দাম্পত্যের সেকাল একাল

মা-চাচিদের দেখতাম স্বামীকে রেখে এক দুই রাত ও কোথাও কাটাতে চাইতো না, সে যত যায় হোক। তাদের একটাই কথা থাকত – লোকটার খাওয়া দাওয়ার কষ্ট হবে, কী খাবে না খাবে, কী করবে না করবে, সব কাজে তো আমায় খুঁজবে।
এই যে উদ্বেগ, চিন্তা, এর পেছনে কিন্তু লুকিয়ে কলকাঠি নাড়ত তাদের স্বামীর প্রতি ভালোবাসা, কেয়ারিংনেস। তারা চাইতো না তার অনুপস্থিতিতে স্বামীর এতটুকু কষ্ট হোক। অনেককে দেখেছি কোন অনুষ্ঠান, আমোদ প্রমোদের আসর ছেড়েও এদিক ওদিক চিন্তা করতে করতে শেষমেষ স্বামীর কাছেই চলে গেছে, ঐ আনন্দটা স্যাক্রিফাইস করেছে। কারণটা – ভালোবাসা।

বিনিময়ে, আমার নিজের পরিচিতদের মধ্যে এমন বহু দেখেছি, স্ত্রী ৪৫ ধরতে না ধরতে ডায়াবেটিস, ইউটেরাসের সমস্যা, মাজায় ব্যাথাসহ নানাভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, পঞ্চাশোর্ধ স্বামী অফিস সামলিয়ে আবার বাড়িতে এসে রান্না করা, কাপড় কাচা এগুলো করছে। একটুও বিরক্ত না স্বামীরা, বরং তারাও এটা করছে ভালোবাসা থেকে, খানিকটা কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে। সারাজীবন তো সেই সব করল, এখন সে পারে না, আমি তাকে ছাড়ি কী করে? এই ভালোবাসাগুলোই নিঃস্বার্থ, অকৃত্রিম। ওই সংসার গুলো স্ত্রীর শরীরে মেদ জমা নিয়ে চিন্তিত না, স্বামীর শাসন সহ্য করাতে অতিষ্ট না, সম্পর্কগুলো মৃত্যু পর্যন্ত টিকে যাচ্ছে বিনা অভিযোগে, কোন ভাঙন নেই সেখানে।
যত দিন যাচ্ছে আমি খুবই অবাক হচ্ছি এখনকার দাম্পত্যজীবন গুলো দেখে। কৃত্রিমত্তায় ঘেরা, স্বার্থ ছাড়া যেখানে কিচ্ছু নেই, একের প্রতি অন্যের ভালোবাসা দেখে অবাক হচ্ছি। স্ত্রী ফ্রেন্ডদের সাথে এক সপ্তাহের ট্যুরে যাচ্ছে, স্বামীকে রেখে। কেন? স্বামী গেলে মজাই মাটি। স্ত্রীর রান্না করতে ভালো লাগছে না, কিছু একটা কিনে খাচ্ছে স্বামী বা অর্ডার করছে। রান্না করা প্রেসার, তাই সপ্তাহে চারদিন তিনদিন করে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে স্বামী স্ত্রী। সংসার করা ঝামেলা, দায়িত্ব নিতে হয় বলে বিয়ে যত দেরীতে করা যায়। সংসারের ঝামেলা পোহাতে হবে বলে বাপের বাড়ি বা ক্যাম্পাসেই বেশিদিন থাকার চেষ্টা করছে স্ত্রী। সেদিন এক বান্ধবী বলল, তার হোস্টেলের অলমোস্ট সব অবিবাহিত মেয়ের চাওয়া, এমন ছেলেকে বিয়ে করবে যার সংসারে গিয়ে কোন কাজ করা লাগবে না, ওসব রান্নাবান্না করতে পারবে না তারা।
এই যে রান্না করা, বা সংসারের অন্য কাজগুলো করা এগুলো শুধু কাজ নয়, এগুলো দায়িত্ব, এগুলো ভালোবাসা। আমি থাকতে আমার সঙ্গীর জীবনটা সহজ সুন্দর করার চেষ্টা আমি কেন করব না? এটাই তো কেয়ারিংনেস। নাকি কেয়ার বলতে আমরা শুধু বুঝি বাবু সোনা বলে সারপ্রাইজ গিফট দেয়া? প্রতিবছর ধুমধাম করে এ্যানিভার্সারি সেলিব্রেট করা?
আমি সুস্থ, সবল, বেঁচে আছি, অথচ আমার পার্টনার আনহেলদি ফাস্ট ফুড খাবে, আমি কী করে সহ্য করি? আমি আমোদ প্রমোদে ব্যস্ত অথচ আমার পার্টনারের একা ঘুম আসছে না, অফিস থেকে মাথা ব্যাথা নিয়ে ফিরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার মত কেউ নেই, এ আমি কি করে মেনে নেই? আমি ভালো থাকি কীভাবে? তাকে আমি ভালোবাসি না?
হ্যা, আমাদের বাপ চাচাদেরও উচিত ছিল রান্নাটা জেনে রাখা, যাতে ঐ সব দিনগুলোতে স্ত্রীর তাকে নিয়ে চিন্তা করতে না হয়। আমাদের আদর্শ রাসূল (স)। তিনি ঘরের কাজে স্ত্রীদের সাহায্য করেছেন। নিজের সব কাজ নিজে করতে জানতেন। কিন্তু চিন্তাধারার একটু পরিবর্তন এই সুন্নাহগুলোর মধ্যে কেমন যেন খাঁদ ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
যেমন ধরুন, আপনি আর আপনার হাজবেন্ড সপ্তাহে চারদিন তিনদিন করে রান্না ভাগাভাগি করে নিলেন। এমন স্বামী তো এখনকার মেয়েদের ড্রীম হাজবেন্ড। তো যায় হোক, যে চারদিন সব কাজ আপনার, সব কাজ একা সামলিয়ে স্বামীকে টিভি দেখতে দেখে মেজাজ খারাপ হবে আপনার, আবার যে তিনদিন সে রান্না করছে আর আপনি বসে ফোন টিপছেন, তারও মেজাজ খারাপ হবে স্বাভাবিক৷ এভাবেই সম্পর্কে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ধীরে ধীরে উঠে যায়। সম্পর্কগুলো আজ ভেন্না পাতার ছানির মত ঠুনকো, দুজনের প্রতি দুজনের ফিলিংস নাই, বরং একসাথে থাকাকে অসহ্য মনে করে এখনকার ছেলেমেয়েরা।
অথচ সুন্নাহ মেনে যদি সপ্তাহে রোজ আপনিই রান্না করতেন এবং আপনার পার্টনার রোজ আপনাকে সাহায্য করত, গুছিয়ে দিত, যদি নাও পারে, অন্তত রান্নাঘরে আপনার সাথে গল্প করত, এতে দুজনেই ভালো থাকতেন, কারো প্রেসার হতো না, মাঝখান থেকে দুজনের মধ্যে ভালোবাসা যে কতগুণে বাড়তো দেখতেন শুধু।
ঘরের কাজ নারীরা যেভাবে সুন্দর করে গুছিয়ে করতে পারবে পুরুষরা তা পারবে না, শরীয়তে এজন্যই ঘর সামলানোর মূল দায়িত্ব নারীকে দেয়া হয়েছে। তবে পুরুষরাও সব কাজ শিখবেন, এটা রাসূলের সুন্নাহ। যখন স্ত্রী অসুস্থ থাকবে, বা পিরিয়ড এর প্রথম দুই একদিন আপনি স্বেচ্ছায় কাজ করবেন। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জন্য। দুজন মিলে কিভাবে ভালো থাকা যায়, সুন্দরভাবে বাঁচা যায় সেই চেষ্টা করবেন। ভালোবাসলে কখনো পার্টনারের কষ্টে দূরে থাকা যায়? আর একবার দুজন দুজনের কথা ভেবে দেখুন, কেয়ার করে দেখুন পার্টনারকে, জীবনে আর কিচ্ছু লাগবে না। পার্টনার মনের মত হলে তার থেকে একদিনও দূরে থাকতে চাইবেন না, বাপের বাড়ি হাসফাস লাগবে, ক্যাম্পাসে একা লাগবে, বন্ধুদের সাথে ট্যুরে তাকে মিস করবেন, পারবেন না, একদিনও পারবেন না, আপনার সবটা জুড়ে থাকবে সে। ইসলাম মানুন, সুন্নাহ মেনে চলুন, জীবন কত সুন্দর হয়ে যাবে ভাবতেও পারবেন না।
– ফৌজিয়া তাবাসসুম মিম্মা

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88