একদিনতো জান্নাতে যাবোই!
একটা সময় ধারনা ছিল মুমিন যেহেতু একদিন না একদিন তো জান্নাতে যাবই! [যদিও প্রকাশ করা যায় না তবুও শয়তানের প্রচ্ছন্ন ওয়াস-ওয়াসায় ধোকা একটা আছেই] আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুক! কিভাবে এই চিন্তা করা সম্ভব। এমন না যে মৃত্যুর পরপরই জাহান্নাম আর তারপর কিছুদিন আজাব ভোগ করে এসে জান্নাত। কক্ষনও না। এমন নয়। ধরুন কেউ যদি জাহান্নামে কিছুক্ষন থেকে আল্লাহর দয়ায় জান্নাতে ফিরেও আসে তবুও তো তাঁকে এমন কয়েকটি ধাপ পেরোতে হবে যার একটি অন্যটি থেকে ভয়ংকর।
প্রথমেই মৃত্যু, যার ভয়াবহতাই জাহান্নমীদের জন্য যথেষ্ঠ। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন, “যিনি ছাড়া কোন রব নেই সেই আল্লাহর কসম, যদি আমার কাছে দুনিয়ার সকল স্বর্ণ এবং রৌপ্য থাকতো, আমি সেগুলোর বিনিময়ে হলেও মৃত্যুর পরে যে ভয়াবহতা রয়েছে তা থেকে বাঁচার চেষ্টা করতাম।” [সাহীহ আত-তাওতিক ফি সীরাত ওয়া হায়াত আল-ফারুক, পৃ ৩৮৩]
যারা পাপাচারী ব্যাক্তি এবং অবিশ্বাসী, সে যখন দুনিয়ার জীবন ত্যাগ করে আখিরাতের দিকে যেতে থাকবে, তখন মৃত্যুরঅন্ধকার ফেরেশতা খসখসে কফিন নিয়ে আগমন করবে যেটা আমদানি হয়েছে জাহান্নাম থেকে। তার পাশে এসে বসে মৃত্যুর ফেরেশতা বলবেন, “হে পাপী আত্মা! আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা’আলার ক্রোধ এবং রোষের দিকে ছুটে আস।” তাকে বলা হবে যে, যে তোমাকে এখনই আসতে হবে এবং তোমার জন্য আল্লাহর ক্রোধ অপেক্ষা করছে। যখন মৃত্যুর ফেরেশতা এই ঘোষণা করবে, তখন তার আত্মা দেহের মধ্যে ছুটে বেড়াবে আর সে বের হয়ে আসতে চাইবে না। মৃত্যুর ফেরেশতারা তখন তার আত্মাকে খপ করে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাবে, ভেজা পশমের মধ্য থেকে কাটাঁযুক্ত কিছুকে টেনে আনতে যেমন অবস্থা হয় তেমন। [আর-রুহ, ইমাম ইবনুল কায়্যুম]
মৃত্যুর ভয়াবহতা শেষ না হতেই কবরের নিঃসঙ্গতা ও ভয়ানক দুর্দশাগ্রস্থ জীবন। আপনার সাথে কেউ নাই, একা। কী দিন, কী রাত! সেখানে কেবল যন্ত্রনা আর যন্ত্রনা। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন- ‘আমি কবরের দৃশ্য থেকে অধিক ভয়ানক দৃশ্য কখনো দেখিনি। [তিরমিযী/২৩০৮ (হাসান)]
যখন তাকে কবরস্থ করা হয় তখন কবর তাকে বলে, তোমার আগমন খারাপ আগমন। আর জেনে রাখ, তুমি খারাপ জায়গায়ই এসেছো, আমার উপর চলাফেরাকারীদের মধ্যে তুমিই আমার সবচেয়ে বড় দুশমন ছিলে। আজ তোমাকে আমার কাছে অর্পণ করা হয়েছে, তুমি আমার আয়ত্তে এসে গেছ, এখন তোমার সাথে আমি কিরূপ ব্যবহার করি দেখে নাও। তারপর কবর তাকে এমনভাবে চাপ দেয় যে, তার ডান পাশের হাড় বাম পাশের হাড়ের ভিতর ঢুকে যায়। আল্লাহ তা’আলা তার জন্য সত্তরটি এমন অজগর সাপ নিযুক্ত করে দেন, যার একটিও যদি জমিনের বুকে শ্বাস ফেলে তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত জমিনে কোন কিছু উৎপন্ন হবে না। হিসাবের জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সাপগুলো তাকে কামড়াতে ও দংশন করতে থাকবে।’ [তিরমিযী/২৪৬০ (যয়ীফ)]
এই দীর্ঘ্য যন্ত্রনাময় জীবন শেষ হবে শিংগার বিকট শব্দে। রূহসমূহ মৌমাছির মতো বের হয়ে আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থান পূর্ণ করে দেবে। অতঃপর রুহসমূহ দেহে প্রবেশ করবে। কিয়ামত! মহান আল্লাহ বলেন,
শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, ফলে আসমান ও যমীনে যারা আছে সবাই বেহুঁশ হয়ে যাবে, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন। অতঃপর আবার শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দন্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে। [৩৯:৬৮]
অতঃপর হিসাবের জন্য হাশরের মাঠে অপমান আর লাঞ্চনার অপেক্ষা। “ইয়াওমুদ্দিন” অপরাধীদের দাড়ানোর কোন জায়গা থাকবে না, উপুর মুখে…আপনি চিন্তা করতে পারেন!
আর আমি কিয়ামতের দিনে তাদেরকে একত্র করব উপুড় করে, অন্ধ, মূক ও বধির অবস্থায়। তাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম; যখনই তা নিস্তেজ হবে তখনই আমি তাদের জন্য আগুন বাড়িয়ে দেব [১৭-৯৭]
এই ভীতিকর ও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পাপাচারী, জালেম, মুনাফিকদের দেখা যাবে অবনত মস্তকে, অপলক নেত্রে। আর তাদের অন্তর থাকবে শূন্য। সেদিন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না। সেদিন মানুষের হৃদয় থাকবে ওষ্ঠাগত, বিষন্ন। কিয়ামতের সে দিনটির দৈর্ঘ হবে পঞ্চাশ হাজার বছর। মহান আল্লাহ বলেন,
হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর। নিশ্চয় কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা দেখবে সেদিন প্রত্যেক স্তন্য দানকারিণী আপন দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভধারিণী তার গর্ভপাত করে ফেলবে, তুমি দেখবে মানুষকে মাতাল সদৃশ, অথচ তারা মাতাল নয়। তবে আল্লাহর আযাবই কঠিন। [২২; ১-২]
আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন: ‘কিয়ামতের দিন মানুষ ঘামতে থাকবে। এমনকি তাদের ঘাম যমীনের সত্তর গজ নীচ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। আর তা তাদেরকে বাকরুদ্ধ করে দেবে এবং তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছে যাবে [বুখারী/৬৫৩২]
অতঃপর মহান আল্লাহ ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করবেন। ছোট বড় কিছুই সেদিন বাদ যাবে না, মহান আল্লাহ বলেন,
আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম হবে না। যদি কোন আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্যে আমিই যথেষ্ট। [২১-৪৭]
রসুলুল্লাহ (স) বলেন, তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে আল্লাহ তাআলা সরাসরি কথা বলবেন, মাঝখানে কোনো দোভাষী থাকবে না। তখন সে তার ডান দিকে তাকাবে এবং সেখানে সে তার কৃত আমল ছাড়া আর কিছুই দেখবে না। সে বাম দিকে তাকাবে, সেখানেও সে তার কৃত আমল ছাড়া অন্যকিছু দেখবে না। সে তার সামনের দিকে তাকাবে এবং আগুন ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। সুতরাং আগুন থেকে বাচোঁ যদিও শুকনো খেজুরের এক টুকরো অথবা একটি ভালো কথা ব্যয় করে হয়’ [মুসলিম/১০১৬]
সেখানে মানুষের আমলনামা প্রকাশ করা হবে লিখিত আকারে, আড় চোখের দৃষ্টিও যে সেদিন ফিরে আসবে মহা দুঃসংবাদ হয়ে..
আর আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে; তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবেঃ হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা। এ যে ছোট বড় কোন কিছুই বাদ দেয়নি-সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারও প্রতি জুলুম করবেন না। [১৮-৪৯]
হিসাবের পর আপনাকে মুখোমুখি করা হবে পুলসিরাতের। পুলসিরাতের উপর দিয়ে সকলকেই অতিক্রম করতে হবে। নেককার বিদ্যুৎ, বাতাস ও দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে তা পার হয়ে যাবে। কেউ পার হবে সম্পূর্ণ নিরাপদভাবে। কেউ সামান্য আঁচড় খেয়ে। কেউ আহত হয়ে। আর কেউ হুমরী খেয়ে পড়ে যাবে জাহান্নামে। এমনকি সর্বশেষ ব্যক্তিকে টেনে টেনে নেয়া হবে। সাহাবী আবু সাঈদ রাযি. বলেন,‘পুলসিরাত হবে চুলের চেয়েও চিকন, তরবারির চেয়েও ধারালো।
এরপর সেই জাহান্নাম যেখানে ঘুরে আসার প্লান নিয়ে দিনের পর দিন পার হয়ে যাচ্ছে!
যার আমলনামা তার বাম হাতে দেয়া হবে সে বলবে, ‘হায়, আমাকে যদি আমার আমলনামা দেয়া না হত’! ‘আর যদি আমি না জানতাম আমার হিসাব’! ‘হায়, মৃত্যুই যদি আমার চূড়ান্ত ফয়সালা হত’! ‘আমার সম্পদ আমার কোন কাজেই আসল না!’ আমার ক্ষমতাও আমার থেকে চলে গেল! (বলা হবে) ‘তাকে ধর অতঃপর তাকে বেড়ি পরিয়ে দাও।’ ‘তারপর তাকে তোমরা নিক্ষেপ কর জাহান্নামে’। [৬৯;১৯-৩১]
এখনও কি জাহান্নামের ঝুকি নিয়ে আগামীকাল থেকে প্লান? কক্ষনো নয়। আল্লাহ্ আমাদের সকল প্রকার সীমালঙ্ঘন থেকে হেফাজত করুক। আমীন।
এ সম্পর্কিত ছোট ভিডিও