রমযান মাসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিশেষ আমল (পর্ব-১)
রমযান মাসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিশেষ আমল (পর্ব-১)
ইসলামের মূল পাঁচটি ভিত্তির মধ্যে রোযা হল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। এ রোযা বা উপবাস হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে সর্বকালে ও সর্বধর্মে প্রচলিত ছিল। তবে ইসলাম ধর্মেই অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য একমাস রোযা ফরয করা হয়েছে। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের তৃতীয় স্তম্ভ হচ্ছে রোযা। ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী রোযা প্রতিটি সুস্থ বয়ঃপ্রাপ্ত মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরয বা অবশ্য পালনীয়। মুসলিম রোযা পালন করে আল্লাহ্র নির্দেশ পালনার্থেই-তাঁর সন্তুষ্টির জন্যেই। এর বস্তুগত-অবস্তুগত উপকারিতার কথা তার কাছে মুখ্য বিবেচ্য নয়-মুত্তাকী হওয়া,পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী হওয়াই তাঁর কাছে প্রধান বিষয়। এ মহিমান্বিত ও সম্মানিত রমজান মাসে আমরা যে সকল নেক আমল বেশি বেশি করার মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে পারি তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নে আলোচনা করা হল :
১. তারাবীহের নামায আদায় করা : কিয়ামুল লাইল শব্দের অর্থ রাতের সালাত। অর্থাৎ সালাতে তারাবীহ। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন :
من قام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه.
‘যে রমযান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রাতে সালাত আদায় করবে তার অতীতের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’[1]
২. আল-কুর’আনের তিলাওয়াত করা : রমযান যেহেতু কুরআন নাযিলের মাস সেহেতু এ মাসে কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন অন্য সময়ের চেয়ে বেশি করা উচিত। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ বলেছেন : … কুরআনও বলবে,হে রব! (রাতে কুরআন পাঠের কারণে) রাতের নিদ্রা থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই এ পাঠকের ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ মঞ্জুর কর। তিনি বলেন : অতঃপর উভয়েরই সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।[1] এ প্রসঙ্গে অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেছেন :
الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة .
‘রোযা ও কুর’আন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে…।’[2]
৩. বেশি বেশি দান-সাদকা করা : এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন :
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم أجود الناس بالخير، وكان أجود ما يكون في شهر رمضان.
‘রাসূলুল্লাহ্ সা. ছিলেন মানুষের মাঝে সবচেয়ে বেশি দানশীল। আর রমজানে তার বদান্যতা আরো বেড়ে যেত।’[3]
৪. ই‘তিকাফ তথা মসজিদে অবস্থান করা : এ প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বিধায় এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচনা না এনে সংক্ষেপে একটি হাদীস উল্লেখ করা হলো। ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন :
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتكف العشر الأواخر من رمضان.
‘রাসূলুল্লাহ সা. রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন।’[4]
৫. রমযানে উমরাহ আদায় : রমযানে একটি উমরা আদায করলে অন্য মাসে ৭০টি ওমরাহ করার সাওয়াব হয়। তাই এ মাসে ওমরাহ আদায় করাটাও অনেক বড় সাওয়াবের কাজ। এপ্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেছেন :
عمرة في رمضان كحجة معي.
‘রমযান মাসে ওমরাহ আদায় আমার সাথে হজ আদায়ের সমতুল্য।’[5]
৬. অপরকে ইফতার করানো : রোযাদারকে ইফতার করালে যে ব্যক্তি রোযাদারকে ইফতার করালো সেও রোযাদারের মত একটি রোযার সাওয়াব পাবে। এটি হাদীসে রাসূল থেকে প্রমাণিত। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,
من فطر صائما كان له مثل أجره ، غير أنه لا ينقص من أجر الصائم شيئا.
‘যে ব্যক্তি কোন রোযা পালনকারীকে (রোযাদারকে) ইফতার করাবে সে রোযা পালনকারীর অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে,তবে রোযা পালনকারীর সওয়াব থেকে বিন্দুমাত্র হ্রাস করা হবে না।’[6]
৭. বেশি বেশি করে আল্লাহর দরবারে দোয়া করা : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রোযার বিধান বর্ণনা করার পর বলেছেন,
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ.
‘আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করে,আমি তো নিকটেই। প্রার্থনাকারী যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে,আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দেই।’[7]
৮. বেশি বেশি করে তওবা করা : এ মাসে তওবার অনুকূল অবস্থা বিরাজ করে। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়,জাহান্নাম থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়া হয়। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
رغم أنف رجل دخل عليه رمضان، ثم انسلخ قبل أن يغفر له.
‘যে ব্যক্তি রমযান মাস পেয়েও তার পাপ ক্ষমা করাতে পারেনি,তার নাক ধুলায় ধূসরিত হোক।’[8]
৯. অধিক হারে সাওয়াবের কার্য করতে চেষ্টা অব্যাহত রাখা : রমযান মাসে অধিক হারে নেক আমল করতে চেষ্টা করা প্রত্যেকটি মুসলিম নর-নারীর জন্য একান্ত আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,
عن عائشة رضي الله عنها قالت : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا دخل العشر أحيى الليل، وأيقظ أهله، وجد وشد المئزر.
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন : ‘যখন রমজানের শেষ দশক এসে যেত,রাসূলুল্লাহ সা. তখন রাত্রি জাগরণ করতেন,পরিবার বর্গকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দিতেন,লুঙ্গি শক্ত ও ভাল করে বেঁধে (প্রস্তুতি গ্রহণ) নিতেন।’[9]
১০. বেশি বেশি ইসলামী জ্ঞান চর্চা করা : রমযান মাসকে আমরা ইসলামী শিক্ষা অর্জন ও শিক্ষা প্রসারের একটি সুযোগ হিসেবে নিতে পারি। মূর্খতার অবসান ঘটানো রোযার একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবি। যেমন রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
من لم يدع قول الزور والعمل به والجهل، فليس لله حاجة أن يدع طعامه وشرابه.
‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না,তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’[10]
১১. বেশি বেশি যিকির করা : ইমাম নববী রহ. বলেন : জিকির কেবল তাসবীহ,তাহলীল,তাহমীদ ও তাকবীর ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ নয়,বরং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আনুগত্যের সাথে প্রত্যেক আমলকারীই জিকিরকারী হিসেবে বিবেচিত। এ-কারণে আল্লাহ তাআলা মুসলিম ব্যক্তিকে দিবা-রাত্রে গোপনে-প্রকাশ্যে জিকির করার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا. وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا.
‘মুমিনগণ ! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর। এবং সকাল বিকাল আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা কর।[11]
১২. মিসওয়াক করা : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিসওয়াকের প্রতি অশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। হাদীসে এসেছে,মিসওয়াক মুখের জন্য পবিত্রকারী,এবং রবের সন্তুষ্টি আনয়নকারী।[12]
১৩. একজন অপরজনকে কুরআন শুনানো : রমযান মাসে একজন অপরজনকে কুরআন শুনানো একটি উত্তম আমল। এটিকে দাওর বলা হয়। ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,জিবরাইল আলাইহিস সালাম রমযানের প্রতি রাতে রমযানের শেষ পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং রাসূল তাকে কুরআন শোনাতেন।[13]
১৪. কুরআন বুঝা এবং কুর’আন অনুযায়ী নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা : এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেন :
اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ .
‘তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে,তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর’।[14]
১৫. যথাযথভাবে সুন্নাত মোতাবিক রোযা পালন করা : রমযান মাসের প্রধান আমল হলো সুন্নাহ মোতাবেক রোযা পালন করা। মহান আল্লাহ বলেন : “সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে,মাসটিতে উপস্থিত হবে,সে যেন তাতে রোযা পালন করে।”[15]
১৬. যথা সময় মত সালাত আদায় করা : রমযান মাসে রোযা পালনের সাথে সাথে সব সময় সঠিক সময়ে নামায আদায় করার মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম হয়। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,
إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا.
‘নিশ্চয় সালাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরয।’[16]
১৭. অপরকে কুর’আন শিক্ষা দেয়া : রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সাহাবীদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,‘যে আল্লাহর কিতাব থেকে একটি আয়াত শিক্ষা দিবে,যত তিলাওয়াত হবে তার সাওয়াব সে পাবে।’[17]
১৮. রাত্রে সাহরী খাওয়া : রোযা পালনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সাহরী খাওয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال : قال النبي صلى الله عليه و سلم : تسحروا فإن في السحور بركة.
“তোমরা সাহরী খাও,কারণ সাহরীতে বরকত রয়েছে।[18]
অপর এক হাদীসে এসেছে,‘‘সাহরী হল বরকতময় খাবার। তাই কখনো সাহরী খাওয়া বাদ দিয়ো না। এক ঢোক পানি পান করে হলেও সাহরী খেয়ে নাও। কেননা সাহরীর খাবার গ্রহণকারীকে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর ফেরেশতারা স্মরণ করে থাকেন’’[19]
রচনায় :- মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি,ঢাকা।
তথ্যসূত্র :-
- মুসলিম, মুসলিম ইব্ন হাজ্জাজ ইব্ন মুসিলম, আস-সহীহ, (কায়রো : মাকাতাবাহ আল-কুদসী, ১৩৬৭ হি.), প্রাগুক্ত, হাদীস নং-১৭৩
- আহমাদ, আবূ আব্দিল্লাহ ইব্ন হাম্বল, আল-মুসনাদ, (মিশর : কর্ডোভা, তা.বি.),হাদীস নং-৬৬২৬
- মুসলিম, আস-সহীহ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-৩২০৮
- প্রাগুক্ত, হাদীস নং-১১৭১
- মাজমাউল কাবীর, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-৭২২; জামি‘উল আহাদীস, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-১৪৩৭৯
- আহমদ, আল-মুসনাদ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-২২৩০২
- সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৬
- জামি‘উল উসুল, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-১৪১০
- মুসলিম, আস-সহীহ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-১১৭৪
- বুখারী, আবু ‘আব্দিল্লাহ্ ইসমাঈল ইব্ন মুগীরাহ, আল-জামি‘উস সহীহ, (বৈরূত : দারু ইব্ন কাছীর, ১৪০৭হি.),হাদীস নং-৫৭১
- সূরা আহযাব, আয়াত : ৪১-৪২
- ইবন খুযাইমাহ, আস-সহীহ প্রাগুক্ত, হাদীস নং-১৩৫
- বুখারী, আস-সহীহ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-১৯০২
- সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত : ৩
- সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত : ১৮৫
- সূরা নিসা, আয়াত : ১০৩
- সহীহ কুনুযুস সুন্নাহ আন-নবুবিয়্যাহ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-০৭
- বুখারী : ১৯২৩; মুসলিম : ১০৯৫
- আহমাদ, আল-মুসনাদ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-১১১০১।