শিশু প্রিয় নবী মুহাম্মদ (দঃ)
শিশুদের সঙ্গে রাসূলুল্লাহের (সাঃ) ব্যবহার ছিল স্নেহপূর্ণ, কোমল এবং বন্ধুসুলভ। তিনি তাদের হাসি আনন্দে যোগ দিতেন। ছোটদের চপলতায় তিনি কখনও অসন্তুষ্ট বা বিরক্ত হতেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন।
বড়রা সাধারণত শিশুদের কথা মন দিয়ে শোনেনা। হা, হু, করে যায়। শিশুরা কিন্তু তা বুঝতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন বলে তারা তাঁকে ছাড়তে চাইতোনা।
হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সাথে পথ চলছিলাম। পথের পাশে একদল ছেলে খেলা করছিলো। রাসূল (সাঃ) তাদের কাছে থেমে গেলেন এবং সালাম জানালেন। পথ চলার সময় অন্যদেরকে বিশেষ করে শিশুদেরকে সালাম জানানো নবী করিমের অভ্যাস ছিলো।
সাহাবী জাবের বিন সামুরা (রাঃ) তাঁর বাল্যকালের একটি ঘটনার বর্ণনা দেন। ছোট সময় তিনি একদিন রাসুলুল্লাহর (সাঃ) পেছনে সালাত (নামাজ) আদায় করছিলেন। সালাত শেষ করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঘরের দিকে রওনা হন। জাবের বিন সামুরাও পিছে পিছে তাকে অনুসরণ করেন। কিছুপথ অতিক্রম করার পর হঠাৎ একদল শিশু এসে রাসূলকে (সাঃ) ঘিরে ধরলো। জাবের বিন সামুরাও (রাঃ) তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। রাসূল (সাঃ) সব শিশুকে আদর করলেন। হাত মুসাফা করলেন, মাথায় হাত বুলালেন এবং জাবের বিন সামুরাকেও আদর করলেন।
শিশুদেরকে দেখাবার জন্য আনয়ন
সাহাবীরা তাঁদের নিজ এবং আত্মীয় শিশু সন্তানদেরকে দেখানোর জন্য রাসূলের কাছে নিয়ে আসতেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের মাথায় হাত বুলাতেন। নিজের মুখে খেজুর চিবিয়ে ছোট শিশুদের মুখে দিতেন এবং তাদের জন্য দোয়া করতেন।
সাহাবিয়া উম্মে কায়েসের পুত্র
একদিন প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) খাওয়ার জন্য বসেছিলেন। কিন্তু খানা তখনও শুরু করেননি। উম্মে কায়েস বিনতে মুহসিন (রাঃ) তাঁর শিশু পুত্রটিকে কোলে করে রাসূলের (সাঃ) সাথে দেখা করতে এলেন।
শিশুটিকে দেখে রাসূল (সঃ) খানা ছেড়ে তার দিকে এলেন। পরম আদরে শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে খাবারের স্থানে গিয়ে বসলেন। শিশুটি নবীর আদর পেয়ে তাঁর কোলেই পেশাব করে ভিজিয়ে দিলো।
রাসূল (সাঃ) স্মিত হাসলেন। চেহারায় বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ পেলোনা। তিনি কিছু পানি আনার জন্য একজনকে বললেন। পানি আনা হলে যে যে জায়গায় পেশাব পড়েছিল সেখানে তিনি পানি ঢেলে দিলেন। বাগানের ফুল যেমন পবিত্র, মায়ের কোল থেকে নেয়া শিশুও তেমন পবিত্র।
উটের পিটে দু’শিশু
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন কোনো সফর শেষে বাড়ী ফিরতেন তখন শিশু কিশোরদেরকে তিনি নিজ সওয়ারীর উপর তুলে নিতেন, তাদেরকে আগে-পিছে বসিয়ে বাড়ীর ভিতরে ঢুকতেন।
একদিন দু’শিশু রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উষ্ট্রির উপরে উঠে বসেছে। একজন তার সম্মুখে, আর একজন পিছনে। যে শিশুটি সামনে বসেছিলো সে পিছনের শিশুটিকে লক্ষ্য করে বললো, আমি রাসূলুল্লাহর (সাঃ)-এর সামনে বসেছি, তুই বসেছিস পিছনে।
পিছনের শিশুটিও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে দু’হাত দিয়ে ধরে বলে উঠলো আমিতো নবীর গায়ের সঙ্গে মিশে আছি। সামনের শিশুটি তখন রাসূল (সাঃ)-এর বুকের দিকে হেলান দিয়ে বললো, আমি নবীর গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছি।
পিছনের শিশুটি তার ছোট্ট হাত দিয়ে রাসূল (সাঃ) কে জড়িয়ে ধরে বললো, আমি রাসূল (সাঃ) কে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছি। সামনের শিশুটি এবার বলার জন্য কিছু পেলনা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার গায়ে হাত রাখলেন। শিশুটি আরো আনন্দিত হলো।
মদীনার শিশু কর্তৃক অভ্যর্থনা
হিজরতের পর মরু প্রান্তর অতিক্রম করে পথশ্রান্ত মহানবী (সাঃ) উপস্থিত হলেন মদিনার উপকণ্ঠে কুবা পল্লীতে। মদিনার নারী পুরুষ তাকে খোশ আমদেদ ও সম্বর্ধনা দেয়ার জন্য স্থানে স্থানে ভীড় করছিলো। কেউ গাছের উপর উঠেও তার উট দেখার চেষ্টা করছিলো। তিনি যে উটে চড়ে কুবা হয়ে মদিনায় প্রবেশ করেন তার নাম ছিল আল কাসওয়া।
একই উটে প্রিয় নবীর (সাঃ) পিছনে বসেছিলেন শ্রেষ্ঠ সাথী হযরত আবুবকর (রাঃ)। পথ দেখিয়ে এনেছিলেন আবদুল্লাহ বিন উরাইকিত নামক একজন অমুসলিম। কাফিরদের ঘোষিত ১০০টি উট পাওয়ার লোভে তিনবার তাদের আক্রমণ করেছিল সুরাকা বিন মালিক।
কুবায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বনি আম বংশের কুলসূম ইবনে হাদাম এবং সাদ ইবনে খাইসামার অতিথি ছিলেন। কুবায় প্রিয়নবী (সাঃ) চৌদ্দ দিন অবস্থান করে মদিনায় যাত্রা করেন (বুখারী)। দিনটি ছিল শুক্রবার। এদিন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কুবা পল্লী ত্যাগ করে মদিনার দিকে অগ্রসর হয়ে বানুনা উপত্যকায় বনি সালেম ইবনে আওফ মহল্লায় তশরিফ আনেন এবং ঐ মহল্লায় জুমুয়ার নামাজ আদায় করেন। এটা ছিল ইসলামের ইতিহাসের প্রথম জুমুয়ার নামাজ।
বনি সালেম মহল্লা থেকে রাসূল (সাঃ) মদিনার রওনা হন। মদিনাবাসীরা নবী (সাঃ) আগমনের খবর এর মাঝেই পেয়ে গিয়েছিলো।
মদিনার বয়স্ক নারী-পুরুষের সাথে শিশুরাও প্রিয় নবীকে (সাঃ) দেখার জন্য পথের পাশে ভীড় করেছিলো। ‘আল্লাহু আকবার’, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এসেছেন। ‘আল্লাহু আকবার, মুহাম্মদ এসেছেন’। ‘আল্লাহু আকবার, জান্নাতের নেয়ামত মদিনায় এসেছেন, শান্তির দূত আমাদের মাঝে এসেছেন’। এ সমস্ত কথা বলে তার জন্য অপেক্ষমান জনতা আনন্দ প্রকাশ করছিলো।
রাসূলুল্লাহর (সাঃ) উটনী (কাসওয়া) বনি মালিক ইবনে আন নাজ্জারের দু’টি এতিম বালক সুহাইল ইবন আমার (রাঃ) এবং সাহল ইবনে আমারের (রাঃ) উট বাঁধার এবং খেজুর শুকাবার স্থানে বসে পড়েছিলো। সুহায়ল (রাঃ) ও সাহল (রাঃ) এর অভিভাবক ছিলেন আসাদ ইবনে জুবারা (রাঃ)। দশ স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে এ জমি ক্রয় করা হয়েছিল। মুদ্রা দিয়েছিলেন হযরত আবু বাকর (রাঃ)।
অন্যদের সাথে সাথে শিশুরাও বলছিলো “ইয়া মুহাম্মদ (সাঃ) সালামু আলাইকা”, ইয়া রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) সালামু আলাইকা।” শিশুদের সমবেত সুললিত কণ্ঠধ্বনি মহানবীর (সাঃ) বেশ ভাল লাগলো। তাদের আনন্দে তিনিও আনন্দিত হলেন এবং উট থেকে তাদের কাছেই নেমে গেলেন। তাদের হাত ধরলেন, মাথায় হাত রাখলেন, চিবুক ধরে আদর করলেন।
অন্যদের সাথে সাথে বনি নাজ্জারের শিশু-কিশোরীরা কবিতা আবৃত্তি করে, রাসুলুল্লাহকে খোশ আমদেদ জানায়। তাদের কবিতার একটি বাক্য ছিলো- আমরা নাজ্জার গোত্রের মেয়ে, কি সৌভাগ্য আমাদের, মুহাম্মদ আমাদের প্রতিবেশী। রাসূলুল্লাহ আবু আইয়ুব নাজ্জারীর (রাঃ) আতিথ্য গ্রহণ করেন।
মহানবী (সাঃ) শিশুদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি আমাকে পছন্দ কর ? আমাকে ভালোবাস ? শিশুরা মহানন্দে জবাব দিলো, “অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)। আমরা আপনাকে পছন্দ করি। আপনাকে আমরা ভালোবাসি।” আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মধুর হাসি হেসে তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, আমিও তোমাদেরকে পছন্দ করি। আমিও তোমাদেরকে ভালোবাসি।
মক্কার বনু হাশেম কবিলার শিশুদের আনন্দ
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মানুষকে ভালোবাসতেন, বিশেষ করে শিশুদেরকে, এ ভালোবাসার অনুভূতি তাঁর কথায় এবং বহু কর্মে প্রকাশিত হয়েছিলো। মহানবী (সাঃ) যখন মক্কায় হজ্জ করতে যান, মক্কার শিশুরাও তাঁর আগমণে আনন্দ প্রকাশ করেছিলো।
বনু হাশেম গোত্রের শিশুদের আনন্দ ছিল সবচেয়ে বেশি। একস্থানে তিনি নিজের উট থেকে নেমে যান এবং শিশুদেরকে উটে বসিয়ে দেন। তারা প্রিয়নবী (সাঃ)-এর উটে বসে আনন্দ উচ্ছাসে বিগলিত হয়ে উঠেছিলো।
নিষ্পাপ শিশু
শিশুরা ফিরিস্তাদের ন্যায় নিষ্পপ। তারা কোনো ষড়যন্ত্র করে মানুষের ক্ষতি করেনা। অসৎ চিন্তা তাদের মাথায় আসেনা। তারা মানুষের মনে কষ্ট দেয়না। তাদের কষ্টে বড়দের মনে কষ্ট হয়। বড়রা তাদের নিরাপত্তা এবং হেফাজতের জন্যে বেশ উদ্বিগ্ন হন।
জন্মকালে কত দুর্বল ও অসহায় মানব শিশু। কিন্তু কালক্রমে হয়ে উঠে কত শক্তিশালী। শিশু ফুটন্ত গোলাপ নয়; গোলাপ কুঁড়ি। মনিমুক্তা প্রাণহীন। শিশু বেহেস্ত বিচ্যুত জীবন্ত মনিমুক্তা।
শিশুহীন ঘর
ঘর সাজাতে হলে শিশু প্রয়োজন। যতসব মূল্যবান আসবাবপত্র দ্বারাই গৃহ পূর্ণ করা হোক না কেন; একটি শিশু ঘরটিকে যত জীবন্ত, আনন্দময় এবং সুন্দর করে তোলে, অতি মূল্যবান আসবাবপত্র তার তুলনায় মূল্যহীন।
শিশু আল্লাহর প্রদত্ত নিয়ামত। পরিবারে সন্তান এলে মানুষের মন উদার হয়। প্রশস্ত হয়। নিঃস্বার্থভাবে অন্যের জন্যে কিছু করার উত্তম প্রশিক্ষণের মাধ্যম হলো শিশু।
স্নেহ, ভালোবাসা, মমতারূপ মানবীয় গুণাবলী বিকাশ লাভ করে অপত্যস্নেহের মাধ্যমে। সন্তানের মাধ্যমে মানুষ দেশ, জাতি এবং সভ্যতায় অবদান রেখে যায়।
সূত্র: মহানবী ও শিশু বই থেকে। লেখক: এ. জেড. এম. শামসুল আলম