বনি ইসরায়েলের বারসিসা এবং আমাদের গল্প

বারসিসার এই কাহিনী হয়ত অনেকেই শুনেছেন। বারসিসা ছিল বনী ঈসরাইলের একজন সুখ্যাত উপাসক, ধর্মযাজক,‘আবিদ’। তার নিজের মন্দির ছিল আর সেখানে সে একাগ্রভাবে নিজেকে উপাসনায় নিয়োগ করত। বনী ঈসরাইলের তিনজনপুরুষ জিহাদে যেতে চাচ্ছিল, তাদের একমাত্র বোনকে কোথায় রেখে যাবে বুঝতে পারছিল না।তারা সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘কোথায় আমরা আমাদের বোনকে রেখে যেতে পারি? তাকে তোআমরা একা ফেলে যেতে পারিনা। কোথায় তাকে রেখে যাওয়া যায়?’ তখন তারা তাদেরকে বলল, ‘তাকে রেখে যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হবে তাকে ঐ উপাসকের কাছে রেখে যাওয়া, সেই-ই সবচেয়ে ধার্মিক ব্যক্তি, আর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য।

তোমাদের বোনকে তার কাছে রেখে যাও, সে তার খেয়াল রাখবে’।তারা আবিদের নিকট গেল। তাকে সব বর্ণনা করে বলল, ‘এই হল অবস্থা – আমরা জিহাদে যেতে চাই,আপনি কি কষ্ট করে আমাদের বোনকে দেখে রাখতে পারবেন?’ সে বলল, ‘আমি তোমাদের থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। আমার কাছ থেকে চলে যাও’। তখন শয়তান তাকে প্রলুব্ধ করল, ‘তুমি তাকে কার কাছে রেখে আসবে? তুমি যদি তার খেয়াল না রাখো তাহলে হয়ত কোন দুষ্ট লোক তার খেয়াল রাখবে, আর তারপর তো তুমি জানোই কী ঘটবে! তুমি কি করে এই ভাল কাজটা তোমার হাতছাড়াকরে দিতে পার?’

দেখুন ! শয়তান তাকে ভাল কাজে উৎসাহিত করছে! তোসে তাদেরকে আবার ডেকে এনে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তার খেয়াল রাখব, কিন্তু সে আমার সাথেআমার মন্দিরে থাকতে পারবে না, আমার আরেকটা বাড়ি আছে সে সেই ঘরে থাকবে’। সে মেয়েটিকে বলল, ‘তুমি ওখানে থাক, আমি আমার মন্দিরে থাকব’। তো মেয়েটা সেই বাড়িতে একটা ঘরে থাকত, আর সেই ধর্মযাজক তার জন্য প্রতিদিন খাবার নিয়ে এসে তার নিজের দরজার বাইরে রেখে দিত। সে মেয়েটির বাড়িতে পর্যন্ত যেত না, নিজের দরজার বাইরেই খাবাররেখে দিত আর মেয়েটিকে ঘর থেকে বের হয়ে এসে খাবার নিয়ে যেতে হত; সে মেয়েটির দিতে তাকিয়ে দেখতে পর্যন্ত ও চাইত না। তখন শয়তান আবার তার কাছে এসে বলল, ‘তুমি করছটা কি? তুমি কিজানো না মেয়েটা যখন তার ঘর থেকে বের হবে আর তোমার মন্দির পর্যন্ত আসবে লোকে তাকে দেখতেপাবে? তোমার উচিত তার দরজায় যেয়ে খাবারটা রেখে আসা।’ সে বলল,‘হ্যাঁ, আসলেই’।

শয়তান কিন্তু তার সাথে সামনা-সামনি কথা বলছেনা,তাকে ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। ধর্মযাজক ‘আবিদ তাই এবার খাবার নিয়ে মেয়েটির দরজা পর্যন্ত রেখে আসতে শুরু করল। এভাবে কিছুদিন চলল, এরপর শয়তান তাকে বলল, ‘মেয়েটাএখনও তার দরজা খুলছে আর বাইরে বের হয়ে আসছে প্লেট নেয়ার জন্য, কেউ তাকে দেখে ফেলতে পারে, তোমার উচিত প্লেটটা তার ঘরে গিয়ে দিয়ে আসা’। শয়তান কিনাতাকে বলছে আরো ভাল কাজ করতে! তাই সে খাবারের প্লেটটা ঘরে রাখা আরম্ভ করল, সেখানে রেখেই সে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসত। এভাবে আরো কিছুদিন পার হলো। আর ওদিকে জিহাদ চলতে থাকায় ভাইদের ফিরে আসতে বিলম্ব হচ্ছিল। শয়তান আবারো তার কাছে আসল, বলল, ‘আচ্ছা, তুমি তাকে এভাবেএকা ছেড়ে দিবে, কেউ তো নেই যে তার দিকে একটু খেয়াল রাখবে, একটু কথা বলবে। সে যেন জেলখানায় আবদ্ধ হয়ে আছে, কথা বলার কেউ নেই। তুমি কেন ওর দায়িত্ব নিচ্ছ না? ওর সাথে একটু সামাজিকতা বজায় রেখে তো চলতে পার, যেয়ে একটু কথা বলো যাতে করে তুমি তার খোঁজখবর রাখতে পারো। তানাহলে দেখা যাবে সে বাইরে যেয়ে কোন পরপুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বে’। তাই সে মেয়েটিরসাথে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করল, মেয়েটা ঘরের মধ্য থেকেই কথা বলত; দুজনকে প্রায় চিৎকার করে কথা বলতে হতো যেন তারা একজন অন্য জনকে শুনতে পায়।

শয়তান এবার তাকে বলল, ‘তুমি এরকম দূর থেকে একজন আরেকজনের উপর চিৎকার না করে কেন ব্যাপারটাকে নিজের জন্য আরেকটু সুবিধাজনক করে নিচ্ছনা? কেন তার সাথে একই ঘরে বসে কথা বলছ না?’ তো এবার সে মেয়েটার সাথে একই ঘরে বসে কিছুসময় ব্যয় করতে শুরু করল। তারপর ধীরে ধীরে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একসাথে কাটাতে লাগল,আর আস্তে আস্তে তারা পরস্পরের আরো কাছাকাছি আসতে লাগল। এক সময় এমন হল যখন সেই আবিদ,ধর্মযাজক,উপাসক সেই মেয়ের সাথে যিনায় (ব্যাভিচার) লিপ্ত হল। ফলে মেয়েটা অন্তসত্ত্বাহয়ে পড়ল।

কাহিনী এখানেই শেষ নয়। মেয়েটি একটি সন্তানের জন্ম দিল। শয়তান ধর্মযাজকের কাছে এসে বলল, ‘একি করেছ তুমি! তুমি কি জানো যখন ওর ভাইরা ফিরে আসবে তখন কি হবে? তারা তোমাকে মেরে ফেলবে, এমনকি তুমি যদি এটাও বলো যে – “এটাআমার বাচ্চা না”,তারা তোমাকে বলবে যে “তোমার বাচ্চা না হলেও তুমি তার দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলে, তাইএটা এখন তোমারই দায়ভার। বাচ্চার বাবা কে আমরা তার পরোয়া করি না, তুমিই এর জন্য দায়ী”। সুতরাং এখন একটাই উপায়, তুমি বাচ্চাটাকে মেরে তাকে পুঁতে ফেল’। বারসিসা বলল, ‘এটা কি গোপন থাকবে আমি তার ছেলেকে মেরে ফেলার পরে?’ শয়তান বলল, ‘তোমার কি মনেহয় ও এটাকে গোপনে রাখবে? তুমি যদি এরকম ভাব, তাহলে তুমি মস্ত বড় বোকা’। সে জিজ্ঞেসকরল, ‘তাহলে আমি কি করব?’। শয়তান জবাব দিল, ‘তোমার ঐ মেয়েটাকেও মেরে ফেলা উচিত’। তাই সে মেয়েটাকে আর বাচ্চাকে মেরে ফেলল, এরপর দুজনকে একই ঘরের নিচে কবর দিয়ে দিল।

ভাইয়েরা একসময় ফিরে আসল, তারপর জানতে চাইল,‘আমাদের বোন কোথায়?’, সে উত্তরে বলল, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, সে অসুস্থ হয়ে পড়ে এরপর মারা যায়, তাকে ওখানে কবর দেয়া হয়েছে’ এই বলে সে মনগড়া একটা কবর দেখিয়ে দিল তাদেরকে। তারা বলে উঠল, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহিরাজি’উন’, তারা বোনের জন্য দু’আকরল, আর নিজেদের বাসায় ফিরে গেল।

রাতের বেলা, তিনজনের মাঝে এক ভাই একটা স্বপ্নদেখল, কে তার সেই স্বপ্নে এসেছিল? শয়তান, সে তাকে বলল, ‘তুমি বারসিসা কে বিশ্বাস করো?তুমি কি তাকে বিশ্বাস করো? সে মিথ্যা বলেছে। সে তোমার বোনের সাথে ব্যাভিচার করেছে,তারপর তাকে আর তার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আর এই কথার প্রমাণ হল সে তোমাদেরকে যেখানে সেকবর দেখিয়েছে তোমাদের বোন সেখানে নেই, আছে তার ঘরের পাথরের নিচে’। তার ঘুমভেঙ্গে গেল আর সে তার বাকি ভাইদেরকে স্বপ্নের কথা জানাল। তারা বলল, ‘আমরাও তো একই স্বপ্নই দেখেছি, তাহলে এটা নিশ্চয়ই সত্যি’। পরদিন তারা সেই মিথ্যা কবরটা খুড়ল কিন্তু কিছুই পেল না, এরপর তারা তাদের বোনের ঘরে যেয়ে মাটি সরাল তখন দেখতে পেল তার বোনের মৃতদেহ সাথে একটা শিশু। তারা যেয়ে বারসিসাকে ধরল, ‘মিথ্যুক! এইসব করেছ তুমি?’ তারা তাকে ধরে টেনে হিঁচড়ে রাজার কাছে নিয়ে গেল।

এমন সময় শয়তান আসল বারসিসার কাছে, এবারে কিন্তু সেমনের ওয়াসওয়াসা হিসেবে আসেনি, সে আসল মানুষের রূপ ধরে। তাকে বলল, ‘বারসিসা, তুমি কিজানো আমি কে? আমি শয়তান, আমিই সে, যে তোমাকে এতো ঝামেলার মধ্যে ফেলেছি। আর আমিই সে একজন, যে তোমাকে এখন এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারব। আমিই এসব ঘটনা ঘটিয়েছি আর আমারকাছেই আছে এসবের সমাধান। এখন তোমার উপর নির্ভর করে, তুমি যদি মরতে চাও তো ঠিক আছে।তুমি যদি চাও আমি তোমাকে রক্ষা করি, তাহলে আমি করতে পারি’। বারসিসা বলল, ‘দয়া করে আমাকে বাঁচাও’। শয়তান বলল, “আমাকে সিজদাহ করো’। বারসিসা শয়তানের প্রতি সিজদাহ করল। কিন্তু শয়তান কি বলল? সে বলল, ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, তোমার সাথে দেখা হয়ে ভাল লাগল’এরপর সে তাকে আর কোনদিন দেখতে পেল না। বারসিসা শয়তানের উদ্দেশ্যে সিজদাহ করল, আর এটাই ছিল তার জীবনে করা শেষ কাজ, কারণ এর কিছুক্ষণ পরেই তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।সুতরাং তার জীবনের শেষ কাজটা তাহলে ছিল- শয়তানকে সিজদাহ করা, সে ছিল সেই উপাসক যে কিনাছিল সরল পথের উপর, কিন্তু যেহেতু সে সেপথ থেকে বাঁক নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যদিওখুব খুব ছোট্ট একটা বাঁক, প্রথমদিকে যেটাকে একেবারেই তুচ্ছ মনে হচ্ছিল, একটু সুবিধারনামে, দ্বীনের মাসলাহার নামেই সে এগুলো করেছিল। সরলপথ থেকে তার বিচ্যুতির পরিমাপটাছিল একদমই নগণ্য কিন্তু দেখুন তার শেষ পরিণতি! নিজের ইচ্ছাকে অনুসরণ করার বিপত্তিটাএখানেই; আমরা আমাদের জ্ঞান, কুরআনের যতখানি জানি, আমাদের ইবাদত ইত্যাদি নিয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসীহয়ে যাই। সুবহান আল্লাহ! আমাদের তো সব সময় উচিত নিজেদের নিয়ে শঙ্কায় থাকা, আমরা কখনইঅতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হব না বরং আমাদের সব সময় উদ্বিগ্ন থাকতে হবে, আর এটাই হল আল্লাহ-ভীতি,এটাই সত্যিকার অর্থে ‘জ্ঞান’।

আল্লাহ বলেন,
“আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে ভয় করে” (ফাতির ৩৫:২৮)।

আসুন এবার আমরা দেখি বারসিসার এই কাহিনী থেকে আমাদের জন্য কি কি রয়েছে-

১। খেয়াল করে দেখুন শয়তান বারসিসার সাথে কোন নীতি গ্রহণ করেছিল? যদি শয়তান বারসিসার কাছে এসে সরাসরি বলত, ‘আমাকে সিজদাহ করো’ বারসিসা কিকখনো তা করত? না, করত না। শয়তান step by step ‘ধাপে ধাপে’ মানুষকে দীন থেকে বিমুখ করার নীতি গ্রহণ করেছিল। শয়তানের কাজই হল এটা যে সে সারাজীবন আপনার আমার পেছনে লেগে থাকবে এবং তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য মানুষকে বিভ্রান্ত করা, ঈমান থেকে বিচ্যুত করে মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুমুখে পতিত করা।সুবাহানাল্লাহ বারসিসার করুণ পরিণতি থেকে আমরা সেটা উপলব্ধি করতে পারি! এখানে ইমাম আহমেদের মৃত্যুর সময়টার কথা বলা যেতে পারে। আবদুল্লাহ ইবন ইমাম আহমেদ বলেন, তার পিতা যখন অবচেতন পর্যায়ে পৌঁছে যান আর বলতে থাকেন, ‘লা বা’আদ, লা বা’আদ’ – ‘না এখনও নয়, না এখনও নয়’।একথা শুনে আবদুল্লাহ প্রচন্ড চিন্তিত বোধ করলেন! চিন্তা করে দেখুন, আপনি যদি আপনার বাবাকে তার মৃত্যুকালীন সময়ে বলতে শুনেন, ‘না এখনও না, না এখনও না’, আপনি কিভাবেএটাকে ব্যাখ্যা করবেন? এটার অর্থ কী বলে আপনার কাছে মনে হবে? ‘না এখনও না, আমি এখনও মরতে চাইনা’এমনই মনে হওয়ার কথা, তাইনা?

তো ইমাম আহমেদ জেগে উঠলে, আবদুল্লাহ উদ্বিগ্ন হয়ে পিতাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আমার পিতা, কেন আপনি বলছিলেন – “এখনও না, এখনও না” ?’ ইমাম আহমেদ বললেন, “শয়তান আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে তার অঙ্গুলি কামড়ে বলছিল, “হে আহমেদ, তুমিতো আমার হাত ফসকে বের হয়ে গেলে, হে আহমেদ, তুমি তো আমার হাত ফসকে বের হয়ে গেলে” !’ তাই আমি তাকে বলছিলাম, ‘না, এখনও না, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি মারা যাচ্ছি। তোমার আর আমার যুদ্ধ এখনও চলছে, যখন আমি মারা যাব, একমাত্র তখনই আমি তোমার হাত থেকে রক্ষা পাব।”

ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ বলেন, ‘এরকম হওয়ার কারণটা হলো এই যে, শয়তান বুঝতে পারে আপনার সাথে এটাই তার শেষ সুযোগ, যদি এবার আপনি তার হাত থেকে ছুটে যান তো আপনি চিরকালের জন্যই তার কাছ থেকে পার পেয়ে গেলেন। শেষ সময়ে আপনাকে পথভ্রষ্ট করতে না পারার অর্থ সেআপনাকে আর ধরতে পারল না। এজন্যই শয়তান আপনার জীবনের শেষ সময়ের দিকে বিশেষ নজর দেয় আর আপনার বিরুদ্ধে তার কাজকে আরো জোরদার করে তুলে।’ সুবাহানাল্লাহ!আল্লাহ আমাদের উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুণ যে শয়তান আমাদের পেছনে কি পরিমাণ পরিশ্রমকরে যাচ্ছে শুধু আমাদের পথভ্রষ্ট করে মৃত্যুমুখে পতিত করার জন্য। আল্লাহ আমাদের উপররহম করুণ, আমীন।

২। খালি চোখে বারসিসার কাহিনী থেকে যে শিক্ষাটা আমাদের প্রথমে মনে আসে সেটা হল “নারী ফিতনা”। নারী ফিতনার প্রকটতা বুঝতে হলে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে কেন রাসুল (সঃ) বলে গেছেন, “আমি আমার উম্মতের জন্য নারীর চেয়ে অধিক বড় কোন ফিতনা রেখে যাচ্ছি না”। রাসুল (সঃ)বলেছেন, ‘যখন দুইজন নারী পুরুষ একাকী অবস্থান করে তাদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে শয়তান অবস্থান করে”।শুধু তাই নয় স্বয়ং আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে(নারীদের প্রতি)”। [সূরা নিসাঃ ২৮] যখন এখানে নারীদের প্রতি দুর্বলতার কথা বলা হয়েছেএটা বলা হয় তখন নলেজেবল ভাই বোনেরাও অবাক হন! কিন্তু তাফসীরে নারীর প্রতি দুর্বলতার কথাই বলা হয়েছে। এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা সূরা আলে ইমরানের ১৪ নং আয়াতে আল্লাহর রাহে যুদ্ধকরা থেকে যেসব বিষয় মানুষকে বিরত রেখেছে তার কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই বলেছেন, “মানবকূলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী…”। [সূরা আলে ইমরানঃ১৪]।

সুবাহানাল্লাহ! আমরা যারা নিজেদের ইসলামপন্থী বলে পরিচয় দিই, ইসলামের খাতিরে ফেসবুক,ব্লগ কিংবা ভার্চুয়াল জগতে দাওয়া দিয়ে বেড়ায় খুবই দুঃখজনক সত্যি এই যে নারী ফিতনারএই হাদিস আর কুরানের আয়াতগুলো কখনো আমাদের মনে থাকেনা কিংবা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমরা জানিই না! দেদারছে ছেলে মেয়ে মাখামাখি, হাসি তামাশা, রসালো কমেন্ট বিনিময় করেই যাচ্ছি।আর ইনবক্সের কি অবস্থা আল্লাহই ভাল জানেন। এখন সবার সামনে আমি এত সাধু কিন্তু একটু চিন্তা করেন তো কেমন লাগবে যদি দেখেন আমি একটা নন মাহরাম মেয়েকে চোখ মারছি, ভেংচি কাটছি, মুচকি হাসি- অট্ট হাসি দিচ্ছি কিংবা কাগজে করে একটা লাল রঙের হার্টের চিহ্য একে দিলাম!! কি ভণ্ড মনে হবে না আমাকে? Exactly আমি একজন ভণ্ড বলে বিবেচিত হব।

সুবাহানাল্লাহ এই ভণ্ডামিটাই কোন রাখ ঢাক না রেখে করে যাচ্ছে আমাদের মুসলিম ভাইবোনেরা । আঙ্গুলের একটা খোঁচা দিলেই ফেসবুকের স্ট্যাটাসে,ছবিতে কমেন্ট চলে যাচ্ছে ভেংচি কাটা, চোখ মারা, অট্টহাসি, মুখ বাঁকানো ইমুশন! সুবাহানাল্লাহ!নেট জগত বলে কি নন মাহরাম আপনার জন্য মাহরাম হয়ে গেল dear muslims? নাকি নিজেকে সব ফিতনা থেকে নিরাপধ ভাবেন? নাকি জান্নাতের টিকেট পকেটে নিয়ে ঘুরছেন? আল্লাহু আকবর! মৃত্যু খুব নিকটেই ভাই, খুব নিকটেই! নিজের ঈমান নিয়ে সচেতন হন। এত এত ইসলামিক জ্ঞান, দাওয়া, ইবাদাত নিয়ে শেষ পর্যন্ত যেন বারসিসার মত করে মরতে না হয়! আল্লাহ রহম করুন।

৩। বারসিসার এই কাহিনী থেকে আরেকটা জিনিস লক্ষণীয় সেটা হল “good intention”। আমি তো ভালোর জন্যই কাজটা করছি এই সান্ত্বনা দিয়ে শয়তান আমাদের ফাঁদে ফেলে। একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখব শয়তান বারবার বারসিসাকে মেয়েটির ভালোর জন্য ওয়াসওয়াসা দিয়েছে। তুমি এমন না করলে মেয়েটির এই হবে, তুমি তেমন না করলে মেয়েটির সেই হবে এই ওয়াসওয়াসা। এবং বারসিসা প্রতিবারসেই ফাঁদে পা দিয়েছে আর তার ফল সে পেয়েছে অবশেষে! এই বিষয়টা খুব সূক্ষ্মভাবে আমাদের লক্ষ্য করা উচিত। আমাদের মধ্যে একটা কমন tendency থাকে আমরা ইসলাম পালনের চেয়ে এক ধাক্কায় দাঈ হয়ে যেতে চাই। একটু আধটু জেনে মানুষজনকে ধুমাইয়া দাওয়া করে বেড়াই। সেখানে শয়তানের এসব ওয়াসওয়াসা আর নারী ফিতনার বিষয়ে কোন ধারণা না থাকায় এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে হারাম সম্পর্কেজড়িয়ে পড়ার।

এক মেয়ে স্ট্যাটাস দিল, “ইশ! কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে!”। ছেলে গিয়ে সেখানে চান্দের ফজিলত বর্ণনা করে বিশাল দাওয়া প্রগ্রাম শুরু করে দিল! শয়তানের ওয়াসওয়াসা কি?“আমি তো দাওয়া দিচ্ছি”।মেয়ে স্ট্যাটাস দিল ‘আমার মন খুব খারাপ”। ছেলে গিয়ে islamqa এর ফতোয়ায় কমেন্ট বক্স ভরিয়ে ফেলল, মন খারাপ হলে কি করতে হবে, হতাশ হওয়া চলবেনা, জীবনে আসলে এসব ঘটেই তারপরও মুসলিমদের এই করতে হবে সেই করতে হবে! বিশাল এক শায়খ(only for girls)!! মেয়ে তো মহা খুশি! ‘ভাইয়াআপনি এত কিছু জানেন, সব প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছে পাওয়া যায়, আপনি একটা জিনিয়াস ব্লাব্লা ব্লা’।এখন শয়তান এই আলাপ যে ইনবক্সে নিয়ে যায়নি তার গ্যারান্টি কি!!

সুবাহানাল্লাহ! আমরা যেটা মাথায় রাখব দাওয়ার কিছু rules and regulations আছে। নিজে জানার এবং মানার বিষয় আছে। শয়তানের ফাঁদ নিয়ে উপলব্ধির বিষয় আছে। আপনাকে মনে রাখতেহবে শয়তান স্বভাবতই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আপনাকে আকৃষ্ট করবে তাই শয়তান যার দিকে আপনাকেআকৃষ্ট করছে তার দিকে “দাওয়ার” অজুহাত নিয়ে এগিয়ে যাবেন না! সবাইকেদাওয়া দেওয়ার জন্য আপনি responsible নয়। এটামনে করার কোন কারন নেই যে আপনি দাওয়া না নিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বরং সর্বনাশটা হবেআপনি শয়তানের ফাঁদে পা দিলে। সর্বনাশ হবে আপনি ফিতনাই জড়িয়ে গেলে! শয়তানের হাতে নিজের প্রবৃত্তিকে সঁপে দেওয়ার আগেতাই খুব গভীর দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবা উচিত। সামনে তো বারসিসার কাহিনী আছেই reminder হিসেবে!

৪। সর্বশেষ একটা lesson আমরা বারসিসার কাহিনীথেকে নিতে পারি সেটা হল বৈরাগ্য বা একাকীত্বের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন হয়ে। একটুচিন্তা করুন মেয়েটি যদি বারসিসার স্ত্রী হত, কিংবা বারসিসার যদি পরিবার থাকত তাহলে হয়ত শয়তান এত সুযোগ পেত না তাকে পথভ্রষ্ট করার। একটি কথা আমার খুব ভাল লাগে__ আপনি একা থাকলে যা করেন সেটাই আপনার চরিত্র! একাকীত্ব শয়তানকে খুব বেশী সুযোগ করে দেয় তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার। যে কারনে দ্বীনের পথে থাকতে চাওয়া ভাই বোনদের সবসময় একটা motivation এর মধ্যে থাকা উচিত। বারসিসার ক্ষেত্রে শয়তান এই সুযোগটা নিয়েছিল! তাকে ওয়াসওয়াসা দিয়েছিল যা বারসিসা এড়িয়ে চলতে পারেনি। একাকিত্বের সময়ের শয়তানী ওয়াসওয়াসা মানুষের তাক্বওয়ার লেভেলকেও নিচে নামিয়ে দেয় খুব সহজে। আল্লাহ ক্ষমা করুন আমাদের। আমাদের উপর রহম করুন।

শেষকথাঃ একটা বিষয় ইদানীংআমাকে খুব ভাবায় সেটা হল ইসলামের ব্যাপারটা আসলে পুরোটা উপলব্ধির! যে কারনে অনেক নলেজেবল ভাই বোনকেও দেখবেন ইসলামের অনেক কিছু জানা সত্বেও আমল করার ব্যাপারে তারা উদাসীন। সেসব ভাই বোনদের জন্য আমরা দোয়া করি যাদের অর্জিত জ্ঞান তাদের জীবনবোধের কোন পরিবর্তন করতে পারেনি। যারা কুরআন অধ্যয়ন করেছে, ইসলামের অনেক জ্ঞান অর্জন করেছে আর এই জ্ঞান জাহিরকরে বেড়িয়েছে কিন্তু নিজের জীবনে তার কোন reflection পড়েনি। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। আল্লাহ আমাদের ভুলগুলো শুধরে সত্যকে আঁকড়ে ধরার তৌফিক দান করুন।

বারসিসার যে কাহিনীটা বর্ণনা করলাম এটা হয়ত অনেকেই জানেন। কিন্তু হয়ত এভাবে ভেবে দেখেননি। এখান থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাটুকু আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশগুলোকে purify করার কাজে লাগতে পারে ইনশাআল্লাহ। ভুলকে মেনে নিয়ে তার জন্য অনুতপ্ত হয় মানুষ আর ভুলের উপর অবিচল থেকে তার জন্য অজুহাত দেখায় শয়তান। আমরা আশরাফুল মাখলুকাত আমরা আমাদের ভুলের জন্য মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইব ইনশাআল্লাহ।আল্লাহ । এই লেখায় উপলব্ধি করার মত কিছু থাকলে আল্লাহ যেন আমাদেরকে তা উপলব্ধি করার তৌফিক দেন। যেন আমাদের পাপগুলো মুছে দেন। বিগতদিনের ভুলগুলো যেন আজকের দিনের শুদ্ধতার অনুপ্রেরণা হয় ইনশাআল্লাহ! ইসলামের শিক্ষা আর উপলব্ধি যেন আমাদের জান্নাতের পথের পথিক হতে সাহায্য করে। শয়তান যেন দুর্ভাগা বারসিসার মত আমাদেরকে টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামের কঠিন আগুনে নিয়ে না যায়। সর্বাবস্থায় আল্লাহরসাহায্য চাই। আল্লাহ রহম করুন। আল্লাহ ক্ষমা করুন। ইহদিনাস সিরাত্বাল মুস্তাকিম, আমীন।

[ এই ঘটনার দলিল সম্পর্কে জানতে দেখুন

1.   http://islamweb.net/emainpage/index.php?page=showfatwa&Option=FatwaId&Id=92621]

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত ও সামান্য পরিবর্তিত)

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button