
অসীলার শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ
রচনায় : ডক্টর আব্দুস সালাম বারজাস আল আব্দুল করীম
অনুবাদ : মোহাম্মদ ইদরীস আলী মাদানী
অসীলার শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ
এ মাহফীলে বক্তব্যের প্রথম বিষয় হলো: ‘‘আরব এবং শরিয়তের ভাষায় তাওয়াস্সুল বা অসীলার অর্থ’’ নিয়ে আলোচনা। কেননা এ বিষয়ে অধিকাংশ লোক যে কারণে পথভ্রষ্ট হয়েছে, তা হলো আরব এবং শরিয়তের ভাষায় তাওয়াস্সুল এর অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞতা। তারা তাওয়াস্সুল এর অর্থ করেছে আরব এবং শরিয়তের ভাষার পরিপন্থি অর্থ, ফলে ধ্বংসে নিমজ্জিত হয়েছে।
আরবদের ভাষায় তাওয়াস্সুল শব্দের কয়েকটি অর্থ হয়:
এক: তাওয়াস্সুল অর্থ : নৈকট্য লাভ করা, আর অসীলা অর্থ : নিকটবর্তী হওয়া।
আল কামূসে বলা হয়েছে: وسّل إلى الله تعالى توسيلا “ এমন কাজ করেছে যার মাধ্যমে সে আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছে। যেমন তাওয়াস্সুল।
এ অর্থই আমাদের আজকের বিষয়, তাই আলোচনা তাতেই সীমাবদ্ধ রাখব।
আর শরিয়তের ভাষায় তাওয়াস্সুল বা অসীলার অর্থ সম্পর্কে আল কুরআনে দু’টি আয়াত এসেছে।
প্রথমটি হলো সূরা মায়েদায়, সেখানে আল্লাহ বলেন :
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱبۡتَغُوٓاْ إِلَيۡهِ ٱلۡوَسِيلَةَ وَجَٰهِدُواْ فِي سَبِيلِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٣٥ ﴾ [المائدة: ٣٥]
“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তার নৈকট্য অর্জন করতে সচেষ্ট হও এবং তার পথে সংগ্রাম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।” [সূরা মায়েদা/৩৫]
দ্বিতীয় আয়াত সূরা ইসরায়, আল্লাহ বলেন :
﴿ قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِهِۦ فَلَا يَمۡلِكُونَ كَشۡفَ ٱلضُّرِّ عَنكُمۡ وَلَا تَحۡوِيلًا ٥٦ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ وَيَرۡجُونَ رَحۡمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُۥٓۚ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحۡذُورٗا ٥٧ ﴾ [الاسراء: ٥٦، ٥٧]
“হে নবী আপনি তাদেরকে বলে দিন, আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে তোমরা উপাস্য মনে কর, তাদেরকে আহ্বান কর, তারা তোমাদের কষ্ট দূর করার ক্ষমতা রাখে না এবং তা পরিবর্তনও করতে পারেনা। যাদেরকে তারা আহ্বান করে তারা নিজেরাই তো তাদের পালন কর্তার নৈকট্য তালাশে ব্যাপ্ত যে, তাদের মধ্যে কে (আল্লাহর) বেশি নৈকট্যশীল (হবে)। তারা তাঁর রহমতের আশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে, নিশ্চয় আপনার পালনকর্তার শাস্তি ভয়াবহ।” [সূরা ইসরা/ ৫৬-৫৭]
এ দু’টি আয়াতে তাওয়াস্সুলের অর্থ কি ?
প্রথম আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার বাণীতে অসীলার অর্থ হলো: নৈকট্য লাভ করা। আর এটাই হচ্ছে ইবনে আব্বাস, আতা, মুজাহিদ এবং ফার্রা রাদিয়াল্লাহু আনহুম এর মত।
কাতাদাহ বলেন: পছন্দনীয় কাজের মাধ্যমে নৈকট্য লাভ করা।
আবু উবাইদাহ বলেন: তাওয়াসাসলতু ইলাইহি অর্থাৎ “তার নিকটবর্তী হয়েছি। তিনি একটি কবিতা পাঠ করেন :
إذا غفل الواشون عدنا لوَصْلنا * وعاد التصافي بيننا والوسائل
“যখন কুৎসা রটনাকারীরা গাফেল হয়ে পড়ল তখন আমরা আমাদের সম্পর্ক পুণঃপ্রতিষ্ঠায় ফিরে এলাম, আর আমাদের পরস্পরের মধ্যে ফিরে এল স্বচ্ছতা ও নৈকট্য।
ইবনে যাইদ বলেছেন: অসীলা অর্থ: মহব্বত, তখন অর্থ হবে, “তারা আল্লাহর প্রিয় হয়েছে।”
বস্তুত: এগুলো কোনো পরস্পর বিরোধী অর্থ নয়, বরং শব্দের পার্থক্য মাত্র, কেননা “আল্লাহর প্রিয় হওয়া তাঁর নৈকট্য লাভেরই একটি প্রকার।”
মোটকথা:
আল্লাহর বাণী وابتغوا إليه الوسيلة এর মধ্যকার ‘অসীলা’ শব্দটির অর্থ: তোমরা আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ কর।
এ অর্থে মুফাস্সিরিনদের মাঝে কোনো মতভেদ নেই, যেমন ইবনে কাছীর রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেছেন।
আর দ্বিতীয় আয়াত, আল্লাহর বাণী يبتغون إلى ربهم الوسيلة এর মধ্যকার ‘অসীলা’ শব্দটির অর্থ: ‘তারা আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ করে।’ যেমন তাফসীরে জালালাইনসহ ও অন্যান্য তাফসীরে এসেছে।
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শরিয়তের পরিভাষায় এবং আরবদের ভাষায় অসীলা হলো: নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্যলাভ করা।
এ থেকে জানা গেল যে, কিছু কিছু লোক ‘অসীলা’ শব্দের ব্যাখ্যায় ভুল করে থাকে, যার কারণে মুসলিমদের বিশ্বাসে মহা অনিষ্টতা তৈরী হয়েছে।
আল্লামা শানকিতি (রহমতুল্লাহি আলাই্হি) বলেছেন: কিছু সুফিবাদী সূরা মায়েদার আয়াতে অসীলার যা ব্যাখ্যা করেছে তা হলো এই: (একজন শাইখ বা আলেম, যিনি কোনো ব্যক্তি এবং আল্লাহর মাঝে মাধ্যম হবে )!!!
এটি একটি পথভ্রষ্টতা, প্রকাশ্য অপবাদ এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উপর অজানা কথা আরোপ করা।
আবার কিছু লোক ধারণা করে যে, ‘অসীলা’ হলো: নবী রাসূল, সৎলোক এবং অলীগণের সত্ত্বা। এ সবই বাতিল, এর কোনোই ভিত্তি নেই।
সাহাবা এবং তাবে‘ঈনদের তাফসীর থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোনো শাইখ বা আলেমের দ্বারা অসীলার ব্যাখ্যা করা মারাত্মক ভুল যা শরিয়ত কখনো মেনে নিবেনা এবং স্বীকৃতিও দিবেনা।
কেননা সালাফগণ সকলেই একমত যে, আল্লাহ তা‘আলার বাণী وابتغوا إليه الوسيلة এ আয়াতে অসীলার অর্থ হলো: আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ করা। এমনিভাবে তাঁর বাণী يبتغون إلى ربهم الوسيلة তে ও একই অর্থ।
ইবাদত সহীহ হওয়ার শর্তসমূহ:
আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের দু’টি শর্ত রয়েছে, যা আল্লাহর কিতাব এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত প্রমাণ করে এবং এর উপরই এ উম্মতের সালাফগণ ঐক্যবদ্ধ।
প্রথম শর্ত: এ নৈকট্য লাভে আল্লাহর জন্য ইখলাস বা নিয়তের বিশুদ্ধতা। তিনি বলেন:
﴿ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ ﴾ [البينة: ٥]
‘‘তাদেরকে এ ছাড়া কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে’’। [সূরা আল-বাইয়্যেনাহ: ৫]
তিনি আরো বলেন:
﴿فَٱعۡبُدِ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ ٢ ﴾ [الزمر: ٢]
“সুতরাং তুমি আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর জন্য দীনকে খালেস করে”। [সূরা আয-যুমার:২]
তিনি আরও বলেন,
﴿ فَٱدۡعُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡكَٰفِرُونَ ١٤ ﴾ [غافر: ١٤]
‘‘তোমরা একনিষ্ঠতার সহিত আল্লাহকে ডাক, যদিও কাফেরগণ তা অপছন্দ করে’’। [সূরা গাফির: ১৪]
সহীহ মুসলিমে আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
«قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي، تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ»
“আল্লাহ তা‘আলা বলেন: আমি শির্ক থেকে মুক্ত, যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করবে যাতে আমার সহিত অন্যকে অংশিদার করবে, আমি তাকে এবং তার শরীককে বর্জন করি।”[1]
ইবনে মাজাহও হাদিসটি সংকলন করেছেন, তবে তার শব্দ হচ্ছে,
«فَأَنَا مِنْهُ بَرِيءٌ، وَهُوَ لِلَّذِي أَشْرَكَ»
“আমি এথেকে পবিত্র, আর তা হচ্ছে মুশরিকদের থেকে।”[2]
দ্বিতীয় শর্ত: এ নৈকট্য লাভ হবে সে জিনিস থেকে যার উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন। কাজেই যে ইবাদত তিনি করেননি এবং স্বীকৃতি দেননি; তা দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না; যদিও সে কাজটি বিশুদ্ধ নিয়তে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই করে থাকুক। কেননা আল্লাহ তা‘আলার তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখে যা শরিয়ত হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন কেবল সেটার মাধ্যমেই ইবাদত করার নির্দেশনা দিয়েছেন, তা দ্বারা নয় যা আমাদের মস্তিষ্ক চায় এবং আমাদের প্রবৃত্তি ভালো মনে করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ٱتَّبِعُواْ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكُم مِّن رَّبِّكُمۡ وَلَا تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَۗ قَلِيلٗا مَّا تَذَكَّرُونَ ٣ ﴾ [الاعراف: ٣]
‘‘তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ কর এবং তাঁকে ব্যতীত অন্য কাউকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করোনা, বস্তুত: তোমরা সামান্য কিছু সময় মাত্র তাকে স্মরণ করে থাক’’। [সূরা আরাফ/৩]
তিনি আরো বলেন:
﴿قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٣١ ﴾ [ال عمران: ٣١]
“তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তবে আমার অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন, তোমাদের পাপ ক্ষমা করে দিবেন, আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, অনুগ্রহকারী।” [সূরা আলে ইমরান/৩১]
বুখারী ও মুসলিম শরীফে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ، فَهُوَ رَدٌّ»
“যে ব্যক্তি আমার এ দ্বীনে কোনো নতুন জিনিস প্রচলন করবে, যা এর অন্তর্ভুক্ত নয় তা প্রত্যাখ্যাত।”[3]
মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে :
«مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ»
“যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করবে যা আমার দ্বীন সমর্থন করেনা তা প্রত্যাখ্যাত।”[4]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশের বহির্ভূত কোনো ইবাদত দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য তালাশকারী কেবল ক্ষতিগ্রস্ত এবং পাপীই হবে, যদিও তা আল্লাহর জন্য বিশুদ্ধ চিত্তে হয়।
বাইহাকী এবং অন্যান্যরা সাঈদ ইবন মুসাইয়্যেব হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি এক ব্যক্তিকে ফজর উদয় হওয়ার পর দুইয়ের অধিক নামায পড়তে দেখেছেন, যাতে সে রুকু সিজদা বেশি বেশী করছে, অতঃপর তিনি তাকে নিষেধ করেছেন। সে বলল : হে আবু মুহাম্মদ ! এ নামায পড়ার জন্য আল্লাহ কি আমাকে শাস্তি দিবেন? তিনি বললেন: না, কিন্তু সুন্নাতের খেলাফ আমল করায় আপনাকে শাস্তি দিবেন।
উল্লেখিত আলোচনার আলোকে আমরা প্রতিটি তাওয়াস্সুলের দিকে দেখব, তাতে কি উল্লেখিত দু’টি শর্ত রয়েছে কিনা ? তাতে কি ইখলাস বা নিয়তের বিশুদ্ধতা রয়েছে? সেটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্বীকৃত কোনো কাজ কি না ?
তথ্যসূত্র :
[1] মুসলিম, ২৯৮৫।
[2] ইবন মাজাহ, ৪২০২।
[3] বুখারী, হাদীস নং ২৬৯৭; মুসলিম, ১৭১৮।
[4] মুসলিম, ১৭১৮।
” বৈধ ও অবৈধ অসীল” বই থেকে সংকলিত।