মহানবী পরিবারের শিশু

মহানবী পরিবারের শিশু

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর শিশু নাতি-নাতনীদের অত্যধিক ভালবাসতেন। শুধু নিজের নাতি-নাতনী নয়, যে কোন শিশুকে কাছে পেলেই তিনি তাদেরকে সালাম দিতেন, পাশে বসাতেন, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তাদের সঙ্গে কথা বলতেন, আদর আপ্যায়ন করতেন।

দৈহিত্রি উমামা

রাসুলুল্লাহর জৈষ্ঠ কন্যা জয়নবের (রাঃ) শিশু কন্যাকে রাসূল (সাঃ) অত্যধিক স্নেহ করতেন। জয়নবের (রাঃ) বিয়ে হয়েছিল তার খালাতো ভাই আবুল আসের (রাঃ)-এর সাথে।

সাহাবী আবু কাতাদা (রাঃ) একটি ঘটনা বর্ননা করেছেন। আমরা এক সময় মসজিদে নবুবীতে অবস্থান করছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মসজিদে তশরিফ আনলেন। কাঁধের উপর আসীন দৈহিত্রি শিশু উমামা।

সে অবস্থায়ই রাসূল (সাঃ) সালাতে দাঁড়ালেন। তিনি যখন রুকুতে যেতেন, তখন শিশু উমামাকে নামিয়ে দিতেন। আবার যখন দাঁড়াতেন, তখন তাকে কাঁধে তুলে নিতেন। এভাবে তিনি পুরো সালাত আদায় করেন।

নামাজের সময়ও শিশুরা রাসূলের সঙ্গ ছাড়তে চাইতোনা। নামাজরত অবস্থায় সেজদাকালে হাসান-হুসাইন তাদের নানার পিঠে উঠে বসতেন।

হাসান (রাঃ) ও হুসাইন (রাঃ)

বিবি ফাতেমা (রাঃ) এর গৃহে রাসূল (সাঃ) গেলে তিনি হাসান ও হুসাইনকে দেখতে চাইতেন। গৃহে প্রবেশের সময় তাঁর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠতো। প্রথমেই তিনি বলতেন “যাও আমার বাচ্চাদের নিয়ে এসো।” বিবি ফাতেমা (রাঃ) শিশুদেরকে নিয়ে এলে মহানবী (সাঃ) তাদের শরীরের ঘ্রাণ নিতেন এবং বুকে জড়িয়ে ধরতেন। হযরত হাসানের চেহারা ছিলো মহানবী (সাঃ)-এর অনুরূপ এবং খুবই সুন্দর।

একদিন রাসূল (সাঃ) মসজিদে নবুবিতে খুতবা দিচ্ছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন শিশু হাসান। এবং হুসাইন মসজিদে ঢুকছে। দু’জনের পরিধানে ছিল লাল জুব্বা। প্রায় গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা জুব্বা গায়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। এ অবস্থা দেখে রাসূল (সাঃ) খুতবা পড়া বন্ধ করে সামনে এগিয়ে এসে দু’জনকে কোলে তুলে নিলেন এবং নিজের সামনে বসিয়ে দিলেন।

বাংলাদেশের কোন মসজিদে কোন ইমাম যদি ইমামতির সময় তার আদরের নাতনীকে কাঁধে উঠায় আর নামায়- আমাদের প্রতিক্রিয়া কি হবে ! ইমাম সাহেব যদি শিশু-নাতিদেরকে দেখে খুতবা বন্দ করে দেন, মুসল্লিগণ কি মনে করবেন ?

হুসাইনের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি

একদিন রাসূল (সাঃ) কোথাও কোন কাজে রওনা হয়েছেন। পথে দেখলেন শিশু হুসাইন (রাঃ) খেলা করছেন। তিনি তার দিকে অগ্রসর হলেন। শিশু হুসাইনও হাসতে হাসতে নানার দিকে এগিয়ে এলেন। প্রিয় নবী (সাঃ) তাকে ধরার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন। শিশু হুসাইনও হাত বাড়িয়ে দিলেন কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাত ধরার আগেই হুসাইন (রাঃ) হাত টেনে নিয়ে সরে গেলেন। রাসূলুল্লাহ তাকে ধরার জন্য অগ্রসর হলেন। শিশু হুসেইন দিলেন দৌড়।

অকারণে যে কাজ আল্লাহ খুব পছন্দ করেন তার মধ্যে আছে শিশুদের দৌড়াদৌড়ি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দৌড়ে হুসাইন (রাঃ) ধরে ফেলেন এবং তাকে কোলে তুলে নিলেন। তিনি পরম আদরের শিশু হুসাইনকে বুকে চেপে ধরে বলেছিলেন, ‘হুসাইন আমার এবং আমি হুসাইনের’।

অল্প বয়স থেকেই শিশুদেরকে দৌড়াদৌড়ি করতে, লাফঝাপ দিতে, ক্লান্ত হতে অভ্যস্ত করাতে হবে। ঘরের মধ্যে আটকিয়ে বা বসিয়ে রেখে অলস করার চেয়ে বাইরে যত বেশী ঘুরাফিরা করবে; ততোই শিশু পরিশ্রমী এবং শ্রমমুখী হবে।

আত্ম-বিশ্বাস

শিশুরা বড়দের ন্যায় কাজ করতে পারে এবং কোন দিক দিয়েই অযোগ্য বা অকর্মন্য নয়এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

বয়স্করা ক্লান্ত হয়। কিন্তু শিশুরা সহজে ক্লান্ত হয়না। তাদের দৈহিক শক্তি কম কিন্তু এনার্জি বেশী। সারাদিন হাটলেও তারা ক্লান্তিবোধ করেনা। দৌড়ানো তাদের স্বভাব। দৌড়াদৌড়িতে তারা অসুস্থ হয়না বরং শ্রমমুখী হবে।

দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত শিশুর বিশ্রামের সর্বোত্তম স্থান হলো মায়ের কোল। তাতে তার ক্লান্তি অর্ধেক দূর হয়ে যায়। শিশুদের নির্দোষ খেলা এবং নির্মল হাসি আনন্দ দেখার চেয়ে আনন্দকর ও পবিত্র দৃশ্য জগতে আর কি আছে !

আনন্দের দৃশ্য

হাটুর উপর শিশুকে বসিয়ে আনন্দ দেয়া, তার ছোট মনের আকুতি শুনা, সে কি ভাবে আনন্দ উপভোগ করে তা দেখা এবং উপভোগ করা, তার জ্ঞান বা দেহ কি ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা দেখা বড়ই আনন্দদায়ক।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন কোন সফর থেকে বাড়ী ফিরতেন তখন টের পেলেই তার শিশু নাতী হাসান এবং হুসাইন দৌড়ে আসতেন। তাদের একটি উদ্দেশ্য থাকতো উটের পিঠে চড়া, রাসূল (সাঃ) দু’জনকেই উটের পিঠে তুলে নিতেন। একজন সামনে একজন পিছনে। কিছুক্ষণ চলার পর তিনি উট থেকে নামতেন এবং জিজ্ঞাসা করতেন কে আগে নামতে চায়। দু’জনই একসাথে আগে নামতে চাইতো। তিনি একজনকে আগে নামালে অন্যজন গোস্বা করতো। প্রথম জনকে পূর্ণরায় তিনি উটের পিঠে তুলে দিতেন। দ্বিতীয় জনকে প্রথমে নামাতেন। তারপর প্রথমজনকে নামাতেন। দ্বিতীয় জন আবার বলতো আমি আরেকবার উঠবো- এভাবে তিনি তাদেরকে আনন্দ দিতেন।

আদরের কাঙাল

শিশুরা আদরের কাঙ্গাল। ঘুম ভাঙ্গলেই কোলে উঠে আদর চায়। গভীর নিশীথেও পিতামাতার আদর-সোহাগের প্রত্যাশা করে। বুকে উঠে আদর-সোহাগ আদায় করে। শিশুকালে যে আদর পেয়েছে, তার হৃদয় নাড়া দিলে কিছু ফল পাওয়ার আশা করা যেতে পারে।

শিশুর অনুভুতি, ভালোবাসা, আদর সব কিছুই খাঁটি। শিশুদের দৌড়-ঝাপ লাফালাফি, হট্টগোল উপভোগ করার ধৈর্য্য ও মানসিকতা আমাদের অনেকের থাকেনা। যেমন বাগান বা ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার ক্ষমতা অনেকের হয়না।

শিশু হলো বেহেস্তের দূত ফিরিস্তাতুল্য, নিষ্পাপ। ঘরে শিশু থাকা মানে ফিরিস্তা থাকা। মানব শিশু প্রতিপালন করা মানে আল্লাহর ফিরিস্তা প্রতিপালন করা।

আদমের অনুলিপি

আদমেরই উত্তরসুরী হলো মানুষ। তাই উত্তরসুরী মানুষ হতে হবে পূর্বসূরী আদমের গুনে গুণান্বিত। মানবজীবন আদমের জীবন ও আদর্শের রূপায়ন। আদম সন্তানের চরিত্রে আদমের রূপই প্রতিফলিত হওয়া উচিত।

জন্মের পর শিশু হৃদয় থাকে পবিত্র, কোমল ও পরিচ্ছন্ন যেন সাদা কাগজ। এর মাঝে কোন কালির দাগ তখনও পড়েনি। কিন্তু ক্রমশঃ এই সাদা বইটি মসীলিপ্ত হয়ে যায়। তবে মসিতে মহাগ্রন্থও রচিত হতে পারে অথবা কালো কালিতে ভরা পড়ার অনুপযোগী বর্জ্য কাগজের চোথাও হতে পারে।

শিশুরা সুখী। কারণ তারা কোন পাপ করেনা। কোন পাপ তাদের হৃদয়কে কলুষিত এবং জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলেনা।

মানুষের মাঝে এমন কি আছে যা পবিত্র এবং আল্লাহ যার দিকে তাকিয়ে তার নিজের সৃষ্টি সম্বন্ধে আনন্দিত হন ? আল্লাহ দেখে খুশী হন এবং প্রত্যেক মানবগৃহে যা থাকতে পারে এবং থাকে তা হলো মানব শিশু। শিশু পরিছন্ন, নিস্পাপ। আল্লাহর কাছে আনন্দদায়ক। তারা তখনও জান্নাতের দ্বার প্রান্তে। জান্নাতের ফিরিস্তারা শিশুদের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত হন। তাদের দেখে জান্নাতের পথভ্রষ্ট শিশু বলে ফিরিস্তাদের মনে হয়।

শিশুরা যখন আল্লাহর কাছে মুনাজাত করে, তাদের সরল বিশ্বাস এবং পবিত্র মুনাজাত আল্লাহ শ্রবন করেন। তাদের সাথে সাথে ফিরিস্তারা আমীন আমীন বলে থাকেন।

সূত্র: মহানবী ও শিশু বই থেকে। লেখক: এ. জেড. এম. শামসুল আলম

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan