ইসলামে উত্সর্গ-মানতের বিধান

উৎসর্গ করা ইবাদাতের একটি সর্বজনীন প্রকাশ। পূজিত ব্যক্তিকে খুশি করতে এবং তার আশীর্বাদ , করুণা বা নেক নযর লাভ করতে মানত, সদকা, বলি, উৎসর্গ, নযর-নিয়ায ইত্যাদি নামে ফুল, ফল, ফসল, অর্থ, পশু ইত্যাদি উৎসর্গ করা হয়। আল্লাহ ছাড়া কারো উদ্দেশ্যে এরূপ উৎসর্গ করা শিরক। মুশরিকগণের এ জাতীয় শিরকের বিষয়ে আল্লাহ বলেছেনঃ

وَجَعَلُوا لِلَّهِ مِمَّا ذَرَأَ مِنَ الْحَرْثِ وَالْأَنْعَامِ نَصِيبًا فَقَالُوا هَٰذَا لِلَّهِ بِزَعْمِهِمْ وَهَٰذَا لِشُرَكَائِنَا ۖ فَمَا كَانَ لِشُرَكَائِهِمْ فَلَا يَصِلُ إِلَى اللَّهِ ۖ وَمَا كَانَ لِلَّهِ فَهُوَ يَصِلُ إِلَىٰ شُرَكَائِهِمْ ۗ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ [٦:١٣٦]
“আল্লাহ যে শস্য ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন তন্মধ্য হতে তারা আল্লাহর জন্য এক অংশ নির্দিষ্ট করে এবং নিজেদের ধারণা অনুযায়ী বলে, ‘এটি আল্লাহর জন্য এবং এটি আমাদের শরীকদের জন্য ‘। যা তাদের শরীকদের অংশ তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু যা আল্লাহর অংশ তা তাদের শরীকদের কাছে পৌঁছে; তাদের ব্যবস্থা খুবই নিকৃষ্ট। ” (সূরা আনআমঃ১৩৬)islame manot ba utosorgo

উৎসর্গ একমাত্র আল্লাহর জন্যই করার নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ বলেনঃ

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ [٦:١٦٢] لَا شَرِيكَ لَهُ ۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ [٦:١٦٣] 
“বল, নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার উৎসর্গ- কুরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু আল্লাহরই জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক, তার কোন শরীক নেই। এজন্যই আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং আমি সর্বাগ্রে আত্মসমর্পণ করেছি।” (সূরা আনআমঃ১৬২-১৬৩)
আমাদের এলাকায় এসব মুসলিম নামধারী মুশরিকদের এসকল কর্মকাণ্ড দেখেছি। আমার গ্রামের অনেক মানুষ হল ভণ্ড ফরিদপুরি খাজার অনুসারী। অনেককে দেখি যারা ঠিক মত সালাত আদায় করে না , গরীব অসহায়কে সাহায্য করে না অথচ বছরের বিভিন্ন সময় তারা আম, কাঁঠাল, ধান, চাউল, বাঁশঝাড়, ইত্যাদি তাদের বাবার দরবারে নিয়ে যায়। অর্থাৎ এসব তারা তাদের ভণ্ড বাবাকে উৎসর্গ করে! সত্যি তাদের সাথে মক্কার মুশরিকদের তেমন তফাৎ নেই। হ্যাঁ, তফাৎ আছে………… মক্কার মুশরিকরা একটা অংশ আল্লাহর জন্য রাখত কিন্তু এসব মুসলিম মুশরিকরা সম্পূর্ণই তাদের বাবার জন্য রাখে। আল্লাহর কথা তারা মনেও করে না। এমনকি তাদের কেউ মারা গেলে আল্লাহর নামের চেয়ে বেশি তাদের বাবার নাম নেওয়া হয়!
আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়াত দান করুক, সঠিক বুঝ দান করুক। আমীন।

প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু আলী আলাউদ্দিন আল-হাসকাফী আদ-দুররুল মুখতার গ্রন্থে বলেনঃ

“জেনে রাখ, মৃতদের জন্য নযর-মানত যা অধিকাংশ সাধারণ মানুষ করে থাকে এবং আওলিয়ায়ে কেরামের মাযার-কবরের জন্য যে সব টাকা পয়সা, মোমবাতি, তেল ও অনুরূপ দ্রব্য গ্রহণ করা হয় তাদের নৈকট্য বা নেক-নযর লাভের জন্য তা সবই বাতিল ও হারাম বলে ইজমা হয়েছে। যদি না তারা দরিদ্র অসহায় মানুষদের জন্য তা ব্যয় করার মানত করে। মানুষেরা এরূপ নিষিদ্ধ নযর-মানতের মধ্যে নিপতিত হয়েছে, বিশেষত বর্তমান যুগে।” (ইবনু আবেদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ২/৪৩৯-৪৪০)

এর ব্যাখ্যায় আল্লামা শামী “হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার” গ্রন্থে বলেনঃ

“মাযারে তাদের নৈকট্য বা নেক-নজর লাভের জন্য মানত করার ধরণ এই যে, মানতকারী বলবে, হে অমুক হুজুর বা অমুক বাবা, যদি আমার হারানো ব্যক্তি ফিরে আসে বা আমার অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হয় বা আমার হাজত পূর্ণ হয় তবে তোমার জন্য অমুক পরিমাণ স্বর্ণ, রৌপ্য, খাদ্য, মোমবাতি বা তেল দেব। এ প্রকারের মানত বাতিল ও হারাম হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে; প্রথমত, তা মাখলুক বা সৃষ্টির জন্য নযর-মানত করা, আর কনো সৃষ্টির জন্য নযর-মানত জায়েয নয়। কারণ নযর-মানত ইবাদাত এবং কনো মাখলুকের ইবাদাত করা যায় না। দ্বিতীয়ত, যার জন্য মানত করা হয়েছে তিনি মৃত। আর মৃত ব্যক্তি কোন মালিকানা লাভ করতে পারে না। তৃতীয়ত, এরূপ মানতকারী ধারণা করেছে যে, আল্লাহ ছাড়া মৃত মানুষও দুনিয়ার পরিচালনায় কিছু করতে পারেন, আর তাঁর এ আকীদা কুফর।”

(ইবনু আবেদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ২/৪৩৯)

এ প্রসঙ্গে আল্লামা আলূসী রহঃ বলেনঃ “মহান আল্লাহ বলেছেনঃ

إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ لَن يَخْلُقُوا ذُبَابًا وَلَوِ اجْتَمَعُوا لَهُ

“তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না……… ”(সূরা হাজ্জঃ৭৩)

যারা আল্লাহর ওলীগণের বিষয়ে বাড়াবাড়ি করে এখানে তাদের নিন্দার প্রতি ইশারা করা হয়েছে; কারণ তারা বিপদে আপদে তাদের নিকট ত্রান প্রার্থনা করে এবং মহান আল্লাহর নিকট ত্রান প্রার্থনা করা থেকে গাফিল থাকে এবং এ সকল ওলীর জন্য তারা নযর-মানত করে।তাদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান তারা বলে , এ সকল ওলী হচ্ছেন আল্লাহর নিকট আমাদের ওসীলা। এবং বলে যে, আমরা আল্লাহর জন্যই নযর-মানত করি এবং এর সাওয়াব ওলীর জন্য প্রদান করি। এ কথা সুস্পষ্ট যে, তাদের প্রথম দাবির বিষয়ে তারা মূর্তিপূজকদের সবচেয়ে নিকটবর্তী ও মূর্তিপূজকদের মতই, যারা বলতঃ‘আমরা এদের ইবাদাত করি তো এজন্যই যে এরা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করিয়ে দেবে।’ (সূরা যুমারের ৩ আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে)

তাদের দ্বিতীয় দাবিটি আপত্তিকর হবে না, যদি তারা এরূপ মানতের মাধ্যমে ওলীগণের নিকট থেকে তাদের অসুস্থ ব্যক্তিদের সুস্থতা, তাদের হারানো মানুষের প্রত্যাবর্তন বা অনুরূপ কোন হাজত প্রার্থনা না করে। কিন্তু তাদের বাহ্যিক অবস্থা প্রমাণ করে যে, তারা এদের নিকট মানতের দ্বারা এরূপ কিছুই প্রার্থনা করে। এর প্রমাণ এই যে, তাদেরকে যদি বলা হয় যে, তোমরা আল্লাহর জন্য মানত করএবং এর সাওয়াব তোমাদের পিতা-মাতার জন্য দান কর, কারণ এ সকল ওলী-আওলিয়ার চেয়ে তোমাদের পিতামাতাগণেরই সাওয়াবের প্রয়োজন বেশী, তবে তারা তা করবে না। আমি এদের অনেককে দেখেছি যে, তারা ওলীগণের কবরের পাথরের বেদিমূলে সাজদা করছে।

এদের অনেকে দাবি করে যে, সকল ওলীই তাদের কবরে বসে দুনিয়া পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন, তবে তাদের বেলায়াতের মর্তবা অনুসারে তাদের ক্ষমতার কমবেশী রয়েছে। তাদের মধ্যে যারা আলিম তারা বিশ্ব পরিচালনার এরূপ ক্ষমতা ৪ বা ৫ জন কবরবাসীর জন্য সীমাবদ্ধ করেন। তাদের নিকট যদি প্রমাণ চাওয়া হয় তবে তারা বলেন, কাশফ দ্বারা তা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ এদের ধংস করুন! এরা কত বড় জাহিল!! আর এদের মিথ্যাচার ও জালিয়াতি কত ব্যাপক!!!!!!

তাদের অনেকে দাবি করে যে, এ সকল ওলী-আওলিয়া তাদের কবর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করেন। তাদের মধ্যে যারা আলিম তারা বলে, এ সকল ওলীর রূহ প্রকাশিত হয়ে যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়ায় এবং কখনো কখনো তারা বাঘ, সিংহ, হরিণ বা অনুরূপ প্রাণীর আকৃতি ধারণ করে। এ সবই ভিত্তিহীন বাতিল কথা। কুরআন, সুন্নাহ এবং উম্মাতের প্রথম যুগের ইমামগণের কথার মধ্যে এর কোন অস্তিত্ব নেই। এ সকল মিথ্যাচারী মানুষদের দীন-ধর্ম নষ্ট করে দিয়েছে। ইহূদী, খৃস্টান ও অন্যান্য বাতিল ও বিকৃত ধর্মের মানুষদের নিকটেও এরা হাসি-মস্করার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এমনকি বাতিল মতবাদ ও নাস্তিকতার অনুসারীরাও এদের নিয়ে হাস্যকৌতুক করে। আমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করি।”

(আলূসী, রুহুল মা‘আনী ১৩/১৫৫)

শাহ ওয়ালি উল্লাহ রহঃ বলেনঃ “কবর পূজারীদেরকে পীর পুরস্ত বা পীর পূজারীও বলা হয়। কবর পূজারী সম্প্রদায় কবর পূজাকে ফরয ইবাদাত তথা নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি হইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। সুন্নাত ইবাদাত ও অযীফা করার চেয়ে কবর পূজাকে অধিক ফযীলতপূর্ণ ও সাওয়াবের কাজ মনে করে। তাই তাহারা কবর পূজাকে যে কোন প্রকার ইবাদাতের পরিবর্তে করিয়া থাকে এবং ইহাকেই যথেষ্ট মনে করে। বস্তুত তারা কিন্তু কবর পূজার পরিবর্তে আল্লাহর কোন ইবাদাতকে গুরুত্ব দেয় না এবং উহাকে যথেষ্ট মনে করে না। যখন কোন বুজুর্গের উরশ বা মেলা ইত্যাদি হয় তখন সেখানে বহু দূর দূরান্ত হইতে বহু লোকের সমাগম হয়। এই ক্ষেত্রে কবর পূজারীরা সেই মেলায় উপস্থিত হওয়া ফরয ইবাদাত মনে করে এবং অন্যান্য ফরয অর্জন করার চেয়ে এটাকেই অধিক প্রয়োজন মনে করিয়া থাকে।

কবর পূজারীদের সবচদেয়ে জঘন্য কাজ হইল যাবতীয় পার্থিব বিপদাপদ ও সংকটময় কাজের সমাধান হওয়ার জন্য কবরের নিকট গিয়া এমন বিনয়তা, একাগ্রতা ও আন্তরিকতার সাথে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে যে, মসজিদে বা অন্য কোথাও আল্লাহকে হাযির নাযির মনে করিয়া উহার শত ভাগের এক ভাগও করে না। কবরে শায়িত বুজুর্গের নাম ধরিয়া তাহাকে ডাকে এবং দোআ করে এবং তাহার নিকট জীবিকা ও সন্তানাদি কামনা করে। অত্যন্ত বিনয় ও মনোযোগের সহিত মাথানত (করিয়া) কাপড়ের গেলাফ এবং চাদর লাগায়; কবরের উপর সুগন্ধি ছড়ায়। পুণ্যের কাজ মনে করিয়া লোবান, আগর বাতি জ্বালায় এবং কবরকে সুন্দরভাবে সজ্জিত করে। এই অযথা কাজে পীরের আত্মাকে খুশী করার নিয়তে তাহার সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করে। আপাতঃদৃষ্টে দেখা যায় যে হিন্দু ও মুশরিক সম্প্রদায় তাহাদের প্রতিমার জন্য যেভাবে অর্চনা করিয়া থাকে ঠিক সেই ভাবেই এই কবর পূজারীগণও সেই সমস্ত কাজকে পুন্যময় মনে করিয়া সম্পাদন করিয়া থাকে।” (শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবি রহঃ, আল-বালাগুল মুবিন)

সুত্রঃ আল-ফিকহুল আকবর বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা, লেখক:- ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88