মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা পর্ব -১
লেখক: ড. মো: আমিনুল ইসলাম | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
আদব-কায়দা’র পরিচয়, গুরুত্ব ও তাৎপর্য
১. আদব-কায়দা’র পরিচয়:
আদব শব্দটি আরবি ” أدب “শব্দ থেকে বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ; যার অর্থ হলো: বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা, শিষ্টাচার।[1] আবার ” أدب “শব্দের অর্থ: নিয়মনীতি, পদ্ধতি ইত্যাদি। আর আদব-কায়দা মানে— ভদ্র সমাজের রীতি-পদ্ধতি; ভদ্র ব্যবহার। অন্যভাবে বলা যায়: আদব-কায়দা মানে কাঙ্খিত শিক্ষা, সভ্যতা ও মার্জিত সংস্কৃতির দ্বারা আত্মগঠনের অনুশীলন করা।[2]
ইবনু হাজার ‘আসকালানী রহ. বলেন:
« الأدب: استعمال ما يحمد قولاً وفعلاً » .
“কথায় ও কাজে প্রশংসনীয় ব্যবহারকে আদব বলে।”[3]
আবার কেউ বলেন:
« الأخذ بمكارم الأخلاق » .
“উত্তম চরিত্র লালন করাকে আদব বলে।”[4]
আবার কেউ কেউ বলেন:
« هو تعظيم من فوقك والرفق بمن دونك » .
“আদব হলো ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিকে সম্মান করা এবং অধস্তনকে স্নেহ করা।”[5]
কেউ কেউ বলেন:
« الأدب هو حسن الأخلاق وفعل المكارم » .
“আদব মানে উত্তম চরিত্র এবং ভালো কাজ।”[6]
আর ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন:
« الأدب اجتماع خصال الخير في العبد » .
“বান্দার মধ্যে উত্তম বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটানোকে আদব বলে।”[7]
আবার কেউ কেউ বলেন:
« والأدب هو الخصال الحميدة » .
“প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহকেই আদব বলে।”[8]
আর আমাদের দেশীয় ভাষায় বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা ইত্যাদি গুণাবলী যে ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাকে ‘মুয়াদ্দাব’ (শালীন, ভদ্র ও সুশিক্ষিত) বলে। আর এসব গুণাবলী যার মধ্যে বিদ্যমান নেই, তাকে ‘বেয়াদব’ (অশালীন, অভদ্র, অসভ্য) বলে।
২. আদব-কায়দা’র গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
মানবজীবন তথা মুসলিম ব্যক্তির জীবনে আদব-কায়দার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহুল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« إِنَّ الْهَدْىَ الصَّالِحَ ، وَالسَّمْتَ الصَّالِحَ ، وَالاِقْتِصَادَ جُزْءٌ مِنْ خَمْسَةٍ وَعِشْرِينَ جُزْءًا مِنَ النُّبُوَّةِ » . (رواه أبو داود).
“নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুয়্যাতের পঁচিশ ভাগের এক ভাগ সমতুল্য।”[9]
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন:
« اُطْلُبْ الْأَدَبَ فَإِنَّهُ زِيَادَةٌ فِي الْعَقْلِ ، وَدَلِيلٌ عَلَى الْمُرُوءَةِ ، مُؤْنِسٌ فِي الْوَحْدَةِ ، وَصَاحِبٌ فِي الْغُرْبَةِ ، وَمَالٌ عِنْدَ الْقِلَّةِ » . (ذَكَرَهُ الْحَاكِمُ فِي تَارِيخِهِ).
“তুমি আদব অন্বেষণ কর; কারণ, আদব হলো বুদ্ধির পরিপুরক, ব্যক্তিত্বের দলীল, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রবাসজীবনের সাথী এবং অভাবের সময়ে সম্পদ।”[10]
আর আদব বা শিষ্টাচার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার দ্বারা ব্যক্তির জীবন পরিশুদ্ধ ও পরিপাটি হয়; আর এ আদব হলো দীন ইসলামের সারবস্তু; সুতরাং মুসলিম ব্যক্তির জন্য জরুরি হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এবং সাধরণ মানুষসহ সকল সৃষ্টির সাথে আদব রক্ষা করে চলা; আর এ আদবের মাধ্যমেই একজন মুসলিম জানতে পারবে তার খাবার ও পানীয় গ্রহণের সময় তার অবস্থা কেমন হওয়া উচিৎ; কিভাবে তার সালাম প্রদান, অনুমতি গ্রহণ, বসা, কথা বলা, আনন্দ ও শোক প্রকাশ করা, হাঁচি দেওয়া ও হাই তোলার মত বিবিধ কাজ সম্পন্ন হবে; আর কেমন ব্যবহার হবে তার পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে। এক কথায় এ আদব-কায়দা রক্ষা করে চলার মাধ্যমেই একজন মুসলিম কাঙ্খিত মানের ভদ্র ও সভ্য মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং নিজেকে অন্যান্য জাতির চেয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে; ফলে দীন ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে যাবে সমাজ, রাষ্ট্র ও দুনিয়ার দিক দিগন্তে। তাইতো কেউ কেউ শিক্ষার চেয়ে আদব বা শিষ্টাচারের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন; ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
« تَأَدَّبُوا ثُمَّ تَعَلَّمُوا » .
“তোমরা আগে সুসভ্য হও, তারপর জ্ঞান অর্জন কর।”[11]
আল-কারাফী তাঁর ‘আল-ফারুক’ গ্রন্থে বলেন:
«وَاعْلَمْ أَنَّ قَلِيلَ الْأَدَبِ خَيْرٌ مِنْ كَثِيرٍ مِنْ الْعَمَلِ » .
“আর জেনে রাখবে, অনেক বেশি কাজের চেয়ে অল্প আদব অনেক বেশি উত্তম।”[12]
আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন:
« لَا يَنْبُلُ الرَّجُلُ بِنَوْعٍ مِنْ الْعِلْمِ مَا لَمْ يُزَيِّنْ عِلْمَهُ بِالْأَدَبِ » .
“ব্যক্তি কোনো প্রকার জ্ঞান দ্বারা মহৎ হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার জ্ঞানকে আদব দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করবে।”[13]
তিনি আরও বলেন:
« نَحْنُ إلَى قَلِيلٍ مِنْ الْأَدَبِ أَحْوَجُ مِنَّا إلَى كَثِيرٍ مِنْ الْعِلْمِ » .
“আমরা অনেক বেশি জ্ঞানের চেয়ে কম আদবকে অনেক বেশি জরুরি বা প্রয়োজন মনে করতাম।”[14]
কোনো কোনো দার্শনিক বলেন:
« لَا أَدَبَ إلَّا بِعَقْلٍ ، وَلَا عَقْلَ إلَّا بِأَدَبٍ » .
“আকল (বুদ্ধি) ছাড়া আদব হয় না; আবার আদব ছাড়া আকলও হয় না।”[15]
অর্থাৎ একটি আরেকটির পূরিপূরক। আর জনৈক সৎব্যক্তি তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন:
« اجْعَلْ عَمَلَك مِلْحًا وَأَدَبَك دَقِيقًا » .
“তুমি তোমার আমলকে মনে করবে লবণ, আর তোমার আদবকে মনে করবে ময়দা।”[16]
অর্থাৎ তুমি আমলের চেয়ে আদবকে এত বেশি গুরুত্ব দিবে, লবণ ও ময়দার স্বাভাবিক মিশ্রণে উভয়ের অনুপাত যেভাবে কম বেশি হয়।
[1] ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, আল মুনীর আরবী-বাংলা অভিধান, দারুল হিকমা বাংলাদেশ, প্রকাশকাল: জুলাই ২০১০ খ্রি., পৃ. ১৫; বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পরিমার্জিত সংষ্করণ: ডিসেম্বর ২০০০, পৃ. ১০৩
[2] আল-মু‘জাম আল-অসীত, দ্র: ” أدب ”
[3] ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[4] প্রাগুক্ত।
[5] প্রাগুক্ত।
[6] প্রাগুক্ত।
[7] প্রাগুক্ত।
[8] প্রাগুক্ত।
[9] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ৪৭৭৮; আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।
[10] হাকেম রহ. তাঁর ‘আত-তারীখ’ গ্রন্থে বর্ণনটি উল্লেখ করেছেন।
[11] উদ্ধৃত, গিযাউল আলবাব (غذاء الألباب ), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[12] উদ্ধৃত, ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[13] উদ্ধৃত, গিযাউল আলবাব (غذاء الألباب ), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[14] উদ্ধৃত, ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[15] উদ্ধৃত, গিযাউল আলবাব (غذاء الألباب ), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[16] উদ্ধৃত, ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। “
উৎসঃ কুরআনের আলো