সচ্চরিত্র ও এর প্রকরণ

عــــفة অর্থ হারাম ও অসুন্দর কাজ থেকে নিজেকে সংরক্ষণ করা।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাগণকে সচ্চরিত্রবান হওয়ার আদেশ করতেন। আবু সুফিয়ান রা. থেকে বর্ণিত, হিরাক্ল বাদশা তাকে নবী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, নবী তোমাদেরকে কি করার আদেশ দেয় ? আমি বললাম তিনি বলেন―‘তোমরা এক আল্লাহর এবাদত কর, তার সাথে কাউকে শরিক করো না। তোমাদের পূর্বপুরুষ যা বলতেন তোমরা তা ছেড়ে দাও। আর আমাদেরকে সালাত, সততা ও সচ্চরিত্র ও আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার আদেশ করেন।’

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রভুর নিকট দোয়া করতেন—

اللهـم إنى أسألك الهدى والتقى والعفاف والغنى. (رواه مسلم : ৪৮৯৮)

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকাল হুদা ওয়াত-ত্বকা ওয়াল আফাফা ওয়াল গীনা।

হে আল্লাহ আমি আপনার নিকট হেদায়েত, তাকওয়া, সচ্চরিত্র ও অভাব-মুক্তির প্রার্থনা করছি।[i]

সচ্চরিত্রের প্রকার সমূহ :

(১) হারাম খাওয়া থেকে বিরত থাকা : এটি ওয়াজিব। এর উপকারিতা হলো জাহান্নাম থেকে মুক্তি। কেননা, যে দেহ হারাম দ্বারা লালিত হয় তার জন্য জাহান্নামই উপযুক্ত স্থান। হারাম খাদ্য থেকে বেঁচে থাকলে দোয়া কবুল হয়। এবং আল্লাহ বিশেষভাবে তাকে হেফাজত করেন।

(২) ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বিরত থাকা : আল্লাহ তাআলা বলেন—

لَا يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا (سورة البقرة : 273)

তারা মানুষের কাছে কাকুতি-মিনতি করে ভিক্ষা চায় না।[ii]

আউফ ইবনে মালেক রহ. থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সহ কয়েকজন সাহাবিকে বললেন : ألا تبايعـــون؟ তোমরা কেন বাইআত গ্রহণ করনা? সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমরা তো বাইআত গ্রহণ করেছি। নতুন করে কোন বিষয়ে আপনার হাতে বাইআত গ্রহণ করব ? তিনি বললেন, তোমরা মানুষের নিকট কিছু চেওনা।

উপকারিতা :

  • আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে আশ্রয় না নেয়া।
  • তাঁর উপর সত্যিকারার্থে ভরসা করা।
  • নিজের সম্মান রক্ষা করা।
  • মাখলুকের নিকট ভিক্ষা করার লাঞ্ছনা থেকে নিজেকে হেফাজত করা।

এক্ষেত্রে মানুষ কয়েক ভাগে বিভক্ত।

সকলে এক পর্যায়ের নয়। কারো ক্ষেত্রে ভিক্ষা না করা ওয়াজিব। যেমন প্রয়োজন না হলে সম্পদ না চাওয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি সম্পদ বাড়ানোর জন্যে মানুষের নিকট ভিক্ষা চায়, সে যেন আগুনের জ্বলন্ত কয়লা চাইল। অতএব, তা কম করুক বা বেশি করুক সেটা তার ইচ্ছা।

কারো কারো ক্ষেত্রে ভিক্ষা ছেড়ে দেয়া ওয়াজিব নয়। তাদের ক্ষেত্রে ভিক্ষা ছেড়ে দেয়া মর্যাদার বিষয়। যেমন ইতিপূর্বে উল্লেখিত আউফ ইবনে মালেকের রেওয়ায়েতে আছে―

فلقـد رأيت بعض أولئك النفر يسقط سوط أحدهم فما يسأل أحداً يناوله إياه. (رواه مسلم : ১৭২৯)

আমি তাদের কাউকে কাউকে দেখেছি ঘোড়ায় আরোহিত অবস্থায় হাতের লাঠি পড়ে গেলে, তা উঠিয়ে দেয়ার জন্যে অন্য কাউকে বলতেন না।[iii]

(৩) গোপনাঙ্গের পবিত্রতা : এর উদ্দেশ্য হচ্ছে অশ্লীল কাজ ও উপকরণ থেকে গোপনাঙ্গ সংরক্ষণ করা। এটি ওয়াজিব। আল্লাহ বলেন―

وَلْيَسْتَعْفِفِ الَّذِينَ لَا يَجِدُونَ نِكَاحًا (سورة النور: 33)

যারা বিবাহ করতে পারে না, তারা যেন নিজেদেরকে হেফাজত করে।[iv]

তিনি আরো বলেন―

قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ ﴿30﴾ (سورة النور : 30)

(হে নবী) আপনি মোমিন পুরুষদের বলেন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি নিচু করে রাখে এবং তাদের গোপনাঙ্গ হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্যে পবিত্র পন্থা। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাদের কর্ম সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত।[v]

উপকারিতা :

  • গোপনাঙ্গের হেফাজতকারীকে আল্লাহ তাআলা আরশের নীচে ছায়া দেবেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন―

سـبعة يظلهم الله في ظله يوم لا ظل إلا ظله …. ورجل دعته امرأة ذات منصب وجمال، فقال : إني أخاف الله.(رواه البخاري : 1334)

সাত প্রকার ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা আরশের নীচে ছায়া দেবেন। তাদের মাঝে ঐ ব্যক্তিও অন্তর্ভুক্ত যাকে কোন সুন্দরী সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারী কু-কর্মের দিকে আহবান করলে সে বলে, إني أخاف الله অর্থাৎ, আমি আল্লাহকে ভয় করি।[vi]

  • জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম : নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি দুই চোয়ালের মধ্যকার মুখ ও দুই পায়ের মধ্যকার গুপ্তাঙ্গ হেফাজতের জিম্মাদার হলো, আমি তার জান্নাতে প্রবেশের দায়িত্ব নিলাম।

গোপনাঙ্গ হেফাজতের উপকরণসমূহ :

  • দৃষ্টির হেফাজত।
  • যৌবনে পদার্পণের সাথে সাথে দ্রুত বিবাহ।
  • বিবাহে অপারগ হলে সিয়াম সাধনা।
  • নারীর পূর্ণ হিজাব গ্রহণ।
  • বেশির ভাগ সময় ঘরে অবস্থান। আল্লাহ তাআলা বলেন :―

وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى. (سورة الأحزاب : 33)

আর তোমরা (নারীরা) ঘরে অবস্থান কর এবং জাহেলী যুগের নারীদের মত খোলামেলা চলাফেরা কর না।[vii]

  • অপরিচিত নারীর সাথে নির্জনে অবস্থান না করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : إياكم والدخول على النـــساء ‘‘তোমরা নারীদের নিকট প্রবেশ করার ব্যাপারে সতর্ক থাক।’’
  • কোন নারীর সাথে মুসাফাহা না করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : إني لا أصافح النـــساء‘‘আমি নারীর সাথে মুসাফাহা করি না।’’
  • পুরুষ-নারী একসাথে মেলামেশা না করা।
  • অশ্লীলতার দিকে ধাবিত করে এমন সকল কথা ও কাজ থেকে দূরে থাকা। আল্লাহ তাআলা বলেন—

وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا. (سورة بني إسرائيل : 32)

‘আর তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না।’

অশ্লীল কথা বা কাজের কথা শোনা, অশালীন বস্ত্তর প্রতি দৃষ্টিপাত, অশ্লীল ছবি বা সিনেমা দেখা, অশ্লীল কিছু পাঠ করা―এ সবই আয়াতের নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত

পবিত্রতা দুর্বল হওয়ার কারণসমূহ :

(1)  অভিভাবক ও মুরববীগনের তরবিয়ত ও নজরদারি দুর্বল হওয়া।

(2)   হারাম বস্তুর প্রতি অবাধে দৃষ্টিপাত। এটি ফিতনার সবচেয়ে বড় কারণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : فزنا العينين النظر ‘চোখের ব্যভিচার হলো দৃষ্টিপাত।’

জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আকস্মিক দৃষ্টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে বললেন।

বুরাইদা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : হে আলী, তুমি প্রথম দৃষ্টির পর দ্বিতীয়বার দৃষ্টি দিয়ো না। প্রথমটি তোমার জন্যে জায়েজ বটে, কিন্তু দ্বিতীয়টির অধিকার নেই।

(3)  যুবক-যুবতীদের দেরি করে বিবাহ দেয়া।

(4) এমন দেশে ভ্রমণ করা, যেখানে বেহায়া ও উলঙ্গপনার সয়লাব রয়েছে।

(5) অপরিচিত নারীর সাথে মেলামেশা ও নির্জনবাসের ব্যাপারে অবহেলা করা। পূর্বসুরীগণ এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক করতেন। উবাদা ইবনে সামেত রা. ছিলেন একজন বয়োজ্যাষ্ঠ আনসারী সাহাবি। তিনি বলেন―তোমরা দেখ না আমি অন্যের সাহায্য ব্যতীত দাঁড়াতে পারি না এবং নরম খাবার ব্যতীত খেতে পারি না। আমার সাথি (পুরুষাঙ্গ) অনেকদিন হল মরে গিয়েছে। সারা পৃথিবীর বিনিময়ে হলেও কোন অপরিচিত নারীর সাথে নির্জনে থাকা আমার পছন্দ হয় না। কেননা শয়তান হয়তোবা আমার জিনিসটিকে নাড়া দিতে পারে।

(6) যে ব্যক্তি নিজে পবিত্র থাকতে চায় না এবং সমাজকে কলুষমুক্ত রাখতে চায় না এমন লোকের সাথে উঠা-বসা করা। অতএব, এ ধরনের লোকদের সঙ্গ ত্যাগ করে ভালো লোকদের সঙ্গ তালাশ করা উচিত।

(7) অধিক অবসর। তাই দ্বীন-দুনিয়ার উপকার হয়, এমন কাজে নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রাখা উচিত। যাতে শয়তানি চিন্তা-ভাবনা আক্রমণ করতে না পারে।

(8) সর্বশেষ কথা হলো শরিয়তের হুকুম আহকাম ছেড়ে দেয়াই হলো চারিত্রিক দুর্বলতার সবচেয়ে বড় কারণ।

গোপনাঙ্গ সংরক্ষণের সু-ফল :

(1)  চরিত্রবান ব্যক্তির জান্নাতে প্রবেশের দায়িত্ব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর।

(2)  কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহ তাআলার ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ।

(3) ব্যক্তির পবিত্রতা তার পরিবার ও মাহরাম আত্মীয়দের পবিত্রতার কারণ। যে ব্যক্তি হারামে লিপ্ত হয়, তার নিজের ও পরিবারের উপর যে কোন সময় এর খারাপ পরিণতি নেমে আসতে পারে।

(4) ধ্বংসাত্মক রোগ, ফাসাদ, আপদ-বিপদ ও অনিষ্ট থেকে সমাজ নিরাপদ থাকার বড় মাধ্যম হলো চারিত্রিক পবিত্রতা।

(5) সাধারণ ও বিশেষ শাস্তি এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে দূরে থাকার মাধ্যম পবিত্রতা।

তথ্যসূত্র :

১. মুসলিম হা/৪৮৯৮

২. বাকারাহ, আয়াত নং-২৭৩

৩. মুসলিম/১৭২৯

৪. সূরা তাওবা আয়াত নং-৩৩

৫. সূরা আন-নূর, আয়াত নং-৩০

৬. বুখার,হা/১৩৩৪

৭. আহযাব আয়াত নং-৩৩

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88