নষ্ট সংস্কৃতি
আমরা এদেশেই গ্রামে জন্মেছি, এদেশেই বড় হয়েছি। হিন্দু-মুসলমান মিলিত যে গ্রাম ছোট বেলায় দেখেছি, সেই গ্রাম আজও দেখছি। নববর্ষ উদযাপন কখনো শুনিনি, দেখিনি বা আজও হয় না। আমরা জানতাম ‘মেলা’ হিন্দুরা করে। মুরববীরা বলতেন, মুসলমানদের মেলায় যেতে নেই। ভাদ্রের শেষ দিনে সাতক্ষীরার গুড়পুকুরের মেলায় বয়স্করা কেউ গেলেও লুকিয়ে-চুরিয়ে যেত। বাড়ী এসে ভয়ে মুখ খুলতো না। অথচ আমরা জন্ম থেকেই বাঙ্গলাভাষী, আজও বাংলাভাষী। কিন্তু সংস্কৃতিতে ছিলাম তখনও মুসলমান, এখনও মুসলমান।
হিন্দুরা ‘নমস্কার’ দিত। আমরা ‘আদাব’ বলতাম। কিন্তু পাল্টা নমস্কার বলতাম না। তারা ‘জল’ খেত। আমরা ‘পানি’ খেতাম। ওরা শুকর পালন করত ও তার মাংস খেত, আমরা ছাগল-গরু পালতাম ও তার মাংস খেতাম। ওরা ধুতি পরত, আমরা লুঙ্গি-পায়জামা পরতাম। ওরা পৈতা গলায় দিত, মাথায় টিকি রাখত। ওদের মেয়েরা মাথায় সিঁদুর দিত ও হাতে শাখা পরত। ওদের বিয়েতে কত যে নাচগান। আমাদের মধ্যে এসব ছিল না। তারা মাসী-পিসী, কাকা-কাকী, বাবা-মামা বলত।
আমরা খালা-ফুফু, চাচা-চাচী, আববা-মামু বলতাম। তারা ভগবানকে ডাকত ও মূর্তিকে পূজা দিত। আমরা আল্লাহকে ডাকতাম ও মসজিদে সিজদা করতাম। তারা তাদের পূজার সময় ঢোল-বাদ্য বাজাত ও উলুধ্বনি করত। আমরা আমাদের ছালাতের সময় আযান দিতাম ও মসজিদে জামা‘আতে যেতাম। তাদের সাথে আমাদের খুবই সুসম্পর্ক ছিল। আজও আছে। আমরা উভয় সম্প্রদায় একই গ্রামে শত শত বছর ধরে বসবাস করছি পরস্পরে আত্মীয়ের মত। উভয় সম্প্রদায় বাংলা ভাষায় কথা বলি।
কিন্তু আমাদের উভয়ের সংস্কৃতি পৃথক। এ পার্থক্যের ভিত্তি হ’ল আক্বীদা। আমাদের আক্বীদায় রয়েছে তাওহীদ। তাদের আক্বীদায় রয়েছে শিরক। দুই আক্বীদার ভিত্তিতে দুই সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ফলে এই পার্থক্য ভাষায়, পোষাকে, সামাজিকতায় সর্বত্র ফুটে উঠেছে। তাইতো দেখি মুশরিক কবি গেয়েছেন, ‘এসো হে বৈশাখ! দুর্বলেরে রক্ষা কর, দুর্জনেরে হানো’। অথচ মুসলমানের আক্বীদামতে বৈশাখের কোন ক্ষমতা নেই। সকল ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর হাতে। অতএব বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলে পৃথক কোন সংস্কৃতির অস্তিত্ব কোন কালে ছিল না। আজও নেই।
এরপরেও ১লা বৈশাখে নববর্ষ সম্পর্কে যদি কিছু বলতে হয়, তবে সংক্ষেপে সেটা এই যে, রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে ফসলী সনের ১ম দিন হিসাবে ১লা বৈশাখ থেকে বাংলা নববর্ষের সূচনা হয় সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫ খৃঃ) নির্দেশে তাঁর সিংহাসনারোহণের বছর ৯৬৩ হিজরীর ২রা রবীউছ ছানী মোতাবেক ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দের ১৪ই এপ্রিল ১লা বৈশাখ শুক্রবার হ’তে। ফসলী সনের ১ম দিন হওয়ায় এবং ব্যবসায়ী শ্রেণীর হালখাতার দিন হওয়ায় শহরে-গ্রামে এ সময় উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হ’ত।
এ দিনটিতে দা, বটি, খোন্তা, কোদাল, লাঙ্গল, জোয়াল, গরুর গাড়ীর চাকা, পিড়ে, চৌকি, মাটির হাড়ি-পাতিল, কাঁসার থালা-বাটি-জগ ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের মেলা বসত। ফলে এ দিনটি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের তারিখ হিসাবে উৎসবের চরিত্র ধারণ করত। এদিন কেউ অনৈতিক কাজ করত না। কাউকে কেউ কষ্ট দিত না। এর পিছনে কোন আক্বীদা বা সংস্কৃতি চেতনা কাজ করত না। বরং অর্থনৈতিক কারণই ছিল মুখ্য। মোগলদের সাম্রাজ্য চলে যাবার পর বর্তমানে সে কারণ আর অবশিষ্ট নেই।
উল্লেখ্য যে, সম্রাট আকবর কর্তৃক বাংলা নববর্ষ চালু হবার সময় বাংলাদেশে ছিল শকাব্দের ২য় মাস হিসাবে বৈশাখ মাস। কেননা শকাব্দের ১ম মাস হ’ল চৈত্র মাস। পরবর্তীকালে ১৯৬৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারীতে ডঃ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি মাস গণনার সুবিধার্থে বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত পাঁচ মাস ৩১ দিনে এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত সাত মাস ৩০ দিনে বর্ষসূচী নির্ধারিত করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকার তা মেনে নেন। যা আজও চালু আছে।
কিন্তু সম্ভবতঃ মুসলিম সম্রাট দ্বারা প্রবর্তিত হওয়ায় এবং হিজরী সনের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলা সনের পরিবর্তে শকাব্দ ব্যবহার করে আসছে। ফলে শকাব্দের চৈত্র মাস ৩১ দিনে হওয়ার কারণে তাদের পহেলা বৈশাখ আমাদের ১ দিন পরে হয়ে থাকে। অভিন্ন বাঙ্গালী সংস্কৃতির প্রবক্তারা এখন কী বলবেন?
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, বৈশাখী সংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকার হয়েছে এখন আমাদের জাতীয় মাছ ‘ইলিশ’। কথিত সংস্কৃতিসেবীরা এদিন ‘ইলিশ-পান্তা’ খেয়ে থাকেন। অথচ ইলিশের জাটকা বৃদ্ধির মওসুম হ’ল নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত। ইলিশ সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। বাংলাদেশের জিডিপিতে অর্থাৎ মোট জাতীয় আয়ে এককভাবে ইলিশের অবদান ১ শতাংশ। এ মাছ মানুষের রক্তের ক্ষতিকর কোলেষ্টেরল-এর মাত্রা কমায়। এতে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। এ ধরনের একটি মহামূল্যবান মাছকে নির্মূল করার মিশনে নামেন উভয় বাংলার কথিত বাঙ্গালী সংস্কৃতির ধারক সুশীল সমাজভুক্ত একদল লোক।
এরা হাযার হাযার টাকা খরচ করে ‘ইলিশ-পান্তা’ খাওয়ার বিলাসী প্রতিযোগিতায় নামেন এদিন। যা পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নামে ‘নূন আনতে পান্তা ফুরায়’ যাদের, তাদের সাথে নিষ্ঠুর রসিকতার শামিল। ওদিকে আরেকদল তরুণকে সারা গায়ে কালি মাখিয়ে ও কালি মাখান চট মুড়ি দিয়ে ভূত সাজিয়ে রাস্তায় চাঁদাবাজিতে নামিয়ে দেওয়া হয় এটা বুঝানোর জন্য যে, হে সভ্য পথিকেরা! তোমরা তোমাদের বুনো ও নগ্ন আদি পিতাদের কথা ভুলে যেয়ো না। অর্থাৎ সেই বিবর্তনবাদী নাস্তিক্যবাদী দর্শনের প্রতি আহবান। অতএব এইসব নষ্ট সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে জাতি যত দ্রুত মুক্তি পাবে, ততই মঙ্গল।
আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর অন্যতম নিদর্শন হ’ল রাত্রি, দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্য বা চন্দ্রকে সিজদা কর না। বরং সেই আল্লাহকে সিজদা কর, যিনি এদেরকে সৃষ্টি করেছেন। যদি তোমরা সত্যিকার অর্থে তাঁরই ইবাদত করে থাক’ (হামীম সাজদাহ ৩৭)। তিনি আরও বলেন, আল্লাহর নিকট মাস সমূহের গণনা হ’ল ১২টি, যা আসমান ও যমীন সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর কিতাবে নির্ধারিত..’ (তওবা ৩৬)। অর্থাৎ বর্ষ পরিক্রমা ও ঋতুবৈচিত্র্য আল্লাহর হুকুমেই হয়ে থাকে। সবকিছু তাঁর সৃষ্টি ও পালনের মহাপরিকল্পনারই অংশ। প্রতিটি সূর্যোদয়ের সাথে নতুন দিনের আগমন ঘটে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠার মাধ্যমে মৃত্যু থেকে নবজীবন পেয়ে আমরা আল্লাহর নামে নতুন দিনের কর্মসূচী শুরু করি।
তাই প্রতিটি দিন আমাদের কাছে নতুন দিন এবং প্রতিটি রাত্রি আমাদের কাছে বিদায়ের ঘণ্টা ধ্বনি। আল্লাহ নির্ধারিত দিবস বা রাত্রি ব্যতীত অন্য কোন দিবস বা রাত্রি আমাদের কাছে বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার দাবী রাখে না। শুভ ও অশুভ বলে কোন দিন বা রাত্রি নেই। আল্লাহ বলেন, তোমরা কাল-কে গালি দিয়ো না, আমিই কালের সৃষ্টিকর্তা। আমিই দিন ও রাতের আবর্তন-বিবর্তন ঘটিয়ে থাকি’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত, হা/২২)। অতএব কোন দিবসকে নয়, বরং দিবসের মালিক আল্লাহকে মেনে চলা ও তাঁর প্রেরিত বিধানকে জাতীয় জীবনের সর্বত্র বাস্তবায়িত করার কামনাই হবে নববর্ষের সর্বোত্তম কামনা। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!!