ইসলামী দৃষ্টিকোণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

ইসলামী দৃষ্টিকোণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

রচনা: আলী হাসান তৈয়ব

সম্পাদনা : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

বাংলাদেশের বিজয় বা স্বাধীনতা দিবস এলেই কিছু মানুষকে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়। এ সুযোগে তারা নিজেদের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ইসলাম বিদ্বেষ কিংবা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা তুলে ধরেন। তারা পরোক্ষে বলতে চান, ১৯৭১ সালে আমরা যুদ্ধ করেছি পাকিস্তানের জুলুম-বঞ্চনার বিরুদ্ধে নয়; ইসলামের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে এ দেশের লাখ লাখ মুসলিম প্রাণ দিয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষবাদ কায়েমের জন্য। আরেকটু বাড়িয়ে বললে, ইসলাম থেকে বিযুক্ত হবার উদ্দেশে!  এমন জঘন্য ইতিহাস বিকৃতি বা মিথ্যাচার এ দেশে আর কেউ করেনি। liberation war of bangladesh

তথাকথিত সুশীল নামের কিছু ব্যক্তি যে মিথ্যার বেসাতি সাজিয়েছেন তার কোনো তুলনা হয় না। কারণ, সত্য হলো, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধটি ছিল জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। ইসলামের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ হয় কীভাবে, ইসলামই তো মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশের প্রেরণা ছিল। কেননা জুলুম বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইসলামই সবচে বেশি সোচ্চার। গোড়া থেকেই ইসলাম জুলুম সহ্য করে নি। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বারবার জুলুম থেকে বারণ করা হয়েছে। নানা উপলক্ষ্যে জুলুমের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। উপরন্তু জুলুম প্রতিরোধে ইসলামে জিহাদের বিধান রাখা হয়েছে।
বরং তেতো সত্য হলো, এখন যারা অতি কষ্টে পাকিস্তানকে ইসলামের সমার্থক বানিয়ে তাদের ইসলামবিদ্বেষ চরিতার্থের ব্যর্থ প্রয়াস চালান, এদের কেউ কেউ যুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে নানা অনৈতিক কাজে লিপ্ত ছিলেন। আজ যেমন তাদের স্ত্রীরা হিন্দি সিরিয়াল আর শিশুরা হিন্দি ডোরেমন নিয়ে মাতোয়ারা থাকেন। হিন্দি গান ও নাচ ছাড়া তাদের কোনো অনুষ্ঠানই যেন জমে না। অবাক লাগে, আজও যখন স্বাধীনতার সুফল থেকে বঞ্চিত রয়েছে অনেক পঙ্গু বা আহত মুক্তিযোদ্ধা, তখন এসব সুবিধেবাদী ব্যস্ত স্বাধীনতার চেতনার নামে নিত্য নতুন বিভেদ সৃষ্টিকারী তত্ত্ব ও বানোয়াট তথ্য আবিষ্কারে। তখন যারা জীবনবাজী রেখে লড়াই করেছিলেন সেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কিন্তু কখনোই এসব ভাবেননি কিংবা আজও তেমন ভাবেন না।
আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, এর ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র বা চলচ্চিত্র কিংবা পরিবারের কাছে রণাঙ্গণ থেকে পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠিপত্র দেখলেই সে কথা জানতে পারি। এসব থেকে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গণে যাবার আগে আল্লাহর কাছে সালাত আদায়ান্তে মুনাজাত করে রওনা হয়েছেন। বাবা, মা বা স্ত্রীর অশ্রুসজল চোখের দিকে চেয়ে তাঁদের হৃদয় নিংড়ানো দুআ আর কায়োমন প্রার্থনা শুনেই তাঁরা ছুটেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের শতকরা একজনও সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মনিরপেক্ষতা কী তা জানতেন বলে মনে হয় না। অথচ অমুক্তিযোদ্ধারাই এসব চেতনা চাপিয়ে দিচ্ছেন আজ আমাদের ওপর।
বছর খানেক আগে আমি গিয়েছিলাম শেরপুরের এক সীমান্তঘেঁষা পল্লী মরিয়ম নগরে। খ্রিস্টান মিশনারির তৎপরতায় সেখানে অনেক মুসলিম নর-নারী খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহর রহমতে ময়মনসিংহের কিছু উদ্যমী ও দায়িত্বসচেতন আলেমের তৎপরতায় আবার তাঁরা ইসলামে ফিরে আসেন। ওই গ্রামে একটি ইসলামী সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল ইসলামের সুমহান শান্তির বাণী এবং শ্রেষ্ঠত্বের অনস্বীকার্য বাস্তবতা তুলে ধরতে। আলোচক হিসেবে সেখানে যাবার সময় দুর্গম পথে দেখা হয়েছিল স্থানীয় একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের সঙ্গে। নাম মনে না থাকলেও ভদ্রলোকের শ্মশ্রুমণ্ডিত টুপি-পাঞ্জাবিপরা ইসলাম অন্তপ্রাণ চেহারাটি মনে এখনো জ্বলজ্বল করছে। দুর্গম পথে এক পর্যায়ে তিনি আমাদের সঙ্গী হলেন পথপ্রদর্শক হিসেবে।
গাড়িতে পাশের সিটে বসে আমি দাদার বয়েসী ওই মুরুব্বির ছোট্ট একখান সাক্ষাৎকারই নিয়ে ফেললাম। জানালেন ক’দিন পরেই তিনি ঢাকায় আসছেন মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে। সেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা দেবেন প্রধান অতিথি হিসেবে। তাঁর মুখে এ প্রসঙ্গ শুনতেই আমার মনে হলো তাঁকেই জিজ্ঞেস করা দরকার আমার দীর্ঘদিনের লালিত সেই মোক্ষম প্রশ্নটি। আচ্ছা বুযুর্গ, আপনারা যুদ্ধ করেছিলেন কী উদ্দেশ্যে? ধর্মনিরপেক্ষতা কায়েম করা বা ইসলাম নির্মূল করার কোনো অভিপ্রায় ছিল কি তখন কোনো মুক্তিযোদ্ধার অন্তরে?
দ্ব্যর্থহীনভাষায় তাঁর উত্তর : ‘বাবা, এসব হলো এখনকার মুক্তিযোদ্ধা ব্যবসায়ীদের স্বার্থান্ধ দাবী। আমরা লড়াই করেছি জালেম হটিয়ে মজলুমদের বাঁচাতে। ইসলামই আমাদের সে প্রেরণা যুগিয়েছে। ইসলাম কখনো জালেমের পক্ষে নয়। ইসলাম সবসময় জালেম নির্মূল করতে বলে। আচ্ছা, স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের কজন আছেন যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস নিয়ে মরেন নি? তাঁরা সবাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেই লড়াই করেছেন। এই সম্পদ বুকে নিয়েই শহীদ হয়েছেন। আমরা সবাই ফজর নামাজ পরে আল্লাহর কাছে কেঁদে বুক ভাসিয়ে মুনাজাত করেই চলে গেছি যুদ্ধক্ষেত্রে।’
আমার ভোলার বন্ধু চিন্তাশীল তরুণ লেখক মাওলানা আবুল কাসেম আদিল এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, তার বাবা ও চাচারাও মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের মুখে তিনি একাধিকবার মুক্তিযুদ্ধের তখনকার চেতনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেছেন। তাঁরাও ওই শেরপুরের স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধার মতো জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ের চেতনা তুলে ধরেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমার ধর্ম পরায়ন বাবা এবং চাচারাও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা যে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা লালন করতেন না, এটা বুঝার জন্য আমার আর কোনো প্রমাণের দরকার নেই।’
আলেম মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের চেয়ারম্যান সাংবাদিক শাকের হোসাইন শিবলি সহস্রাধিক পৃষ্ঠার শেকড়সন্ধানী একটি ঢাউস বই লিখেছেন। বহুল প্রশংসিত সেই বইটির নাম ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’। এ বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ের ইতিহাস। এ চেতনায় শত শত আলেমের অস্ত্র তুলে নেবার রোমাঞ্চকর ইতিবৃত্ত। বইটির প্রকাশনা উৎসবে আমন্ত্রিত দেশের প্রবীণ সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন স্পষ্ট বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ইসলামের কোনো বিরোধ নেই। ঢালাওভাবে আলেমদের কিংবা টুপি-দাড়ি দেখলেই রাজাকার বলা স্বাধীনতার চেতনা নয়।
বঙ্গবন্ধু মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তার শুরুতেই পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা হয়। সেখানে যে মাওলানা সাহেব কুরআন তিলাওয়াত করেছিলেন তাঁর ছোট ভাই স্বনামখ্যাত লেখক অনুবাদক মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীর মুখে তার গৌরবদীপ্ত বর্ণনা শুনেছি। বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন সেখানে তাঁর শেষ উক্তি ছিল, ‘…এদেশের মানুষকে মুক্ত করেই ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ এই ‘ইনশাআল্লাহ’ শব্দের মধ্যেও তাঁর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও ভরসার চেতনা ফুটে ওঠে। তাঁর বক্তব্য থেকেও তো কখনো মুক্তিযু্দ্ধকে ইসলামের বিপক্ষে যুদ্ধ বলে মনে হয় নি।
যে দেশের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধের প্রেরণা ছিলেন, যে দেশের জেলখানায় তিনি বিনা বিচারে ৯ মাস বন্দি ছিলেন, সে দেশের প্রতি তিনি প্রসন্ন হতে পারেন না। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার মাত্র কয়েক মাসের মাথায় তিনি পাকিস্তানে ওআইসির সম্মেলনে যোগদান করেন। নিজের ক্ষোভ ও কষ্ট মনে পুষে রেখে তিনি এতে যোগদান করেন কেবল ‘উম্মাহ চেতনায়’ উদ্বুদ্ধ হয়ে। এটিও তার ইসলাম সম্পর্কে ইতিবাচক মানসিকতাকে সপ্রমাণ করে।
আমার ব্যক্তিগত পড়াশোনায় দেখেছি পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কিরাম এমনকি বিশ্বের শীর্ষ আলিমগণও এই যুদ্ধকে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের বৈধ ও উচিত লড়াই বলে আখ্যায়িত করেছেন। পাকিস্তানের বিশ্বখ্যাত আলেম সাবেক বিচারপতি মুফতি তাকী উসমানীর বিশ্বভ্রমণকাহিনীর বই ‘জাহানে দীদাহ’–এর বাংলাদেশ ভ্রমণ অংশে এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামিক স্কলার ড. ইউসুফ আল-কারযাবীর ভ্রমণকাহিনীর বাংলাদেশ অধ্যায়েও এ সত্যের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। তাঁরা সবাই মুক্তিযুদ্ধকে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ বলেই আখ্যায়িত করেছেন।
অবশেষে প্রার্থনা, আল্লাহ বাংলাদেশের মানুষ ও তাদের ঈমানকে হেফাযত করুন। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ইসলামের সেবক ও রক্ষক বানিয়ে দিন। আমীন।

উত্স: ইসলাম হাউস ডট কম।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan