মাতৃভাষায় জুমু’আর খুতবা দেয়ার বিধান

সকল প্রশংসা সেই মহান রব্বুল আলামীনের জন্য যিনি সকল কিছুর স্রষ্টা, অতঃপর তাঁর প্রেরিত রসূলের প্রতি অসংখ্য সলাত ও সালাম।

পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
জুমু’আর জমায়েত মুসলিমদের একটি প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র। সাপ্তাহিক এই প্রশিক্ষণে মুসলিমের বিস্মৃত কথা স্মরণ হয়, চলার পথে অন্ধকারে আলোর দিশা পায়, সুন্দর চরিত্র ও ব্যবহার গড়তে সহায়তা পায়, ঈমান নবায়ন হয়, হৃদয় নরম হয়, মৃত্যু ও পরকালের কথা স্মরণ হয়, তওবা করতে অনুপ্রাণিত হয়, ভালো কাজ করতে এবং খারাপ কাজ বর্জন করতে উৎসাহ পায়, ইত্যাদি। তাই খুতবার ভূমিকা আরবীতে হওয়ার পর স্থানীয় ভাষায় (মাতৃভাষায়) বাকী খুতবা পাঠ বৈধ।

যেহেতু খুতবার আসল উদ্দেশ্য হল জনসাধারণকে শরীয়তের শিক্ষা ও উপদেশ দান করা। আর এই শিক্ষা ও উপদেশ দান তখনই সফল হবে যখন মানুষের বোধগম্য ভাষায় তা দেওয়া হবে। অনারবদের নিকট যদি আরবী ভাষায় খুতবা দেওয়া হয় তাহলে সেই খুতবার মাধ্যমে মুসলিমরা লাভবান হতে পারবে না, খুতবা থেকে কোন শিক্ষা ও উপদেশ নিতে পারবে না, যদিও খতীব কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে অত্যন্ত সুন্দর খুতবা প্রদান করে, কারণ, খতীব যা বলেছে তা তো মুসুল্লীরা বুঝতেই পারে নি!!!! আর না বুঝতে পারলে তাঁরা কি কোন শিখতে পারবে??
.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমু’আর খুতবায় আল্লাহর তারীফ করতেন, দরুদ পড়তেন, কুরআন থেকে তেলাওয়াত করতেন এবং কিছু ওয়াজ-নছীহত ও করতেন।
নবীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ
“আমি সব নবীকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে।” (সূরা ইবরাহীম: ৪)

রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাতৃভাষা যেহেতু আরবী ছিল এবং ছাহাবীদেরও ভাষা আরবী ছিল, তাই তিনি আরবীতেই তাদেরকে নছীহত করতেন।
নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর যেহেতু কোন নবী আসবে না তাই আলেমদেরকেই মানুষকে নসিহত করতে হবে, ইসলামের দাওয়াত দিতে হবে। এজন্যই বলা হয় যে, আলেমরা হল নবীদের ওয়ারিশ। আর আমাদের দেশের আলেমরা এই দাবীটা খুব জোরালোভাবে করে। তাই খতীবদেরকে বলব যে, আপনারা নিজেদেরকে নবীদের ওয়ারিশ দাবী করবেন আর তাদের অনুসরণ করবেন না তা তো সঠিক নয়। আপনারা যদি সত্যিই নিজেদেরকে নবীদের ওয়ারিশ মনে করেন তাহলে নবীদের অনুসরণ করে আপনার মসজিদের মুসুল্লীদেরকে তাদের মাতৃভাষায় খুতবা প্রদান করুন। আর খুতবার উদ্দেশ্য তখনই সফল হবে যখন আপনি নিজ ভাষায় তা প্রদান করবেন।
এই কারণেই ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন: প্রত্যেক খতীবকে জুমার সময় তাঁর মাতৃভাষায় ওয়াজ করা ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য। (তানক্বীহুর রুওয়াত ১/২৬৪)
আল্লামা তাহাভী হানাফী বলেন: জুমার খুতবা আরবী জানলেও ফারসী ভাষায় ও চলবে। (হাশিয়া তাহতাবী আলা মারাক্বিল ফালাহ ২৭)
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনভী হানাফী (রহ) বলেন: শ্রোতাদেরকে তাদের মাতৃভাষায় খুতবা বুঝিয়ে দেয়া জায়েজ। (মাজমূআহ ফাতাওয়া ১/২৪৫)

• হানাফী ফিক্বহ গ্রন্থ নিহায়া, মুজতাবা, ফাতাওয়া সিরাজিয়্যাহ, মুহীত প্রভৃতি গ্রন্থে আছে যে, ইমাম আবূ হানীফার মতে ফারসী ভাষাতে জুমার খুতবা দেয়া জায়েজ।
• হানাফী ফতোয়ার কিতাব শামীতে আছে, আরবী ভাষায় খুতবা দেয়া শর্ত নয়।
• হানাফী ফিকহ গ্রন্থ হিদায়ায় আছে, প্রত্যেক ভাষায় খুতবার নছীহত চলতে পারে। (কিতাবুল জুমআহ ৫৫-৫৬) (আলোচনা দ্র: আইনী তোহফা সলাতে মুস্তফা১/৯৮-৯৯)

সুতরাং যে খুতবা আরবীতে হত তারই ভাবার্থ স্থানীয় ভাষায় হলে মুসলিমদেরকে সপ্তাহান্তে একবার উপদেশ ও পথনির্দেশনা দান করার মত মহান উদ্দেশ্য সাধিত হয়।  সঊদী আরবের বরেণ্য মুফতী শাইখ ইবনে উসাইমীন(রহ:) কে আরবী ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় খুতবা প্রদানের বিধান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এই মাসআলায় বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, উপস্থিত মুসল্লীগণ যে ভাষা বুঝে না সে ভাষায় জুমু’আর খুতবা প্রদান করা জায়েয নয়। যদি উপস্থিত মুসল্লীগণ অনারব হন- তাঁরা আরবী না বুঝেন, তবে তাদের ভাষাতেই খুতবা প্রদান করবে। কেননা তাদেরকে বুঝানোর জন্য এ ভাষাই হচ্ছে বক্তৃতা করার মাধ্যম। আর জুমু’আর খুতবার লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে আল্লাহর বিধি-বিধান বর্ণনা করা, তাদেরকে ওয়াজ–নসীহত করা। তবে কুরআনের আয়াত সমূহ অবশ্যই আরবী ভাষায় পাঠ করতে হবে। অতঃপর মাতৃভাষায় তাঁর তাফসীর করে দিবে। আর মাতৃভাষায় খুতবা প্রদানের দলীল হচ্ছে, আল্লাহ বলেনঃ
“আমি সব নবীকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে।” (সূরা ইবরাহীম: ৪)
এখানে আল্লাহ তা’আলা বর্ণনা করে দিলেন যে, সম্প্রদায়ের লোকেরা যে ভাষা বুঝে সে ভাষাতেই তাদের সামনে বক্তৃতা করতে হবে।(ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, পৃষ্ঠা ৪৪৯)

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সহীহ হাদীস থেকেও আমরা এ বিষয় সম্পর্কে বুঝতে পারি। যেমন
একবার এক সাহাবী (রাঃ) মসজিদে প্রবেশ করে সলাত না পড়েই বসে পড়েন তখন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুতবা বন্ধ করে সেই সাহাবীকে দু রাক’আত সলাত আদায়ের নির্দেশ দেন। (সহীহ বুখারী হা/ ৯৩০)
হযরত আব্দুল্লাহ বিন বুসর রা কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন এক জুমু’আর দিনে এক ব্যক্তি লোকদের কাতার চিরে (মসজিদে ভিতর) এল। সে সময় নাবী সাঃ খুতবা দিচ্ছিলেন। তাঁকে দেখে নাবী সাঃ বললেন, “বসে যাও, তুমি বেশ কষ্ট দিয়েছ এবং দেরী করেও এসেছ।” ( মুসনাদ আহমাদ,আবু দাউদ, সহীহ তারগীব হা/ ৭১৩ )
মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরবী ভাষী ছিলেন তাই তিনি আরবীতে খুতবা দিতেন এবং প্রয়োজন হলে খুতবা বন্ধ করে মানুষকে আদেশ করতেন। তাই আমাদের খতীব সাহেবদেরকে আহ্বান জানাবো, আপনারা আমাদের ভাষাতেই খুতবা প্রদান করুন এবং প্রয়োজন হলে খুতবা বন্ধ করে মানুষকে উপদেশ দিন, আদেশ করুন। বিশেষ করে মসজিদে প্রবেশ করে দু রাক’আত সলাত আদায় করার এবং কাতার চিরে সামনে যাওয়ার বিষয়ে। এই দুইটা ভুল আমাদের দেশের অনেক মানুষই করে, বিশেষ করে কিছু বয়স্ক মানুষ আছে যাদের কাজ দেখে মনে হয় যে, প্রথম কাতার তাদের নিজেদের সম্পত্তি আর সেজন্য তাঁরা মানুষকে কষ্ট দিয়ে কাতার চিরে সামনে যায়।
বিঃ দ্রঃ নিজ ভাষায় খুতবা না দেয়ার কারণে যেহেতু তা মানুষের বোধগম্য হয় না এজন্যই এই খুতবার আগে খতীবগণ বয়ানের ব্যবস্থা রেখেছেন, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে একটি জঘন্যতম বিদআত। কারণ খুতবা দানের পূর্বে বয়ান দেয়া এবং ইহাকে এভাবে স্থায়ী রূপ দেয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আদৌ প্রমাণিত নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুতবার পূর্বে কখনো এ ধরণের বয়ান দেন নি। দিতে বলেছেন বলে ও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
বর্তমানে আমাদের দেশের বেশ কিছু জামে মসজিদে মাতৃভাষায় খুতবা দেয়া হয়ে থাকে। যেমন ঢাকার উত্তরার আজমপুরে এক মসজিদে শাইখ কামাল উদ্দিন জাফরী সাহেব মাতৃভাষায় খুতবা প্রদান করে থাকেন। বস্তুত: এটাই সুন্নত। এর বিপরীত সুন্নত বিরোধী কাজ যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুক। বিদআত পরিত্যাগ করে কুরআন ও সহীহ হাদীসের অনুসরণ করার তওফিক দান করুক। আমীন।

প্রমাণপঞ্জীঃ
১। মাতৃভাষায় জুমার খুতবা দেয়ার বিধান, লেখক: শাইখ আখতারুল আমান বিন আব্দুস সালাম সম্পাদনা: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
২। সলাতে মুবাশশির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) , আব্দুল হামীদ ফাইযী
৩। ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন রহঃ।

 

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88