মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলাম

রচনায়: মুহাম্মদ আবদুর রশীদ

বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে এসে মানুষ যে সকল মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখী হয়েছে তার মধ্যে মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাস অন্যতম। মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাস এমন দু’টি ব্যাধি যা একটি রাষ্ট্র তথা সমাজ ব্যবস্থার মূলে আঘাত করে। মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাস একদিকে পারিবারিক জীবনকে বিপর্যস্ত করে ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে সামাজিক সংহতি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে, অন্য-দিকে একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে করে ব্যাহত। যেহেতু মাদকাসক্তি মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তাই মাদকাসক্ত লোকের পক্ষে যেকোন ধরনের জঘন্য অপকর্মে লিপ্ত হওয়া স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। তাই মাদকাসক্তি সকল সামাজিক অপরাধের মূল উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছে।

আদিকাল থেকেই মানব সমাজে নেশার ব্যবহার প্রচলিত হয়ে এসেছে। নেশা শব্দটি আরবী নিসাতুন শব্দের বাংলা রূপান্তর। যার অর্থ আনন্দ, প্রফুল্লতা, আমোদ, ভোগ ইত্যাদি। তবে বাংলা ভাষায় নেশা শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত। ড্রাগ শব্দটি ইংরেজি। ইতালীয় ড্রাগের রূপান্তর এটি। যার অর্থ শুষ্ক ঔষধি গাছ-গাছড়া থেকে আহরিত বস্ত। বাংলায় যাকে ভেষজ বলা চলে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ড্রাগের সংজ্ঞায় বলেছে : ড্রাগ হলো এমন বস্তু যা জীবন্ত জীব গ্রহণ করলে তার এক বা একাধিক কার্যকলাপে ঈষৎ পরিবর্তন ঘটায়।

মিসরীয়, সুমেরীয়, আসিরীয়, গ্রীক, রোমান প্রভৃতি প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসে মাদক বা নেশাজাতীয় দ্রব্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। ৬০০০ বছরের অধিক পুরাতন সুমেরীয় সভ্যতার নিদর্শনস্বরূপ আবিষ্কৃত শিলালিপিতে Opium Poppy নামক উদ্ভিদের উল্লেখ পাওয়া যায়। আর আফিম নামক মাদকদ্রব্যের উৎস এই Poppy গাছ। আফিমের উল্লেখ আছে গ্রীক মহাকবি হোমারের ওডিসি মহাকাব্যে। মিসরের রাজা কর্তৃক ট্রয়ের রমনী হেলেনকে Nepenthe (নেপেনথি) নামক নেশাজাতীয় বস্তু উপহার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য বলতে মদ, গাঁজা, আফিম, চরস, হেরোইন, প্যাথেড্রিন, ভাং, তাড়ি, ফেনসিডিল, স্পিরিট বা এলকোহল প্রভৃতি বস্তুকে বোঝায়। আমাদের দেশে নেশার ব্যবহার পূর্ব থেকে কিছুটা থাকলেও হেরোইন শব্দটির সাথে সাধারণের পরিচয় ঘটেছে মাত্র দেড়- দু’দশক আগে। আমেরিকানদের নিকট এই হেরোইনের পরিচয় হোয়াইট ডেথ নামে, ইংল্যাণ্ডের লোকদের কাছে স্ন্যাক ডাস্ট, জাপানীদের কাছে ড্রাগন, চীনাদের কাছে চিংকচি, আর আমাদের দেশীয়দের নিকট ব্রাউন সুগার, পুরিয়া, পাত্তি ডাইল ইত্যাদি নামে পরিচতি।

বর্তমানে আমাদের দেশ মাদকাসক্তির ক্যান্সারে আক্রান্ত। কিশোর থেকে শুরু করে প্রৌঢ় পর্যন্ত এক মরণ ছোবলের শিকার। বিশেষ করে যুব সমাজ আজ এর শিকারে পরিণত হয়েছে চরমভাবে।

একটি জাতির ভবিষ্যৎ হল যুব সমাজ। তাদেরকে মাদকাসক্ত করে পঙ্গু করে দিতে পারলে জাতির ভবিষ্যৎ বিনষ্ট হয়ে নিশ্চিত ধ্বংস ছাড়া আমাদের উপায় থাকে না। দেশের যুব সমাজ মাদকাসক্ত হওয়ার অর্থ দেশের সার্বিক অধঃপতন। যুব সমাজই দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণকারী মূল শক্তি। যুব সমাজই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তারাই জাতির রাজনীতিক, কূটনীতিক, শিক্ষক, সমাজসেবক; এক কথায় দেশের চালিকাশক্তি। এ যুব সমাজই যদি চত্রিহীন হয় তবে দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি, সমাজ-ব্যবস্থা সব কিছুতেই এর প্রতিফলন ঘটতে বাধ্য- যার নিশ্চিত ফল একটি অধঃপতিত জাতি।

আমাদের দেশ আজ মাদকদ্রব্যে ছেয়ে গেছে।’ ১৯৯৬ সালের এক পরিসংখান মতে ঢাকাতেই রয়েছে ১৩৮টি মাদকদ্রব্যের বাজার। এসব জায়গায় অন্যান্য মাদকদ্রব্যের সাথে ফেনসিডিল বিক্রি হয় অবাধে ! এ ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে প্রায় ৫ হাজার লোক। বর্তমানে ঢাকার প্রায় প্রতিটি মহল্লায়ই বিক্রি হচ্ছে মাদকদ্রব্য। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও বর্তমানে সকল শহর অঞ্চলে এমন কি গ্রাম-গঞ্জ পর্যন্ত সাধারণ পণ্যের মত সহজলভ্য হয়ে পড়েছে মাদকদ্রব্য। শুধু নরসিংদীর মত ছোট জেলা শহরে এক রাতে দু’টি দোকান থেকে বিষাক্ত মদ পান করে প্রায় দেড়শতের মত লোক প্রাণ হারায়। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় সারা দেশে মাদকদ্রব্যের প্রসার কী পরিমাণ বেড়েছে। এভাবে মাদকের ব্যবহার জাতিকে প্রতিদিন নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের অতল গহ্বরের দিকে। এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে হত্যা, ছিনতাই, হাইজ্যাক, রাহাজানি, চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, ইত্যাকার নানা ধরনের অপরাধ। সেই সাথে মাদকাসক্তরা হচ্ছে পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, স্বাস্থ্যহীন, ধীশক্তি-বিস্মৃত !

অসংখ্য সমস্যার সাথে বর্তমানে মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাস আমাদের সমাজকে অনিশ্চয়তার অতল গহ্বরে তলিয়ে দিচ্ছে। আমাদের উন্নয়নের সকল কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করছে, এমন কি নস্যাৎ করে দিচ্ছে।

আমরা মাদকাসক্তির কয়েকটি কারণ নির্ধারণ করতে পারি। যথা- (১) বেকারত্ব, (২) হতাশা, (৩) অসৎসংগ, (৪) মাদকদ্রব্যের প্রতি কৌতূহল ও এর দ্বারা সহজ আনন্দ লাভের ইচ্ছা, (৫) পারিবারিক প্রভাব, (৬) ধর্মানুভূতির অভাব, (৭) মাদক- দ্রব্যের সহজপ্রাপ্যতা।

মাদক সমস্যা নিরসনে কি কি পদক্ষেপ নেয়া যায়, বিষয়টি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি। মাদক সদস্যা আমাদের একক কোন সমস্যা নয়। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ এ সমস্যায় জর্জরিত। মাদক সমস্যা মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার পথে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বিশ্বসম্প্রদায় এ সমস্যা নিরসনে আজ একতাবদ্ধ। জাতিসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত হয়েছে বিভিন্ন মাদক বিরোধী কনভেনশন ও চুক্তি। এর মধ্যে ১৯৬১ সালের একক কনভেনশন ও চুক্তি, ১৯৭১ সালের মানুষের মানসিক আচরণ পরিবর্তনকারী মাদকদ্রব্য সাইকোট্রোপিক সাবস্ট্যান্স সংক্রান্ত কনভেনশন এবং ১৯৮৮ সালের মাদকদ্রব্যের চোরাচালান-বিরোধী কনভেনশন অন্যতম। বাংলাদেশ এ সকল কনভেনশনের স্বাক্ষরদাতা দেশ হিসেবে মাদক সমস্যা নিরসনে চলমান আন্তর্জাতিক প্রয়াসের সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত। এতদ্ব্যতীত সার্ক চেতনার আলোকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মাদকদ্রব্যের চোরাচালান ও অপব্যবহার প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রণীত সার্ক কনভেনশন ১৯৯০-এ বাংলাদেশ অন্যতম স্বাক্ষরদানকারী দেশ। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি বাংলাদেশও ভয়াবহ সমস্যার সমাধানকল্পে উল্লেখযোগ্য প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অবৈধ মাদকদ্রব্যের চোরাচালান বন্ধের জন্য ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রবর্তন করা হয়। এবং এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ অধিদপ্তর আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংস্থা ইউ এনডিসিপি-এর সহায়তায় এ পর্যন্ত ১৭টি প্রশিক্ষণ কোর্সে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মোট ৩৫৭ জন কর্মকর্তাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। মাদক অপরাধের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জন্য ২৫৮.০৭ লক্ষ্য টাকা ব্যয়ে ঢাকায় একটি পৃথক রাসায়নিক পরীক্ষাগার স্থাপনের কাজ হাতে নিয়েছে।[1]

মাদকাসক্তির প্রতিকারের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এবং সামাজিকভাবে যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন তা হলো: (১) মাদকের কুফল প্রচার, (২) দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকারত্ব দূর করার জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি, (৩) মাদক নিবারণে সামাজিক আন্দোলন, (৪) ধর্মানুভূতি ও নৈতিকতার জাগরণ, (৫) সহজপ্রাপ্যতা বন্ধ করা, (৬) পারিবারিক শান্তি পুনর্বাসন ব্যবস্থা।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সর্বশক্তি নিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে সর্বপ্রথম। তবে এ কথা সত্য যে, এ কাজ সরকারের একার পক্ষে কিছুতেই সম্পাদন করা সম্ভব নয়। সমাজের বিবেকবান সকলকে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসতে হবে, তা না হলে আমাদের সকলেরই ভবিষ্যৎ বিনষ্ট হয়ে যাবে। বিনষ্ট হয়ে যাবে পুরো সমাজ, দেশ ও জাতি।

ইসলাম-পূর্ব অন্ধকার যুগে আরবগণ মাদকাসক্তিতে ছিল সম্পূর্ণ নিমজ্জিত। তাদের জীবনের প্রধান অবলম্বন ছিল মদ, জুয়া, নারী ইত্যাদি। ইসলাম-পূর্ব জাহেলী যুগে তারা মদপান করে হেন অপকর্ম নেই যা করত না। তাই ইসলাম আগমনের পর প্রথম মদ্যপানকে নিরুৎসাহিত করা হয় এবং ধীরে ধীরে মদ্যপানকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি মদের নেশা চিরতরে নির্মূল করার লক্ষ্যে মদের পাত্র ব্যবহারের প্রতিও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ইসলাম মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। পবিত্র কুরআন ঘোষণা করছে:

“হে মু’মিনগণ বস্তুত মদ (সকল প্রকার মাদকদ্রব্য) জুয়া, প্রতিমা (মানুষের নিজ হাতে তৈরি উপাস্য), ভাগ্য নির্ণায়ক তীর হচ্ছে ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কারসাজি, তোমরা এ (ঘৃণ্য কর্ম) থেকে বিরত থাক, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।” (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ১০)

অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা বলেন:

“শয়তান তো চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহ্ স্মরণ ও নামায থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে, অতএব তোমরা এখনও কি নিবৃত্ত হবে না?” (সূরা আল মায়িদা, আয়াত:৯১)

রাসূল (সা) মাদক ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। এর ব্যবহারকারী, উৎপাদনকারী ও সংশ্লিষ্টকারী সম্পর্কেও মারাত্মক পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ ও রাসূলের কঠোর নিষেধাজ্ঞার পরেও একজন মুসলমান মাদকাসক্ত হতে পারে না। কিন্তু যা বাস্তব তা হলো শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশসহ বাংলাদেশ এখন মাদকাসক্তির করাল গ্রাসে নিপতিত। ধর্মানুভূতির অভাব এবং ইসলামী অনুশাসন পালন না করার কারণে আজ আমাদের সমাজে ঘটেছে মাদকাসক্তির মত মহা বিপর্যয়। তাই ব্যক্তি-জীবনে ইসলামী আদর্শ অনুসরণ ও সমাজে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল মাদকাসক্তির করাল গ্রাস হতে ব্যক্তি, সমাজ ও দেশকে রক্ষা করা সম্ভব।

এখন সন্ত্রাস নিয়ে কিছু আলোচনা করছি। বর্তমানে আমাদের দেশে এটি একটি বহুল আলোচিত বিষয়। শুধু এদেশেই নয়; বরং গোটা বিশ্বেই এটি এখন আলোচনার বিষয়বস্তু। বিশ্বনেতৃবৃন্দ রীতিমত শংকিত হচ্ছেন সন্ত্রাসবাদের বিস্তারের কথা ভেবে। সন্ত্রাসকে যদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তাহলে কোন কোন ক্ষেত্রে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এটিই এখন প্রধান সমস্যা।

সন্ত্রাস শব্দটির প্রকৃতিগত বিশ্লেষণ হলো সম-ত্রাস। অর্থ: অতিশয় ত্রাস বা ভয়ের পরিবেশ। আর একটি সত্য যে, সকল হিংসাত্মক কার্যকলাপই ভয়ের হেতু। সুতরাং মানুষের জন্য অকল্যাণকর একটি ঘৃণিত কাজই হলো সন্ত্রাস। এক অর্থে সন্ত্রাস প্রতিহিংসামূলক বিরোধিতারই ফলশ্রুতি। প্রতিহিংসাপরায়ণ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যখন প্রতিশোধ নেয়ার কিংবা আধিপত্য বিস্তারের জন্য সংকল্পবদ্ধ হয় তখন প্রতিপক্ষের কার্যকলাপ প্রতিরোধে মরিয়া ও হিংস্র হয়ে ওঠে; এই হিংস্রতাই বস্তুত সন্ত্রাস। এক কথায়, সন্ত্রাস অর্থ হচ্ছে ত্রাস সৃষ্টি করা- যেমন হত্যা, ছিনতাই, অপহরণ, হাইজ্যাক, হয়রানি ইত্যাদি। অন্য কথায় বলতে গেলে হত্যা, নির্যাতন, ডাকাতি, ছিনতাই, অবিচার, অনাচার ইত্যাদির দ্বারা সাধারণ মানুষকে যিম্মী করে রাখাকেই সন্ত্রাস বলে।

আমাদের সমাজের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, সন্ত্রাস আজ সমাজের প্রতিটি স্তরে ঘাতক ব্যাধির ন্যায় সংক্রামিত হয়েছে। সন্ত্রাসের কুপ্রভাবে আমাদের সবচেয়ে বেশি যে ক্ষতিটি হচ্ছে তা হলো সমাজে সর্বব্যাপী অশান্তির উপস্থিতি। সন্ত্রাসীদের ভয়ে শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোর চোখের নিদ্রাও পলায়ন করছে। অন্তরের স্বপ্ন ভঙ্গ হচ্ছে। আমাদের দেশে সন্ত্রাস বেশিমাত্রায় বিস্তার লাভ করেছে শিক্ষাঙ্গনে। তাই শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস আমাদের দেশে একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে এখন বিবেচিত। অনেক কষ্ট করে পিতা-মাতা সন্তানকে কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন তাদের ঘিরে থাকে। অথচ সন্ত্রাসের শিকার হয়ে একদিন হয়ত প্রিয় সন্তানের লাশের কফিন পিতা-মাতাকে ক্ষত-বিক্ষত করে। সন্ত্রাসের ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিন থাকে অনির্ধারিত বন্ধ, ছাত্রজীবন হয় বিলম্বিত। রাজনীতির অঙ্গনেও চলছে সন্ত্রাসের মরণ-ছোবল। গোটা সমাজ যেন আজ সন্ত্রাসের কাছে হয়ে পড়েছে যিম্মী। গৃহবধূ থেকে শুরু করে ছাত্র, রাজনীতিক, সমাজপতি, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী এবং সাধারণ মানুষ সন্ত্রাসের যন্ত্রণা থেকে কেউ মুক্তি পাচ্ছে না। পত্রিকার পাতা পরিপূর্ণ থাকে প্রতিদিন হত্যা, নির্যাতন, ডাকাতি, হাইজ্যাক, ছিনতাই, ধর্ষণ ইত্যাদি সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সংবাদে। মানুষ আজ সন্ত্রাসের কাছে অসহায়। সন্ত্রাস জাতীয় উন্নয়নেও বড় বাধা। এটি জাতি তথা দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে। সাধারণ মানুষের পরম চাওয়া একটু সুখ-শান্তিকেও বানচাল করছে।

কিন্তু কেন এই সন্ত্রাস? কেন হয়েছে সন্ত্রাসের জন্ম? সমাজবাদীরা সন্ত্রাসের কারণ হিসেবে বহুবিধ বিষয়কে চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তবে মোটামুটিভাবে সন্ত্রাসের কারণ হিসেবে যে বিষয়গুলোর উপর তাঁরা একমত পোষণ করেছেন তা হলো: (১) সন্ত্রাসীদের প্রতি তাদের মাতা-পিতার উদাসীনতা। এমন অনেক পিতা- মাতা আছেন যারা তাদের সন্তান সারাদিন কোথায় থাকে তার খোঁজ-খবর রাখার প্রয়োজন মনে করেন না। বাল্যকাল থেকে এভাবে লাগামহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ার ফলে বয়ঃসন্ধিক্ষণে তারা কুসংসর্গে এসে সহজেই সন্ত্রাসবাদকে বেছে নেয়।

(২) রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। (৩) বিদ্বেষপ্রসূত কর্মকাণ্ড। (৪) বেকারত্বের অভিশাপ। (৫) সম্মিলিত নাগরিক প্রতিরোধের অভাব (৬) প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা। (৭) আধিপত্য বিস্তারের মনোভাব। (৮) সর্বোপরি ধর্মীয় অনুশাসন তথা নৈতিক শিক্ষাবিমুখতা প্রভৃতিই সন্ত্রাসের কারণ হিসেবে এখন চিহ্নিত। (৯) তা ছাড়া বিভিন্ন প্রচার ও প্রকাশনা মাধ্যমগুলোতে প্রকারান্তরে সন্ত্রাসের প্রতি উৎসাহ যোগানো হয় বলে অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন। (১০) চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের পর্দায় মারদাঙ্গা ছবির নামে সন্ত্রাসের চিত্র এমনভাবে প্রদর্শিত হয় যাতে কোমলমতি কিশোরদের উপর সন্ত্রাসী কার্যকলাপে উৎসাহিত হতে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। (১১) প্রভাবশালীরা ক্ষমতার লোভেও কখনো কখনো সন্ত্রাস করে নির্দ্বিধায়। এখন কথা হলো, এই সন্ত্রাস কিভাবে দমন করা যায়? এ বিষয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কোন মতই কার্যকরভাবে সন্ত্রাস দমন করতে পারছে না।

তাহলে কি এ সমস্যার সমাধানের কোন উপায় নেই? সব সমস্যারই সমাধানের নিশ্চই উপায় আছে। এখন প্রশ্ন: কোন্ সে উপায় যা দ্বারা সন্ত্রাস দমন সুনিশ্চিৎভাবে সম্ভব? এক কথায় যদি বলি তা হলে বলব: ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নই সন্ত্রাস দমনের একমাত্র পথ। নৈতিক অবক্ষয়ই সন্ত্রাসের মূল কারণ। তাই সন্ত্রাস দমন করতে হলে চারিত্রিক উন্নতি অর্জন করা অপরিহার্য। মূলত অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজের একজনের সাথে আর একজনের সম্পর্কের টানাপড়েন থেকেই চূড়ান্ত পর্যায়ে জন্ম হয় সন্ত্রাসের। অথচ রাসূল (সা) বলেছেন: সকল মুসলিম মায়া-মমতায় এক দেহের মত। দেহের একটি অংশ রোগগ্রস্ত হয়ে পড়লে সমগ্র দেহে তা অনুভূত হয়। রাসূল (সা) আরো বলেছেন, সে-ই প্রকৃত মুসলিম যার জিহ্বা ও হাতের অনিষ্ট থেকে অন্যে নিরাপদ থাকে। বিদায় হজ্জের বাণীতে মানবতার নবী (সা) উল্লেখ করেছেন, তোমরা একে অপরের ভাই। একজনের নিকট অন্যের জান-মাল আমানতস্বরূপ। রাসূল (সা) আরো বলেছেন: তুমি জগতবাসীর প্রতি দয়া কর; আকাশবাসী তোমার প্রতি দয়া করবে। মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেন:

“তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে।” (সূরা আল ইমরান, আয়াত: ১০৩)

নিশ্চিত করে বলা চলে আল্লাহ্ ও রাসূল (সা) ঘোষিত মায়াময় ভাতৃত্বের আদর্শে উজ্জীবত হয়ে সামজে সকলে বসবাস করলে সন্ত্রাসের অংকুরাদ্‌গম হতো না। সন্ত্রাস সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:

“ফিতনা বা সন্ত্রাস হত্যা অপেক্ষা গুরুতর।” (সূরা আল বাকারা, আয়াত: ১৯১)

সন্ত্রাস যে সর্বগ্রাসী হয় এবং ভাল-মন্দ সকলকেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট করে তোলে সে সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন: “তোমরা এমন ফিতনা (সন্ত্রাস)-কে ভয় কর যা বিশেষ করে তোমাদের মধ্যে যারা জালিম কেবল তাদেরকেই ক্লিষ্ট করবে না। এবং জেনে রাখ যে, আল্লাহ্ শাস্তি-দানে কঠোর।” (সূরা আনফাল, আয়াত: ২৫)

সন্ত্রাসীরা নিজেরদের অপকর্ম স্বীকার করতে চায় না; বরং কখনো কখনো দর্পভরে নিজেদের সমাজের অন্যতম ভাল লোক হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ এদের সম্পর্কে বলেন:

“তাদের যখন বলা হয় পৃথিবীতে অশান্তি (সন্ত্রাস) সৃষ্টি করো না তারা বলে আমরাই তো শান্তি স্থাপনকারী।” (সূরা বাকারা, আয়াত: ১১)

সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে আল্লাহ্ বলেন:

 “দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তাতে বিপর্যয় (সন্ত্রাস) ঘটিয়ো না।” (সূরা আরাফ, আয়াত : ৫৬)

সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন:

“যখন সে প্রস্থান করে তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি (সন্ত্রাস) সৃষ্টির এবং শস্যক্ষেত্র ও জীব-জন্তুর বংশ নিপাতের চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহ্ অশান্তি (সন্ত্রাস) পছন্দ করেন না।” (সূরা বাকারা, আয়াত : ২৫)

“এ কারণেই বনি ইসরাঈলের প্রতি এ বিধান দিলাম যে, নরহত্যা বা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করা হেতু ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে তারা যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল। আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।” (সূরা মায়িদা, আয়াত : ৩২)

সন্ত্রাসীর ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন:

“তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলি প্রত্যাখ্যান করল, যদিও তাদের অন্তর এগুলিকে সত্য বলে গ্রহণ করেছিল, দেখ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কী হয়েছিল!” (সূরা নাহল, আয়াত: ১৪)

প্রতিরোধ বা দমন শব্দটির সাথে শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারটা সম্পৃক্ত। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সন্ত্রাস প্রতিরোধ সম্মিলিত সহযোগিতারই নামান্তর। রাসূল (সা) অন্যায়-অত্যাচার ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার লক্ষ্যে কতিপয় তরুণ ও যুবকদের নিয়ে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক সংগঠন গড়ে তুলছিলেন, যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আজও সামান্যতম লোপ পায়নি।

কখনও নেতৃত্বের লোভে সন্ত্রাস সৃষ্টি হয়। তাই নেতৃত্ব পাবার লোভকে ইসলাম অযোগ্যতা বলে ঘোষণা করেছে। ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গের দুর্নীতিমূলক চাপে বিচার ও শাসন বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না বলে কার্যকরভাবে সন্ত্রাস দমন হয় না। রাসূল (সা) শাসন ও বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যার অনুসরণে এ বিংশ শতাব্দীতেও সন্ত্রাস দমনে সফল হওয়া সম্ভব।

প্রকৃতপক্ষে ইসলাম হল শান্তির ধর্ম, কল্যাণের ধর্ম। সে ধর্মের অনুসারী মুসলিম সমাজে সন্ত্রাসের শিকার হওয়া চিন্তা করা যায় না; অথচ শতকরা নব্বই জন মুসলমানের সমাজে আজ আমরা সন্ত্রাসের শিকার। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে, পরিত্রাণের পথ খুঁজতে হবে।

পরিশেষে বলব, আমাদের জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইতিহাস আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা যেমন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম স্বাধীনতার জন্যে, তদ্রূপ মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও দলমত নির্বিশেষে আজ ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে আমাদের সমাজ থেকে মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাস দূর করা মোটেই অসম্ভব ব্যাপার নয়।

সর্বোপরি শান্তির প্রতীক বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা)-এর পবিত্র জন্মের স্মৃতিময় এ রবিউল-আউয়াল মাসে প্রিয়নবীর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আসুন আমরা মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাসমুক্ত দেশ গড়তে আত্মনিয়োগ করার সুদৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করি।

আল্লাহ্ আমাদের মাদক ও সন্ত্রাস নির্মূলের সংগ্রামে সাহায্য করুন, সফল করুন। আমীন!

[1] প্রবন্ধটি ১৯৯৯ সালে লেখা। এখানে প্রদত্ত পরিসংখ্যান সে আলোকেই বিবেচ্য। –সম্পাদক।

***উক্ত লিখাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘কল্যাণ সমাজ গঠনে মহানবী (সা)’ প্রবন্ধ সংকলন থেকে সংগৃহীত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button