শবে বরাত ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা : পর্ব-৩

ভাগ্য লিপিবদ্ধ করা সম্পর্কিত একটি হাদীস ও উহার পর্যালোচনা

পাঠকগণের অবগতির জন্য নিম্নে মিশকাতুল মাসাবীহ-এর শাবান মাসের মধ্যবর্তী রজনী সম্পর্কি একটি হাদীসের পর্যালোচনা করা হলো। হাদীসটি হল :

عن عائشة رضي الله عنها عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: هل تدرين ما هذه الليلة؟ يعني ليلة النصف من شعبان.

قالت ما فيها يا رسول الله ؟ فقال : فيها أن يكتب كل مولود (من) بني آدم في هذه السنة وفيها أن يكتب كل هالك من بني آدم في هذه السنة وفيها ترفع أعمالهم وفيها تنزل أرزاقهم.

من مشكاة المصبايح في باب قيام شهر رمضان، رواه البيهقي في الدعوات الكبير.

“আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তুমি কি জানো এটা (অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত) কোন্‌ রাত?তিনি জিজ্ঞেস করলেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ রাতে কি রয়েছে? তিনি বললেন ঃ এ রাতে এই বছরে যে সকল মানব-সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে তাদের ব্যাপারে লিপিবদ্ধ করা হয়, যারা মৃত্যু বরণ করবে তাদের তালিকা তৈরী হয়,এ রাতে ‘আমলসমূহ পেশ করা হয়,এ রাতে রিয্‌ক নাযিল করা হয়।

আলোচ্য হাদীসটি আল-মিশকাতুল মাসাবীহ কিতাবে ‘রামাযান মাসে কিয়াম’ (রামাযান মাসের রাতের সালাত) অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

তিনি লিখেছেন যে, ইমাম বাইহাকী (রঃ) তার ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির পর্যালোচনা নিম্নে তুলে ধরলাম ঃ

এক. উল্লিখিত হাদীসে ‘অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত’বাক্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা নয়। এ বাক্যটি পরবর্তী কালের বর্ণনাকারীর নিজস্ব বক্তব্য বলে। আর আয়িশা (রাঃ) এমন কোন অজ্ঞ মহিলা ছিলেন না যে তাকে তারিখ বলে দিতে হবে।

দুই. এ হাদীসে বর্ণিত ‘অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত’কথাটি আয়িশার (রাঃ) বক্তব্য নয়। কারণ তার বক্তব্য শুরু হয়েছে ‘তিনি জিজ্ঞেস করলেন’বাক্যটির পর। তাহলে এ বক্তব্যটি কার? এ বক্তব্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আয়িশা (রাঃ) ব্যতীত অন্য কোন বর্ণনাকারীর নিজস্ব মন্তব্য, যা মেনে নেয়া আমাদের জন্য যরুরী নয়।

তিন. এ হাদীসের বিষয়বস্তুর দিকে তাকালে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, হাদীসে ভাগ্য লেখার বিষয়টি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পর্কিত। কেননা জন্ম, মৃত্যু, ‘আমল পেশ, রিয্‌ক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী রামাযান মাসে লাইলাতুল কদরে স্থির করা হয়। এ কথা যেমন কুরআনের একাধিক আয়াত দ্বারা প্রমাণিত তেমনি বহু সংখ্যক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

চার. আল-মিশকাত আল-মাসাবীহর সংকলক বিষয়টি ভালভাবে বুঝেছেন বলে তিনি হাদীসটিকে রামাযান মাসের সালাত (কিয়ামে শাহরি রামাযান) অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। বুঝা গেল যে,তার মত হল হাদীসটি রামাযান মাসের লাইলাতুল কদর সম্পর্কিত। যদি তিনি বুঝতেন যে, হাদীসটি মধ্য শাবানের তাহলে তিনি তা রামাযান মাসের অধ্যায়ে আলোচনা করবেন কেন?

পাঁচ. এ হাদীসটি আল-মিশকাত আল-মাসাবীহর সংকলক উল্লেখ করার পর বলেছেন : তিনি হাদীসটি ইমাম বাইহাকীর ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’কিতাব থেকে নিয়েছেন।

ইমাম বাইহাকী তার ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কে মাত্র দুটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। তার একটি হল এই হাদীস। তিনি তার ‘শুআ’বুল ঈমান’গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কিত এই বইয়ে আলোচিত ৫ নং হাদীসটি উল্লেখ করার পর লিখেছেন ঃ

وقد روي في هذا الباب أحاديث مناكير، رواتها قوم مجهولون ، ذكرنا في كتاب الدعوات منها حديثين.

“এ বিষয়ে বহু মুনকার হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যার বর্ণনাকারীরা অপরিচিত। আমি তা থেকে দু’টি হাদীস ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’গ্রন্থে উল্লেখ করেছি।

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! তাহলে ফলাফল দাড়াল কী?ইমাম বাইহাকীর এ মন্তব্যে যা প্রমাণিত হল :

১. শবে বরাত সম্পর্কে অনেক মুনকার (অগ্রহণযোগ্য) হাদীস রয়েছে।

২. আদ-দাওআত আল-কাবীর গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস দুটি মুনকার।

৩. তাই আলোচ্য হাদীসটি হাদীসে মুনকার।

৪. তিনি ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’গ্রন্থটি আগে সংকলন করেছেন,তারপরে শুআবুল ঈমান সংকলন করেছেন। এ কারণে তিনি পরবর্তী কিতাবে আগের কিতাবের ভুল সম্পর্কে পাঠকদের সতর্ক করেছেন। এটা তার আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার একটি বড় প্রমাণ।

৫. মুনকার হাদীস ‘আমলের জন্য গ্রহণ করা যায় না।

৬. যিনি হাদীসটি আমাদের কাছে পৌছিয়েছেন তিনি নিজেই যখন হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে মতামত দিয়েছেন তখন আমরা তা সঠিক বলে গ্রহণ করব কেন?

 

রচনায়:

মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম

সহকারী অধ্যাপক

ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ

উত্তরা ইউনিভার্সিটি,ঢাকা।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button