বাংলাদেশে নারী নির্যাতন – পশ্চিমা পূঁজিবাদী ধ্যান-ধারণার প্রত্যক্ষ ফলাফল
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এদেশের সমাজও আজ পুঁজিবাদী ধ্যান-ধারণা দিয়ে প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত। আর তাই পশ্চিমা বিশ্বের মতো এদেশের আনাচে-কানাচেও চলছে আজ নারীদের উপর চরম নির্যাতন।
১. পারিবারিক সহিংসতা: যদিও এদেশে পারিবারিক সহিংসতার জন্য সবসময় ইসলামকেই দায়ী করা হয়, কিন্তু, প্রকৃত পক্ষে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল পারিবারিক জীবন তৈরীর মাধ্যমে ইসলামই একমাত্র বন্ধ করতে পারে সমাজে চলমান পারিবারিক সহিংসতা। বস্তুতঃ স্বামী-স্ত্রী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অনুপস্থিতিতে লাগামহীন ব্যক্তি স্বাধীনতার চূড়ান্ত অপপ্রয়োগই ভয়াবহ পারিবারিক সহিংসতার মূল কারণ। বিভিন্ন জরিপ থেকে দেখা যায় যে, এ দেশে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সমাজের বেশীর ভাগ নারীরা দাম্পত্য জীবনে স্বামী কর্তৃক বা পরিবারের অন্যান্য সদস্য কর্তৃক কোন না কোন ভাবে নির্যাতনের শিকার হন। এ নির্যাতনের কবল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, চিকিৎসক অথবা ইংরেজী মাধ্যমের স্কুল শিক্ষিকা কেউই রেহাই পায় না। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে তারা চেপে যান এ সব নির্যাতনের কথা। (সূত্র: পি.আই.বি ইউনিসেফ ফিচার)।
২. ধর্ষণ ও হত্যা: পাশ্চাত্যের মতোই এদেশে প্রতিবছর ধর্ষিত কিংবা ধর্ষণের পর নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হয় অসংখ্য নারী ও শিশু। সবস্তরে জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি আর প্রবৃত্তি পূরণের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগই মূলতঃ পুরুষকে ঠেলে দেয় বিকৃত উপায়ে তার চাহিদা পূরণে। আর তার অসহায় শিকার হয় হাজার হাজার নিরপরাধ নারী। বিভিন্ন এন.জি.ও থেকে প্রাপ্ত তথ্য দেখা যায়, এ দেশে প্রায় ৫০ শতাংশ নারী ধর্ষন সহ বিভিন্ন যৌন হয়রানির শিকার হয় এবং শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ নারী জোরপূর্বক ধর্ষণের শিকার হয়। কিন্তু, এদের বেশীর ভাগই মানসম্মানের ভয়ে কখনো তা প্রকাশ করে না।
৩. যৌতুকের জন্য নির্যাতন: যৌতুকের জন্য এদেশে প্রতিবছর শত শত নারীকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। আর নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয় লক্ষ লক্ষ নারীকে। মূলতঃ ব্যক্তি স্বাধীনতার নিরেট পুঁজিবাদী ধ্যান-ধারণা থেকেই মানব জীবনের বিবাহ নামক অধ্যায়টিও পরিণত হয় মুনাফা হাসিলের উপকরণে। আর কাঙ্খিত যৌতুকের অর্থ প্রদানে কন্যাপক্ষের অপারগতায় নারীর জীবনে নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। কখনো তাকে ঝরে যেতে হয় এ সুন্দর পৃথিবী থেকে। সমপ্রতি বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থা এবং বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবি সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, এ দেশে ২০০১ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতিত হয়েছে ১২,৫০০ জন নারী। ২০০২ সালে তা বেড়ে দাড়াঁয় ১৮,৪৫৫ জন এবং ২০০৩ সালের শেষের দিকে এ সংখ্যা গিয়ে দাড়াঁয় ২২,৪৫০ জনে।
৪. ইভটিজিং: নারীকে গণমাধ্যম সহ সর্বত্র প্রতিনিয়ত ভোগ্যপণ্য হিসাবে উপস্থাপিত করে তার সম্মান ও মর্যাদা ভূলুন্ঠিত করার প্রত্যক্ষ ফলাফল হচ্ছে ইভটিজিং এর মতো ভয়ঙ্কর সামাজিক সমস্যা। মূলতঃ সমাজের সর্বত্র নারীর প্রতি সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গীর অভাবে উঠতি বয়সের তরুণদের কাছে নারী পরিণত হয়েছে এখন বিনা পয়সার বিনোদনে। আর তাদের এ বিকৃত বিনোদনের দুঃসহ ভার সইতে না পেরে রুমি, সিমি আর তৃষার মতো তরুণীরা বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ। ২০০৬ সালের জুন মাসে দৈনিক জনকন্ঠে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ৪ বছরে ইভটিজিং এর শিকার হয়ে এ দেশে ২৮ জন কিশোরী ও তরুণী আত্মহত্যা করেছে।
৫. এসিড সন্ত্রাস: এসিড সন্ত্রাস নারীর জীবনে এক মুর্তিমান আতঙ্ক। নিজ স্বার্থসিদ্ধির মোহে অন্ধ পুরুষ নারীকে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হলে বা নারী তার স্বার্থসিদ্ধির অন্তরায় হলে প্রতিহিংসা বশতঃ এসিডে ঝলসে দেয় নারীকে। চুরমার হয়ে যায় নারীর জীবনের সকল স্বপ্ন। কোন কোন সময় নিভে যায় তার জীবন প্রদীপ। দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যায়, শুধুমাত্র ২০০৭ সালেই প্রেমে প্রত্যাখান সহ বিভিন্ন কারণে এসিডে ঝলসে দেয়া হয়েছে ৮০ জন নারীকে। এদের মধ্যে মাত্র ৪০ জন অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এসিড সন্ত্রাস মূলতঃ স্বেচ্ছাচারী এ সমাজে নারীর নিজস্ব মতামতের প্রতি চূড়ান্ত অশ্রদ্ধা প্রদর্শনেরই হিংসাত্মক বহিঃপ্রকাশ।
৬. কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি: নারী যে সমাজে পরিণত হয়েছে সস্তা বিনোদনের পণ্যে আর প্রতিনিয়ত তাকে উপস্থাপন করা হচ্ছে যৌনতার প্রতীক হিসাবে, সে সমাজে নারীরা কর্মক্ষেত্রেও হয়রানির শিকার হবে এটাই স্বাভাবিক। মূলতঃ নারীর প্রতি সমাজের এ জঘণ্য দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই এ দেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব নারীরাই কর্মক্ষেত্রে তার পুরুষ সহকর্মীর কাছে হয় যৌন হয়রানিসহ নানা রকম হয়রানির অসহায় শিকার।