মৃত্যুকালীন শয়তানের ইমান হরণের কঠিন চক্রান্ত এবং আত্মরক্ষার উপায়

মৃত্যুকালীন শয়তানের ইমান হরণের কঠিন চক্রান্ত এবং আত্মরক্ষার উপায়
▬▬▬▬◆◈◆ ▬▬▬▬
প্রশ্ন: মানুষের মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে শয়তান ওয়াস‌ওয়াসা (কুমন্ত্রণা) দিয়ে তার ঈমান নষ্ট করার চেষ্টা করে। এ থেকে বাঁচার উপায় কি?
উত্তর:
প্রথমত: আমাদের জানা দরকার যে, শয়তান বনী আদমের দীন ও ইমান সহ সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে চ্যালেঞ্জ করে আসা এক প্রকাশ্য শত্রু। সে প্রতি মুহূর্তে বনী আদমকে পথভ্রষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। সে তার শয়তানি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মানুষের গাফলতি, অসচেতনতা, বিপদাপদ, দুর্যোগ ও দুর্বল মুহূর্তগুলোকে কাজে লাগায়। সুতরাং মৃত্যুর মত কঠিন ও বিভীষিকাময় মুহূর্তে সে তাকে পথভ্রষ্ট করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করবে-তা খুবই স্বাভাবিক।

◍ আল্লাহ তাআলা বলেন,
قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ – ثُمَّ لَآتِيَنَّهُم مِّن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَن شَمَائِلِهِمْ ۖ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ
“সে (ইবলিশ) বলল, আপনি আমাকে যেমন উদভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্যই তাদের জন্যে আপনার সিরাতে মুস্তাকিম বা সরল পথে বসে থাকবো। এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে এবং আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।” [সুরা আরাফ: ১৬ ও ১৭]
◍ আল্লাহ তাআলা শয়তান থেকে সতর্ক করে আরও বলেন,
وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ ‎
“আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” [সূরা বাকারা: ১৬৮]
◍ তিনি অন্যত্র বলেন,
إِنَّهُ عَدُوٌّ مُّضِلٌّ مُّبِينٌ
“নিশ্চয় সে প্রকাশ্য শত্রু ও পথভ্রষ্ট কারী।” [সূরা কাসাস: ১৫]
এভাবে কুরআনে আল্লাহ তাআলা বহু স্থানে তাকে ‘প্রকাশ্য শত্রু’ হিসেবে উল্লেখ করে মানবজাতিকে তার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।
(যদিও বিশেষ করে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে শয়তান ইমানদারের সামনে ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মকে অধিক উত্তম বলে উপস্থাপন করার ব্যাপারে কিছু আলেম লিখেছেন। কিন্তু সেগুলোর পক্ষে কোন দলিল নেই।)
❑ মৃত্যুকালীন শয়তান কর্তৃক ঈমান হরণের কঠিন চক্রান্ত থেকে আত্মরক্ষার দুআ:
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ করে মৃত্যুর বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে শয়তান যেন ইমান ছিনিয়ে নিতে না পারে বা পথভ্রষ্ট করতে না পারে সে জন্য আল্লাহর কাছে নিজে দুআ করেছেন এবং তার উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন:
১. আবুল ইয়াসার রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন,
الَّلهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الهَدمِ ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ التَرَدِّي ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الغَرَقِ وَالحَرَقِ وَالهَرَمِ ، وَأَعُوذُ بِكَ أَن يَتَخَبَّطَنِي الشَّيطَانُ عِندَ المَوتِ ، وَأَعُوذُ بِكَ أَن أَمُوتَ فِي سَبِيلِكَ مُدبِرًا ، وَأَعُوذُ بِكَ أَن أَمُوتَ لَدِيغًا
“হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি পতন জনিত মৃত্যু থেকে। আশ্রয় প্রার্থনা করছি ভারী কোনও বস্তুর চাপা পড়ে বা গর্তে পড়ে মৃত্যু থেকে। আরও আশ্রয় প্রার্থনা করছি, সলিল সমাধি ও আগুনে দগ্ধীভূত হয়ে মৃত্যু এবং বার্দ্ধক্য থেকে।
আর আমি মৃত্যুকালে শয়তানের ছোঁ মারা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি আপনার রাস্তায় (জিহাদের সময়) পলায়নপর অবস্থায় মৃত্যু থেকে এবং আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি সাপ-বিচ্ছুর দংশন জনিত মৃত্যু থেকে।” [সহিহ আবু দাউদ, হা/ ১৩৮৮]
ইমাম খাত্তাবি ‘শয়তান কর্তৃক ছোঁ মারা’ এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম মৃত্যুর সময় শয়তান কর্তৃক ছোঁ মারা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। এর অর্থ হল, দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় শয়তান যেন তার উপর কর্তৃত্ব আরোপ করে তাকে পথভ্রষ্ট করতে না পারে, তার তওবার সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে, তার আত্ম সংশোধন করা এবং তার সম্মুখের অন্ধকার থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক না হয়ে দাঁড়ায়। সে যেন তাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না করে বা তার মনে মৃত্যুর ব্যাপারে ঘৃণা বোধ এবং দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে হা-হুতাশ সৃষ্টি না করে। কেননা এর ফলে এই নশ্বর জীবন ছেড়ে আখিরাতের পথে পাড়ি জমানোর ব্যাপারে আল্লাহর ফয়সালায় অসন্তোষ প্রকাশিত হবে। ফলে তার জীবনের পরিসমাপ্তি হবে মন্দ পরিস্থিতির উপরে এবং সে আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়ে তার সাথে সাক্ষাত লাভ করবে।” [মাআলিমুস সুনান, ২/১৯৪]
২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক নামাযের শেষ বৈঠকে সালাম ফিরানোর পূর্বে মৃত্যুর ফিতনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। আর মৃত্যু কালীন ফিতনার অন্তর্ভুক্ত হল, জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণের সংকটময় মুহূর্তে শয়তানের ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ সালাতে তাশাহুদ পড়বে, তখন চারটি বিষয় থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে। বলবে,
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ وَمِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ
“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি জাহান্নামের আযাব থেকে, কবরের আযাব থেকে, জীবন-মৃত্যুর ফিতনা থেকে এবং মাসীহ দাজ্জালের অনিষ্ট থেকে।”
[সহিহহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৫/ মসজিদ ও সালাতের স্থান, পরিচ্ছেদ: ২৫. সালাতের মধ্যে এসব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা]
সুতরাং কেউ যদি মৃত্যুকালীন শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে চায় তাহলে তার কর্তব্য, ১ম দুআটি অধিক পরিমাণে পাঠ করা। আর ২য় দুআটি বিশেষ করে প্রত্যেক সালাতের শেষ বৈঠকে সালাম ফিরানোর পূর্বে পাঠ করা।
সেই সাথে কর্তব্য, জীবনভর শয়তানের রাস্তা থেকে দূরে থাকা, আল্লাহর নাফরমানি পরিত্যাগ করা, কখনো পাপাচার সংঘটিত হয়ে গেলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা ও তৎক্ষণাৎ আল্লাহর পথে ফিরে আসা।
আর যখনই মনের মধ্যে শয়তানি ওয়াসওয়াসা ও আল্লাহর নাফরমানির কথা উদ্রেক হবে তখনই ‘আঊযুবিল্লাহি মিনাশ শাত্বানারি রাজীম” (অর্থ: আমি বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি) পাঠ করা।
মোটকথা, যে ব্যক্তি তার জীবনটাকে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি ও সৎকর্ম দ্বারা সাজাতে সক্ষম হবে, শয়তানের পথ অনুসরণ থেকে দূরে থাকবে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক শিখানো দুআগুলো আমল করবে সে মৃত্যুর বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাবে ইনশাআল্লাহ।
——–উত্তর প্রদানে——–
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদি আরব

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan