মার্কিন নও মুসলিম সায়িদ মুহাম্মাদ বা স্কট লাইঞ্চ

“যারা মহান আল্লাহর বার্তা শুনতে চান তারা তা শুনতে পারেন। এমনই এক বাস্তবতা যে এই বার্তা  দিনকে দিন আমার হৃদয়ে বড় হচ্ছে। বিশ্ব জগতের স্রস্টার সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্ব দুই যুগ ধরে আমার অন্তরকে ভারী করে রেখেছিল যতক্ষণ না ইসলামকে আবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে আমি একত্ববাদের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।”

 শুনছিলেন মার্কিন নও-মুসলিম স্কট লাইঞ্চ বা বর্তমান সায়িদ মুহাম্মাদের বক্তব্য। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন এক খ্রিস্টান পরিবারে। তার বাবা ছিলেন ২৫ বছর ধরে একটি গির্জার পুরোহিত। স্কট ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সপ্তায় কয়েকদিনই কাটাতেন গির্জায়। স্রষ্টা ও ঈসা মাসিহ’র প্রতি বিশ্বাস ও ভয় নিয়ে বড় হয়েছিলেন সাবেক স্কট। পরবর্তীতে তার মাথায় অনেক প্রশ্ন জাগলেও সেসব বাবা-মায়ের ধর্মের বিরোধী হয়ে যাচ্ছে বলে ভয় পেতেন তিনি। এক সময় বাবার চাপের মুখে তিনি খ্রিস্টান সোসাইটির সদস্য হন। কিন্তু সে সময় স্কট বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছিলেন খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি।

স্কট বেশ কয়েক বছর ধরে বাইবেলের ব্যাখ্যার ক্লাসে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি তার আস্থা তো বাড়েইনি বরং এই ধর্ম ত্যাগের ইচ্ছে দৃঢ় সংকল্পে রূপ নিতে থাকে। তিনি বলেছেন,

“যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম তখন কেবলই ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা ভাবতাম। এখানে বাবা-মা থেকে দূরে থেকে ধর্মগুলো নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পেলাম। প্রথমে ইহুদি ধর্ম নিয়ে গবেষণার খুব আগ্রহ জন্মেছিল। হিব্রু ভাষাও খুব পছন্দ করতাম। তাই শুরু করলাম ইহুদি ধর্ম নিয়ে গবেষণা। কিন্তু দেখলাম খ্রিস্ট ধর্মের মত এ ধর্মেও অনেক শূন্যতা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ ইসলামী বিধান ও সংস্কৃতি’ শীর্ষক একটি ক্লাসে ইসলামী শিক্ষা সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছিল।”

ইসলামী শিক্ষার প্রধান দিকের মধ্যে এক, মহাকৌশলী ও মানব-দরদী আল্লাহর অস্তিত্বসহ মানুষের চাহিদাগুলোর সঙ্গে এই ধর্মের শিক্ষাগুলোর সামঞ্জস্য স্কটকে অভিভূত করেছে। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন,

“বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার মাঝামাঝি সময়ে ক্যাম্পাসের কাছাকাছি একটি মসজিদ পরিদর্শন করি। এটাই ছিল কোনো মসজিদে আমার প্রথম প্রবেশ। সেখানে আমি মুসলমানদের ইবাদত ও দোয়ার সামগ্রিক ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করি। যদিও আমি সেসবের তাৎপর্য বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু মহান আল্লাহর প্রতি তাদের সবিনয় প্রার্থনা, সিজদা, নম্রতা ও আচার-অনুষ্ঠানের সরলতা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ক্লাসে ও মসজিদে ইসলামের সঙ্গে এইসব সংক্ষিপ্ত যোগাযোগ আমার মনে এমন এক বীজ বপন করেছিল যে তা বিকশিত ও পল্লবিত হতে  দশ বছর সময় লেগেছিল।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেয়ার পর লাইঞ্চ চাকরিতে ব্যস্ত থাকায় ধর্ম নিয়ে গবেষণায় খুব একটা অগ্রসর হতে পারেননি। পেশাগত কারণে তাকে থাকতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের ফোর্ট কলিন্সে। সেখানকার সুবিশাল পাহাড়, প্রান্তর ও শ্যামলিমা আবারো তাকে স্রষ্টা সম্পর্কে ভাবিয়ে তোলে। তিনি ভাবতেন এমন সুশৃঙ্খল ও সুন্দর প্রকৃতি কি কোনো স্রষ্টা ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে? এসবই কি আল্লাহর সৌন্দর্যের প্রকাশ নয়?

এভাবে হঠাত যেন স্কটের মন খোদাপ্রেমের শিহরণে রোমাঞ্চিত হলো। ধর্ম বিষয়ে দশ বছর আগের সেই অভিজ্ঞতার কথা আবারো তার মনে জেগে উঠল। ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্ম নিয়ে আবারো শুরু করলেন গবেষণা। কিন্তু ভিজলো না তার তৃষ্ণার্ত চিত্ত।

এ প্রসঙ্গে স্কট বলেন, “আমি শুরু করলাম ইসলাম নিয়ে গবেষণা। কলম্বিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের সেই ক্লাসে ও মসজিদে ইসলাম সম্পর্কে যা জেনেছি তা আমার গবেষণাকে এগিয়ে রেখেছিল। এরপরও নানা মিডিয়ায় ইসলাম সম্পর্কে জেনেছি। গবেষণায় দেখলাম যে,

ইসলাম একত্ববাদ-ভিত্তিক সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বাসের অধিকারী। আল্লাহর কোনো শরিক নেই-এ বক্তব্যের ওপর খুব বেশি জোর দিয়েছে ইসলাম। ফলে আমি এ সত্যটি বুঝলাম যে, ইসলাম কেবলই একটি ধর্ম নয়। বরং মানুষের জীবন ও সৌভাগ্যের জন্য একটি সার্বিক বা পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা।”

এরপর হানি নামের একজন মুসলমানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে স্কটের এবং তার সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তিনি তাকে ইসলাম সম্পর্কে আরো তথ্য জানানোর অনুরোধ করেন। তিনি স্কটকে কুরআন পড়ার পরামর্শ দিলেন ও তাকে কুরআনের একটি কপি উপহার দেন। হানি কুরআনের ওই কপির প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন, “আশা করছি আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথ দেখাবেন।” এ বাক্যটি যেন হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন স্কট।

পবিত্র কুরআনের অন্যতম অলৌকিকত্ব হলো- এ মহাগ্রন্থ সম্পর্কে অমুসলমানদের বিস্ময়কর ও বিমুগ্ধ অভিব্যক্তি। মার্কিন নও-মুসলিম স্কট লাইঞ্চও এর ব্যতিক্রম হতে পারেননি। কুরআন স্কটের হৃদয়ের চোখ খুলে দিয়েছিল। খ্রিস্ট ও  ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে তার যেসব সন্দেহের অভিজ্ঞতা হয়েছিল কুরআনে তার সত্যতা খুঁজে পেলেন। তিনি যে পথ খুঁজছিলেন কুরআন তার সামনে দেখিয়ে দিল সেই পথ। কুরআনের কিছু অংশ পড়ার পরই তিনি অনুভব করছিলেন যে, এ মহাগ্রন্থের শিক্ষাগুলো বিশ্বাস করছি বলে অবশ্যই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা উচিত।

কিন্তু এরপরও প্রবল আবেগ দমন করে নীরবে ইসলাম সম্পর্কে জানা অব্যাহত রেখেছিলেন স্কট। তিনি ইসলাম সম্পর্কিত আরো বেশি বই পড়তে লাগলেন। কিনতে লাগলেন ইসলামী ছায়াছবি। এমনকি নামাজের রীতিও রপ্ত করতে লাগলেন। ইসলামী ইবাদতগুলো পালন করতে গিয়ে তিনি দেখলেন যে, নামাজ তার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখছে। আল্লাহর সামনে রুকু ও সিজদা করতেও ইচ্ছে হলো তার। অবশেষে হানির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ৮ মাস পর স্কট প্রথমবারের মতো নামাজ পড়লেন। নামাজের মধ্যে যা কিছু পড়তে বা উচ্চারণ করতে হয়েছে তার সবকিছুর অর্থ না বুঝলেও প্রথম সেই ইবাদত গভীর প্রভাব ফেলেছিল লাইঞ্চের ওপর।

আল্লাহর নির্দেশিত এই এবাদত সম্পন্ন করার পর পরই তিনি কলেমায়ে শাহাদাতাইন উচ্চারণ করে মুসলমান হন এবং নিজের জন্য সায়িদ মুহাম্মাদ নামটি বেছে নেন। এ সময় তার অনুভূতি ছিল নতুন জীবন শুরু করার অনুভূতি। আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল এই বাক্য উচ্চারণের সময়ে তার মনে হয়েছিল যে হৃদয়ের ওপর থেকে যেন এক বড় বোঝা অপসারিত হল।

এভাবে লাইঞ্চ খুঁজে পান প্রকৃত প্রশান্তি, যে প্রশান্তি যুগে যুগে খুঁজেছে মানুষ এবং এ জন্য করেছে অনেক ত্যাগ স্বীকার। পবিত্র কুরআনের সুরা ফাতহের চার নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

তিনি মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করেন, যাতে তাদের ঈমানের সাথে আরও ঈমান বেড়ে যায়।

মার্কিন নও-মুসলিম সায়িদ মুহাম্মাদ মনে করেন ইসলাম গ্রহণের ফলে যে প্রশান্তি তিনি পেয়েছেন তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। এক আল্লাহ ও একত্ববাদের বাস্তবতা আল্লাহ তাকে চেনার সুযোগ দিয়েছেন বলেই তিনি এই মহাপ্রশান্তি লাভ করেছেন। তিনি সব অমুসলিম ও মুসলিম ভাইবোনের জন্য এই মহা-প্রশান্তির উতস তথা সঠিক পথটি কামনা করছেন মহান আল্লাহর কাছে।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button