আস্তিক নাস্তিক বিতর্কে লজিক ও পাল্টা লজিক

আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কে আমাদের আস্তিকদের মধ্যে একটি লজিক খুব জনপ্রিয় ছিল। লজিকটা এরকমঃ

“ধরা যাক, স্রষ্টা বলতে আসলে কেউ নেই। তাহলে মৃত্যুর পর কী হবে? তুমিও মারা যাবে, আমিও মারা যাব। তুমিও শূন্যতায় হারিয়ে যাবে, আমার ভাগ্যেও ঘটবে একই পরিণতি। কিন্তু ধরা যাক, স্রষ্টা বলতে কেউ আছেন। তাহলে? আমি তো পার পেয়ে যাব। কিন্তু তুমি তো ধরা খেয়ে যাবা, অনন্তকাল আগুনে পুড়বা। আমার কিন্তু ধরা খাওয়ার কোন চান্স নাই। কিন্তু তোমার ধরা খাওয়ার প্রবাবিলিটি ফিফটি-ফিফটি। গণিতের ভাষায় ১/২।


একসময় নাস্তিকরা গাধা পর্যায়ের ছিল। এখন বানরের স্তরে এসেছে। বুদ্ধিমত্তা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। তারা এখন এই লজিকের বিরুদ্ধে কাউন্টার লজিক দাঁড় করায়-

“পৃথিবীতে হাজার হাজার (প্রায় ৩৭০০) ধর্ম আছে। এর মধ্যে তোমার ধর্মই যে সঠিক তার সম্ভাব্যতাই বা কতোটুকু? হাজারে একভাগ। এই ক্ষুদ্র মান তো আমি ইগনোরই করতে পারি। আমাদের দিকে তাকাও! আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, কোন ধর্মে বিশ্বাস করি না, আমাদের একটাই ভাগ। আবার তোমাদের ধর্মের নিজেদের মধ্যেই অসংখ্য ভাগ। সবাই দাবী করে তারাই সঠিক। মুসলিমদের মধ্যে শিয়া-সুন্নী রয়েছে। একদল আরেকদলকে কাফের বলে। খ্রিষ্টানদের ইতিহাস তো ক্যাথলিক-প্রটেস্ট্যান্ট রেষারেষিতে রক্তাক্ত। তোমাদের প্রবাবিলিটি কিন্তু আরো কমছে। আর আমাদের প্রবাবিলিটি? সেইম। ঈশ্বর নাই তো নাই। একদম ফুলস্টপ।”

লজিকটা চমৎকার। কিন্তু এখানে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। এখানে ধরা হয়েছে সবগুলো ধর্ম একইরকম, তাদের সত্যি হবার প্রবাবিলিটিও সেইম। এখন একটা ধর্ম যতোই যৌক্তিক হোক না কেন আর অন্য ধর্ম যতোই অযৌক্তিক হোক না কেন। সব তাদের কাছে একই রকম।

ধরা যাক, আমি জিজ্ঞেস করলাম, দুইটি চিড়িয়াখানা আর দুইটা চায়ের কাপের মধ্যে একটি সিংহ পাবার সম্ভাব্যতা কতোটুকু? উপরের লজিক খাটালে উত্তর আসে ১/৪। কিন্তু কমন্সেন্সটাকে যদি একটু কাজে লাগাই তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, চায়ের কাপের মধ্যে কখনোই সিংহ থাকবে না। তাই সঠিক উত্তর হওয়া উচিত ১/২।

এভাবেই স্রষ্টা ও ধর্মের প্রশ্নে আমাদের কমনসেন্সটাকে আরেকটু বাড়ালে দেখা যাবে স্রষ্টা আছেন। আর সেই স্রষ্টা একজনই। তারপর একেশ্বরবাদী রিলিজিওনগুলো এনালাইসিস করা যেতে পারে। একেবারে অন্ধ না হলে যে কারো কাছেই ইসলামের সৌন্দর্য ফুটে উঠতে বাধ্য।

এখন তাদের লজিকের এই অংশটুকুতে আবার চোখ বুলানো যাকঃ “আমাদের দিকে তাকাও! আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, আমাদের একটাই ভাগ। ঈশ্বর নাই তো নাই। একদম ফুলস্টপ।”

বাস্তবতা কি তাই বলে? যারা প্রচলিত ধর্মগুলোকে অস্বীকার করেছে তারা কি শুধু Atheist (নাস্তিক) ক্যাটাগরিতেই সীমাবদ্ধ রাখতে পেরেছে? মোটেও না। এদের মধ্যেও অসংখ্য ফের্কা সৃষ্টি হয়েছে, অসংখ্য ভাগ রয়েছে। কয়েকটার উদাহারণ দেই-

১) Atheism: সোজা বাংলায় নাস্তিক। তাদের দাবি স্রষ্টা বলতে কেউ নেই। এখনকার বিজ্ঞানীরা যতোই দাবি করুক না কেন, নাস্তিকতা কিন্তু মোটেও সায়েন্টিফিক এপ্রোচ থেকে প্রমাণিত না। বিখ্যাত নাস্তিকরা মূলত দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে নাস্তিকতার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। দুইটি আর্গুমেন্ট খুবই জনপ্রিয় এসব দার্শনিকদের কাছে-

i) Problem of Evil: এ যুক্তিটাকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা হয়-

ক) যদি ঈশ্বর থেকে থাকেন, তবে তিনি অবশ্যই সকল অন্যায় প্রতিহত করবেন।
খ) কিন্তু পৃথিবীতে অন্যায় হয় আর তা প্রতিহত করা হয় না।
গ) তাই ঈশ্বর বলে কেউ নেই।

এ ধরনের দার্শনিকরা পৃথিবীতে ঈশ্বর থাকার পরেও এতো দুঃখ-কষ্ট থাকার কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তাই তারা ধরেই নিয়েছেন ঈশ্বর বলে আসলে কেউ নেই।

আমরা মুসলিমরা এ ধরনের দুঃখ-কষ্টকে নিজেদের জন্য পরিক্ষা মনে করি। (কুরআন ৬৭:২) আর বিশ্বাস করি, ঈমানের সাথে ধৈর্য ধরলে এর জন্য আল্লাহতায়ালা পরকালে উত্তম প্রতিদান দিবেন। খালি চোখে একজন নিরীহ মানুষ আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছে কিংবা একজন মা সন্তান জন্ম দিতে দিয়ে মারা গেছেন- এই ব্যাপারগুলো মেনে নেয়া কষ্টকর। অথচ ইসলাম বলছে এরা সবাই শহীদ। (ইবনে মাজাহ)

ii) Argument from Inconsistent Revelation: এ আর্গুমেন্ট বলছে-পৃথিবীতে অনেক ধর্ম রয়েছে। আর প্রত্যেক ধর্মেই ঈশ্বরের আলাদা কনসেপ্ট রয়েছে। এগুলো সাংঘর্ষিক। যেমনঃ খ্রিষ্টানরা বলে ঈসা (আ) হচ্ছেন আল্লাহর পুত্র, তিনি নিজেই ঈশ্বর। আবার মুসলিমরা বলে তিনি একজন রাসূল, আল্লাহর একজন দাস। এভাবে প্রতিটা রিলিজিওনই যেহেতু আলাদা কনসেপ্ট নিয়ে আসছে, তাই আসলে কোন ধর্মই সঠিক না।

ধরা যাক, ছয় রকমের ছয়টা বাক্স রয়েছে। এদের যে কোন একটিতে লাল বল থাকবে। এখন আমি যদি বলি, বাক্সগুলো যেহেতু আলাদা, তাই কোনটিতেই বল থাকার সম্ভাবনা নেই। আসলে বাক্স বলতেই কিছু নেই। আমার এ কথা কতোটুকু যৌক্তিক হবে? “Argument from Inconsistent Revelation” ঠিক ততোটুকুই যৌক্তিক।

২) Agnosticism: এদেরকে অজ্ঞেয়বাদী বলা হয়। অনেক নাস্তিক দাবী করে, ঈশ্বর যে নেই তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা যায়, তাই ঈশ্বর যে নেই সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত। তবে এগনোস্টিকরা এক্ষেত্রে অনেস্ট। তারা বলে, ঈশ্বর আছে কি নেই সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত না। বিখ্যাত এগনোস্টিক বার্নাড রাসেল বলেছিলেনঃ

“Are Agnostics Atheists? No. An atheist, like a Christian, holds that we can know whether or not there is a God. The Christian holds that we can know there is a God; the atheist, that we can know there is not. The Agnostic suspends judgment, saying that there are not sufficient grounds either for affirmation or for denial.” [The Basic Writings of Bertrand Russell. Routledge. pp. 557]

অর্থাৎ, “অজ্ঞেয়বাদীরা কি নাস্তিক? না, মোটেও না। একজন নাস্তিক হচ্ছে খ্রিষ্টানদের মতো। তারা জানে ঈশ্বর আছে কি নেই। খ্রিষ্টানরা বলে ঈশ্বর আছেন। আর নাস্তিকরা বলে ঈশ্বর নেই। আমরা এগনোস্টিকরা নিজেরা কোন রায় দেই না। আমরা বলি, ঈশ্বর আছে কি নেই তার স্বপক্ষে কিংবা বিপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।”

মজার ব্যাপার এগনোস্টিকদের মধ্যেও অনেক ফের্কা আছে-

i) Strong Agnosticism: এরা বলে, কারো পক্ষেই প্রমাণ করা সম্ভব না ঈশ্বর আছেন কি নেই। আমার পক্ষে সম্ভব না, আপনার পক্ষেও না।

ii) Weak Agnosticism: এরা কিছুটা মিনমিন করে বলে, হ্যাঁ! এটা সত্যি যে আমি জানি না ঈশ্বর আছেন কি নেই। তবে তুমি যদি আমাকে প্রমাণ দেখাতে পারো, তবে আমি বিশ্বাস করলেও করতে পারি।

৩) Apatheism: ঔদাসীন্যবাদ। এরা মূলত এগনোস্টিক ক্যাটাগরীতেই পড়ে। তারা বলে, ঈশ্বর আছে কি নেই, তা নিয়ে আমার মাথাব্যাথা নেই। I don’t care at all! সম্প্রতি বিখ্যাত নাস্তিক প্রফেসর লরেন্স ক্রাউস Atheism থেকে নিজেকে মুরতাদ ঘোষণা করে Apatheism এ নাম লিখিয়েছেন। [Is religion to blame for violence? UpFront- Al Jazeera ]

৪) Deism: এরা কোন প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাস করে না। তবে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে, ঈশ্বর এতোই মহান যে, আমাদের নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। তিনি আমাদের খোঁজখবর রাখেন না। শুনতে ভালো লাগলেও আসলে এটা একটা হাস্যকর কথা।

একজন মায়ের কথা কল্পনা করুন তো! যিনি সন্তান জন্ম দিয়ে রাস্তায় ফেলে রেখেছেন। বাচ্চার খোঁজ নিচ্ছেন না। এমন মায়ের কথা তো আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আমাদের আল্লাহ তায়ালা সে মায়ের চেয়েও বহুগুণ বেশি মমতাময়। তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব যে, তিনি আমাদেরকে কোন গাইডলাইন ছাড়াই পৃথিবীতে পাঠাবেন? Deist’দের কথা নাকচ করে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-

“আমি আমার সৃষ্টি সম্পর্কে উদাসীন নই।” (কুরআন ২৩:১৭)

৫) Ignosticism: এ মতবাদ লালনকারীরা বলে, ঈশ্বর ব্যাপারে সব জ্ঞানই আসলে ফালতু। স্বর্গ, নরক, আখিরাত- এসব নিয়ে কথা বলা সময়ের অপচয় ছাড়া কিছুই না।

৬) Omnism: “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।”- এ কথাটা শোনেনি এমন বাঙ্গালী হয়তো নেই। যারা এ মতবাদ প্রচার করে তাদের ব্যাপারে দুইটা কথা বলা যায়।

হয় তারা বিশ্বাস করে, সব ধর্মই আসলে ফালতু, তবে আমাদের অনুষ্ঠানের মজা নিতে সমস্যা কী?

নতুবা তারা বিশ্বাস করে, সব ধর্মই সঠিক।

দ্বিতীয় ভাগের লোকেরা মূলত “Omnism” এর অনুসারী।

আচ্ছা এই যে, প্রচলিত ধর্মের বাইরে যারা আছে, তাদের মধ্যে এতো ভাগের ভিত্তিতে কি আমি সব গ্রুপকে বাতিল করছি? না, মোটেও না। চাইলে ক্রিটিকালি এনালাইসিস করে এদের অসারতা প্রমাণ করা যায়। আর ভাগ তো আমাদের মুসলিমদের মধ্যেও আছে। যদি একশজন মা এক সন্তানের মাতৃত্ব দাবী করে তার মানে কিন্তু এই না যে, সন্তানের কোন মা নেই। অবশ্যই আছে! তবে সেটা বের করতে আমাদেরকে আমাদের বুদ্ধিমত্তা খাটাতে হবে।

মজার ব্যাপার, আমরা তো কোন নির্দিষ্ট মতবাদকে আঁকড়ে ধরতে পারি। নিশ্চিত হতে পারি। আমাদের সামনে গাইডলাইন থাকে। কিন্তু তাদের মধ্যে কোন নিশ্চয়তা থাকে না। কোন দিকনির্দেশনা থাকে না। আল্লাহ তায়ালা এদের সম্পর্কে বলেন,

“তারা পরষ্পরকে কী বিষয়ে জিজ্ঞেস করছে? মহাসংবাদ (কিয়ামত) সম্পর্কে। সে বিষয়ে তারা নিজেরাই মতবিরোধী।” [কুরআন ৭৮: ১-৩]

অর্থাৎ, যারা পরকালকে অস্বীকার করে তারা নিজেরা যে নিজেদের মধ্যে একমত, ব্যাপারটা মোটেও তেমন না। যেমনঃ মক্কার কেউ কেউ বলতো আল্লাহ আছেন কিন্তু পরকাল নেই। আবার কেউ কেউ বলতো, আল্লাহও নেই। পরকালও নেই। তাদের চিন্তা-ভাবনা একেকসময় একেকরকম হয়ে যেতো। [তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে মাযহারী]

সামান্য কিছু দর্শনের জ্ঞান নিয়ে স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করা খুবই হাস্যকর। এ জ্ঞান তো সামান্য আলো দেয়ার বিনিময়ে অধিক অন্ধকারেই নিয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা কতোই না সুন্দরভাবে তাদের এ অবস্থার কথা পবিত্র কুর’আনে ফুটিয়ে তুলেছেন-

“তাদের উপমা ঐ ব্যক্তির মত, যে আগুন জ্বালাল। এরপর যখন আগুন তার চারপাশ আলোকিত করল, আল্লাহ তাদের আলো কেড়ে নিলেন এবং তাদেরকে ছেড়ে দিলেন এমন অন্ধকারে যে, তারা দেখছে না।

তারা বধির-মূক-অন্ধ। তাই তারা ফিরে আসবে না।

কিংবা (তাদের তুলনা) আকাশের বর্ষণমুখর মেঘের ন্যায়, যাতে রয়েছে ঘন অন্ধকার, বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুৎচমক। বজ্রের গর্জনে তারা মৃত্যুর ভয়ে তাদের কানে আঙুল দিয়ে রাখে। অথচ আল্লাহই কাফিরদেরকে পরিবেষ্টন করে আছেন। (তারা কার কাছ থেকে পালাচ্ছে?)

বিদ্যুৎচমক তাদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার উপক্রম হয়। যখনই তা তাদের জন্য আলো দেয়, তারা তাতে চলতে থাকে। আর যখন তা তাদের উপর অন্ধকার করে দেয়, তারা দাঁড়িয়ে পড়ে। আর আল্লাহ যদি চাইতেন, অবশ্যই তাদের শ্রবণ ও চোখসমূহ নিয়ে নিতেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।” [ কুরআন ২:১৭-২০]

Original Source

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan