দল, ইমারত ও বায়আত সম্পর্কে উলামাগণের বক্তব্য (পর্ব ১৩)

দল, সংগঠন, ইমারত ও বায়‘আত সম্পর্কে বিশিষ্ট উলামায়ে কেরামের বক্তব্য (তেরতম পর্ব)

আবু মুহাম্মাদ আমীনুল্লাহ পেশোয়ারী(১)

মুহতারাম শায়খকে বিভিন্ন ইসলামী জামা‘আত, দল ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং সেগুলোতে যোগদান প্রসঙ্গে বারংবার প্রশ্ন করা হলে তিনি বিস্তারিত যে জবাব প্রদান করেন, তার কিছু অংশ নীচে তুলে ধরা হলঃ
তিনি হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণিত ফেতনা সম্পর্কিত হাদীছটি উল্লেখ করার পর বলেন, ‘অতএব, একজন মুসলিমের উচিৎ, তার প্রভূর ইবাদত করা এবং সাধ্যানুযায়ী এই ইবাদতের দিকে মানুষকে দা‘ওয়াত দেওয়া। কোনো সংগঠন বা দলে যোগ দেওয়া এবং কোনো দলের রুকন হওয়া তার জন্য সমীচীন নয়। তাকে যে মহান উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে, সেদিকে মনোনিবেশ করা উচিৎ। আজ অনেক মানুষকে বলতে শুনি, এখন আমরা কি করতে পারি? আমি বলব, তোমাকে কেবল আল্লাহ্‌র ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। অতএব, তুমি সেকাজেই ব্রত থাক’।(২ )
তিনি দলাদলি সৃষ্টির অনেকগুলি ক্ষতি উল্লেখ করেছেন, তন্মধ্যে কয়েকটি নীচে উল্লেখ করা হলোঃ


১. দলাদলি কুরআন-হাদীছ বিরোধী। এসব দলাদলি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর ছাহাবায়ে কেরামের সোনালী যুগে ছিল না; বরং সেগুলো পরবর্তীতে সৃষ্ট বিদ‘আত। সুতরাং তাঁরা যা করেছেন, আমাদেরকে তাই করতে হবে এবং তাঁরা যা বর্জন করেছেন, আমাদেরকে তা বর্জন করতে হবে।

২. দলাদলি বান্দার ইখলাছে বিরূপ প্রভাব ফেলে। দলের একজন সদস্য সর্বদা নিজ দলের জয় কামনা করে; এক্ষেত্রে সে কিতাব ও সুন্নাহ্‌র বিরোধিতারও তোয়াক্কা করে না।
৩. দলের প্রতি অন্ধভক্তি ও গোঁড়ামী অন্যান্য মুসলিমকে হেয় প্রতিপন্ন করতে শেখায়। সেজন্য দেখা যায়, দলের একজন অন্ধভক্ত তার দলের না হওয়ার কারণে বড় বড় আলেমের প্রচেষ্টাকে ছোট করে দেখে।
৪. ধর্মীয় বিষয়াবলীর গুরুত্বের চাইতে তার কাছে দলীয় বিষয়াবলীর গুরুত্ব বড় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সে দলীয় সভা-সমাবেশ, সম্মেলন ইত্যাদিতে উপস্থিত হলেও জামা‘আতে ছালাত, ইলম অর্জন, সুন্নাতের অনুসরণ ইত্যাদি ধর্মীয় বিষয়ে গুরুত্ব দেয় না।
৫. দলাদলি করতে যেয়ে একজন দলপ্রধান বানিয়ে তাকে কেন্দ্র করে কারো সাথে মিত্রতা বা শত্রুতা গড়ে তোলা হয় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর মহব্বত দাবী করা হলেও আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। এই একটি ক্ষতিই এসব দলাদলি থেকে দূরে থাকার জন্য যথেষ্ট।
৬. দলাদলি অন্যায়ভাবে কারো নিন্দা-বদনাম আবার কারো সুনাম করতে শেখায়। সেজন্য একজন নিকৃষ্ট মানুষও যদি দলে যোগ দেয়, তাহলে তার প্রশংসার শেষ থাকে না। পক্ষান্তরে মর্যাদাবান কোনো মানুষও যদি দল ত্যাগ করে, তাহলে তিনি হয়ে নিকৃষ্ট মানুষ।
৭. দলের সাথে সম্পৃক্ত না হওয়ার কারণে পরহেযগার ভালো আলেমের বক্তব্য পর্যন্ত শোনা হয় না। এমনকি দলীয় মাদরাসা-মসজিদে তাঁকে আল্লাহ্‌র পথে দা‘ওয়াত দেওয়ারও অনুমতি দেওয়া হয় না।
৮. নির্দিষ্ট কোনো দলে সীমাবদ্ধ থাকলে সময় ও অর্থের অপচয় হয় এবং পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও উম্মতের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়।

৯. সংগঠনের ব্যানারে দা‘ওয়াত দিলে দা‘ওয়াতের ফলাফল হয় খুব সংকীর্ণ। কেননা সংগঠনের সমর্থক ছাড়া আর কেউ এই দা‘ওয়াতে সাড়া দেয় না। পক্ষান্তরে বিদ‘আতী এসব বন্দীত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে দা‘ওয়াত দিলে যে কেউ তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকে।
১০. দলাদলির মাধ্যমে অনেক সময় শর‘ঈ দলীলের অপব্যাখ্যা করা হয়। কারণ আগে দলের মূলনীতি ও কর্মপদ্ধতি তৈরী করা হয়, তারপর এর পক্ষে শরী‘আতের এমন কিছু দলীল তালাশ করা হয়, যেগুলি তাদের পক্ষ সমর্থন করে না। ফলে তারা সেগুলো অপব্যাখ্যার আশ্রয় নেয়।
১১. দলাদলি ঈমানী মহান ভ্রাতৃত্বের পরিবর্তে নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলে সংকীর্ণ ভ্রাতৃত্বের জন্ম দেয়।(৩ )

তথ্যসূত্র :

(১)আল্লামা আমীনুল্লাহ পেশোয়ারী আফগানিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুরআন এবং হাদীছ শাস্ত্রে প্রথিতযশা এক পুরুষ। আরবী, উর্দূ এবং পশতু ভাষায় তিনি অনেকগুলি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে ১. তাক্বলীদ কে আন্ধেরুঁ সে নাজাত, ২. আফিঊন আওর উসকী তিজারাত কী হুরমাত, ৩. আত-তাহক্বীক্বুস-ছরীহ ফী শারহি মিশকাতিল মাছাবীহ, ৪. আল-ফাওয়ায়েদ, ৫. আসমা ওয়া ছিফাত উল্লেখযোগ্য। শায়খের ফৎওয়ার বই ‘ফাতাওয়াদ্‌-দীনিল খালেছ’ এ পর্যন্ত ১০ খণ্ড ছাপা হয়েছে। তাঁর ভাষ্য মতে, এটি ৫০ খণ্ড পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।

(২)আমীনুল্লাহ পেশোয়ারী, ফাতাওয়াদ্‌-দীনিল খালেছ (মাদরাসা তা‘লীমিল কুরআন ওয়াস-সুন্নাহ, পেশোয়ার, প্রথম প্রকাশঃ ১৪২৩ হি:), ৬/৪৮-৪৯।

(৩)দেখুনঃ আমীনুল্লাহ পেশোয়ারী, ফাতাওয়াদ্‌-দীনিল খালেছ (মাদরাসা তা‘লীমিল কুরআন ওয়াস-সুন্নাহ, পেশোয়ার, প্রথম প্রকাশঃ ১৪২৩ হি:), ৬/৫৯-৬৩।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button