চারটি মূলনীতি
আরশে আযীমের প্রতিপালক মহান আল্লাহর নিকট দুআ করি, তিনি যেন আপনাকে দুনিয়া ও আখেরাতে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন,আপনাকে বরকতময় করেন আপনি যেখানেই অবস্থান করুন না কেন, আপনাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যাকে কিছু প্রদান করা হলে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, পরীক্ষায় পড়লে ধৈর্য ধারণ করে এবং গুনাহ করলে ক্ষমা প্রার্থনা করে। কারণ এই তিনটি বিষয় হচ্ছে সৌভাগ্যের প্রতীক।
জেনে নিন-আল্লাহ আপনাকে তাঁর আনুগত্যের পথ দেখাক- নিষ্ঠাবান মিল্লাতে ইব্রাহীম হচ্ছে, আপনি এক আল্লাহর ইবাদত করবেন নিষ্ঠার সাথে। আর আল্লাহ তাআ’লা সকল মানুষকে এরই আদেশ করেছেন এবং এর কারণে তাদের সৃষ্টি করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন :
وَ مَا خَلَقْتُ الجنَّ والإنْسَ إلاّ لِيَعْبُدُونِ
“আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করিনি কিন্তু আমার ইবাদতের উদ্দেশ্যে।” [যারিয়াত/৫৬]
অতঃপর যখন জানতে পারলেন যে, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে তাঁর ইবাদতের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, তখন এটাও জেনে নিন, যে তাওহীদ ব্যতীত ইবাদত, ইবাদত হিসেবে গণ্য নয়, যেমন পবিত্রতা ব্যতীত নামায, নামায হিসাবে গণ্য নয়। ইবাদতে শিরক প্রবেশ করলে তা নষ্ট হয়ে যায়, যেমন পবিত্রতার পর বায়ু নির্গত হলে তা বিনষ্ট হয়।
অতঃপর যখন জানলেন যে, যখন ইবাদতে শিরকের সংমিশ্রণ হয় তখন আমলকে নষ্ট করে দেয় এবং সে ব্যক্তি চিরস্থায়ী জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তাই এই বিষয়টি জানা জরুরী যেন আল্লাহ আপনাকে এই বেড়াজাল থেকে মুক্তি দেন। আর তা হচ্ছে আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন করা যার সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
إنَّ اللهَ لا يَغْفِرُ أن يُشْرَكَ بِهِ ، و يَغْفِرُ مَا دُونَ ذالكَ لِمن يشاَءُ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে অংশী স্থাপন করলে তাকে ক্ষমা করবেন না এবং তদ্ব্যতীত যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন।” [ নিসা/৪৮]
আর এটা চারটি মূলনীতি জানার মাধ্যমে হবে, যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাবে বর্ণনা করেছেন :
প্রথম মূলনীতি: জানা প্রয়োজন যে, ঐ সমস্ত কাফের যাদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধ করেছিলেন, তারা স্বীকার করত যে আল্লাহ তায়ালাই সৃষ্টিকর্তা এবং পরিচালক। তবুও এই স্বীকারোক্তি তাদের ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশ করায় নি।এর প্রমাণে আল্লাহর বাণী:
قُلْ مَن يَرزُقُكُمْ من السماءِ والأرْضِ أمّن يملكُ السمْعَ والأبْصارَ وَ مَن يُخْرِجُ الحَيَّ مِنَ المَيِّتِ وَيُخْرِجُ المَيِّتَ مِنَ الحَيِّ وَ مَن يُدَبِّرُ الأمْرَ ، فَسَيَقُولُونَ اللهُ ، فَقُلْ أفَلا تَتَّقُونَ
“তুমি বল : তিনি কে, যিনি তোমাদেরকে আসমান ও জমিন হতে রিজিক দিয়ে থাকেন? অথবা কে তিনি, যিনি কর্ণ ও চক্ষুসমূহের উপর পূর্ণ অধিকার রাখেন? আর তিনি কে, যিনি জীবন্তকে প্রাণহীন হতে বের করেন, আর প্রাণহীনকে জীবন্ত হতে বের করেন? আর তিনি কে যিনি সমস্ত কাজ পরিচালনা করেন? তখন অবশ্যই তারা বলবে যে, আল্লাহ। অতএব, তুমি বল: তবে কেন তোমরা (শিরক হতে) বিরত থাকছ না? ” (সূরা ইউনুস: ৩১)
দ্বিতীয় মূলনীতি: তারা বলে: আমরা তাদের নিকট প্রার্থনা করি না এবং তাদের শরণাপন্ন হই না কিন্তু নৈকট্য এবং সুপারিশ পাওয়ার আশায়।
নৈকট্যের প্রমাণে আল্লাহর বাণী :
وَالذيْنَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِه أولِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إلاَّ لِيُقَرِّبُوْنَا إلى اللهِ زُلْفَى إنَّ اللهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيْهِ يَخْتَلِفُوْنَ ، إنَّ اللهَ لا يَهْدِى مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ
“যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করে, (তারা বলে) আমরা তো এদের পূজা এজন্যেই করি যে, এরা আমাদের আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দিবে। তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে আল্লাহ তার ফায়সালা করে দিবেন । যে মিথ্যাবাদী ও কাফির , আল্লাহ তাকে সৎ পথে পরিচালিত করেন না।” [জুমার/৩]
শাফায়াতের প্রমাণে আল্লাহর বাণী : “আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন বস্তুসমূহেরও ইবাদত করে যারা তাদের কোন অপকারও করতে পারে না এবং তাদের কোন উপকারও করতে পারে না, আর তারা বলে: এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশ কারী ।” [ ইউনুস/১৮]
সুপারিশ বা শাফাআত দুই প্রকার। যথা: ক) অস্বীকৃত খ) স্বীকৃত।
ক- অস্বীকৃত সুপারিশ হচ্ছে, যা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট চাওয়া হয়, যার ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নেই। যেমন আল্লাহ বলেন:
يأيُّها الذيْنَ آمَنوا أنْفِقُوا ممَّا رَزَقْناكُمْ مِنْ قَبْلِ أن يأتِيَ يَومٌ لا بَيْعٌ فيْهِ وَ لا خُلَّةٌ وَ لا شَفَاعَةٌ والكَافِرُونَ هُمُ الظّالِمُونَ
“হে বিশ্বাসীগণ! আমি তোমাদেরকে যে জীবিকা দান করেছি, তা হতে সে সময় আসার পূর্বে ব্যয় কর যাতে ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ নেই, আর কাফেররাই অত্যাচারী।” [ বাক্বারাহ: ২৫৪]
খ- স্বীকৃত সুপারিশ হচ্ছে, যা আল্লাহর কাছে চাওয়া হয়। সুপারিশ কারী সুপারিশের মাধ্যমে সম্মানিত। সে হবে সেই ব্যক্তি যার কথা ও কাজ থেকে আল্লাহ সন্তুষ্ট। অনুরূপ সে এমন হবে যাকে সুপারিশের জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআ’লা বলেন :
مَنْ ذَا الذي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إلا بِإذْنِهِ
“এমন কে আছে যে অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে?” বাক্বারাহ/২৫৫]
তৃতীয় মূলনীতি: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আগমন ঘটে এমন লোকদের মাঝে যারা তাদের ইবাদতে এক ছিল না; বরং তাদের মধ্যে কেউ ফেরেশতার ইবাদত করতো, কেউ নবী ও সৎ লোকদের ইবাদত করতো, কেউ গাছ-পালা ও পাথরের পূজা করতো এবং কেউ সূর্য ও চন্দ্রের ইবাদত করতো। আর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পার্থক্য ছাড়াই এদের সবার সাথে যুদ্ধ করেন। এর প্রমাণে আল্লাহর বাণী: তোমরা “সদা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিতনার অবসান হয় এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্যেই হয়ে যায়।” [ আন্ ফাল/৩৯]
সূর্য চন্দ্রের ইবাদতের প্রমাণে : আল্লাহ বলেন :
وَ مِنْ ءَايَاتِهِ الَّيْلُ والنَّهَارُ والشَّمسُ والْقَمَرُ لا تَسْجُدُوا للشَّمْسِ وَ لا للقَمَرِ واسْجُدُوا للهِ الذي خَلَقَهُنَّ إنْ كُنْتُمْ إيّاهُ تَعْبُدُونْ
“তাঁর নিদর্শনা বলীর মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন, সূর্য ও চন্দ্র । তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, চন্দ্রকেও না; সিজদা কর আল্লাহকে, যিনি এইগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত কর।” [ হা মীম সাজদা/৩৭]
সেকালে ফেরেশতার ইবাদতের প্রমাণে আল্লাহ বলেন :
وَ لا يأمُرُكُمْ أنْ تَتَّخِذُوا المَلائِكَةَ والنَّبِيّيْنَ أرْبَاباً
“আর তিনি আদেশ করেন না যে, তোমরা ফেরেশতাগণ ও নবীগণকে প্রতিপালক রূপে গ্রহণ কর।” [ আল্ ইমরান/৮০]
নবীগণের ইবাদতের দলীল: আল্লাহ বলেন: “আর যখন আল্লাহ বলবেন, হে মারইয়ামের পুত্র ঈসা! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলে তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার মাতাকে মা’বূদ বানিয়ে নাও ? ঈসা নিবেদন করবেন আমি তো আপনাকে পবিত্র মনে করি; আমার পক্ষে কোনক্রমেই শোভনীয় ছিল না যে, আমি এমন কথা বলি যা বলবার আমার কোনই অধিকার নেই; যদি আমি বলে থাকি, তবে অবশ্যই আপনার জানা থাকবে; আপনি তো আমার অন্তরের কথাও জানেন, পক্ষান্তরে আপনার অন্তরে যা কিছু রয়েছে আমি তা জানি না; সমস্ত গায়েবের বিষয় আপনিই জ্ঞাত।” [ আল্ মায়েদা/১১৬]
নেক লোকদের ইবাদতের প্রমাণস্বরূপ আল্লাহর বাণী :
أولئك الذينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إلى رَبِّهمُ الوَسِيْلَةَ أيُّهُمْ أقْرَبُ وَ يَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَ يَخافُونَ عَذابَه
“ তারা যাদের আহ্বান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে তাদের মধ্যে কে কত নিকট হতে পারে, তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করে।” [ ইস্ রা/৫৭]
গাছ-পালা ও পাথরের ইবাদতের দলীল। আল্লাহ বলেন :
أفَرأيْتُمُ اللاتَ والْعُزَّى ، والْمَنَاتَ الثّالِثَةَ الأخْرَى
“তোমরা কি ভেবে দেখেছো ‘লাত’ ও ‘উযযা’ সম্বন্ধে এবং তৃতীয় আরেকটি ‘মানাত’ সম্বন্ধে?” [নাজম/১৯-২০]
এ প্রসঙ্গে ওয়াকিদ লায়সী (রাযিঃ) এর হাদীস, তিনি বলেন: আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সঙ্গে হুনাইনের যুদ্ধে বের হলাম আমরা তখন নূতন মুসলমান ছিলাম।সেকালে মুশরিকদের একটি কুল-বৃক্ষ ছিল, যার পার্শ্বে তারা অবস্থান করতো এবং তাতে তাদের অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখতো। ওটাকে বলা হত ‘যাতু আন্ওয়াত্’ (বরকতের গাছ)। আমরা এই ধরনের এক কুল-গাছের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম। আমরা আল্লাহর রাসূলকে বললাম : হে আল্লাহর রাসূল ! আমাদের জন্যও একটি ঝুলিয়ে রাখার বৃক্ষ নির্ধারণ করে দিন যেমন তাদের রয়েছে ..।
চতুর্থ মূলনীতিঃ আমাদের যুগের শিরক কারীরা পূর্বের যুগের শিরক কারীদের থেকে অধিক কঠোর। কারণ পূর্বের লোকেরা সুখ-সচ্ছলতার সময় শিরক করতো আর দুঃখের সময় তাকেই ডাকতো। কিন্তু আমাদের যুগের শিরককারীরা সুখ-দুঃখ সর্বাবস্থায় অংশী করে। এর স্বপক্ষে দলীল, আল্লাহ বলেন :
فَإذَا رَكِبوا فَي الفُلْكِ دَعَوُا اللهَ مُخْلِصِيْنَ له الدينَ فَلَما نجَّاهُمْ إلى البَرِّ إذا هُمْ يُشْرِكُونَ
“তারা যখন নৌকায় আরোহণ করে তখন তারা বিশুদ্ধ চিত্তে খাঁটি ভাবে আল্লাহকে ডাকে; অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদের উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে।” [ আনকাবূত/৬৫]
পরিশেষে নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার – পরিজন ও সাথীদের প্রতি রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।
লেখক: ইমাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রহ.
অনুবাদক :শাইখ Abdur Raquib
বি.এ. অনার্স ফিকহ (মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব)
এম.এ. এরাবিক ( জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া,নিউ দিল্লী )
দাঈ, বাংলা বিভাগ: ইসলামিক দাওয়াত সেন্টার, খাফজী, সউদী আরব।