার মসজিদে লোকেরা ফজরের নামায পড়ছিল। ইত্যবসরে এক আগন্তুক তাদেরকে এসে বলল, ‘আজ রাত্রে আল্লাহর রসূলের উপর কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে তাঁকে কা’বার দিকে মুখ করে নামায পড়তে আদেশ করা হয়েছে। সুতরাং শোন! তোমরা কা’বার দিকে মুখ ফেরাও।’ তখন তাদের মুখ ছিল শাম (বর্তমানে প্যালেস্টাইন) এর দিকে। সংবাদ শোনামাত্র তারা কা’বার দিকে ঘুরে গেল। (বুখারী, মুসলিম,  আহমাদ, মুসনাদ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২৯০নং)

কোন্‌ কোন্‌ অবস্থায় ক্বিবলাহ্‌-মুখ না হলেও নামায শুদ্ধ

১। অসুস্থ ও অক্ষম ব্যক্তি ক্বিবলার দিকে মুখ না করতে পারলে এবং তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার মত কেউনা থাকলে, সে যে মুখে নামায পড়বে সেই মুখেই নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। যেহেতু “আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতীত বোঝা বহ্‌নের ভার দেন না।” (সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত নং-২৮৬)

২। যুদ্ধ চলাকালীন হানাহানির সময় নামাযে ক্বিবলাহ্‌-মুখ হওয়া জরুরী নয়। শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য রেখে তাদের দিকে মুখ করেই নামায পড়তে হবে। (বুখারী, মুসলিম,  ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৫৮৮নং)

মহান আল্লাহ বলেন, “যদি তোমরা (শত্রুর) ভয় কর, তাহলে পথচারী অথবা আরোহী অবস্থায় (নামায পড়ে নাও)।” (সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত নং-২৩৯)

ইবনে উমার (রাঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘ভয় খুব বেশী হলে তোমরা দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় অথবা সওয়ার হওয়া অবস্থায় ক্বিবলার দিকে মুখ করে অথবা না করেই নামায পড়ে নাও।’ (বুখারী ৪৫৩৫ নং)  আর মহানবী (সাঃ) বলেন, “শত্রুর সাথে যুদ্ধরত হলে (নামাযে) তকবীর ও মাথার ইশারাই যথেষ্ট।” (বায়হাকী ৩/২৫৫)

৩। সফরে উট, ঘোড়া বা গাড়ির উপর নফল বা সুন্নত নামায পড়ার সময়ও ক্বিবলাহ্‌-মুখ হওয়া জরুরী নয়। যেহেতু নবী (সাঃ) সফরে নিজের সওয়ারীর উপর যে মুখে উট চলত, সেই মুখেই নফল ও বিত্‌র নামায পড়তেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১৩৪০ নং)

এ ব্যাপারে কুরআন মাজীদের এই আয়াত অবতীর্ণ হয়, “পূর্ব ও পশ্চিম সব দিকই আল্লাহর। সুতরাং তুমি যে দিকেই মুখ ফেরাও, সে দিকই আল্লাহর।” (সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত নং-১১৫)

আর কখনো কখনো তিনি উটনীর উপর নফল পড়ার ইচ্ছা করলে উটনী সহ্‌ ক্বিবলাহ্‌-মুখ হয়ে তকবীর দিতেন। তারপর বাকী নামায নিজের সওয়ারীর পথ অভিমুখেই সম্পন্ন করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, প্রমুখ সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৭৫পৃ:)  অবশ্য ফরয নামাযের সময় সওয়ারী থেকে নেমে ক্বিবলাহ্‌-মুখ হয়ে নামায পড়তেন। (বুখারী, আহমাদ, মুসনাদ, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৭৫পৃ:)

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button