আধুনিক ইসলাম ভাবনা

রচনায়: মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান*

অনুলিখন : মাকসুদ বিন আমাল

ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম দুনিয়ায় এসেছে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এর মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের পূর্বে আরব দেশে অনাচার-অবিচার ছিল, অহেতুক রক্তপাতের ঘটনা ছিল; হিংসা-বিদ্বেষ-হানাহানি ছিল। বিভিন্ন প্রকার বিশৃঙ্খলা ছিল সমাজে। তৎকালীন ইতিহাসই তা প্রমাণ করে। কুরআন মাজীদে যেসকল অতীত কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, তাতেও অশান্তি এবং বিশৃঙ্খলার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। সর্বকালেই আল্লাহর দ্বীন ইসলাম চেয়েছে অনাচার-অবিচার ও অশান্তির মূলোৎপাটন করতে। মহানবী (ছাঃ) নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বেই ‘হিলফুল ফুযূল’ নামে এক শান্তি সংগঠন কায়েম করেছিলেন। ইসলামের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে অশান্ত আরবে শান্তির ফোয়ারা বয়ে গিয়ে ছিল, তা ঐতিহাসিক সত্য। তবু কতিপয় ইয়াহুদি-নাছারা-মুশরিক ইসলামকে কখনও সুনজরে দেখেনি। তাদের বক্তব্য ইসলাম তরবারির জোরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অথচ এমন কোন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে নেই যে, কারো গর্দানে তরবারি ঠেকিয়ে বলা হয়েছে, ইসলাম কবুল করো, নতুবা ধড় থেকে গর্দান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। বস্তুতঃ ইসলাম প্রচারিত এবং সম্প্রসারিত হয়েছে উদারতার মাধ্যমে।

কুরআন মাজীদে আল্লাহর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা-

وَلَتَجِدَنَّ أَقْرَبَهُم مَّوَدَّةً لِّلَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ قَالُوا إِنَّا نَصَارَىٰ

‘ইয়াহুদি-নাছারা ও মুশরিকরা ইসলাম তথা মুসলমানদের দুশমন।’ (মায়েদাহ ৫/৮২)।

Modern Islam Thinking

এ বিষয়ে অন্ততঃ মুসলমানদের কোন বিকল্প ভাবনার অবকাশ নেই। তাছাড়া বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি তারই জাজ্বল্যমান প্রমাণ বহন করে। কোন মুসলিম দেশকে শক্তিশালী হতে দেখলেই ইহুদী-নাছারা ব্লকের টনক নড়ে যায়। তারা বারোটা না বাজিয়ে সুস্থির হতে পারে না। সেজন্য তাদের ছল-ছুতোর কোন অভাব হয় না। আফগানিস্থান ও ইরাককে তারা অকারণেই ছারখার করে দিয়েছে। আবার ইরান কিংবা পাকিস্থান পরমাণবিক স্থাপনা নির্মাণ করতে গেলে বুশ-ব্লেয়ার-শ্যারনের আতে ঘা লাগে। জাতিসংঘে নালিশ দেবার আবশ্যকতা দেখা দেয়। কিন্তু ভারতের সঙ্গে যৌথ অস্র নির্মাণ এবং পারমাণবিক চুক্তি করতে আমেরিকান বুশের কোন বাঁধা হয় না। বিশ্বের কেউ এ ব্যাপারে টু-শব্দটিও করছে না। শুধু ইরান-পাকিস্থানের বেলায় সব আপত্তি। এ ব্যাপারটা কেন খতিয়ে দেখা হচ্ছে না? পড়ল এর মরল কায়দায় তড়িৎ গতিতে ভুঁইফোড় ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্ম হতে পারে, পূর্ব তিমুরের ইন্দোনেশিয়া থেকে বেরিয়ে স্বাধীন খৃষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় খুব একটা সময় লাগে না। কিন্তু অর্ধ শতাব্দীর অধিক সময় ধরে আন্দোলন এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেও ফিলিস্তীনে মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায় না, কাশ্মীর এখনো স্বাধীন হয় না। এসব ব্যাপার কি আমরা ভেবে দেখেছি?

ইসলামী খেলাফত ভেঙ্গে গিয়ে মুসলমানদের কপাল পুড়েছে। ইহুদী-খৃষ্টানদের শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে সেই পতনের ফলে। শুধু কি তাই? মুসলমানরা শক্তির সঙ্গে ইমানও হারিয়ে ফেলেছে অনেকটাই। আজ মুসলমানের সঙ্গে মুসলমানের ঐক্য নেই। মুসলমানের বিপদাপদে মুসলমানের কোন মাথা ব্যথা নেই। মুসলমানের আমল-আখলাক্ব আজ মুসলমানের কাছেই নিন্দিত। খাঁটি ইসলামত্বকে আজ মুসলমানরাই বলে মৌলবাদ (নিন্দার্থে); ফৎওয়া (ইসলামের আইনী ফায়ছালা)কে বলে ফৎওয়াবাজি। রাস্ট্র ব্যবস্থায় ইসলামকে ভাবে অযোগ্য। মুসলমান সন্ত্রাসীকে বলা হয় ইসলামী জঙ্গী। অথচ ইসলাম জঙ্গীপনা (চরমপন্থার যুদ্ধবাজি/ফ্যাসিজম) সমর্থন করে না। ইসলাম বলে আক্রান্ত না হয়ে কাউকে আক্রমণ করো না; নর হত্যা-আত্মহত্যা মহাপাপ। ইসলামে কোথাও জঙ্গীপনার সুযোগ নেই। যদি কেউ মুসলমান হয়েও ইসলাম অসমর্থিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তখন সে আর মুসলমানের অন্তর্ভুক্ত থাকে না। আর যা ইসলামে নেই তাকে ‘ইসলামী’ বলার যুক্তি কোথায়? আসলে যাদের কাছে ইসলাম অপসন্দের, তারাই এ ধরণের মন্তব্য করে থাকে।

অধুনা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং পাশ্চাত্যের ইসলাম বিরোধী ভাবধারায় অনুরক্ত হয়ে একদল মুসলমান ইসলামী বিষয়ে বিভিন্ন খুঁত দেখতে পায় এবং অনৈসলামিক বিষয়াদিকে উৎকৃষ্ট মনে করে। আমাদের দেশের এক উচ্চ শিক্ষিতা ঔপন্যাসিকের নাম সেলিনা হোসেন। ২০০৫ সালে মুক্তকণ্ঠ-এর ঈদ সংখ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘নির্বাণ একটি কঠিন কথা। উচ্চারণ করেছিলেন আমার একজন অত্যন্ত প্রিয় মানুষ গৌতম বুদ্ধ। আমাকে যদি কোনদিন বলা হয়, আপনাকে চারটি ধর্ম দিলাম, আপনি একটি পসন্দ করুন, আমি বৌদ্ধধর্ম পসন্দ করব। জন্মসূত্রে আমি মুসলিম, এটাকে আমি অবজ্ঞা করি না, কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের অহিংস নীতি, শান্তির পথের বানী আমার কাছে জীবনের মৌল সত্য। আমি অন্য অনেক কিছুর মধ্যে তা খুজে পাই না। নিজের স্বার্থ-মোহ ইত্যাদি ত্যাগ করে নির্বাণ লাভ করা একজন মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে।’

সেলিনা হোসেন শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ডিগ্রীর অধিকারিণী। তিনি আবার একজন খ্যাতিমান কথাশিল্পীও। তার নিশ্চয়ই জানা থাকা উচিত যে, একটি ধর্ম পালন করতে থাকলে অন্য আরেকটি ধর্মকে সমর্থন করবার অবকাশ থাকে না। বিশেষত ইসলাম ধর্মমতে বিশ্বাসের দৃঢ়তা এবং একনিষ্ঠতাই কাম্য। যে ধর্মের প্রতি তা থাকে না, তা পালন করার কোন প্রয়োজনীয়তা থাকে না। বিশ্বাস বিহীন ধর্ম পালনে কোন ফায়দা নেই। পালন করা এবং না করা একই কথা। ইসলাম ধর্ম পাঁচটি স্তম্ভের উপরে প্রতিষ্ঠিত। তার প্রথম স্তম্ভটি হল ঈমান (বিশ্বাস)। এটিই যদি নড়বড়ে হয় তাহলে ধর্ম পালন অন্তঃসারশূন্য হতে বাধ্য। সেলিনা হোসেনের উদ্দেশ্যেই বলছি, ইসলামের মহানবী (ছাঃ)-এর মধ্যে কি আপনি কোন অহিংসনীতি দেখতে পেলেন না? মহানবী (ছাঃ)-এর জীবনে কি স্বার্থ মোহ ত্যাগের কোন দৃষ্টান্ত নেই? যিনি অহিংস নীতিতে থাকেন, তিনি শত্রুকেও ক্ষমা করেন। মহানবী (ছাঃ)-এর জীবনে কি তেমন ঘটনা ঘটেনি? যদি ঘটেই থাকে, তাহলে আপনার বৌদ্ধ ধর্ম নির্বাচনের কি আবশ্যকতা? আর যদি ইসলামের মহানবী (ছাঃ)-এর মধ্যে এসব কিছু আপনি খুঁজে না পেয়ে থাকেন, তাহলে আপনার ইসলাম ধর্মে থাকা সঠিক হয় নি। ‘দু’দিল বান্দা কালিমাচোর, না পায় শ্মশান না পায় গোর’- কথাটা আপনি শোনেনি কখনও? কুরআন মাজীদে আল্লাহ বলেছেন,

لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ

‘রাসূল তোমাদের উত্তম আদর্শ’(আহযাব ২১)।

এটাও কি আপনার জানা নেই? জেনে রাখুন! স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য অবহেলা করে গৌতম বুদ্ধ যে নির্বাণ খুঁজেছেন, তা মরীচিকা। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে বৈরাগ্য হাছিল করার জন্য পৃথিবীতে পাঠাননি।

মধ্য যুগের কবি আব্দুল হাকিম লিখেছিলেন,

‘যেজন বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী

সেজন কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।’

এই উক্তিটি ইসলাম নিন্দাকারী মুসলমানদের ক্ষেত্রে ঘুরিয়ে বলা যায়,

যেজন ইসলামে থাকি ইসলামকে বলে মন্দ

তার শরীরে কি করে থাকে মুসলমানের গন্ধ?

ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুরা বিরুদ্ধবাদী হবে, তা স্বাভাবিক। কিন্তু মুসলমানের মুখে ইসলামী বিষয়ের নিন্দা মানায় না। আবার যদি সেই মুখে ইসলাম বিরোধী ইহুদী-খৃষ্টানের প্রশস্তি শোনা যায়, শোনা যায় বাতিল ধর্মের গুণগান, তাহলে ধরে নিতে হবে, এরাও শত্রু, তবে এরা ছদ্মবেশী শত্রু। এরা ইহুদী-নাছারাদের চাইতেও ভয়ংকর। এরা মুসলমানদের ভেতরে থেকেই ইঁদুরের মতো সব কেটে-কুটে সর্বনাশ ঘটানোর সুযোগ নিচ্ছে। প্রকাশ্য শত্রুর চাইতে এই শত্রুরা আরও ভয়ংকর। এরাই ইসলাম ও মুসলমানের বিপদ এবং সর্বনাশকে ত্বরান্বিত করবে। অতএব দ্বীনদার মুসলমান, এদের থেকে সাবধান হও!

* সম্পাদক, কালান্তর, রাজবাড়ী, পিরোজপুর।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88