বায়ান্ন

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

সামনে একুশে ফেব্রুয়ারি। কারো কাছে সেটা শহীদ দিবস, কারো কাছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, কারো কাছে কোনো দিবসই নয়—ঢাকার রাস্তায় রঙ্গ দেখার দিন মাত্র। বিশে ফেব্রুয়ারি রাত কিংবা একুশ তারিখের প্রভাতফেরিতে যাওয়া মানুষগুলোকে যদি কাছ থেকে কেউ দেখেন তবে তাদের মধ্যে দুটি শ্রেণি পাওয়া যাবে। একটি আদর্শিক, অপরটি চামবাজ সুবিধাবাদী রাজনীতিজীবি। বিরানিখেকো শাহবাগিদের নিয়ে আলাপ না করি, মূল্যবোধের মূল না থাকায় এরা শ্যাওলাসম। তবে বুকের ভেতর আদর্শধারী যেসব মানুষ তাদের কার্যকারণ ব্যবচ্ছেদের সৎ সাহস রাখেন তাদের জন্য কিছু ভাবনার খোরাক রইল সামনে।

ভাষা ভাববিনিময়ের মাধ্যম। ভাষার সূচনা আদিতে আদমে, আলাইহি ওয়া সাল্লাম । আল্লাহ তাঁকে শিখিয়েছিলেন সবকিছুর নাম[1]। শিখিয়েছিলেন কথা বলতে।

আদম (আ:)  যেমন আমাদের প্রথম পুরুষ তেমন তাঁর ভাষাটিও আমাদের প্রথম ভাষা। তার সন্তানেরা যেমন হরেকরকমের, তেমন তাদের কথ্যগুলো। ভাষা শেখার প্রক্রিয়া শুরু হয় মাতৃগর্ভে। মানুষ মানুষকে পড়তে বা লিখতে শেখায়, কিন্তু কথা বলতে শেখান আল্লাহ। সূরা আর-রাহমানে আল্লাহ সুবহানাহু আমাদের জানাচ্ছেন তিনি আর-রাহমান—তিনি কুরআন শিখিয়েছেন। খ্বলাক্বাল ইনসান-‘আল্লামাহুল বায়ান—তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন ও তাকে ভাষা শিখিয়েছেন। কুরআন তিনি সবাইকে শেখাননি তবে সব মানুষকেই ভাষা শিখিয়েছেন—এমনকি মূকদেরও যোগাযোগের নিজস্ব সংকেত রয়েছে। এই ভাব বিনিময়ের সুযোগ তাঁর দয়াগুলোর মধ্যে অন্যতম। সভ্যতার সূচনা হয় যে দয়া থেকে সেটা সূরা আর-রাহমানে উল্লেখ করার পরে মোট ৩৮ বার ঐ সূরাটিতেই আল্লাহ আমাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করেছেন, তাঁর কোন নিয়ামাতটিকে আমরা অস্বীকার করতে পারি?

মানুষের মতো ভাষারও নানান পরিবার আছে। যেমন : প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় নামে অতীতে একটি ভাষা ছিল। তার অনেক সন্তানের মধ্যে দুটি হলো প্রোটো-জার্মানিক আর ল্যাটিন। ল্যাটিনের উত্তরসূরীদের মধ্যে আছে ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ আর ইটালিয়ান। ওদিকে ইংরেজি, জার্মান, ডাচ, সুইডিশ ভাষাগুলো এসেছে প্রোটো-জার্মানিক থেকে। এই ভাষা পরিবারগুলোর মধ্যেও অনেক লেন-দেন, শব্দ চালাচালি হয়েছে। এরপরেও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে তাদের মূলের সন্ধান পাওয়া যায়। ভাষার বিবর্তনের এই ইতিহাস মানুষের বিবর্তনের মতোই—এক জোড়া মানব-মানবী থেকে হাজারো জাতের উৎপত্তি।

ভাষার এত প্রকারভেদ কেন? আমাদের রব্ব চাইলে কী পৃথিবীর সব মানুষের মুখের রব একরকম করে দিতে পারতেন না? অবশ্যই পারতেন, কিন্তু করেননি। কেন করেননি? যাতে আমরা চিন্তা করি। তিনি এ ব্যাপারে আমাদের চিন্তা করতে বলেছেন। ভাষাবিদদের বলেছেন, ভাষার এই তারতম্যটা আল্লাহর একটা আয়াত—নিদর্শন।[2] একই আয়াতে নৃতাত্ত্বিকদের বলেছেন, তোমরা তো জ্ঞানী—এই যে মানুষের চামড়ার রঙের এত বৈচিত্র্য—তাও একটা আয়াত—আল্লাহর অসীম ক্ষমতার সামান্য একটা নিদর্শন। মজার ব্যাপার হচ্ছে মানুষের ভাষা আর জীনগত বৈশিষ্ট্য (যা আরো অনেক কিছুর সাথে সাথে মানুষের গায়ের রঙ নির্ধারণেও ভূমিকা রাখে) দুটোই মানুষ উল্লম্বভাবে (vertically) বাবা-মায়ের কাছ থেকে পায়। ভাষার পরিবর্তন হয় অনুভূমিক আদান-প্রদানে (horizontally) যেখানে জনগোষ্ঠীর ভাষা ব্যক্তির ভাষাকে প্রভাবিত করে।

একই কারখানা থেকে একই ছাঁচে তৈরি সব পুতুল একরকমের দেখতে হয়। পেটে ব্যাটারিওয়ালা পুতুলগুলো যখন শব্দ করে, একরকমেরই হয়। একই রকমের সার্কিট—একই রকম শব্দ। কিন্তু আল্লাহর তৈরি একেকটা মানুষ একেকরকম। একেকটা জাত একেকরকম। একটা জাত থেকে আরেকটা জাতের পার্থক্য করা যায় সহজেই। আবার একটা জাতের ভেতরকার সদস্যদেরও আলাদা করা যায়। বাংলাদেশিরা বাংলা বলে, অ্যামেরিকানরা ইংরেজি। হিলটি-চাটগাঁইয়া-অংপুরিয়া-ঢাকাইয়া সবাই বাংলা বলে অথচ তাতে কী আকাশ-পাতাল তফাত! তফাত আছে বোস্টনের ইংরেজি আর শিকাগোর ইংরেজিতে। ইস্ট কোস্ট-ওয়েস্ট কোস্টে স্ট্যান্ডার্ড ইংলিশ যে কতটা বদলে যায় তা কানে না শুনলে বিশ্বাস হয় না। মানুষের সৃষ্টিতে বৈচিত্র্য নেই—আল্লাহর সৃষ্টিতে আছে এটাই আল্লাহর নিদর্শন।

ভাষা কীভাবে বদলে যায় তা নিয়ে সোশিও-লিঙ্গুইস্টদের গবেষণার অন্ত নেই। শব্দের ব্যবহার বদলায়, নতুন পদ আসে, পুরনো শব্দ হারিয়ে যায়। শত বছরের ব্যবধানে শব্দের অর্থ যায় বদলে। পরিবর্তন আসে বাক্যের গঠনে—ব্যাকরণে। এমনকি মানুষের মুখের ধ্বনিও থাকে না আগের মতন।[3] পরিবর্তন হওয়ার জন্য যে প্রজন্ম ধরে অপেক্ষা করতে হবে এমনটিও নয়। ভাষাবিদ জে কে চেম্বার্স কানাডার অন্টারিওর মানুষদের নিয়ে করা এক গবেষণা শেষে বলেছেন একই মানুষ বিভিন্ন বয়সে একই ধ্বনি বিভিন্নভাবে বলে।[4]

ডায়লেক্টলজি নামে একটা বিষয়ই আছে যাদের আলাপের কেন্দ্র—ভৌগলিক অবস্থান কেমন করে ভাষার পরিবর্তন আনে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির এভোল্যুশনারি বায়োলজিস্ট সহিনি রামাচন্দ্রন দেখিয়েছেন কীভাবে ভৌগলিক দূরত্ব, এমনকি ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য যেমন নদী-নালা, পাহাড়, মাটির ধরণ, বন ইত্যাদি কীভাবে মানুষের ভাষার বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে। ভূগোলের এই প্রভাব কিন্তু মানুষের জেনেটিক গড়নের উপরেও একই রকম প্রভাব রাখে। মানুষের জীন আর ভাষার মধ্যে যে একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে সেটা টের পেয়েছি আমরা আজকে! অথচ আল্লাহ সুবহানাহু সূরা আর রুমের একই আয়াতে একই সাথে দুটো বিষয়ের উল্লেখ করে আমাদের চিন্তার খোরাক দিয়েছিলেন কতশত বছর আগে! আয়াতটি শেষও তিনি করেছেন জ্ঞানীদের কথা উল্লেখ করে—এভোল্যুশনারি জেনেটিক্স নিয়ে গবেষণা তো আর যার-তার কম্মো নয়।

আল্লাহ সুবহানাহু যখন কোনোকিছুর দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, সেটা তাঁর আয়াত বলে ঘোষণা দেন—তখন আমরা ব্যাপারটাকে সম্মানের চোখে দেখি। ভাষার বিভিন্নতা মশকরার ব্যাপার নয়। একেক দেশের একেক বুলি জাতীয়তাবাদ প্রচারের অস্ত্র নয়। আমি উন্নত, তুমি ছোট—এহেন নাক সিঁটকানোর নিমিত্তে আল্লাহ তাঁর আয়াত পাঠাননি। তথাকথিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস থেকে কেমন যেন বিভাজনের গন্ধ আসে। সব ভাষাই যে সে ভাষাভাষীর আপন, ভালোবাসার—সে স্বাদ দিবসভিত্তিক ভাষা-ভালোবাসাতে পাওয়া যায় না। সে স্বাদ পাওয়া যায় আল-কুরআনে। আল্লাহ যখন বলেন তিনি প্রত্যেক জাতির কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন তাদের মুখের ভাষাতেই।[5] কিন্তু দুঃখ লাগে যে শহীদ দিবসের আলাপনে আল্লাহ কোথাও আসেন না। মাতৃভাষা দিবসে কুরআনের কোনো স্থান নেই। মিনার পূজাতে শুরু—হাত ধরাধরি হয়ে সাদা-শাড়ি-কালো-পাড়ের ব্যবসাতে শেষ। ভাষার স্রষ্টা কী চেয়েছিলেন সে সংলাপ বাঙালি ধর্মের ধুন্ধুমারে হারিয়ে গেছে।

মাথামোটা পাকিস্তানিরা যে উর্দুকে আমাদের উপরে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল সেটার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। আর জোর করে কোনো জিনিস চাপানো যায় না। ভাষাটা মনের ভাবের বাহন। মন থেকে টান না থাকলে মানুষ সে ভাষায় কথা কইবে কেন? আজকালকার বাচ্চারা যে হিন্দিতে বাৎচিত করে সেটা কী কোনো সরকারি প্রজ্ঞাপনের ফসল? সরকার আকাশ থেকে সংষ্কৃতির বর্ষণকে উন্মুক্ত করে দেবে, বাবা-মায়েরা দরজা খুলে টিভীষণকে ঘরে বিদ্যুধ-কলা দিয়ে পুষবে—আর সবাই আশা করতে থাকবে যে শিশুরা শান্তিনিকেতনী বাংলা বলবে—এ তো পাগলের স্বপ্ন!

ভাষা শেখার জিনিস, শেখানোর জিনিস। সুলাইমান এর মতো নবীকেও পাখির ভাষা শেখানো হয়েছিল[6]—ইতর প্রাণীর ভাষা তকমা লাগিয়ে তা অবহেলা করা হয়নি। ভাষার প্রতি ভালোবাসাকে শুধু আবেগ দিয়ে আটকে দিলে হয় না। শব্দ নিয়ে খেলা ভারী মজার ব্যাপার—করাটাও মজার, বোঝাটাও মজার। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতায় আনন্দলাভের এই তরিকাগুলো হারিয়ে গেছে। জিহবার কেরামতি এখন ফুল দিয়ে ফেরার পথে শাহবাগে চটপটি চাখাতেই সীমাবদ্ধ। ফাল্গুনকে ছাপিয়ে ফেব্রুয়ারির বড় হয়ে ওঠাই সম্ভবত একুশে ফেব্রুয়ারির সবচেয়ে বড় পরাজয়।

একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত অর্থহীন আনুষ্ঠনিকতার আয়োজন হয়—একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে তার ঘোর বিরোধীতা করা আমাদের কর্তব্য। এর পথ ধরে শির্ক আসে—প্রাণহীন বেদীকে সম্মান দেখানোর শির্ক। মৃতদের স্মরণে ভাস্কর্য, সৌধ, মিনার নির্মাণ—সবই প্রশংসা ও স্মরণের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি এবং শির্কের দরজা[7]। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশে যে মূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছিল একদিন আজ সেটা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে গেছে। ১৯৫২-২০১৫ এই সময়ের ব্যবধানে এখন মানুষকে নগ্নপদে করজোরে মিনারের সামনে নতজানু অবস্থায় দেখা যায়। হিন্দু পূজার অনুকরণে ফুলের সমারোহ দেখা যায়। কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত অপব্যয় চলে। এসব অর্থহীন প্রথা না রফিক-সালাম-জব্বারের কবরে কোনো খুশখবর নিয়ে যায়, না ডোরিমগ্ন বাঙ্গাল শিশুদের বিশুদ্ধ কথন শিক্ষা দেয়। অক্ষরের আলপনায় দেয়াল সয়লাব হয়, আর নিরক্ষর পথশিশুরা সেই দেয়ালের ধারে বস্তা পেতে ঘুমিয়ে থাকে। সিমেন্টের বেদীর উপরের ফুলের সমারোহ আর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গান মাটির তলায় পচে যাওয়া মানুষগুলোর কী লাভ ডেকে আনে তা চিন্তা করার ফুরসত মেলে না কারো। বাগান থেকে চুরি করে হলেও নাকি ফুল দিতে হবে—এটাই নাকি শ্রদ্ধার রীতি।

পূজার প্রসাদের প্রথাটা নীতিগতভাবে প্রপঞ্চময়। মাটির মূর্তি কিংবা লাল সালুর মাজার—যেখানেই যে অর্ঘ্য দেওয়া হোক না কেন, যাদের উদ্দেশ্যে তা দেওয়া হচ্ছে সেগুলো তারা গ্রহণ করতে পারে না। কাঁচা টাকা, প্রসাদ, শিন্নি সবগুলোই তাই ঠাকুর কিংবা খাদেমের ঘরে ঠাঁই পায়। পেট পূজোই প্রধান, পূণ্যকর্ম পণ্যার্জনের উপলক্ষ্য মাত্র। অর্থনীতির সূত্র মাফিক চিন্তা করলে একুশে ফেব্রুয়ারির মিনারপূজো বড় হতাশার। শ্রদ্ধামিশ্রিত কোটি টাকার ফুলের শ্রাদ্ধ হয় নির্মম অশ্রদ্ধায় ভাগাড়ে—বাচ্চাদের  হাগুর ডায়াপার, গৃহস্বামীর ছুড়ে ফেলা ব্যবহৃত চুপসানো বেলুন আর হেঁসেলের আবর্জনার সাথে। ফুলগুলো না ঘর সাজায় না সুবাস দেয়। নীতিহীন পেটপূজারিদের পেট সামান্যতম ভরতে পারলেও হয়ত কিছুটা যৌক্তিকতা পাওয়া যেত।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কম-বেশি আমাদের জানা। যে মানুষগুলো সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমেছিল তাদের একটা আদর্শগত অবস্থান ছিল। স্বেচ্ছাচারীরা আদর্শিক দ্বন্দ্বকে সহ্য করে না। তাদের অসহনশীলতা সময়ে সময়ে মাত্রা এতটাই অতিক্রম করে যে গণজমায়েতে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে। মিছিলে গুলির  ঘটনা আমরা বর্তমানেও দেখি। শাপলা চত্বরে ব্ল্যাক আউট করে মানুষ মারার ঘটনা আমাদের নিজেদের চোখের সামনে দেখা। তবে বায়ান্নর ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নেইনি। গণদাবীকে গুলি করে দমানো যায় না। গুলি যাদের শরীরে লেগেছে তাদের সংখ্যা হয়ত হাতে গোণা যায়, তবে গুলি মনে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে সেটা দেখাও যায় না, গোণাও যায় না। বায়ান্নর পথ ধরে যদি একাত্তর আসে তবে ২০১৩ এর পথ ধরে ইসলাম অবমাননার রাষ্ট্রীয় কৃষ্টির বিলাপ একদিন ঘটবেই। সে বিপ্লবে কেউ সামনে এগিয়ে শ্রদ্ধেয় হবে, কেউ বিরোধীতা করে ঘৃণিত হবে।

বায়ান্নতে যারা শাসকদের বন্দুকের মুখেও আদর্শের দাবীতে আপন দাবীটি তুলেছিল তাদের আমরা শ্রদ্ধা করি। শ্রদ্ধা অন্তরমহলের ব্যাপার। সেখানে কারু জোর চলে না। এর উৎস কৃতজ্ঞতা। কোনো মানুষ যখন আমার জন্য এমন কিছু করে যেটা তার না করলেও চলত তখন সেই মানুষটির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আসে। যখন সেই মানুষটি আমার মতো অনেক মানুষ তথা সমাজের কল্যাণে এমন কিছু করে যেটা আমি মনে মনে করতে চেয়েছি কিন্তু করার সামর্থ্য রাখি না তখন সেই সাড়ে তিন হাত দেহের ব্যক্তিত্বটিকে পাহাড়ের মতো বড় মনে হয়। এটাই শ্রদ্ধা। যে বিশ পেরুনো তরুণটা লেপের ওম ছেড়ে একাত্তুরে পাকিদের উন্মত্ততা প্রতিরোধে জল-কাদায় নেমেছিল তাকে আমরা শ্রদ্ধা করি। যারা জীবন দিয়েছিল তাদের শ্রদ্ধা করি। যারা যুদ্ধের পরে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট বিক্রি করে পেট চালায়নি তাদেরও শ্রদ্ধা করি। শ্রদ্ধা করি আজকের দিনেও যারা দখলদার সন্ত্রাসী রাষ্ট্রযন্ত্রের মারণাস্ত্রের বিপরীতে তুচ্ছ সম্বল নিয়ে প্রতিরোধে নামে। সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, চেচনিয়, কাশ্মীর, বার্মা… শ্রদ্ধা আসে আত্মত্যাগের বিনিময়ে। ভোজনবিলাসীরা আমাদের জ্ঞাতিভাই। আর আদর্শ বিক্রি করে যারা তারা নিরেট ঘৃণার পাত্র। চেতনার বাণী, ওঝা মন্ত্র, মিলাদের কাসিদা… পেটের তাগিদের ভাই-বেরাদর।

মানব মননে আবেগ আর কর্তব্যবোধের একটা দ্বন্দ্ব দেখা যায় প্রায়শই। এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। পরিপূরক হওয়ার বদলে আবেগ যখন কর্তব্যবোধের বিকল্প হয়ে দাঁড়াল তখন শ্রদ্ধা শ্রদ্ধাপ্রকাশের একটি আনুষ্ঠানিকতায় রূপান্তরিত হয় মাত্র। এতে মানুষ প্রচুর আত্মতৃপ্তি লাভ করলেও শুরুর সেই আদর্শের আর কোনো প্রকৃত ধারক-বাহক থাকে না। একে আদর্শটির মৃত্যু বলা চলে। আদর্শের গড়ে ওঠা কিংবা টিকে থাকার রসদ যোগায় মানুষের আত্মত্যাগ। আর আনুষ্ঠানিকতা যে আত্মত্যাগের দ্বার বন্ধ করে দেয় তা সর্বজনবিদিত। এজন্য সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, নেমপ্লেট ও গাড়ির নম্বর প্লেটে বাংলা লেখার জন্য হাইকোর্ট থেকে আদেশ দেওয়া সহজ; কঠিন নিজের ছেলেটাকে বাংলা মাধ্যমে পড়ানো। পরিহাস বোধহয় এটাই যে এতসব ‘বোর্ড’ ও ‘প্লেট’কে বাংলা করতে বলা হচ্ছে অথচ সেগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ রায়তে ঠাঁই পায়নি।

বায়ান্নর চেতনা যদি কেউ সত্যি ধারণ করতে চান তাহলে রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। শাসনযন্ত্রের অন্যায়ে তাল দেওয়া আর তেল মারা যদি আদর্শ হতো তাহলে বায়ান্নতে কাউকে মরতে হতো না। মানুষের ন্যায্য দাবীটাকে বুঝে সেটার পক্ষে দাঁড়াতে হবে। ভাষা যে আল্লাহর দান, একটি নিদর্শন সেটা যদি আমরা নাই বুঝি, সেটা নিয়ে না চিন্তা করি, ভাষা-ভাবনা যদি আমাদের আল্লাহর কাছাকাছি না-ই নেয়, তাহলে মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠান দিবসকেন্দ্রিক ভণ্ডামি মাত্র। এতে কোনো মঙ্গল নেই। মিনার পূজা জাহান্নামে যাওয়া আর নেওয়ার উপলক্ষ্য মাত্র। সব দেবতার দশটা হাত থাকে না, আঁকা চোখ-মুখ থাকে না। বিমূর্ত স্থাপত্যের উপাসনা প্রতিমা পূজার চেয়ে ক্ষতিকর—এতে মানুষ তার স্খলনের তীব্রতা অনুভব করতে পারে না।

আল্লাহ যেন আমাদের তাঁর নিদর্শনগুলো বোঝার তাওফিক দেন, তাঁর দানগুলোর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ দেন। তিনি যেন বায়ান্নতে নিহত মানুষগুলোকে ক্ষমা করে দেন, তাদের জান্নাত দান করেন। তিনি যেন আমাদের মানবরচিত ধর্ম ছেড়ে তাঁর প্রকৃত দ্বীন—ইসলামে ফিরে আসার তাওফিক দেন। আমীন।

৩০শে রবিউস সানি, ১৪৩৬ হিজরি।

[1] সূরা আল-বাকারাহ, (২:৩১)

[2] সূরা আর-রুম, (৩০:১২)

[3] http://www.linguisticsociety.org/resource/language-variation-and-change

[4] Chambers, J.K. (1995). Sociolinguistic Theory, Oxford: Blackwell.

[5] সূরা ইব্রাহিম, (১৪:৪)

[6] সূরা আন-নামল, (২৭:১৬)

[7] কালিমা তায়্যিবা, অধ্যায় ১২—মুহাম্মাদ নাসিল শাহরুখ।

সুত্র

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member