আল-কুরআনের দৃষ্টিতে মূর্তিপূজার অসারতা : একটি পর্যালোচনা
রচনায়ঃ মুহাম্মাদ রফীকুল ইসলাম*
أَفَرَأَيْتُمُ اللَّاتَ وَالْعُزَّىٰ وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَىٰ
‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও উযযা সম্বন্ধে এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্বন্ধে’? (সূরা আন-নাজম ৫৩/১৯-২০)।
অন্যত্র এসেছে
قُلْ أَرَأَيْتُم مَّا تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ أَرُونِي مَاذَا خَلَقُوا مِنَ الْأَرْضِ أَمْ لَهُمْ شِرْكٌ فِي السَّمَاوَاتِ ۖ ائْتُونِي بِكِتَابٍ مِّن قَبْلِ هَٰذَا أَوْ أَثَارَةٍ مِّنْ عِلْمٍ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّن يَدْعُو مِن دُونِ اللَّهِ مَن لَّا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ
‘বল, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তাদের কথা ভেবে দেখেছি কি? এরা পৃথিবীতে কি সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও অথবা আকাশমণ্ডলীতে তাদের কোন অংশীদারিত্ব আছে কি? পূর্ববর্তী কোন কিতাব অথবা পরম্পরাগত কোন জ্ঞান থাকলে তা তোমরা আমার নিকট উপস্থিত কর যদি তোমরা সত্যবাদী হও। সেই ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত কে যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে, যা কিয়ামত দিবস পর্যন্তও তাতে সাড়া দেবে না’। (আহকাফ ৪৬/৪-৫)
এখানে মূর্তিপূজার অসারতা প্রসঙ্গে শক্তির দেবতা হিসাবে দৃশ্য এবং অদৃশ্য দু’টি দেবতার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের কাছে কিছু প্রার্থনা করা না করা উভয়ই নিরর্থক বলে বর্ণিত হয়েছে।
পূর্ববর্তী জাতি সমূহের নিকটও এর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি ছিল না। ছিল না কোন কিতাব কিংবা পরম্পরাগত কোন জ্ঞান। যার দ্বারা মূর্তিপূজার পক্ষে কোন দলীল পেশ করা যেতে পারে। আর আল-কুরআনের দৃষ্টিতে এ পৃথিবীতে সেই ব্যক্তি কিংবা জাতি এক আল্লাহর পরিবর্তে অসংখ্য অসংখ্য দৃশ্য এবং দেবতার কাছে তাদের চাহিদার কথা বলে এসেছে। ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত ডাকলেও এ সমস্ত শক্তির কোন কিছু দেওয়ার ক্ষমতা নেই। কুরআনে ঘোষিত হ’ল-
وَاتَّخَذُوا مِن دُونِ اللَّهِ آلِهَةً لَّعَلَّهُمْ يُنصَرُونَ
لَا يَسْتَطِيعُونَ نَصْرَهُمْ
‘তারা তো আল্লাহর পরিবর্তে অন্য ইলাহ গ্রহণ করেছে। এই আশায় যে তারা সাহায্যপ্ৰাপ্ত হবে। কিন্তু এইসব ইলাহ তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম নয়’। (ইয়াসীন ৩৬/৭৪-৭৫)
এমনিভাবে এই দেবতা শক্তির অসারতার সুর পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে বিভিন্ন আঙ্গিকে কখনো বা দৃষ্টান্ত প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। কুরআনে যে সমস্ত নবী-রাসূলের ইতিহাস উপস্থাপিত হয়েছে সেখানে পূর্ববতী প্রত্যেক নবী-রাসূলকে এই তথাকথিত দেব-দেবী বিরুদ্ধে এক আল্লাহর শক্তি-মহিমা প্রচার করতে দেখা গেছে।
প্রত্যেক নবী-রাসূলই তাঁদের সম্প্রদায়ের কাছে এক ও অভিন্ন দাওয়াত পেশ করেছেন। তাঁরা দাওয়াত পেশ করেছেন। তাঁরা দাওয়াত পেশ করেছেন এভাবে- বল, এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন রাসূল। বলা হয়েছে, ‘আমি ছামূদ জাতির নিকটে তাদের ভ্রাতা ছালিহকে প্রেরণ করেছিলাম’।
তিনিও বলেছিলেন,
يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ
‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই’। (হূদ ১১/৬১)
মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে এই দাওয়াত পেশ করতে গিয়ে প্রায় প্রত্যেক নবী-রাসূলকে কায়েমী স্বার্থবাদীদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হ’তে হয়েছে। নমরূদ, ফেরাউন, কওমে নূহ, কওমে শু’আইব, কওমে ইলিয়াস, কওমে আদ-ছামূদ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের ইতিহাস তো সেই সংঘাতেরই জাজ্জ্বল্য প্রমাণ। তাই একত্ববাদ প্রকাশের এই বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, জীবনের সমস্ত বড় বড় পাপ যদিও মার্জনা করা হয়, তবুও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে এই সমস্ত দেবতার সংমিশ্রণের ফলে যে পাপরাজি সংঘটিত হয় তা কখনো মার্জনা করা হয় না। কুরআনে ঘোষিত হয়েছে,
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না, তা ব্যতীত সব কিছু যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং কেউ আল্লাহর শরীক করলে সে ভীষণভাবে পথভ্ৰষ্ট হয়’। (নিসা ৪/১১৬)
এখানে শিরকের যে পরিণতির কথা বলা হয়েছে অন্যান্য ইবাদত পরিত্যক্ত হ’লেও সেখানে সে ধরনের কোন পরিণতির কথা বলা হয়নি। তাই শিরক একটি অমার্জনীয় অপরাধ। কুরআনের এ সকল বাণী প্রমাণ করে যে, ঈমান আনয়নের পরও যে কেউ এমনকি একটি জাতিও পথভ্ৰষ্ট হ’তে পারে। তা অন্য কোন পাপরাজির দ্বারা নয় বরং আল্লাহর সাথে অপর দেবতা শক্তির শরীক করার দ্বারাই তা অর্জিত হয়। এটা জ্ঞাত এবং অজ্ঞাতসারে ঘটলেও অনেক ক্ষেত্রেই আমরা জ্ঞাতসারেই এই পাপটি করে চলেছি।
এ বিষয়টি সম্পর্কে তাই আমাদের অতি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। পূর্ববতী যে সমস্ত জাতি আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়েছে বলে প্ৰমাণ মেলে তাদেরও একটি অপরাধই জাতীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছিল। তা ছিল এক আল্লাহর পরিবর্তে অন্য শক্তির কাছে, মূর্তির কাছে কোন কিছু চাওয়া। অর্থাৎ প্ৰকাশ্য-অপ্ৰকাশ্য দেব-দেবীর উপাসনার মাধ্যমেই তাদের মধ্যে অসংখ্য পাপরাজির সমাবেশ তাদেরকে অনিবাৰ্য ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوا لَهُ ۚ إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ لَن يَخْلُقُوا ذُبَابًا وَلَوِ اجْتَمَعُوا لَهُ ۖ وَإِن يَسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَيْئًا لَّا يَسْتَنقِذُوهُ مِنْهُ ۚ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوبُ
مَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ
‘হে মানুষ! একটি উপমা দেওয়া হচ্ছে মনোযোগ সহকারে তা শ্ৰবণ কর, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না। এই উদ্দেশ্যে তারা সকলে একত্র হ’লেও এবং মাছি যদি কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের নিকট থেকে তাও তারা তার নিকট থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। অন্বেষক ও অন্বেষিত কতই না দুর্বল। তারা আল্লাহর যথোচিত মর্যাদা উপলব্ধি করে না। আল্লাহ নিশ্চয়ই ক্ষমতাবান পরাক্রমশালী’। (হজ্জ ২২/৭৩-৭৪)
এমন সহজ সাবলীল ভাষায় প্রতিমা পূজার অসারতার চমৎকার যৌক্তিক উপমা পৃথিবীর আর কোন গ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যাবে কি?
মূর্তিপূজা উৎপত্তির ইতিহাস :
মূর্তিপূজার ইতিহাস অতিপ্রাচীন। নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের লোকদের মাধ্যমে মূর্তিপূজার সূচনা। তাদের উপাস্য কতিপয় দেব-দেবীর নাম সম্পর্কে তাদের বক্তব্য আল্লাহ কুরআনে এভাবে উল্লেখ করেন,
وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا
‘তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের দেব-দেবীকে। পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্’, সুআ, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নাসরকে’। (নুহ ৭১/২৩)
আমরা আমাদের দেব-দেবী বিশেষত এই পাঁচ জনের উপাসনা পরিত্যাগ করব না। আয়াতে উল্লেখিত শব্দগুলো পাঁচটি প্রতিমার নাম। ইমাম বাগাভী (রহঃ) বর্ণনা করেন, এই পাঁচ জন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা’আলার নেক ও সৎকর্মপরায়ণ বান্দা ছিলেন। তাদের সময়কাল ছিল আদম (আঃ) ও নূহ (আঃ)-এর আমলের মাঝামাঝি। তাদের অনেক ভক্ত ও অনুসারী ছিল। তাদের মৃত্যুর পর ভক্তরা সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত তাদের পদাংক অনুসরণ করে আল্লাহ তা’আলার ইবাদত ও বিধি-বিধানের প্রতি আনুগত্য অব্যাহত রাখে। কিছুদিন পর শয়তান তাদেরকে এই বলে প্ররোচিত করল, ‘তোমরা যেসব মহা পুরুষের পদাংক অনুসরণ করে উপাসনা কর, যদি তাদের মূর্তি তৈরী করে সামনে রেখে দাও, তবে তোমাদের উপাসনা পূর্ণতা লাভ করবে এবং বিনয় ও একাগ্রতা অর্জিত হবে। তারা শয়তানের ধোঁকা বুঝতে না পেরে মহা পুরুষদের প্রতিকৃতি তৈরী করে উপাসনালয়ে স্থাপন করল এবং তাদের স্মৃতি জাগরিত করে ইবাদাতে বিশেষ পুলক অনুভব করতে লাগল। এমতাবস্থায়ই তাদের সবাই একে একে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল এবং সম্পূর্ণ নতুন এক বংশধর তাদের স্থলাভিষিক্ত হ’ল। এবার শয়তান এসে তাদেরকে বুঝালো এই সকল তোমাদের পূর্ব পুরুষদের উপাস্য ছিল মূর্তি। তারা এই মূর্তিগুলোরই উপাসনা করত। এরপর থেকেই প্রতিমা পূজার সুচনা হয়।[1]
উপরোক্ত পাঁচটি মূর্তির মাহাত্ম্য তাদের অন্তরে সর্বাধিক প্রতিষ্ঠিত ছিল বিধায় এখানে পারস্পরিক চুক্তিতে তাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। শয়তানের এই প্রচেষ্টা এখনো থেমে থাকেনি। বরং তা ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। মোড়ে মোড়ে মূর্তি স্থাপনের অব্যাহত প্ৰচেষ্টা সেই শয়তানেরই পদাংক অনুসরণ কি-না তা ভাবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। ইসলাম যেখানে প্ৰতিমা পূজা, মূর্তি-ভাস্কর্য নির্মাণকে শয়তানের ঘূণ্য কার্যকলাপ বলে এ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে (মায়েদাহ ৫/৯৩) সেখানে বর্তমান যুগে এই কাজের বহুল সম্পপ্রসারণ তা যে শয়তানেরই পদাংক অনুসরণ এবং সম্পপ্রসারণ তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে বাড়ীতে কুকুর ও ছবি রয়েছে সেখানে ফেরেস্তা প্ৰবেশ করে না’ ৷ =(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৪৮৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন সবচেয়ে বেশী শাস্তি পাবে ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টির মত সৃষ্টি করে’। =(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৪৯৫)। এ সমস্ত বাণী ইসলামে চিত্রকলাকে নিরুৎসাহিত করলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আড়ালে ইসলামে চিত্ৰকলাকে জায়েয করার প্রবণতা চলছে।
কুরআনে নূহ (আঃ)-এর কওমের উপাস্যদের মধ্যে থেকে এখানে যেসব দেব-দেবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে পরবর্তীকালে মক্কাবাসীরা তাদের পূজা করতে শুরু করেছিল এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবের বিভিন্ন স্থানে তাদের মন্দিরও বর্তমান ছিল। এটা অসম্ভব নয় যে, মহা প্লাবনে যেসব লোক রক্ষা পেয়েছিল পরবর্তী বংশধরগণ তাদের মুখ থেকে নূহ (আঃ)-এর জাতির প্রাচীন উপাস্য দেব-দেবীর নাম শুনেছিল এবং পরে তাদের বংশধরদের মধ্যে নতুন করে জাহেলিয়াত ছড়িয়ে পড়লে তারা সেসব দেব-দেবীর প্রতিমা তৈরী করে তাদের পূজা অৰ্চনা শুরু করেছিল।[2] আরবে এই মূর্তি পূজার সূচনা করেছিলেন আমর ইবনে লুহাই নামে এক ব্যক্তি। তিনি সিরিয়া থেকে মূর্তি এনে কা’বা ঘরে স্থাপন করেছিলেন। এই সময় তায়েফের ছাকিফ গোত্রের লোকেরা লাত-এর পূজা করত। বাতনে নাখলার গাতফান ও কুরাইশরা উযযার এবং মদীনা সংলগ্ন কাদীদ অঞ্চলের আউস, খাজরায ও গাসসান গোত্রের লোকেরা মানাত দেবীর উপাসনা করত এবং এসব স্থানে তাদের মন্দির ছিল বলে জানা যায়।[3]
আল-কুরআনে মক্কাবাসী আরবদেরকে, তাই এ তিনটি মূর্তির কথা বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে এবং এই সাথে সূরা নূহে মূর্তি পূজার পূর্ববর্তী ইতিহাস বর্ণনার সাথে সাথে চিন্তা-গবেষণার দ্বারা তার অসারতার প্রমাণের মধ্য দিয়ে সত্য পথ অনুসন্ধানের উদাত্ত আহবান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যাদেরকে আহ্বান কর, তারা তোমাদের ডাকে সাড়া দিক যদি তোমরা সত্যবাদী হও। তাদের কি পা আছে যা দ্বারা তারা চলে? তাদের কি হাত আছে যা দ্বারা তারা ধরে? তাদের কি চক্ষু আছে যা দ্বারা তারা দেখতে পায়? তাদের কি কান আছে যা দ্বারা তারা শুনতে পায়? বল, তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরীক করেছ তাদেরকে ডাক অতঃপর আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এবং আমাকে অবকাশ দিও না।
আমার অভিভাবক তো আল্লাহ, যিনি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং তিনিই সৎকর্ম পরায়ণদের অভিভাবকত্ব করে থাকেন। আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যাকে আহবান কর তারা তো তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারে না এবং তাদের নিজেদেরকেও না। যদি তাদেরকে সৎপথে আহ্বান কর তবে তারা শ্রবণ করবে না এবং তুমি দেখতে পাবে যে, তারা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু তারা দেখে না’। (আরাফ ৭/১৯৪-১৯৮)।
ইসলাম আগমনের পূর্বে আরবে ব্যাপক হারে মূর্তিপূজার প্রচলন থাকলেও সময়ের প্রেক্ষিতে কখনো কখনো মক্কাবাসী আরবরা মূলতঃ এক আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন বলে জানা যায়। এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায় আবরাহা যখন কা’বা ঘর আক্রমণের জন্য মক্কায় আসেন তখন মক্কাবাসী আরবরা কা’বা ঘরে সংরক্ষিত ৩৬০টি মূর্তির কোন একটির কাছেও তাদের বিপদ থেকে উদ্ধারের প্রার্থনা জানায়নি।
মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় উদ্ধৃত হয়েছে, কা’বা ঘর আক্রমণের পূর্বে আব্দুল মুত্তালিব আবরাহার সাথে আলোচনা শেষে সেনানিবাস থেকে ফিরে এসে কুরাইশদেরকে সাধারণ হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষার জন্য পরিবার-পরিজন নিয়ে পর্বতমালায় আশ্রয় গ্ৰহণ করতে বললেন। তারপর তিনি কুরাইশদের আরও কতিপয় সর্দারকে সঙ্গে নিয়ে হারাম শরীফে উপস্থিত হ’লেন এবং কা’বার দরজার কড়া ধরে আল্লাহর নিকট দো’আ করলেন তিনি যেন তার ঘর ও তার সেবকদের হেফাযত করেন। এই সময় কা’বার মধ্যে ৩৬০টি মূর্তি বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এই কঠিন সময়েও তাদের কথা তাদের স্মরণে আসেনি। তারা কেবল আল্লাহর দরবারেই সাহায্যের জন্য ভিক্ষার হাত প্রসারিত করেছিলেন।[4]
ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে তাদের এই সময়কার দোআ সমূহ উদ্ধৃত হয়েছে। এই দোআয় একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো নাম পর্যন্ত উল্লেখ নেই। ইবনে হিশাম, তার সীরাত গ্রন্থে আব্দুল মুত্তালিবের নিম্নোক্ত কবিতা উল্লেখ করেছন, হে আল্লাহ! বান্দাহ নিজের ঘরের সংরক্ষণ করে তুমিও রক্ষা কর তোমার নিজের ঘর।[5] সুহাইলী রওজুল উনুফ গ্রন্থে এই পর্যায়ে নিম্নোক্ত কবিতাংশ উদ্ধৃত করেছেন, ক্রুশধারী ও তার পূজারীদের মোকাবেলায় আজ তোমার স্বপক্ষের লোকদের সাহায্য কর হে আল্লাহ![6] ইবনে জারীর আব্দুল মুত্তালিবের দো’আ হিসাবে নিম্নোক্ত কবিতা ছত্ৰ দু’টিরও উল্লেখ করেছেন, হে আমার রব! এই লোকদের মুকাবিলায় আমি তোমাকে ছাড়া আর কারো নিকট কোন আশা রাখি না। হে আমার রব! তাদের কবল থেকে তুমি তোমার হারামকে রক্ষা কর। এই ঘরের শত্ৰু তোমারও শত্রু। তোমার জনবসতি ধ্বংস করা থেকে এদেরকে বিরত রাখ।[7]
ইতিহাসে দেখা যায় প্রাচীন কালে বিভিন্ন দেশের লোক বা’ল নামক দেবতার পূজা করত। তারা মনে করত এই দেবতাকে তুষ্ট করতে পারলে তাদের সুখ শান্তি অর্জিত হবে। সিরীয় ভাষায় ‘বা’ল’ শব্দের অর্থ প্ৰভু বা স্বামী। এই দেবতার নাম অনুসারে শামে একটি শহরের নাম রাখা হয়েছে ‘বা’লাবাক্কা’। এখানে এই দেবতার মন্দির বিদ্যমান। ইলিয়াস (আঃ) এই মুশরিক কওমকে হেদায়াত করার জন্য নবী রূপে প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি গোমরাহ কওমকে বলেছিলেন যে, তোমরা আমার ডাকে সাড়া দিয়ে মূর্তিপূজা পরিত্যাগ কর। এই সময় বনী ইসরাঈল কওমের একটি বিরাট অংশ বা’লাবাক্বা এবং তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এক বিশাল রাজ্য স্থাপন করেছিল। তাদের বাদশাহর নাম ছিল মালেক তালেহ। রাজা প্ৰজা সকলেই বা’ল দেবতার পূজা করত। বা’ল দেবতার স্বর্ণনির্মিত মূর্তিটি উচ্চতায় বিশ গজ ছিল এবং তার চারদিকেই মুখ ছিল। তার ভিতর ফাঁপা থাকায় বাতাস ঢুকে বিভিন্ন প্রকার আওয়াজ সৃষ্টি করত। পুরোহিতগণ নিজেদের সুবিধামত তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা করত। এই দেবতার চারশ’ খাদেম বা পুরোহিত ছিল। উক্ত রাজ্যবাসীরা এই দেবতাকে সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করত। মালেক তালেহ অতিশয় অত্যাচারী শাসক ছিলেন। তিনি তার প্রজাগণকে বা’লের পূজা করতে বাধ্য করতেন। এই সময় ইলিয়াস (আঃ) তাদের হেদায়াত করার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন।[8]
কেউ কেউ মনে করেন যে, ইসরাঈলের তৎকালীন বাদশাহ আকিয়ার সাইদা সিরিয়ায় বা’ল-এর মন্দির ও যজ্ঞবেদী নির্মাণ করে এক আল্লাহর পরিবর্তে বা’ল-এর পূজার প্রচলন করার পূর্ণ প্রচেষ্টা চালায় এবং ইসরাঈলের শহরগুলোতে প্রকাশ্যে বা’লের নামে বলি দানের প্রথা চালু করে। এমতাবস্থায় তাদের সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য ইলিয়াস (আঃ) তাদের সামনে হাযির হন।[9]
গবেষণা, চিন্তা-ভাবনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ এগুলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এক অপরিসীম নে’মত। কুরআনে এরশাদ হয়েছে-
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ
‘নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃজনে আর রাত ও দিনের ক্রমাবর্তনে সে সকল লোকদের জন্য অসংখ্য নির্দশন বিদ্যমান’। (আলে ইমরান ৩/১৯০)
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন ফজরের ছালাতের আযান দিতে এসে বেলাল (রাঃ) দেখলেন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কাঁদছেন। বেলাল (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আপনার ক্ৰন্দনের কারণ কি? নবীজী বললেন, কারণ আজ রাতে আমার উপর এই আয়াত নাযিল হয়েছে। এরপর তিনি বললেন, হতভাগ্য সেই ব্যক্তি, যে এই আয়াত পড়ল। কিন্তু এই বিশ্ব সৃষ্টির কারিগরী ও নিদর্শন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করল না। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনার জন্য প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে। পৃথিবীর যাবতীয় কৃত্রিম সৃষ্টির পিছনে মানুষের এই অক্লান্ত পরিশ্রম ও চিন্তা-ভাবনার ফল আজ বিশ্ববাসী উপভোগ করছে। সুতরাং এই চিন্তাশীল মানুষও যদি লাত, উষযা, মানাত, ওয়াদ, সুআ, ইয়াগুছ, ইয়াউক, নাসর, বা’ল-এ সমস্ত অলীক দেবতাকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তবে তার অসারতা প্রমাণের মধ্য দিয়ে একটি যৌক্তিক অনিবাৰ্য ফল হিসাবে সেও নিশ্চয়ই সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে যেতে পারে। এ বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।
আল-কুরআনে তাই ঘোষিত হ’ল এভাবে, ‘স্মরণ কর ইবরাহীম তার পিতা আজরকে বলেছিল, আপনি কি মূর্তিকে ইলাহ রূপে গ্ৰহণ করেন? আমি তো আপনাকে ও আপনার সম্প্রদায়কে স্পষ্ট ভ্ৰান্তিতে দেখছি। এভাবে আমি ইবরাহীমকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর পরিচালনা ব্যবস্থা দেখাই, যাতে সে বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। অতঃপর রাত্রির অন্ধকার যখন তাকে আচ্ছন্ন করল সে নক্ষত্র দেখে বলল, এটাই আমার প্রতিপালক। অতঃপর যখন তা অস্তমিত হ’ল তখন সে বলল, যা অস্তমিত হয় তা আমি পসন্দ করি না। অতঃপর যখন সে চন্দ্রকে সমুজ্জ্বল রূপে উদিত হ’তে দেখল তখন বলল, এটা আমার প্রতিপালক, যখন সেটাও অস্তমিত হ’ল তখন বলল, আমাকে আমার প্ৰতিপালক সৎপথ প্ৰদৰ্শন না করলে আমি অবশ্যই পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হব। অতঃপর যখন সে সূর্যকে দ্বীপ্তিমানরূপে উদিত হ’তে দেখল। তখন বলল, এটা আমার প্রতিপালক, এটা সৰ্ববৃহৎ। যখন সেটাও অস্তমিত হ’ল তখন সে বলল, হে আমার সম্পপ্ৰদায়! তোমরা যাকে আল্লাহর শরীক কর, তার সাথে আমার কোন সংশ্ৰব নেই। আমি একনিষ্টভাবে তাঁর দিকে মুখ ফিরাচ্ছি, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (আন’আম ৬/৭৪-৭৯)।
এভাবে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর পরিচালনা ব্যবস্থা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা ও বিশ্লেষণ করলে সতত মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পরিচয় সুস্পষ্ট হবে। সত্য পথের সন্ধান পাওয়া সহজতর হবে। এমনিভাবে চিন্তা-গবেষণা আল্লাহর এমন একটি বরকতপূর্ণ নে’মত, যার দ্বারা নিত্য-নতুন আবিষ্কার ও সঠিক তত্ত্ব ও তথ্যের সন্ধান লাভ সহজতর হয়। নিত্য নতুন গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত হয়। এর ক্ষেত্র কোন একটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থ বিদ্যায় যেমন তা ফলপ্ৰসু হয়, তদ্রুপ ভাষা-সাহিত্য ও ইতিহাস গবেষণায়ও সত্য পথের সন্ধান অনিবাৰ্য হয়ে দেখা যায়।
পবিত্র কুরআনে ইবরাহীম (আঃ) সম্পর্কে উদ্ধৃত হয়েছে-‘যখন ইবরাহীম (আঃ) তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বলল, এই মূর্তিগুলো কি যাদের পূজায় তোমরা রত রয়েছ। তারা বলল, আমরা আমাদের পিতৃপুরুষগণকে এদের পূজা করতে দেখেছি। তিনি বললেন, তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের পিতৃ-পুরুষগণও রয়েছ স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে। তারা বলল, তুমি কি আমাদের নিকট সত্য এনেছ, না তুমি কৌতুক করছ? তিনি বললেন, না, তোমাদের প্রতিপালক তো আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক, যিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন এবং এ বিষয়ে আমি অন্যতম সাক্ষী। শপথ আল্লাহর তোমরা চলে গেলে আমি তোমাদের মূর্তিগুলো সম্বন্ধে অবশ্যই কৌশল অবলম্বন করব। অতঃপর সে চুৰ্ণ-বিচূর্ণ করে দিল মূর্তিগুলোকে তাদের প্রধানটি ব্যতীত। যাতে তারা তার দিকে ফিরে আসে। তারা বলল, আমাদের উপাস্যগুলোর প্রতি এরূপ করল কে? সে নিশ্চয়ই সীমালংঘনকারী। কেউ কেউ বলল, এক যুবককে তাদের সমালোচনা করতে শুনেছি। তাকে বলা হয় ইবরাহীম। তারা বলল, তাকে উপস্থিত কর লোক সম্মুখে। যাতে তারা সাক্ষ্য দিতে পারে। তারা বলল, হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যগুলোর প্রতি এরূপ করেছ? সে বলল, বরং এদের এই প্রধান সেই তো তা করেছে, তাদেরকেই জিজ্ঞেস কর যদি তারা কথা বলতে পারে। তখন তারা মনে মনে চিন্তা করে দেখল এবং একে অপরকে বলতে লাগল তোমরাই তো সীমালংঘনকারী। অতঃপর তাদের মস্তক অবনত হয়ে গেল এবং তারা বলল, তুমি তো জানই যে এরা কথা বলে না। ইবরাহীম বলল, তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর যা তোমাদের কোন উপকার করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না। ধিক তোমাদেরকে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ইবাদত কর তাদেরকে, তবুও কি তোমরা বুঝবে না?’ (আম্বিয়া ২১/৫২-৬৭)
ইবরাহীম (আঃ)-এর যুক্তির কাছে তার সম্পপ্রদায় মাথানত করেছিল ঠিকই কিন্তু বাপ-দাদার এই ধর্মকে তারা পরিত্যাগ করতে সম্মত হয়নি। সাধারণ জ্ঞানের যুক্তি এখানে খুবই সুস্পষ্ট। আর তা হ’ল মূর্তির উপাসনা করা। যে নিজেই নিজের উপকার অপকার কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না, তার কাছে কিছু চাওয়া না চাওয়া বোকামী ছাড়া আর কিছু না। ইবরাহীম (আঃ)-এর সম্প্রদায় তা স্বীকারও করেছে।
মানুষ অসহায়। তাই সে কোন বড় শক্তির সহায়তা পেতে চায়। আদিম যুগে মানুষ বড় কিছু দেখলেই তাকে প্ৰণতি জানাত এবং তার কাছে দয়া ভিক্ষা চাইত। বিরাট বৃক্ষ পাহাড়- পৰ্বত, নদী-সমুদ্র যাই তার কাছে বড় বা শক্তিশালী মনে হয়েছে, তাকে সে পূজা করেছে। সূর্য, চন্দ্র, গ্ৰহ, নক্ষত্র তার নিকট রহস্যাবৃত। তাদের সম্বন্ধে সে কল্পনা করেছে এবং তারা তাদের ভাগ্যবিধাতা বলে বিশ্বাস করেছে। ধীরে ধীরে কিছু অদৃশ্য শক্তির উপলব্ধি সে করেছে, তার ধারণায় সেগুলো হ’ল (আরওয়াহ) আত্মাসমূহ। ভাল ও মন্দ ক্ষমতার অধিকারী ছিল এসব আত্মা। তাই তাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তাদের পূজা অৰ্চনা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মানুষের মধ্যে যারা দৈহিক, আত্মিক অথবা চারিত্রিক অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিয়েছে তারাও সাধারণ মানুষের উপসনার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ধীরে ধীরে তার উপাস্য বস্তুর জন্য কিছু সে কল্পনা করে নিয়েছে আর তার প্রতিকৃতি বা মূর্তি তৈরী করে তার সামনে মাথা নত করেছে। তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য তাকে মূল্যবান বস্তু ভোগ দিয়েছে, এমনকি মানুষকে হত্যা করে তার রক্ত তাকে উপহার দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ মানুষের হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। ইবরাহীম (আঃ), মূসা (আঃ) ও ঈসা (আঃ) শামবাসীর নিকট আল্লাহর বাণী নিয়ে এসেছিলেন। কেউ হেদায়াত গ্ৰহণ করেছে, কেউ করেনি। আরবেও নবী প্রেরিত হয়েছিলেন: হূদ (আঃ) আদ-এর নিকট এবং ছালেহ (আঃ) ছামুদ-এর নিকট। তাছাড়া ইসমাঈল (আঃ) মক্কায় ধর্ম প্রচার করেছিলেন। আরব দেশেও উপযুক্ত বৰ্ণনা মোতাবেক ধর্মীয় ক্রমবিকাশ সম্পন্ন হয়েছে। বস্তু উপাসক, শ্রেণীর মত ও বিশ্বাসের লোক আরবে দেখা গিয়েছে। ইবরাহীম (আঃ), মূসা (আঃ) ও ঈসা (আঃ)-এর অনুসারীও সেখানে বর্তমান ছিল। তবে তারা এসব ধর্মের মৌল রূপ বিকৃত করেছিল। আবার কিছু সংখ্যক লোক ছিল যারা কোন ধর্মই মানত না। কিন্তু তাদের ধর্মীয় ইতিহাস পর্যালোচনা করে পণ্ডিতগণ এ সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে, নক্ষত্ররাজি ও আত্মাসমূহের কাল্পনিক প্রতিকৃতির পূজা করাই সাধারণত আরবদের জাতীয় ধর্ম ছিল।
দক্ষিণ আরবে কাহতানী আরবদের বাস ছিল। এদের মধ্যে সাবাদের সম্বন্ধে কিছু আলোচনা হয়েছে। তারা সাধারণত তারা সেগুলোর পূজা-অৰ্চনা করত। বড় বড় মন্দিরে এসব দেবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। মন্দিরের সেবায়েত নিযুক্ত ছিল। সেবায়েতরা ‘কাহিন’ নামে পরিচিত ছিল। সূর্য দেবতা সাবাদের মহাপ্ৰভু ছিল। কুরআনে সাবার রাণীর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে উল্লিখিত হয়েছে-
وَجَدتُّهَا وَقَوْمَهَا يَسْجُدُونَ لِلشَّمْسِ مِن دُونِ اللَّهِ
‘আমি সাবার রাণীর এবং তার জাতিকে আল্লাহকে বাদ দিয়ে সূর্যের প্রতি প্ৰণতি জানাতে দেখেছি’ (নামল ২৭/২৪)। সাবা জাতির পূর্বপুরুষ ছিলেন আবদ শামস, যার অর্থ হ’ল সূর্যের দাস। ইয়ামনের একটি প্রাচীন শিলালিপির কথা মুসলিম ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন। তাতে লেখা ছিল বাদশাহ শমর য়রউশ এটি সূর্যদেবীর জন্য তৈরী করেছেন।[10]
পরবর্তীকালে প্ৰাপ্ত প্ৰাচীন কিছু নিদর্শন থেকে প্রতীয়মান হয়েছে যে, তারা আরও অনেক নক্ষত্রের উপাসনা করত। তাদের কয়েকটি দেব-দেবীর নাম নিম্নরূপ ছিল, ইয়াগুছ, ইয়াউক, নাসর, আমিয়ানস ইত্যাদি। দেব-দেবীর জন্য নির্মিত মন্দিরগুলোর কয়েকটি নাম উল্লেখ করা যায়: ঘমদান, রিআম, যুলখলাসহ, কলীস ইত্যাদি। ঘমদান রাজধানী সানআর একটি বড় দেবালয়, সাত তলাবিশিষ্ট এক বৃহৎ অট্টালিকায় যুহরহ (শুক্রগ্রহ) এর কাল্পনিক প্রতিকৃতি প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাদের ভাষায় এ দেবতার নাম ছিল আসতার। খলীফা ওছমানের খিলাফতকালে এ মন্দির ধ্বংস করে দেওয়া হয়। যুলখলসসহ মন্দিরটি মক্কার দক্ষিণে নাজিরানের উত্তরে তাবালা নামক উপত্যকায় অবস্থিত। এ মন্দিরের দেব মূর্তিটি সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত ছিল, এর মাথায় মুকুট ও গলায় দামী হার ছিল। সারা আরবে এ মন্দিরের বড় সম্মান ছিল। এটিকে ইয়ামনবাসীদের কা’বা বলা হত। মক্কা বিজয়ের পর রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশে জারীর ইবন আবদিল্লাহ (রাঃ) মন্দিরটি আগুনে পুড়িয়ে দেন।[11]
উত্তর আরবের বাসিন্দারা ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর ছিলেন। তাঁর পিতা ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন একেশ্বরবাদী। ফলে ইসমাঈল (আঃ) ও তাঁর বংশধরগণও এক আল্লাহতে বিশ্বাস করতেন। তাছাড়া ইসমাঈল নিজেও ছিলেন নবী। কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হ’তে থাকে। উত্তর আরব (হিজাজ, নাজদ ও মাদায়েন) এবং প্যালেস্টাইন ও সিরিয়ার ধর্মীয় বিশ্বাসের কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। মাদায়েনের অধিবাসীরা বা’ল দেবতার পূজা করত। প্রায় সকল সামী জাতি এ দেবতার উপাসনা করেছে। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
أَتَدْعُونَ بَعْلًا وَتَذَرُونَ أَحْسَنَ الْخَالِقِينَ
‘তোমরা কি বা’লকে ডাকছ এবং উত্তম স্রষ্টাকে পরিত্যাগ করছো’? (ছফফাত ৩৭/১২৫)।
ইউরোপের প্রাচ্যবিদদের মতে বা’ল হ’ল শনিগ্ৰহ। আরবীতে এই বা’লকে হুবল বলা হয়। আরবী ভাষায় (সামী ভাষার একটি উপভাষা) হুবল অর্থ আত্মা, বাষ্প। হুবল কা’বার প্রধান দেবতা ছিল। মানুষের আকৃতিতে এটি গড়া হয়েছিল। ইবন হিশামের (মৃঃ ৮৩৩ খৃঃ) মতে আমর ইবন লুহাই এই দেবমূর্তিটি মোআব (মেসোপোটেমিয়া) থেকে নিয়ে এসেছিল। এ সম্পর্কে আর একটি মতবাদ হ’ল ভারতবর্ষের কিছু দেবমূর্তি নূহ (আঃ)-এর সময় বন্যার স্রোতে আরব দেশের জিদ্দায় গিয়ে পৌছে। একটি জিন আমর ইবন লুহায়ইকে দেবমূর্তিগুলির সন্ধান দেয় এবং সে আরবদেরকে সেগুলির পূজা করতে উদ্বুদ্ধ করে।[12] মক্কায় মূর্তিপূজার সূচনা সম্পর্কে অন্য একটি বর্ণনা হ’ল যে, মক্কার লোকের কা’বার বড় ভক্ত ছিল। কা’বা পাথরের তৈরী – ঘর হওয়ায় কাবার প্রাঙ্গনের সকল পাথর তাদের নিকট ছিল অতি পবিত্র। ফলে কোথাও যাওয়ার সময় তারা কা’বা প্রাঙ্গন থেকে বরকতের জন্য পাথরের টুকরা সঙ্গে নিত। ধীরে ধীরে সকল মসৃণ পাথর তাদের নিকট পবিত্র বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। এভাবে মূর্তিপূজার প্রতি তারা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।[13]
কুরআনে আরবদের কিছু কিছু দেবমূর্তির নাম উল্লিখিত হয়েছে। হজ্জের সময় এসব দেবতার বিশেষভাবে অৰ্চনা হ’ত। আরবরা তাদের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে বুযুর্গ ব্যক্তিদের ছবি অথবা মূর্তি বানিয়ে তারও পূজা করত। ইবনু আব্বাস (রাঃ)-এর একটি রিওয়ায়াতে জানা যায়- লাত, ওয়াদ্দ ইয়াগুছ ইত্যাদি দেবতা তাদের পূর্ব পুরুষ ছিল। কা’বা প্রাঙ্গনে ছিল ৩৬০টি মূর্তি। কা’বা আরবদের দৃষ্টিতে অতি পবিত্র ঘর। তাদের প্রতি গোত্রের ছিল ভিন্ন ভিন্ন দেবতা। কা’বায় তাদের সকলের দেবমূর্তিদের একত্রে রাখা হয়েছিল। যাতে এ ঘর এবং এ শহর সকলের তীর্থস্থানে পরিণত হয়।
শিরকের (আল্লাহর অংশীদারীকরণ) মধ্যে লিপ্ত থাকলেও আল্লাহ সম্বন্ধে আরবরা একেবারে অজ্ঞ ছিল না। তারা একটি বৃহৎ অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিল। তাদের ভাষায় সে মহান সত্তার নাম হ’ল আল্লাহ। জাহিলী কবিদের কবিতায় শব্দটি পাওয়া যায়।[14] এক সময় কুরআনের তাওহীদ তত্ত্বের কাছে তারা হার মানতে বাধ্য হয়।
উপসংহার:
পৃথিবীতে যত উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্প্রসারণ ঘটছে, ততই একক শক্তির আধার আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অস্তিত্ব দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হচ্ছে। বিজ্ঞানের কারণে বিদ্যমান পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও মতবাদ আজ মিথ্যায় পর্যবসিত হচ্ছে। একমাত্র ব্যতিক্রম হ’ল পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআন। সেখানে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের কোন বৈসাদৃশ্য নেই। ড. মরিস বুকাইলি তাইতো বলেছেন, There is not a single verse in the holy Quran which is assailable from the scientific point of view. ‘পবিত্র কুরআনে এমন একটি মাত্র আয়াতও নেই যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আক্রমণযোগ্য’। আজ সমগ্র পৃথিবীতে এক আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে ছাড়া অসংখ্য মিথ্যা মতবাদকে শক্তির আসনে বসিয়ে মূর্তিপূজার ন্যায় পূজা করা হচ্ছে। এসব মূর্তিপূজা বা দেবতা শক্তির কাছে কোন কিছু চাওয়া যে সম্পূর্ণ নিরর্থক তা আলোচ্য প্ৰবন্ধে অসংখ্য আয়াত দ্বারা প্ৰমাণ করার প্রচেষ্টা চালান হয়েছে। এখান থেকে তাই আমাদের প্রকৃত শিক্ষা গ্ৰহণ করা উচিত। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন!
* প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস, বেনাপোল মহিলা সিনিয়র মাদরাসা, শার্শা, যশোর।
তথ্যসূত্রঃ
[1] মুফতী মুহাম্মদ শফী (র), তাফসীরে মা’রেফুল কুরআন, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, (মুদ্রণ ১৪১৩ হিঃ, পৃঃ ১৪০৮।
[2] তাফহীমুল কুরআন, অনুবাদ: মাওলানা মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, (ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী, ৬ষ্ঠ প্ৰকাশ, ২০০২), ১৮ খণ্ড, পৃঃ ৬৪।
[3] মুহাম্মাদ হাদীসুর রহমান, ইসলামের ইতিহাস, (ঢাকা: আরাফাত পাবলিকেশন, ২০০৩), পৃঃ ৭০-৭১।
[4] তাফহীমুল কুরআন, ১৯তম খণ্ড, পৃঃ ২৩২।
[5] ঐ, পৃঃ ২৩২।
[6] ঐ, পৃঃ ২৩২।
[7] ঐ, পৃঃ ২৩২।
[8] আব্দুল হাই, পবিত্র কুরআনের অভিধান, ২য় খণ্ড, (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৩), পৃঃ ৫৭/৬১।
[9] তাফহীমুল কুরআন, ১৩ খণ্ড, পৃঃ ৬৮।
[10] আ.ত.ম মুসেলেহউদ্দীন, আরবী সাহিত্যের ইতিহাস, পৃঃ ৩৯-৪১।
[11] প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪০।
[12] প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪২।
[13] প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪২।
[14] প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪২।
ALHAMDULILLAH. ……excellent post… I love this website.