لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এ কালেমার অর্থ ও তার দাবী

পূর্ববর্তী আলোচনা হতে এ কালেমার অর্থও এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে এ কথা স্পষ্ট হলো যে,
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
এর অর্থ হচ্ছে, সত্য এবং হক মাবুদ বলতে যে ইলাহকে বুঝায় তিনি হলেন একমাত্র আল্লাহ, যাঁর কোনো শরীক নেই এবং তিনিই একমাত্র ইবাদত পাওয়ার অধিকারী। তাই এ মহান কালেমার অর্থে এটাও অন্তর্ভুক্ত যে, তিনি ব্যতীত যত মাবুদ আছে সব অসত্য এবং বাতিল, তাই তারা ইবাদত পাওয়ার অযোগ্য।

এজন্য অধিকাংশ সময় আল্লাহ তা‘আলার ইবাদাতের আদেশের সাথে সাথে তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করতে নিষেধ করা সম্বলিত নির্দেশনা এসেছে। কেননা আল্লাহর ইবাদতের সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করা হলে সে ইবাদত গ্রহণযোগ্য হবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ۞وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗاۖ﴾ [النساء: ٣٦]
“আর তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করো না।” (আন্ নিসা-৩৬)
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿فَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلطَّٰغُوتِ وَيُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰ لَا ٱنفِصَامَ لَهَاۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ٢٥٦ ﴾ [البقرة: ٢٥٦]
“অতঃপর যে তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনবে সে ব্যক্তি দৃঢ় অবলম্বন ধারণ করল যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সবই শুনেন এবং জানেন।” (আল্ বাকারাহ-২৫৬)
তিনি আরো বলেন,
﴿ وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ ﴾ [النحل: ٣٦]
“আর নিশ্চয় আমরা প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি এ বলে যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুতকে পরিহার কর।” (আন্ নাহাল-৩৬)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَكَفَرَ بِمَا يُعْبَدُ مَنْ دُونِ اللهِ، حَرُمَ مَالُهُ، وَدَمُهُ»
“যে ব্যক্তি বলল, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য সব কিছুর ইবাদতকে অস্বীকার করল তার জীবন ও সম্পদ অন্যের জন্য নিষেধ করল।” (মুসলিম কিতাবুল ঈমান হাদীস-নং ২৩।)
প্রত্যেক রাসূলই তাঁর জাতিকে বলেছেন,
﴿ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُۥٓ ﴾ [الاعراف: ٥٩]
“তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই”। (আল-আ‘রাফ, ৫৯) এতদ ব্যতীত এ সম্পর্কে আরো প্রমাণাদি রয়েছে।
ইবনে রজব বলেন, কালেমার এই অর্থ বাস্তবায়িত হবে তখন, যখন বান্দাহ
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
এর স্বীকৃতি দান করার পর এটা বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং মাবুদ হওয়ার একমাত্র যোগ্য ঐ সত্তা যাকে ভয়-ভীতি, বিনয়-ভালবাসা, আশা-ভরসা সহকারে আনুগত্য করা হয়, যার নিকট প্রার্থনা করা হয়, যার সমীপে দো‘আ করা হয় এবং যার অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা হয়। আর এ সমস্ত কাজ একমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য প্রযোজ্য নয়।

এ জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন মক্কার কাফেরদেরকে বললেন, তোমরা বলো,
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
উত্তরে তারা বললো,
﴿ أَجَعَلَ ٱلۡأٓلِهَةَ إِلَٰهٗا وَٰحِدًاۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيۡءٌ عُجَابٞ ٥ ﴾ [ص: ٥]
“সে কি সমস্ত ইলাহকে এক ইলাহতে পরিণত করেছে ? এ তো অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়।” (ছোয়াদ-৫)
এর অর্থ হলো তারা বুঝতে পারল যে, এ কালেমার স্বীকৃতি মানেই এখন হতে মূর্তিপূজা বাতিল করা হলো এবং ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করা হলো। আর তারা কখনও এমনটি কামনা করে না। তাই এখানেই প্রমাণিত হলো যে,
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
এর অর্থ এবং এর দাবী হচ্ছে ইবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য সব কিছুর ইবাদত পরিহার করা।
এজন্য কোনো ব্যক্তি যখন বলে,
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
তখন সে এ ঘোষণাই প্রধান করে যে, ইবাদতের একমাত্র অধিকারী আল্লাহ তা‘আলাই এবং তিনি ব্যতীত অন্য কিছুর ইবাদাত যেমন, কবরপূজা পীরপূজা ইত্যাদি সমস্ত কিছুই বাতিল। এর মাধ্যমে গোরপূজারী ও অন্যান্যরা যারা মনে করে যে,
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
এর অর্থ হচ্ছে এই বলে স্বীকৃতি দেয়া যে, আল্লাহ আছেন, অথবা তিনি সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি কোনো কিছু উদ্ভাবন করতে সক্ষম, তাদের এই সমস্ত মতবাদ ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হলো।

আবার অনেকে মনে করে যে, কালেমা
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
এর অর্থ হলো কেবল “হাকেমিয়াহ বা হুকুমদাতা-বিধানদাতা অথবা সার্বভৌমত্ব শুধুমাত্র আল্লাহর” এবং মনে করে যে, যে কেউ তার জীবনে এ বিশ্বাস করল, কেবলমাত্র এর দ্বারা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ এর ব্যাখ্যা করল, সে নিঃশর্ত তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করল, এরপর যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পূজা -অর্চনা করা হয় বা মৃত ব্যক্তিদের বিষয়ে বিশ্বাস করা হয় যে, তাদের নামে মান্নত, কোরবানী ও ভেট প্রদান করার মাধ্যমে তাদের নৈকট্য লাভ করা সম্ভব বা তাদের কবরের চার পার্শ্বে ঘুরে তাওয়াফ করাতে কিংবা তাদের কবরের মাটিকে বরকতময় মনে করাতে কোনো অসুবিধা নেই এবং এতে কিছু আসে যায় না। এ লোকেরা অনুধাবন করতে পারেনি যে এদের মত এ ধরনের আক্বীদা-বিশ্বাস তৎকালীন মক্কার কাফেরগণও পোষণ করত। তারা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহই সৃষ্টিকর্তা, একমাত্র উদ্ভাবক এবং তারা অন্যান্য দেব- দেবীর ইবাদত শুধুমাত্র এজন্যই করত যে, তারাই তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার খুব নিকটবর্তী করে দিবে। তারা মনে করত না যে, ঐ সব দেব-দেবী সৃষ্টি করতে কিংবা রিযিক দান করতে সক্ষম। অতএব ‘হাকেমিয়াহ বা বিধানদাতা বা সার্বভৌমত্ব আল্লাহর জন্য’ এবং এটাই ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’এর প্রকৃত অর্থ বা একমাত্র অর্থ এমনটি নয় বরং নিঃসেন্দেহে হাকেমিয়াহ বা বিধান প্রদান বা সার্বভৌমত্ব এগুলো আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট এবং তা এ কালেমার অর্থের একটি অংশ মাত্র। কেননা কেউ যদি এক দিকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে যেমন, আইন আদালত বা বিচার বিভাগ ইত্যাদিতে শরীয়তের হুকুম প্রতিষ্ঠা করে অন্য দিকে আল্লাহর ইবাদতে তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করে তা হলে এর কোনো মূল্যই হবে না। সুতরাং শুধু হাকেমিয়্যাহ বা সার্বভৌমত্ব আল্লাহর, এটা প্রতিষ্ঠাই কালেমা লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ এর প্রকৃত উদ্দিষ্ট অর্থ নয়।

যদি
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
এর অর্থ এটাই হতো যেমনটি ঐ সমস্ত লোক ধারণা করে তাহলে মক্কার মুশরিকদের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের কোনো দ্বন্দ্বই থাকত না। তিনি তাদেরকে যদি শুধুমাত্র এতটুকু আহবানই করতেন যে, তোমরা এ মর্মে স্বীকৃতি প্রদান কর যে,আল্লাহ তা‘আলা উদ্ভাবন করতে সক্ষম। অথবা আল্লাহ বলতে একজন কেউ আছেন, অথবা তোমরা ধন-সম্পদ এবং অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে শরীয়াত অনুযায়ী ফায়সালা কর। এর সাথে সাথে তিনি যদি তাদেরকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার কথা বলা থেকে বিরত থাকতেন তাহলে কালবিলম্ব না করে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহ্বানে সাড়া দিত। কিন্তু তারা আরবী ভাষী হওয়ার কারণে বুঝতে পেরেছিল যে,
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
এর স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থই হচ্ছে সমস্ত দেব-দেবীর ইবাদতকে বাতিল বলে ঘোষণা করা। তারা আরো বুঝেছিল যে, এই কালেমা শুধুমাত্র এমন কতগুলো শব্দের সমারোহ নয় যে, যার কোনো অর্থ নেই বরং এসব কিছু বুঝার কারণেই তারা এর স্বীকৃতি দান থেকে বিরত থাকল এবং বলল,
﴿ أَجَعَلَ ٱلۡأٓلِهَةَ إِلَٰهٗا وَٰحِدًاۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيۡءٌ عُجَابٞ ٥ ﴾ [ص: ٥]
“সে কি সমস্ত ইলাহগুলোকে এক ইলাহতে পরিণত করল? এ তো অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়।” [সূরা ছোয়াদ:৫]
যেমন তাদের সম্পর্কে আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ إِنَّهُمۡ كَانُوٓاْ إِذَا قِيلَ لَهُمۡ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ يَسۡتَكۡبِرُونَ ٣٥ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوٓاْ ءَالِهَتِنَا لِشَاعِرٖ مَّجۡنُونِۢ ٣٦ ﴾ [الصافات: ٣٥، ٣٦]
“তাদেরকে যখন বলা হতো, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই’ তখন তারা উদ্ধত্য প্রদর্শন করত এবং বলত, আমরা কি এক উন্মাদ কবির কথায় আমাদের সকল উপাস্যকে পরিত্যাগ করব? (আস-সাফফাত-৩৫-৩৬)

অতএব তারা বুঝল যে,
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
এর মানেই হচ্ছে সমস্ত কিছুর ইবাদত ছেড়ে দিয়ে একমাত্র আল্লাহর জন্য ইবাদত করা। তারা যদি এক দিকে কালেমা ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ বলত অন্যদিকে দেব- দেবীর ইবাদতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকত তা হলে এটা হত স্ববিরোধিতা, অথচ এমন স্ববিরোধিতা থেকে তারা নিজদেরকে বিরত রেখেছে। কিন্তু আজকের কবর পূজারীরা এই জঘন্যতম স্ববিরোধিতা থেকে নিজদেরকে বিরত রাখছে না। তারা একদিকে বলে, ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ অন্যদিকে মৃত ব্যক্তি এবং মাজার ভিত্তিক ইবাদতের মাধ্যমে এ কালেমার বিরোধিতা করে থাকে। অতএব ধ্বংস ঐ সকল ব্যক্তির জন্য যাদের চাইতে আবু জাহাল ও আবু লাহাব ছিল কালেমা ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ এর অর্থ সম্পর্কে আরো বেশী অভিজ্ঞ।
সংক্ষিপ্ত কথা হলো, যে ব্যক্তি কালেমার অর্থ জেনে বুঝে কালেমার দাবী অনুযায়ী আমল করার মাধ্যমে এর স্বীকৃতি দান করল এবং প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সর্বাবস্থায় নিজকে শির্ক থেকে বিরত রেখে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতকে নির্ধারণ করল, সে ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে মুসলিম। আর যে এই কালেমার মর্মার্থকে বিশ্বাস না করে এমনিতে প্রকাশ্যভাবে এর স্বীকৃতি দান করল এবং এর দাবী অনুযায়ী গতানুগতিকভাবে কাজ করল সে ব্যক্তি মূলত মুনাফিক। আর যে মুখে এ কালেমা বলল এবং শির্ক এর মাধ্যমে এর বিপরীত কাজ করল সে প্রকৃত অর্থে স্ববিরোধী মুশরিক। সুতরাং এ কালেমা উচ্চারণের সাথে সাথে অবশ্যই এর অর্থ জানতে হবে। কারণ অর্থ জানাই হচ্ছে এর দাবী অনুযায়ী আমল করার মাধ্যম। আল্লাহ বলেন,
﴿ إِلَّا مَن شَهِدَ بِٱلۡحَقِّ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٨٦ ﴾ [الزخرف: ٨٦]
“তবে যারা জেনে বুঝে সত্যের সাক্ষ্য দিল তারা ব্যতীত (অন্যরা সুপারিশের অধিকারী হবে না)’’ (আয-যখরুফ, ৮৬)

আর এ কালেমার চাহিদা অনুযায়ী আমল হচ্ছে, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য সকল কিছুর ইবাদতকে অস্বীকার করা। এ কালেমা দ্বারা মূল উদ্দেশ্য তো তাই।

আর কালেমা ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ এর অন্যতম দাবী হলো ইবাদত, মোয়ামেলাত (লেন-দেন) হালাল-হারাম, সর্বাবস্থায় আল্লাহর বিধানকে মেনে নেওয়া এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও প্রবর্তিত বিধানকে বর্জন করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَمۡ لَهُمۡ شُرَكَٰٓؤُاْ شَرَعُواْ لَهُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا لَمۡ يَأۡذَنۢ بِهِ ٱللَّهُۚ ﴾ [الشورى: ٢١]
“তাদের কি এমন কোনো শরীক দেবতা আছে যারা তাদের জন্য বিধান রচনা করবে যার অনুমতি আল্লাহ দেন নি। (সূরা আশ- শুরা, ২১)

এ থেকে বুঝা গেল অবশ্যই ইবাদত, লেন-দেন এবং মানুষের মধ্যে বিতর্কিত বিষয়সমূহ ফয়সালা করতে আল্লাহর বিধানকে মেনে নিতে হবে এবং এর বিপরীত মানব রচিত সকল বিধানকে ত্যাগ করতে হবে। এ অর্থ থেকে আরো বুঝা গেল যে, সমস্ত বিদ‘আত এবং কুসংস্কার যা জ্বীন ও মানবরূপী শয়তান রচনা করে, তাও পরিত্যাগ করতে হবে। আর যে এগুলোকে গ্রহণ করবে সে মুশরিক বলে গণ্য হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ أَمۡ لَهُمۡ شُرَكَٰٓؤُاْ شَرَعُواْ لَهُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا لَمۡ يَأۡذَنۢ بِهِ ٱللَّهُۚ ﴾ [الشورى: ٢١]
“তাদের কি এমন শরীক দেবতা আছে যারা তাদের জন্য বিধান রচনা করবে যার অনুমতি আল্লাহ দেন নি?” [সূরা আশ-শূরা:২১]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ وَإِنۡ أَطَعۡتُمُوهُمۡ إِنَّكُمۡ لَمُشۡرِكُونَ ١٢١ ﴾ [الانعام: ١٢١]
“যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর তাহলে নিশ্চয়ই তোমরা মুশরিক”। (আল-আন‘আম: ১২১)
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ ﴾ [التوبة: ٣١]
“আল্লাহ ব্যতীত তারা তাদের পণ্ডিত ও পুরোহিতদেরকে রবরূপে গ্রহণ করেছে’’। (সূরা আত-তাওবাহ, ৩১)

সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আদী ইবনে হাতেম আত-ত্বায়ীর সামনে উল্লেখিত আয়াত পাঠ করেন তখন ‘আদী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আমাদের পীর-পুরোহিতদের ইবাদত করি না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ যে সমস্ত জিনিস হারাম করেছেন তোমাদের পীর-পুরোহীতরা তা হালাল করেছে, আর আল্লাহ যে সমস্ত জিনিস হালাল করেছেন তা তারা হারাম বা অবৈধ করেছে, তোমরা কি এতে তাদের অনুসরণ কর না ? আদী বললেন, অবশ্যই হাঁ, এতে আমরা তাদের অনুসরণ করতাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম বললেন, এটাই তাদের ইবাদত (তিরমিযী, হাদীস নং ৩০৯৪। কিতাবুত তাফসীর। )।
আশ-শাইখ আবদুর রহমান ইবন হাসান বলেন, সুতরাং অন্যায় কাজে তাদের আনুগত্য করার জন্যই এটা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের ইবাদত হয়ে গেল এবং এরই মাধ্যমে পীর পুরোহিতদের তারা নিজেদের রব হিসাবে গ্রহণ করল। আর এ হলো আমাদের বর্তমান জাতির অবস্থা এবং এটা এক প্রকার বড় শির্ক যার মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদ বা তাওহীদকে অস্বীকার করা হয়, যে একত্ববাদ বা তাওহীদের অর্থ বহন করে কালেমা “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ” এর সাক্ষ্য। অতএব এখানে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, এই ইখলাসের কালেমা (লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ) এসব বিষয়কে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে কারণ তা এ কালেমার অর্থের সম্পূর্ণ বিরোধী।

অনুরূভাবে মানব রচিত আইনের কাছে বিচার চাওয়া, বিচারের জন্য সেগুলোর দ্বারস্থ হওয়া পরিত্যাগ করা ওয়াজিব। কেননা, বিচার ফয়সালাতে আল্লাহর কিতাব কুরআনের কাছে যাওয়া ওয়াজিব। তদ্রূপ আল্লাহর কিতাব ব্যতীত অন্য কোনো আইন ও বিধানের কাছে বিচারের জন্য যাওয়া পরিত্যাগ করাও ওয়াজিব। আল্লাহ বলেন,
﴿ فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ ﴾ [النساء: ٥٩]
“তারপর তোমরা যদি কোনো বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড় তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ কর।” (আন্ নিসা-৫৯)
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَمَا ٱخۡتَلَفۡتُمۡ فِيهِ مِن شَيۡءٖ فَحُكۡمُهُۥٓ إِلَى ٱللَّهِۚ ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبِّي ﴾ [الشورى: ١٠]
“তোমরা যে বিষয়ই মতভেদ কর, তার ফয়সালা আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তিত হবে, আর সে আল্লাহ, তিনিই আমার রব”। (সূরা আশ্-শূরা ১০)
যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ফয়সালা করে না তার বিষয়ে আল্লাহর ফয়সালা হলো এই যে, সে কাফের অথবা যালেম অথবা ফাসেক এবং তার ঈমানদার থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। যা প্রমাণ করে যে, আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী যে ব্যক্তি ফয়সালা করবে না সে কাফের হয়ে যাবে যখন সে শরীয়ত বিরোধী ফায়সালা দেয়াকে জায়েয বা মোবাহ মনে করবে অথবা মনে করবে যে, তার ফয়সালা আল্লাহ তা‘আলার ফয়সালা থেকে অধিক উত্তম বা অধিক গ্রহণীয়। এমন বিশ্বাস পোষণ করা হবে তাওহীদ পরিপন্থী, কুফুরী ও শির্ক এবং তা
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
এই কালেমার অর্থের একেবারে বিরোধী।

আর যদি বিচারক বা শাসক শরীয়ত বিরোধী ফয়সালা দানকে মোবাহ বা জায়েয মনে না করে, বরং শরীয়ত অনুযায়ী ফয়সালা প্রদানকে ওয়াজিব মনে করে কিন্তু পার্থিব লালসার বশবর্তী হয়ে নিজের মনগড়া আইন দিয়ে ফয়সালা করে তবে এটা ছোট শির্ক ও ছোট কুফরীর পর্যায়ে পড়বে। তবে এটাও
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
এর অর্থের পরিপন্থী। অতএব
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
একটি পূর্ণাঙ্গ পথ ও পদ্ধতি, এ কালেমাই মুসলিমদের জীবনকে সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং পরিচালনা করবে তাদের সমস্ত ইবাদত-বন্দেগী এবং সমস্ত কাজ কর্মকে। এই কালেমা শুধুমাত্র কতগুলো শব্দের সমারোহ নয় যে, না বুঝে একে সকাল সন্ধ্যার তাসবীহ হিসাবে শুধুমাত্র বরকতের জন্য পাঠ করবে আর এর দাবী অনুযায়ী কাজ করা থেকে বিরত থাকবে অথবা এর নির্দেশিত পথে চলবে না। মূলতঃ অনেকেই একে শুধুমাত্র গতানুগতিক ভাবে মুখে উচ্চারণ করে থাকে, কিন্তু তাদের বিশ্বাস ও কর্ম এর পরিপন্থী।
কালেমা
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ

এর আরো দাবী হলো, আল্লাহর যত গুণবাচক নাম ও তাঁর নিজ সত্তার যে সমস্ত নাম আছে যে গুলোকে তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন অথবা তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন সে সব নাম ও গুণাবলীকে যথাযথভাবে সাব্যস্ত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ وَذَرُواْ ٱلَّذِينَ يُلۡحِدُونَ فِيٓ أَسۡمَٰٓئِهِۦۚ سَيُجۡزَوۡنَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٨٠ ﴾ [الاعراف: ١٨٠]
“আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সবচেয়ে উত্তম নামসমূহ, কাজেই সে সমস্ত নাম ধরেই তাঁকে ডাক, আর তাদেরকে বর্জন কর যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল অবশ্যই পাবে। (আল-আ‘রাফ: ১৮০)
ফাতহুল মজিদ কিতাবের লেখক বলেন, আরবদের ভাষায় প্রকৃত ‘ইলহাদ’ বলতে বুঝায়, সঠিক পথ পরিহার করে বক্র পথ অনুসরণ করা এবং বক্রতার দিকে ঝুকে পড়ে পথভ্রষ্ট হওয়াকে।

আল্লাহর সমস্ত নাম এবং গুনবাচক নামের মধ্যেই তাঁর পরিচয় এবং কামালিয়াত ফুটে উঠে বান্দার নিকট। লেখক আরো বলেন, অতএব আল্লাহর নামসমূহের বিষয়ে বক্রতা অবলম্বন করা মানে ঐ সমস্ত নামকে অস্বীকার করা, অথবা ঐ সমস্ত নামের অর্থকে অস্বীকার বা অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রাসঙ্গিক মনে করা, অথবা অপব্যাখ্যার মাধ্যমে এর সঠিক অর্থকে পরিবর্তন করে দেওয়া, অথবা আল্লাহর ঐ সমস্ত নাম দ্বারা তাঁর মাখলুকাতকে বিশেষিত করা। যেমন ওহদাতুল ওয়াজুদ পন্থিরা স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে এক করে সৃষ্টির ভাল-মন্দ অনেক কিছুকেই আল্লাহর নামে বিশেষিত করেছে (এ মতবাদকে ইংরেজিতে pantheism আর বাংলাতে সর্বেশ্বরবাদ বলা হয়ে থাকে। )।
অতএব যে ব্যক্তি মুতাযিলা সম্প্রদায় বা জাহমিয়া বা আশায়েরা মতবাদে বিশ্বাসীদের অনুরূপ আল্লাহর নামসমূহের ও গুনাবলীর অপব্যাখ্যা করল, অথবা সেগুলোকে অপ্রয়োজনীয় ও অর্থ-সারশুন্য মনে করল, অথবা সেগুলোর অর্থ বোধগম্য নয় বলে মনে করল এবং এসব নাম ও গুণাবলীর সুমহান অর্থের উপর বিশ্বাস আনলো না সে মুলত আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে বক্রতার পথ অবলম্বন করল এবং ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ এর অর্থ ও উদ্দেশ্যেরই বিরোধিতা করল। কেননা ‘‘ইলাহ’’ হলেন তিনি, যাঁকে তার নাম ও সিফাতের মাধ্যমে ডাকা হয় এবং তাঁর নৈকট্য লাভ করা হয়। আল্লাহ বলেন,
(فَادْعُوْهُ بِهَا) “
ঐ সমস্ত নামের মাধ্যমে তাঁকে ডাক’’। আর যার কোনো নাম বা সিফাত নেই সে কিভাবে ‘‘ইলাহ’’ বা উপাস্য হতে পারে এবং কিসের মাধ্যমে তাকে ডাকা হবে?
ইমাম ইবনুল কাইয়েম বলেন, শরীয়াতের বিভিন্ন হুকুম আহকামের বিষয়ে এ উম্মতের পূর্ববর্তী মানুষগণ বিতর্কে লিপ্ত হলেও সিফাত সংক্রান্ত আয়াতসমূহে বা এসম্পর্কে যে সংবাদ এসেছে তাতে কেউ বিতর্কে লিপ্ত হয়নি। বরং সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীগণ এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, আল্লাহর এসমস্ত আসমায়ে হুসনা এবং সিফাতের প্রকৃত অর্থ বুঝার পর ঠিক যেভাবে তা বর্ণিত হয়েছে, কোনো প্রকার অপব্যাখ্যা ছাড়াই তা ঐ ভাবেই মেনে নিতে হবে এবং স্বীকৃতি দান করতে হবে। এখানে প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহর আসমায়ে হুসনা এবং সিফাতের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ তাওহীদ ও রিসালাতকে দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করার এটাই মূল উৎস এবং তাওহীদের স্বীকৃতর জন্য এ সমস্ত আসমায়ে হুসনার স্বীকৃতি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্যই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন; যাতে কোনো প্রকার সংশয়ের অবকাশ না থাকতে পারে।

হুকুম-আহকাম তথা বিধি-বিধানের আয়াতগুলো বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ ব্যতীত সবার জন্য বুঝে উঠা একটু কঠিন কাজ, কিন্তু আল্লাহর সিফাত সংক্রান্ত আয়াতসমূহের সাধারণ অর্থ সব মানুষই বুঝতে পারে। অর্থাৎ তাঁর সত্তা ও আকৃতি বুঝা ব্যতীত আসল অর্থ সকলই বুঝতে পারে (ইবনুল কাইয়্যেম, মুখতাসারুস সাওয়া‘য়িকুল মুরসালাহ ১/১৫। )।
লেখক আরো বলেন, এটি এমন একটি বিষয় যা সহজাত প্রবৃত্তি, সুস্থ মস্তিস্ক এবং আসমানী কিতাবসমূহের মাধ্যমে বুঝতে পারা যায় যে, যার মধ্যে পূর্ণতা অর্জনের সমস্ত গুণাবলী না থাকে সে কিছুতেই ইলাহ বা মা‘বুদ, পরিচালক ও রব হতে পারে না। সে হবে নিন্দিত ত্রুটিপূর্ণ ও অপরিপক্ক এবং পূর্বাপর কোনো অবস্থায় সে প্রশংসিত হতে পারে না। সর্বাবস্থায় প্রশংসিত হবেন তিনিই যাঁর মধ্যে কামালিয়াত বা পূর্ণতা অর্জনের সমস্ত গুণাবলী বিদ্যমান থাকে। এ জন্যই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের পূর্বকালীন মনীষীগণ সুন্নাতের উপর বা আল্লাহর সিফাত সাব্যস্তকরণ যেমন, তাঁর সকল সৃষ্টির উর্ধ্বে থাকা, তাঁর কথোপকথন ইত্যাদির উপর যে সব গ্রন্থ রচনা করেছেন সেগুলোর নাম দিয়েছেন ‘‘আত-তাওহীদ’’ হিসেবে। কারণ এ সমস্ত গুণাবলীকে অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করা এবং এর সাথে কুফরী করার অর্থ হলো, সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করা এবং তাঁকে না মানা। আর আল্লাহর একত্ববাদ বা তাওহীদের অর্থ হচ্ছে তাঁর সমস্ত কামালিয়তের সিফাতকে মেনে নেওয়া, সমস্ত দোষত্রুটি ও অন্য কিছুর সাথে তুলনীয় হওয়া থেকে তাঁকে পবিত্র মনে করা । (ইবনুল কাইয়্যেম, মাদারিজুস সালেকীন ১/২৬।

( শাইখ সালেহ ইবন ফাওযান আলে-ফাওযান, কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ, শর্তসমূহ এবং ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে তার প্রভাব )

Source

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member